এই পোস্টটি 395 বার দেখা হয়েছে
শ্রীমৎ শিবরাম স্বামীঅনর্পিতচরীং চিরাৎ করুণয়াবতীর্ণঃ কলৌ।
সমর্পয়িতুমুন্নতোজ্জ্বলরসাং স্বভক্তিশ্রিয়ম্।
হরিঃ পুরটসুন্দরদ্যুতিকদম্বসন্দীপিতঃ
সদা হৃদয়কন্দরে ষ্ফুরতু বঃ শচীনন্দনঃ।।
(চৈঃ চঃ / আদি ১/৪, বিদগ্ধ মাধব থেকে)
“পূর্বে যা অর্পিত হয়নি, উন্নত ও উজ্জ্বল রসময়ী নিজের সেই ভক্তিসম্পদ দান করার জন্য যিনি করুণাবশত কলিযুগে অবতীর্ণ হয়েছেন, স্বর্ণ থেকেও সুন্দর দ্যুতিসমূহের দ্বারা সমুদ্ভাসিত সেই শচীনন্দন শ্রীহরি সর্বদা তোমাদের হৃদয় কন্দরে স্ফুরিত হোন।”
চৈতন্য চরিতামৃতের বীজস্বরূপ চৌদ্দটি শ্লোক রয়েছে। সেগুলি উল্লেখ করে রচয়িতা বলেছেন, “আমি এখন এই শ্লোকগুলি আরও বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করব।” আর সেটিই হল “চৈতন্য চরিতামৃত”। বীজ হল ঠিক যেমন আমাদের কাম-বীজ রয়েছে- ক্লীং- তেমনি। সেই বীজ থেকে কাম গায়ত্রী মন্ত্র প্রকাশিত হয়েছেন। ঠিক যেমন একটি গাছ। বীজের মধ্যে সমগ্র গাছটির প্রচ্ছন্ন শক্তি রয়েছে। জড় জগতে যখন আপনি বীজটি লাভ করেন তখন গাছটি থাকে না। বীজটি রয়েছে অথচ গাছটি নেই। কিন্তু পারমার্থিক ক্ষেত্রে, এরকম ঘটে না। এই বিষয়টি শ্রীল রূপ গোস্বামী ভক্তিরসামৃতসিন্ধুতে বর্ণনা করেছেন। বীজ হতে প্রকাশিত গাছের মতোই বীজ ও গাছ উভয়ই বর্তমান থাকে। চৌদ্দটি শ্লোকের শব্দে আলোচ্য শ্লোকটি চতুর্থ। প্রথম ছয়টি শ্লোকে চৈতন্য মহাপ্রভুকে বর্ণনা করা হয়েছে, তারপর শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু, অদ্বৈত আচার্য এবং শেষে পঞ্চতত্ত্বের উদ্দেশ্যে প্রণতি নিবেদন করা হয়েছে। এই শ্লোক সমূহই চৈতন্য চরিতামৃতের ভিত্তি। এই ‘অনর্পিতচরীং চিরাৎ’ শ্লোকটি শ্রীল রূপ গোস্বামীর দ্বারা রচিত। তাঁর রচিত ‘বিদগ্ধ মাধব’ নাটকে এই শ্লোকটি পাওয়া যায়। এই শ্লোকটির ইতিহাস এইরকম-চৈতন্য মহাপ্রভু যখন জগন্নাথ পুরীতে বাস করছিলেন তাঁর প্রতিদিনের অভ্যাস ছিল হরিদাস ঠাকুরের কাছে গমন করা। যেহেতু হরিদাস ঠাকুর ম্লেচ্ছ পরিবারের বলে বিবেচনা হত, তাই তিনি জগন্নাথ মন্দিরে যেতে পারতেন না, যদিও তিনি এক মহান পারমার্থিক ব্যক্তিত্ত্ব। কিন্তু তবুও হরিদাস ঠাকুর মন্দিরের নিয়মকানুন মেনে নিয়ে মন্দিরে যেতেন না। তাই চৈতন্য মহাপ্রভু স্বয়ং তার কাছে আসতেন। কেননা চৈতন্য মহাপ্রভু ছিলেন স্বয়ং অভিন্ন জগন্নাথ। তাই জগন্নাথ হরিদাস ঠাকুরকে দর্শন দান করতেন আর তাঁর জন্য প্রসাদ নিয়ে আসতেন। হরিদাস ঠাকুর যতদিন পুরীতে ছিলেন, ততদিন তাঁর তিরোভাব না হওয়া পর্যন্ত এই প্রথাই চলে আসছিল।
সেই সময় শ্রীল রূপ গোস্বামীও পুরীতে বাস করতেন। রথযাত্রা উৎসব উপলক্ষে হরিদাস একটি সুন্দর শ্লোক রচনা করলেন। এই শ্লোকটি ‘পদ্যাবলী’ তে পাওয়া যায়। