মনে মনে

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১২:৪৩ অপরাহ্ণ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১২:৪৩ অপরাহ্ণ

এই পোস্টটি 261 বার দেখা হয়েছে

মনে মনে

প্রশ্নটি ছিল ঠিক এরকম কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে…… এর বিপরীতে কোথায় আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে? অর্থাৎ মনে মনে নিজেকে হারালেই যদি হরেক রকমের বিপর্যয় নেমে আসে তবে মনকে ঠিক কোথায় হারালে আমি বিপর্যস্ত হব না? এর উত্তরটি শোনার আগে প্রথমে আমাদের অবগত হওয়া প্রয়োজন যে, কৃত্রিম ভাবে মন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ডেল কার্নেগীর নাম উল্লেখযোগ্য। যদিও তিনি মন নিয়ন্ত্রণের অনেক বই রচনা লিখেছেন, কিন্তু সবচেয়ে অবাকের বিষয় হল তিনিই কিনা নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। এরপর আসে হিটলারের আত্মহত্যা। যার সাফল্যের মধ্যে রয়েছিল অনেক দেশ জয়ের সফলতা কিন্তু মনকে নিয়ন্ত্রণের সফলতা অর্জন করতে না পেরে তিনিও আত্মহত্যা করেন। এরকম আরো অনেক ঘটনাই ইতিহাসের পাতায় রয়েছে। মনে মনে নিজেকে যেখানে খুশি হারানোটা যে কতটা বোকামী তা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই ২য় অধ্যায়ের ৬২-৬৩নং শ্লোকে ব্যক্ত করেছেন।

“ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ সম্বন্ধে চিন্তা করতে করতে মানুষের তাতে আসক্তি জন্মায়। আসক্তি থেকে কাম উৎপন্ন হয় এবং কামনা থেকে ক্রোধ উৎপন্ন হয়। ক্রোধ থেকে সম্মোহ, সম্মোহ থেকে স্মৃতিবিভ্রম, স্মৃতিবিভ্রম থেকে বুদ্ধিনাশ এবং বুদ্ধিনাশ হওয়ার ফলে সর্বনাশ। অর্থাৎ মানুষ পুনরায় জড় জগতের অন্ধকূপে অধঃপতিত হয়।” একটু মনোযোগ সহকারে এই শ্লোকটি চিন্তা করুন তখন মনের অবাঞ্চিত ক্রিয়াকলাপ থেকে আপনিও নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হবেন। চৈতন্য সন্দেশ পত্রিকায় একটি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছিল যে, কিভাবে ভারতের IIT (ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন অফ টেকনোলজি) এর একজন স্টুডেন্ট তার ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া নিয়ে নানা দুঃশ্চিন্তা সহ্য করতে না পেরে কিভাবে আত্মহত্যা করেছিল। অথচ পরবর্তীতে সে ফার্স্ট ক্লাসই পেয়েছিল। এই হল মনের অবাধ বিচরণের এক ভয়াবহ নিদর্শন।

সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে মানসিক অস্থিরতার কারণে ৯০ শতাংশ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে। এসব আত্মহত্যার পেছনে বড় দুটি কারণ হচ্ছে হতাশা ও পীড়ন। বিশ্বে প্রতি বছর এভাবেই প্রায় ১০ লক্ষ লোক আত্মহত্যা করে। সূত্রঃ প্রথম আলো।

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ এসব ঘটনার একটু অনুসন্ধান চালালেই ঐ শ্লোকটির বিরাট মিল আপনারাই খুঁজে পাবেন। আপনার জীবনেও কিন্তু এই একটি মাত্র শ্লোক অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। অনেকেই আবার নিজের জীবনের দুর্বিষহ মুহূর্তগুলোকে দূরে ঠেলে দেওয়ার জন্য ধূমপান, মদ্যপান, দেবদেবীর শরণাপন্ন ছাড়াও বিবিধ পদ্ধতির শরণাপন্ন হয়। বিদেশেতো নিজেকে সুখী করার জন্য রয়েছে Laughing Club বা হাসির ক্লাব। সেখানে যারা নিজেকে সুখী দেখতে চায় তারা এই ক্লাবে এসে হো হো হো……. করে কৃত্রিমভাবে সবাই মিলে হাসাহাসি করে। অর্থাৎ সবাই নিজের জীবনকে সুখী দেখতে চায় কেননা তারা দুঃখী বলেই। যে সুখ বা দুঃখ নিয়ে আমরা এত চিন্তিত কিংবা যে সুখ পাওয়ার জন্য সারা বিশ্বে এত সব পদ্ধতির শরণাপন্ন হচ্ছেন সেই সম্পর্কে ভাগবত কী বলছে? আসুন, জানা যাক ।

