এই পোস্টটি 519 বার দেখা হয়েছে
সুখী হওয়ার গোপন সূত্র
এ্যাপল এবং ব্ল্যাকব্যারি সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় বর্তমানে প্রযুক্তি এতটাই প্রসার লাভ করেছে তার মহিমা বলার অপেক্ষা রাখে না। বৈজ্ঞানিক প্রগতি, প্রযুক্তির উন্নয়ন, চিকিৎসা ক্ষেত্রে উন্নতি এসমস্ত উন্নতিগুলো খুবই উপযোগী এবং উপকারী হবে যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এগুলো সঠিক মনোভাব নিয়ে ব্যবহার করব। আমরা যখন আমাদের জীবনের মূল ভিত্তি স্বরূপ আধ্যাত্মিক প্রগতির কথা ভুলে গিয়ে এগুলোর ব্যবহার করব তখন আমরা আরো চাই আরো চাই গর্তে পতিত হব। বর্তমানে এমন পরিস্থিতি হয়েছে যখনই নতুন কোন মোবাইল বা অন্য কোন প্রযুক্তি বের হয় অনেকে কষ্টে ভোগে সেটা ব্যবহার করতে না পারার কারণে।
প্রত্যেকেই মনে করছে নতুনটাতে সুবিধা বেশি আছে আমি বর্তমানটা আর ব্যবহার করব না। আমার নতুনটা চাই, সবাই এখন মনে করছে যতবেশি ভোগে দক্ষ হবে, সে তত বেশি সুখী হবে। আমাদের প্রহ্লাদ মহারাজের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে এবং তা হল যুক্ত বৈরাগ্য। আমরা যখন আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত জীবন-যাপন করব তখন আমরা প্রযুক্তিকে আমাদের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারব।
“মহাত্মাটি প্রহ্লাদ মহারাজকে আরো জানিয়েছিলেন, “আমি মৌমাছি থেকে শিক্ষা নিয়েছি। মৌমাছিরা অত্যন্ত কষ্ট করে উড়ে উড়ে ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌচাক তৈরি করে। কিন্তু মানুষেরা পুরো মৌচাকটি কেটে নিয়ে চলে যায় তদ্রুপ এই জগতের জীবেরা অত্যন্ত পরিশ্রম করে সবকিছু সংগ্রহ করে কিন্তু মৃত্যু সবকিছু হরণ করে নিয়ে যায়।”
প্রযুক্তিকে আমাদের ব্যবহার করতে দিব না। এটাই হচ্ছে সুখী হওয়ার গোপন সূত্র। প্রযুক্তি কি আমাদের ব্যবহার করছে নাকি আমাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছি? বর্তমানে আমরা অত্যন্ত উন্নত কম্পিউটার, মোবাইল ব্যবহার করছি কিন্তু আমরা কি জানি গোস্বামীরা কিভাবে তাঁদের গ্রন্থ রচনা করেছিল? ওনারা গ্রন্থ রচনা করত তালপাতা এবং বৃক্ষের বাকলের উপর।
জীব গোস্বামী নিজেই ঐ তালপাতা ব্যবহার করে ৪ লক্ষ শ্লোক রচনা করেছিল যা বর্তমান সৃজনশীল লেখা-পড়া করে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেও লিখতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। সে ৫০০ বছর আগে লিখা গ্রন্থগুলো আজ মানুষের জীবন পরিবর্তন করে চলছে। তাই প্রযুক্তি ব্যবহার করাটি খারাপ নয় কিন্তু আমাদর এটা লক্ষ্য করতে হবে, প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের জীবনের গুণগত মান বৃদ্ধি করছে নাকি অবনমন করছে।
বর্তমানে আমরা লক্ষ্য করলে দেখব প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উন্নতি সত্ত্বেও হিংসা, ঈর্ষা, বিদ্বেষ, ঘৃণা হতে বিরত থাকতে পারছি না। প্রতিবছর প্রযুক্তি মানুষের কল্পনাতীত উপায়ে উন্নতি লাভ করছে কিন্তু আত্মহত্যার হার, মানসিক অসুস্থতা, মানসিক চাপ, সবকিছু অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়ে যাচ্ছে। একে অপরের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে, একে অপরের সাথে যুদ্ধ করছে এটাকে কি বলব জীবনের উন্নতি হচ্ছে? প্রকৃতপক্ষে তা হচ্ছে না অবনতিই হচ্ছে। বর্তমানে সবাই সিনেমা হলে গিয়ে থ্রিডি ছায়াছবি দেখে কিন্তু আমরা যখন ছোট ছিলাম আমরা প্রকৃতির সাথে খেলতাম, নদীতে নৌকা চালাতাম, নদীতে স্নান করতাম অর্থাৎ প্রকৃতির সাথে সময় কাটাতাম।