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু গাইতেন এমন একটি সঙ্গীতের উত্তরে এই শ্লোকটি রচিত হয়েছিল। রথযাত্রার সময় চৈতন্য মহাপ্রভু এই ভজনটি গাইতেন যার প্রথম পংক্তিটি ছিল যঃ কৌমারহরঃ স এব হি রবস্তা এব চৈত্রক্ষপাস্তে….। এই ভজনটিতে রথযাত্রার ভাবটি ধরা পড়ে ভক্ত উজ্জীবিত হন। শ্রীল রূপ গোস্বামী এই ভজনটি শ্রবণ করার পর ভজনটির ভাবকে আরও প্রত্যক্ষভাবে রচনা করে উপস্থাপন করেন। গানটি হল “প্রিয়ঃ সোহয়ং কৃষ্ণঃ সহচরি কুরুক্ষেত্রমিলিতস্তথাহং স রাধা তদিদমুভয়ে সঙ্গমসুখম্…… / শ্রীল রূপ গোস্বামী ভজনটি একটি তাল পাতায় লিখে শ্রীল হরিদাস ঠাকুরের কুটিরের খড়ের চালের ওপরে রেখে দিলেন। মহাপ্রভু যখন সেখানে এলেন তখন তিনি সেটা দেখতে পেয়ে পাঠ করলেন এবং তাঁর অন্যান্য পার্ষদগণকে দেখালেন। তিনি মুগ্ধ হয়ে প্রশ্ন করলেন, “এটা কীভাবে সম্ভব হল যে, রূপ গোস্বামী আমার হৃদয়কে উপলব্ধি করতে পারল?”
প্রকৃতপক্ষে ভজনটি কুরুক্ষেত্রে শ্রীমতী রাধারানি ও শ্রীকৃষ্ণের মিলন দৃশ্য বর্ণনা করে গোপীদের ভাব ব্যক্ত করেছিল। “তুমি সেই একই কৃষ্ণ, পূর্বেকার মতো সেই একই জ্যোৎস্না রাত্রি আজ রয়েছে, আমিও সেই একই রাধারানি, আমাদের এই মিলন অতীব সুন্দর, এই মিলন আমাদের প্রভূত আনন্দ দান করেছে। তবুও তা আগেকার আনন্দের মতো নয়। এখানে কোথাও যমুনা নেই, কোথাও গোবর্ধন পর্বত নেই, বৃন্দাবন নেই, আর তোমার হাতে বাঁশী নেই। কোথায় গেল তোমার সেই বাশী? এখানে রাজার ঐশ্বর্য রয়েছে, তাই আমরা তোমাকে বৃন্দাবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রথযাত্রা ভাব ।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা কীভাবে সম্ভব হল যে রূপ গোস্বামী আমার হৃদয়কে বুঝতে পারল?” রামানন্দ রায় তখন উত্তর প্রদান করলেন, “এটি কেবল আপণর কৃপার দ্বারাই সম্ভব। আপনার কৃপা ছাড়া কি কেউ কোনোকিছু হৃদয়ঙ্গম করতে পারে?” ব্যাপারটিও প্রকৃতপক্ষে তাই। শ্রীকৃষ্ণের কৃপা ছাড়া কেউই কৃষ্ণলীলার কোনোকিছু, এমনকি কৃষ্ণকেও হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। শ্রীল রূপ গোস্বামীর শ্লোকটিতে কৃষ্ণলীলারই বর্ণনা করা হয়েছিল যা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর হৃদয়ের অভ্যন্তরভাগে প্রকটিত হয়েছিল ‘রাধাভাবদ্যুতি সুবলিতম্’।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রকৃতপক্ষে তাঁর পার্ষদগণের সমক্ষে রূপ গোস্বামীর মহিমা ব্যক্ত করতে চেয়েছিলেন। এই ঘটনায় চৈতন্য মহাপ্রভু কতখানি আনন্দ লাভ করেছেন তা শ্রীল প্রভুপাদ ও শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর বর্ণনা থেকে আমরা তা জানতে পারি। কেননা শেষ পর্যন্ত রূপ গোস্বামী হচ্ছেন আমাদের পরমাচার্য। আমরা রূপানুগ। আমরা শ্রীল রূপ গোস্বামীর পরম্পরা অনুসরণ করছি। যদিও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গে সম্পর্কিত ভাবে অন্যান্য ব্যক্তিত্বগণও অত্যন্ত উন্নত, কিন্তু “শ্রীচৈতন্য মনোহভিষ্টং স্থাপিতং যেন ‘ভূতলে’ বিষয়ে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আকাঙ্খিত কৃষ্ণভাবনামৃতকে জগৎজুড়ে বিস্তার ঘটানোর জন্য শ্রীল রূপ গোস্বামী ছিলেন মহাপ্রভুর বিশেষ ক্ষমতাপ্রদত্ত ৷
