এই পোস্টটি 129 বার দেখা হয়েছে
এক মহাবিস্মৃত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির কাহিনী!
গোপীশ্রেষ্ঠা দেবী দাসী
আমাদের অনেকেই শুধু অর্থ লাভের দ্বারা লালায়িত কিন্তু আমরা জানি না যে, লক্ষ্মীদেবী কিন্তু আমাদেরকে সৌন্দর্য, শক্তি, খ্যাতি, জ্ঞান ও বৈরাগ্যও প্রদান করতে পারেন। ভারতে (বাংলাদেশেও) লক্ষ্মীদেবী হলো প্রশান্তি, সৌন্দর্য, সতীত্ব, ধার্মিকতা, মর্যাদা ও সমস্ত জাগতিক আশির্বাদের প্রতীক হিসেবে সর্বগণ্য। লক্ষ্মী হলেন আদর্শ ভারতীয় নারীর প্রতিভূ রূপ যিনি সবার পূজনীয়। ঐতিহ্যগতভাবে ভারতের (বাংলাদেশেও) গৃহস্থ নারীরা কামনা করে তাদের কন্যা বা পুত্রবধু যেন লক্ষ্মী হয়, অর্থাৎ লক্ষ্মীদেবীর সমস্ত গুণাবলীতে যেন ভূষিত হয়। এই বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে যে, পুত্রবধু যদি লক্ষ্মীদেবীর সমস্ত গুণাবলীতে ভূষিত হয় তবে, সেই গৃহ সমস্ত আশির্বাদ, শান্তি ও ঐশ্বর্য পূর্ণ হবে।
আমরা ভারতবর্ষের প্রাচীন শাস্ত্রাদি থেকে জেনেছি-বহু বহু প্রাচীনকালে এই মহাসৃষ্টির বুকে দেবতারা এক সময়ে মহাজগতের অবিশ্বাস্য এক মহাসমুদ্রের সুবিশাল জলরাশি মন্থন করে তার ভেতর থেকে যত পারেন মহামূল্য সৃষ্টি-ভাণ্ডার উদ্ধারের মহৎ কার্যে সবাই মিলে মগ্ন হয়েছিলেন, যে কোনও বিপুল সৃষ্টি মহাকর্ম যেমন সকলেই করে থাকেন সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে। একথা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করুক বা না করুক, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির সর্ব প্রাথমিক আদি পর্বের একটা বিশ্বাসযোগ্য ধারণা আমাদের ক্ষুদ্র উপলব্ধির মধ্যে এনে দেয় ভারতের এই সমস্ত প্রাচীন কথা। বহু বহু প্রাচীন অবিস্মরণীয় মহাকালের সেই পর্যায়ের একটি বিশেষ মহাবিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কোনও একটি অংশে ক্ষীর সমুদ্র অর্থাৎ দুধের মহাসাগর মন্থনের সময়ে সুরভী গাভী, উচ্চৈঃশ্রবা নামে এক শ্বেতবর্ণ অশ্ব, ঐরাবত নামক এক হস্তীরাজ, বিখ্যাত একটি কৌস্তভ মনি, স্বর্গলোকের অলঙ্কারের মতো অপূর্ব পারিজাত পুষ্প, স্বর্গের নৃত্যগীত পরায়ণ অপ্সরাগণÑএই সব একে একে উত্থিত হয়েছিল।
তারপর রমাদেবী আবির্ভূত হয়েছিলেন, যিনি সর্বতোভাবে ভগবৎ পরায়ণা। সুদাম পর্বত থেকে সৃষ্ট বিদ্যুতের মতো তাঁর দেহ-কান্তিÍর দ্বারা সর্বদিক রঞ্জিত করে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন।
তাঁর অতুলনীয় সৌন্দর্য, দেহের লাবণ্য, যৌবন, অঙ্গকান্তি এবং মহিমার ফলে দেব, দানব এবং মানব সকলেই তাঁকে বাসনা করেছিলেন। তাঁরা সকলেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, কারণ তিনি সমস্ত ঐশ্বর্যের উৎস।
লক্ষ্মীদেবীর উপবেশনের জন্য দেবরাজ ইন্দ্র উপযুক্ত সিংহাসন নিয়ে এলেন। গঙ্গা, যমুনা আদি শ্রেষ্ঠ নদীসমূহ মূর্তিমতী হয়ে লক্ষ্মীদেবীর জন্য স্বর্ণ কলসে পবিত্র জল নিয়ে এলেন।