বর্তমান ভারতের নদীগুলোর এমন অবস্থা মানুষেরা তীর্থে গিয়ে পবিত্র হওয়ার জন্য পবিত্র নদীতে স্নান করে কিন্তু তারা হোটেলে গিয়ে বাথরুমে আবার স্নান করে পবিত্র নদীর জল থেকে পবিত্র হওয়ার জন্য। নদীগুলোতে বর্জ্য ও আবর্জন নিক্ষেপ করে দূষিত করে ফেলছে। এগুলো যখন পরিচ্ছন্ন ছিল, বায়ু যখন পবিত্র ছিল। খাদ্যগুলো যখন নির্ভেজাল ছিল, জীবন তখন কতই না সুন্দর ছিল। আমি কিছুদিন আগে পত্রিকায় পড়লাম ভারতের সবজিতে যে পরিমান রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয় তা সহনীয় মাত্রা থেকে ৮০০ গুণ বেশি। সরল জীবন মানে টাট্কা ও নির্ভেজাল জিনিস উপভোগ করা।
ভগবদ্গীতা অনুসারে তিনটি গুণ রয়েছে সত্ত্ব, রজ ও তমগুণ। সত্ত্বগুণ হচ্ছে প্রতিপালন, রজগুণ হচ্ছে সৃষ্টি, আর তমগুণ হচ্ছে ধ্বংসের প্রতীক। আমরা যখন শিক্ষা, রাজনীতি, বিজ্ঞান, গবেষণা এসব ক্ষেত্রে কাজ করব তখন সেক্ষেত্রে রজগুণ বা সৃজনশীলতার প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু সে রজগুণ যেন সত্ত্বগুণ দ্বারা পরিচালিত হয়। যখনই রজগুণ, সত্ত্বগুণ দ্বারা পরিচালিত হবে না তখন সেটি তমগুণ দ্বারা প্রভাবিত হবে এবং তা আমাদের মূূল্যবোধের ধ্বংস নিয়ে আসবে।
আমরা যদি সত্ত্বগুণের উপর ভিত্তি করে সমস্ত রজগুণের কার্যাবলী পরিচালনা না করি তাহলে তা অবশ্যই ধ্বংসাত্মক হবে। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃতি বা পরিবেশের কোন দোষ বা সংকট নেই, তারা সংকট সৃষ্টি করে না, আমরা মানুষেরাই যতসব সমস্যা সৃষ্টি করি। যেহেতু আমাদের মাঝে সে মূল্যবোধের অভাব রয়েছে তাই আমরা না বুঝে পরিবেশ দূষণ করছি প্রতিনিয়ত। সেজন্য আমরা যখন সৃজনশীল তৎপরতা বা কার্যাবলী সরলতার এবং সত্ত্বগুণের সাথে ভারসাম্য রেখে পরিচালনা করব তখন প্রকৃতই সুখী হওয়া যাবে।
সরল জীবন মানে হচ্ছে আমাদের যা কিছু আছে তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। যা নেই বা হারিয়েছে তার জন্য শোক বা কামনা করা নয়। একবার শ্রীল প্রভুপাদ তার কিছু অন্তরঙ্গ শিষ্যদের নিয়ে ইস্কনের কিছু স্থাপনা ও প্রজেক্ট পরিদর্শন করছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে একপর্যায়ে প্রভুপাদ তাঁর হাতে থাকা ঘড়িটি তোলে দূরে একদিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল তোমরা কি অন্ধ? কিছু দেখতে পাচ্ছ না!
শিষ্যরা বলল কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না, তারা মনে করেছিল প্রভুপাদ কৃষ্ণকে দেখছেন যেহেতু তিনি শুদ্ধভক্ত। কয়েকবার বলার পর প্রভুপাদ স্বয়ং সেখানে গিয়ে একটি পানির টেপ থেকে পানি পরে বন্ধ করে দিলেন। কৃষ্ণের শক্তি অপচয় হয়ে যাচ্ছে তোমরা তা দেখতে পাচ্ছ না। কৃষ্ণের প্রতি কৃতজ্ঞতা শুধু আমাদের নিজেদের যা কৃষ্ণ দিয়েছেন সেটির জন্য নয় বরং পুরো বিশ্বে তিনি যা দিয়েছেন তা আমাদের অধীনে থাক বা অন্যদের অধীনে থাক সবকিছুর জন্য আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত এবং এটিই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃত। কৃষ্ণের কোন সম্পদ অপচয় হতে দেওয়া যাবে না। খুবই সরল কিন্তু খুবই গভীর।