আমরা কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনে রয়েছি আর সেই কৃষ্ণভাবনামৃতের মূর্ত বিগ্রহ হচ্ছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। তাই শ্রীল প্রভুপাদ বিভিন্ন সময়ে বারংবার বলেছেন, “আমরা কেউই সরাসরি শ্রীকৃষ্ণের কাছে যেতে পারি না। আমাদের অবশ্যই গুরুপরম্পরার মাধ্যমে যেতে হবে যা শুরু হয়েছে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ধারা থেকে। অন্যথা কৃষ্ণের কাছে গমন করা অত্যন্ত কঠিন। যেই কৃষ্ণ তত্ত্ববেত্তা সেই শুরু হয়। তাই কৃষ্ণকে তত্ত্বত জানতে হবে। কৃষ্ণও স্বয়ং ভগবদ্গীতায় বলেছেন, যো বেত্তি তত্ত্বতঃ। কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় প্রকৃত সত্য জানা অত্যন্ত কঠিন। শ্রীল রূপ গোস্বামী আরও লিখেছেন- অহের ইব গতিঃ প্রেম্নঃ স্বভাব-কুটিলা ভবেৎ। “তুমি যদি কৃষ্ণকে অথবা কৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলাকে জানতে চাও, সেটি হবে অত্যন্ত জটিল একটি ব্যাপার এবং অত্যন্ত কঠিন।” তিনি বলেছেন যে, “সেটি অনেকটা সাপের গতির মতো।” আপনি যদি কখনও সাপের চলাফেরা লক্ষ্য করেন তাহলে মনে হবে যে, তারা এদিকেও যাচ্ছে, ওদিকেও যাচ্ছে। তাই সত্যি সত্যি তারা কোন দিকে যাবে সেটি কখনও জানা যায় না। সাপ এমনভাবে চলে। তেমনই সরাসরিভাবে কৃষ্ণকে জানার চেষ্টা করা, তাঁর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু কেউ যদি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মাধ্যমে কৃষ্ণের কাছে যেতে চায় তখন সেটি অনেক সহজ হয়ে দাঁড়ায় শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী বলছেন-
কথঞ্চন স্মৃতে যস্মিন্ দুষ্করং সুকরং ভবেৎ।
বিস্মৃতে বিপরীতং স্যাৎ শ্ৰীচৈতন্যং নমামি তম্ ॥
(চঃ আদি ১৪/১)
“যাঁকে কোনো না কোনো ভাবে স্মরণ করলে অত্যন্ত কঠিন কাজও সহজ সাধ্য হয় এবং যাঁকে ভুলে গেলে ঠিক তার উল্টো হয়, অর্থাৎ অত্যন্ত সহজ কাজও দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে, সেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।”
তাই আমাদের কৃষ্ণভাবনামৃতের সামগ্রিক আদর্শ বা পন্থাটি হল শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মাধ্যমে কৃষ্ণের কাছে যাওয়া এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মাধ্যমে কৃষ্ণের মহিমা কীর্তন করা। এ বিষয়ে দুটি চমৎকার উদাহরণ আমার মনে পড়ছে। একটি হল পুরীদাসের কথা, যিনি পরবর্তীকালে কবি কর্ণপুর নামে পরিচিত হয়েছিলেন। পুরীদাস যখন সাত বৎসরের এক ছোট বালক ছিলেন মাত্র, তখন তিনি তাঁর পিতা শিবানন্দ সেনের সঙ্গে জগন্নাথ পুরী দর্শনে এলেন নবদ্বীপ ধাম থেকে। শিবানন্দ সেন প্রতি বছরই সপরিবারে জগন্নাথ পুরী দর্শন করতে আসতেন। তিনি মহাপ্রভুর অন্যান্য পার্ষদগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর তাঁর নাবালক পুত্র পুরী দাসকে নিয়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে দর্শন করতে এলেন। পুরী দাস মহাপ্রভুর কাছে এলে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু পুরী দাসকে ‘কৃষ্ণ’ নাম উচ্চারণ করতে বললেন। কিন্তু পুরী দাস কোনো কিছুই উচ্চারণ করছিল না। এইরকম অবস্থাই চলতে লাগলো। যতক্ষণ না শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু পুরী দাসকে আশীর্বাদ করে তাঁর পাদপদ্মের ধূলি প্রদান করলেন। তখন পুরী দাস কৃষ্ণ নাম উচ্চারণ করলেন। শুধু তাই নয়, মহাপ্রভুর আদেশে সকলকে বিস্মিত করে কৃষ্ণ সম্বন্ধে একটি অপূর্ব শ্লোক রচনা করে নিবেদন করলেন। সেই শ্লোকটি হল-