ভূমি মূর্তিমতী হয়ে অভিষেকের অনুকূল সমস্ত ঔষধি নিয়ে এলেন। গাভীরা পঞ্চগব্য দুগ্ধ, দধি, ঘি, গোমূত্র এবং গোময় প্রদান করল এবং বসন্ত ঋতু চৈত্র ও বৈশাখ মাসে যে সমস্ত ফুল ও ফল উৎপন্ন হয় তা নিয়ে এল ।
মহর্ষিগণ শাস্ত্রবিধি অনুসারে লক্ষ্মীদেবীর অভিষেক করেছিলেন। গন্ধর্বগণ মঙ্গলময় বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন এবং নর্তকীগণ বেদবিহিত সঙ্গীত ও নৃত্য করেছিলেন।
মহাকাশের যতো মেঘ মূর্তিমন্ত হয়ে নানা বাদ্যযন্ত্রÑমৃদঙ্গ, পণব, মুরজ, আনক, শঙ্খ, বেণু, বীণা প্রভৃতি বাঁজিয়েছিল এবং সেই সমস্ত বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি তুমুলভাবে নিনাদিত হয়েছিল।
তারপর নানাদিক থেকে গঙ্গাজলে পূর্ণ কলসের দ্বারা লক্ষ্মীদেবীকে পরমভক্তি ভরে স্নান করিয়েছিল এবং ব্রাহ্মণেরা তখন সুললিত সুমধুর বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন। তখন তাঁর হাতে ছিল একটি পদ্মফুল এবং তিনি অপূর্ব সৌন্দর্যমণ্ডিত ছিলেন। সতী লক্ষ্মী তাঁর পতি শ্রীভগবান ছাড়া অন্য কাউকেই তখন জানেন না। রত্নাকর অর্থাৎ সাগর উত্তরীয় ও পরিধেয় পীতবর্ণ রেশমের বস্ত্র প্রদান করেছিলেন। জলের দেবতা বরুণ মধুপানে উন্নত মধুকরদের দ্বারা পরিবেষ্টিত বৈজয়ন্তী মালা উপহার প্রদান করেছিলেন।
মহাজগতের প্রজাপালক অর্থাৎ প্রজাপতিদের অন্যতম বিশ্বকর্মা বহু বিচিত্র অলঙ্কার দান করেছিলেন। বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী সরস্বতী দিলেন কণ্ঠহার, ব্রহ্মা দিলেন পদ্ম এবং নাগগণ কর্ণকুণ্ডল উপহার দিয়েছিলেন।
তারপর লক্ষ্মীদেবী শুভ অনুষ্ঠানের দ্বারা যথাযথভাবে পূজিত হয়ে, গুঞ্জনরত ভ্রমর বেষ্টিত পদ্মমালা হাতে নিয়ে হয়েছিলেন গতিশীল। তাঁর মনোরম সলজ্জ হাসি এবং কুণ্ডলের দ্বারা শোভিত দুটি গালের সৌন্দর্য প্রভাবে তিনি অপূর্ব সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়েছিলেন ।
তাঁর সুষম ও বক্ষযুগল চন্দন এবং কুমকুমে লিপ্ত এবং তাঁর কটিদেশ ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। তিনি মনোহর নূপুর ধ্বনি সহকারে যখন ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ করছিলেন, তখন তিনি যেন একটি স্বর্ণলতিকার মতোই শোভা পাচ্ছিলেন।
স্বর্গবাসী দেবতা, গন্ধর্ব, যক্ষ, অসুর, সিদ্ধ এবং চারণদের মধ্যে অনুসন্ধান করে লক্ষ্মীদেবী স্বভাবতই সর্বগুণ সমন্বিত কাউকে খুঁজে পেলেন না। তাঁরা কেউই দোষ-রহিত ছিলেন না এবং তাই তিনি তাঁদের কারও আশ্রয় গ্রহণ করতেই পারলেন না ।
লক্ষ্মীদেবী সেই সমাবেশে সম্মিলিত সকলকে পরীক্ষা করে মনে মনে বুঝি চিন্তা করেছিলেনÑ এদের মধ্যে কেউ কঠোর তপস্যা করেছেন, কিন্তু ক্রোধ জয় করতে পারেননি। কারও জ্ঞান আছে, কিন্তু ফলভোগের আকাক্সক্ষা জয় করতে পারেননি। কেউ অত্যন্ত মহান, কিন্তু কাম জয় করতে পারেননি। এমনকি মহান ব্যক্তিও অন্য কারো ওপর নির্ভর করেন। তা হলে তিনি পরম ঈশ্বর হবেন কী করে ?