যখন আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এই মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে তখন আমরা একে অপরকে বিশ্বাস করতে পারি। বর্তমান বিশ্বে বিশ্বাসের খুবই ঘাটতি রয়েছে যার কারণে আমাদের সম্পর্কে অনেক সমস্যা হচ্ছে। বিশ্বাসযোগ্য না হলে অন্যেরা বিশ্বাস করে না। তাই প্রযুক্তিগত যতই উন্নতি হোক না কেন, আমাদের এটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে আমাদের জীবন গুণগতভাবে উন্নতি হচ্ছে। শুধুমাত্র কিছু জড় জিনিস আমাদের সুখী করে না, আমরা যা কিছু প্রাপ্ত হয়েছি তার প্রতি কৃতজ্ঞতা, প্রশংসা আমাদের প্রকৃতই সুখী করে।
যখন আমাদের সমস্ত সম্পদ, প্রযুক্তি, মেধা, শিক্ষা প্রভৃতি এই ভাব নিয়ে ব্যবহার করি, তখন তা আমাদের জীবনে অকল্পনীয় ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনে। আমাদের হৃদয়ের এই ভাব ভগবানের সাথে সম্পর্কিত করা খুবই সহজ এবং সরল পন্থা হচ্ছে ভগবানের দিব্যনাম জপ করা।
শ্রীল প্রভুপাদ বলতেন, ভক্তদের সুখী হওয়ার জন্য কিছুর দরকার নেই শুধু দরকার হরিনাম, একটু প্রসাদ এবং ঘুমানোর জন্য একটু জায়গা। শুধুমাত্র কৃষ্ণ সেবার জন্য এবং জনগণের কল্যাণে প্রচারের স্বার্থে আমরা অ্যাপল, ব্ল্যাকবেরি, রাজপ্রাসাদ, গাড়ি, উড়োজাহাজ, মাইক্রোসফট ইত্যাদি ব্যবহার করছি। এসমস্ত জিনিস ব্যবহার করে আমরা সুখ লাভ করছি না। আমরা এগুলো ব্যবহার করছি প্রচারের স্বার্থে করুণা বিতরণের জন্য।
আমি আমার “জার্নি হোম” গ্রন্থে এই ঘটনাটি বর্ণনা করেছি। ভারতবর্ষে আমি যতদিন ছিলাম কখনো ছাদের নিচে ঘুমায়নি সবসময় বৃক্ষের নীচে, নদীর পাড়ে ঘুমাতাম এবং ভিক্ষা করে রুটি খেয়ে জীবন ধারণ করতাম। একসময় আমি আমেরিকায় একটা ফার্ম কমিউনিটিতে অবস্থান করছিলাম সেখানে প্রতিদিন রাতে আমাদের ভুট্টা পরিবেশন করা হতো। ছাদের নিচে রাত কাটানো এবং প্রতিদিন ভুট্টা গ্রহণের জন্য আমি নিজেকে পাপী অনুভব করছিলাম। একদিন একজন ভক্তকে বললাম- আমি চলে যাচ্ছি, এখানে খুব বেশি ইন্দ্রিয় তৃপ্তি হচ্ছে। ভক্তটি তখন আমায় বলল, কিরকম ইন্দ্রিয়তৃপ্তি হচ্ছে? আমি বললাম, প্রতিদিন ছাদের নিচে গৃহে ঘুমাচ্ছি আর ভুট্টা খাচ্ছি।
তখন সে ভক্তটি প্রভুপাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন, “আমরা যদি বৃক্ষের নিচে থেকে বেশি করে কৃষ্ণ সেবা করতে পারি তাহলে প্রাসাদের প্রতি আসক্ত হওয়া উচিত নয়, আবার প্রাসাদে থেকে যদি বেশি করে কৃষ্ণসেবা করা যায় তাহলে বৃক্ষের প্রতি আসক্ত হওয়া উচিত নয়।”
তখন তিনি আমায় বললেন, “তুমি মায়াগ্রস্থ হয়েছ, তুমি বৃক্ষের নিচে থাকতে থাকতে বৃক্ষের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছ।” প্রভুপাদের উদ্ধৃতি শ্রবণের পর আমি এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলাম আমি সেখানে রয়ে গেলাম এবং আরো বেশি করে ভুট্টা খেতাম। আমরা যখন কৃষ্ণনামে অত্যন্ত আসক্ত হয়ে পরব তখন এ জগতে থেকেও এ জগতের হয়ে পরব না। তখন আমরা আপেল খেলেও বা আপেল ল্যাপটপে ই-মেইল দিলে, ব্ল্যাকবেরি খেলে বা ব্ল্যাকবেরি মোবাইল দিয়ে কথা বললেও আমরা তখন একটা সুখী ও অর্থবহ জীবন-যাপন করতে পারব।
লেখক পরিচিতি: শ্রীল প্রভুপাদের শিষ্য শ্রীমৎ রাধানাথ স্বামী। তিনি ১৯৫০ সালে শিকাগোয় জন্মগ্রহণ করেন এবং কিশোর অবস্থাতেই আধ্যাত্মিক অন্বেষণের জন্য বেরিয়ে পরেন, যা অবশেষে তাঁকে ভক্তিযোগের সন্ধান দেয়। বর্তমানে তিনি এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকায় ভক্তিশাস্ত্রের শিক্ষা দেন।