শ্রবসোঃ কুবলয়মক্নোরঞ্জনমুরসো মহেন্দ্রমণিদাম।
বৃন্দাবনরমনীনাং মণ্ডনমখিলং হরিজয়তি ॥
অর্থাৎ, “যিনি কর্ণের কুবলয়, চোখের কাজল, বক্ষের ইন্দ্রনীল মণির মালা এবং ব্রজ-রমণীদের
অখিল অলঙ্কার, সেই শ্রীহরি কৃষ্ণ জয়যুক্ত হোন।” সাত বছরের এক শিশু, যে কি না তখন লেখাপড়া শুরু করে নি, তার মুখে এমন গভীর তত্ত্বাজ্ঞানসম্পন্ন শ্লোক রচনা শ্রবণ করে সকল গৌড়ীয় বৈষ্ণবগন তাকে ‘কবি’ অর্থাৎ মহান পণ্ডিত বিবেচনা করলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও আনন্দিত হয়েছিলেন প্রকৃতপক্ষে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপা লাভ করার পরই পুরীদাস শ্রীকৃষ্ণের মহিমা কীর্তন করতে পেরেছিলেন। এই বিষয়ে শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী প্রথমেই চৈতন্য চরিতামৃতের আদি লীলার চতুর্থ পরিচ্ছেদের প্রথম শ্লোকে বলেছেন-
শ্রীচৈতন্যপ্রসাদেন তদ্রুপস্য বিনির্ণয়ম।
বালোহপি কুরুতে শাস্ত্রং দৃষ্ট্বা ব্রজবিলাসিনঃ ॥
অর্থাৎ “শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপায় একটি অবোধ শিশুও শাস্ত্রীয় দর্শন অনুসারে ব্রজবিলাসী শ্রীকৃষ্ণের তত্ত্বস্বরূপ নির্ণয় করতে পারে।” এক্ষেত্রে শিশু পুরী দাস বা কবি কর্ণপুর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ।
আরেকটি উদাহরণ হল শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর বলেছেন যে, গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন সম্বন্ধে গবেষণার জন্য তিনি প্রথমে শ্রীমদ্ভাগবত দিয়ে অধ্যয়ন শুরু করেছিলেন। যখন তিনি ভাগবতের দশম স্কন্ধ পড়ছিলেন তখন প্রকৃতই তিনি বিরক্ত হচ্ছিলেন এবং ভগবান যে এরকম তা তিনি মেনে নিতে পারেন নি। তিনি মেনে নিতে পারেন নি যে যিনি পরমেশ্বর ভগবান, তিনি এমন নিশুতি রাতে পরস্ত্রীদের তাঁর সঙ্গে নৃত্য করার জন্য প্রলুব্ধ করবেন। এটি অত্যন্ত নীতি বিরুদ্ধ কাজ। পাঁচ হাজার বছর আগেও যেমন এটি নীতি বিরুদ্ধ কাজ ছিল, একশ বছর আগে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের সময়েও তা ছিল সমান নীতি বিরুদ্ধ কাজ। তাই তখন তিনি স্বীকার করতে পারেন নি যে কৃষ্ণই হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান।
কিন্তু যখন শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর চৈতন্য চরিতামৃত পড়লেন তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মাধ্যমে তিনি প্রকৃত তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করতে পারলেন। তখন তাঁর কাছে পুরো ব্যাপারটিই খুব পরিষ্কার হয়ে গেল।
শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ছিলেন একজন নিত্যমুক্ত আত্মা। কিন্তু তবুও তিনি কিভাবে শ্রীকৃষ্ণকে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে এবং আমরা যদি শ্রীকৃষ্ণের মহিমা কীর্তন চাই তাহলে সেটি কিভাবে সহজ পন্থায় সম্ভব সে ব্যাপারে দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিলেন। শ্রীল প্রভুপাদও এ বিষয়ে আমাদের উৎসাহিত করেছেন। শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর শিষ্যবৃন্দকে শ্রীকৃষ্ণের মহিমা কীর্তন করে গ্রন্থ রচনার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন এটিই আমাদের পরম্পরা, আমাদের ঐতিহ্য। অধিকন্তু, তিনি বলেছেন যে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু চাইতেন যে তাঁর অনুগামীরা গ্রন্থ রচনা করুক। এই জন্য মহাপ্রভু গোস্বামীগণকে গ্রন্থ রচনার ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপা ছাড়া এটি সম্ভব নয়। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর আমাদের সেটিই প্রদর্শন করেছেন যে, কেউ যদি সরাসরি কৃষ্ণের কাছে যেতে চায়, তাহলে সেটি অসম্ভব।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মাধ্যমে সহজে শ্রীকৃষ্ণের কাছে পৌঁছাতে হলে প্রয়োজন কেবল প্রকৃত বিশ্বাস বা শ্রদ্ধার। কৃষ্ণভাবনামৃতের যে কোনো স্তর অর্জনের জন্যই চাই প্রকৃত শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। তাই কৃষ্ণভাবনামৃত পথের পথিকগণের অবশ্যই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রতি দৃঢ় শ্রদ্ধা থাকা চাই। কেবলমাত্র শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রতিই দৃঢ় বিশ্বাস নয়, মহাপ্রভুর পার্ষদগণের প্রতিও থাকা চাই দৃঢ় ভক্তি ও শ্রদ্ধা। যদিও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদগণকে সাধারণ মানুষ বলে মনে হয় কিন্তু তাঁরা কেউই সাধারণ ব্যক্তিত্ব নন। শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর বলেছেন, ‘গৌরাঙ্গের সঙ্গীগণে নিত্য সিদ্ধ করি মানে।’ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদগণ সকলেই নিত্য সিদ্ধ। শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে স্বীকার করলেও শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে স্বীকার করেন নি। তাই তার পতন হয়েছিল এবং শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গ ও গৃহ ত্যাগ করে বৃন্দাবনে গমন করেছিলেন।
অতএব, আমরা বুঝতে পারলাম যে, কথঞ্চন স্মৃতে যস্মিন দৃষ্ণরং সুকরং ভবেৎ-সাধারণভাবে যা অর্জন করা খুবই কঠিন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপা লাভের দ্বারা তা অত্যন্ত সহজ ও সুলভ হয়ে যায়। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অন্যতম প্রিয় পার্ষদ শ্রীল রূপ গোস্বামী আমাদের সেই আশীর্বাদ প্রদান করেছেন। আমরা যদি পরম্পরাক্রমে সেই আশীর্বাদ গ্রহন করি, তাহলে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপায় আমরাও শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান রূপে হৃদয়ঙ্গম করতে পারব, শ্রীকৃষ্ণের মহিমা কীর্তন করতে পারব এবং চরমে কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে উঠতে সক্ষম হব।
|
|