কারও পূর্ণরূপে ধর্ম সম্বন্ধীয় জ্ঞান থাকতে পারে, কিন্তু তবুও তিনি সমস্ত জীবের প্রতি দয়ালু নন। মানুষই হোন অথবা দেবতাই হোন কারও মধ্যে ত্যাগ থাকতে পারে, কিন্তু তা মুক্তির কারণ নয়। কেউ মহা শক্তিশালী হতে পারেন, কিন্তু তিনি মহাকালের প্রভাব কোন মতেই অতিক্রম করতে সমর্থ নন। কেউ জড় জগতের আসক্তি ত্যাগ করেছেন, কিন্তু ভগবানের সঙ্গে তাঁর তুলনা হয় না। তাই কেউই তখনও জড়া প্রকৃতির গুণের প্রভাব থেকে পূর্ণরূপে মুক্ত হতে পারেননি ।
কারও দীর্ঘ আয়ু থাকতে পারে, কিন্তু মঙ্গল আকাক্সক্ষী বা সৎ আচরণ নেই। কারও মঙ্গল বাসনা এবং সৎ আচরণ দু’টিই থাকতে পারে, কিন্তু তাঁর আয়ু স্থির নয়। যদিও বলা হয়, শিব আদি দেবতাদের নিত্য জীবন রয়েছে কিন্তু শ্মশানে বাস করা আদি অশুভ অভ্যাসও রয়েছে। আরও কেউ যদি সর্বতোভাবে সদ্গুণ সম্পন্ন হনও, তবুও তাঁরা ভগবানের যথার্থ ভক্ত নন।
এইভাবে পূর্ণরূপে বিবেচনা করার পর, লক্ষ্মীদেবী মুকুন্দকে তাঁর পতিরূপে বরণ করেছিলেন, যদিও তখন মুকুন্দদেব সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র এবং তাঁকে (লক্ষ্মীদেবীকে) লাভ করার অভিলাষী ছিলেন না। তিনি সমস্ত দিব্য গুণ ও যোগশক্তি সমন্বিত এবং তাই তিনি ছিলেন পরম – বাঞ্ছনীয়। লক্ষ্মীদেবী শ্রীভগবানের কাছে এসে মধুময় ভ্রমর-নিনাদিত নব বিকশিত পদ্মফুলের মালা তাঁর গলদেশে সযত্নে স্থাপন করেছিলেন। তারপর তাঁর বক্ষে স্থান লাভ করার আশায় সলজ্জ হাস্য-বিকশিত নয়নে তাঁর পাশে অবস্থান করতে লাগলেন ।
শ্রীভগবান ত্রিজগতের পিতা এবং তাঁর বক্ষঃস্থল সমস্ত ঐশ^র্যের অধিষ্ঠাত্রী ত্রিজগতের জননী লক্ষ্মীদেবীরই বাসস্থান। লক্ষ্মীদেবী তাঁর কৃপাপূর্ণ দৃষ্টিপাতের প্রভাবে প্রজা ও লোকপাল দেবতাগণ সহ ত্রিজগতের ঐশ^র্য বর্ধিত করতে পারেন।
গন্ধর্ব এবং চারণেরা তখন শঙ্খ, তূর্য ও মৃদঙ্গ আদি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শুরু করেছিলেন এবং তাঁদের পত্নীগণ সহ তাঁরা নৃত্যগীত করতে শুরু করেছিলেন।
ব্রহ্মা, শিব, অঙ্গিরা প্রমুখ ব্রহ্মাণ্ডের ব্যবস্থাপনার নির্দেশকেরা সেই শুভক্ষণে কতই না পুষ্পবর্ষণ করেছিলেন এবং শ্রীভগবানের মহিমা বর্ণনা করে শুভ মন্ত্রাদি উচ্চারণ করেছিলেন।
সেই সময়ে শ্রীলক্ষ্মীদেবীর কাছে উপেক্ষিত হওয়ার ফলে দৈত্য এবং দানবেরা খুবই দুর্বল, মোহাচ্ছন্ন ও নিরুদ্যম হয়ে গিয়েছিল এবং তার ফলে হয়েছিল তারা নির্লজ্জ।
‘ভগবানকে দেখা’ বা ভগবানের দেখা পাওয়াটা জড় চোখ দিয়ে দেখার প্রসঙ্গ । জড় চোখ দুটির সম্পর্ক দেহের সঙ্গেই থাকে-দেহ যতদিন, অর্থাৎ আমাদের জীবন যতদিন, ততদিনই জড় চোখ দিয়ে দেখার প্রসঙ্গ। কিন্তু শ্রীভগবানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তার থেকে অনেক আগেকার, অনেক পুরনো এবং চিরকালের। তাই দেখার ইচ্ছা পোষণের বদলে নিজজনের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক পুনঃ স্থাপন, দৃঢ়করণ করাই কাজের কথা।
(শ্রীমদ্ভাগবতের ৮ম স্কন্ধ, ৮ম অধ্যায় থেকে সংকলিত)