অবন্তি ব্রাহ্মন নামে একজন ধনী ব্যবসায়ী অত্যন্ত মন্দউপায়ে অর্থোপার্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন খুবই নিষ্ঠুর ও অত্যাচার পরায়ন। কিন্তু এক পর্যায়ে যখন তিনি কর্মের প্রভাবে তার সমস্ত উপার্জিত অর্থ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়লেন। তখন তার ভুল বুঝতে পেরে তিনি ভগবানের উদ্দেশ্যে সাধনায় ব্রতী হলেন। তা দেখে তখন সবাই তাকে উত্যক্ত করত, ক্ষতি করার চেষ্টা করত কিংবা উপহাস করত। তখন সমস্ত অপমান সহ্য করে তিনি বলেন,

এই সমস্ত লোকেরা আমার সুখ দুঃখের কারণ নয়, নয় কোন দেবদেবী। নয় আমার নিজের দেহ, গ্রহসমূহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, আমার অতীত কর্ম অথবা কাল। বরঞ্চ আমার সুখ এবং দুঃখ পাওয়ার পেছনেই কিংবা এ জড় জগতের জন্ম চক্রে আবর্তনের অন্যতম কারণ হল এই মন” । (ভাগবত ১১.২৩.৪২)
তাহলে বুঝতে পারছেন মনই হচ্ছে সমস্ত কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। মন যদি উপযুক্ত শিক্ষা পায় তবে সে সর্বাবস্থায় আপনাকে সুখ দিবে। সেকথা ভগবান শ্রীকৃষ্ণও গীতার ৬ষ্ট অধ্যায়ের ৬নং শ্লোকে ব্যক্ত করেছেন। “যিনি তার মনকে জয় করেছেন, মন তার পরম বন্ধু। কিন্তু যিনি তা করতে অক্ষম তাঁর মনই তাঁর পরম শত্রু। ঐ একই অধ্যায়ে ৫নং শ্লোকে ভগবান বলেছিলেন “মানুষের কর্তব্য তার মনের দ্বারা নিজেকে জড় জগতের বন্ধন থেকে উদ্ধার করা, মনের দ্বারা আত্মাকে অধঃপতিত করা কখনই উচিত নয়। মনই জীবের অবস্থা ভেদে বন্ধু ও শত্রু হয়ে থাকে।”

সুতরাং এখন প্রশ্ন হল আপনার মনকে কিভাবে শিক্ষা দিবেন? সে প্রসঙ্গে ভগবান বলছেন, “হে মহাবাহো। মন যে দুর্বার ও চঞ্চল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু হে কৌন্তেয়। ক্রমশ অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা মনকে বশীভূত করা যায়।” (ভ. গীতা ৬/৩৫) অমৃতবিন্দু উপনিষদ-২ এ ও ভগবান বলেছেন মন এব মনুষ্যানাং কারনং বন্ধমোক্ষয়োঃ। বন্ধায় বিষয়াসঙ্গো মুক্ত্যৈ নিবিষয়ং মনঃ ॥ “মনই মানুষের বন্ধন ও মুক্তির কারণ। বিষয়াসক্ত মনই বন্ধনের কারণ এবং বিষয়ে অনাসক্ত মনই মুক্তির কারণ। অতএব মনকে সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিযুক্ত করা উচিত। তা পরম মুক্তির কারণ।”

ভ. গীতার ৮ম অধ্যায়ের ৮নং শ্লোকেও ভগবান বলছেন, “হে পার্থ! অভ্যাস যোগে যুক্ত হয়ে অনন্যগামী চিত্তে যিনি অনুক্ষণ পরম পুরুষের চিন্তা করেন, তিনি অবশ্যই তাকে প্রাপ্ত হবেন।” তাই কৃষ্ণভাবনায় মনকে অনুক্ষণ হারালেই আপনার মন আপনার জন্য বিপদের কারণ হবে না বরঞ্চ সুখের অমৃত আস্বাদন করতে পারবেন। এই হচ্ছে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ ইস্কনের আদর্শ। শ্রীল প্রভুপাদ কৃষ্ণভাবনামৃত হতে বলেছেন এজন্যই যাতে করে আমরা সবসময় কৃষ্ণভাবনাময় হতে পারি। সেজন্যই আপনার দৈনন্দিন জীবনধারাকে কৃষ্ণভাবনা হিসেবে গড়ে তুলুন যাতে করে আপনি যাই করুন না কেন তা যেন কৃষ্ণের সন্তুষ্টির জন্য হয়। এই হল কৃষ্ণভাবনা। তবে এক্ষেত্রে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ ও কীর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সারাবিশ্বের মানুষ আজ এ কৃষ্ণভাবনামৃত পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে স্ব-স্ব- মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হচ্ছে। তাই কোথায় আমার হারাতে নেই মানা মনে মনে……? এ প্রশ্নে উত্তরে কি বলবেন? হ্যাঁ, অবশ্যই এর উত্তর হবে কৃষ্ণভাবনায়। তাই আজকের বিশ্বের মানুষ যদি সমস্বরে গাইতে পারে কৃষ্ণভাবনায় আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে……। তবে এ জগতে আর এত অশান্তি থাকবে না। কেননা ভগবান নিজেই বলেছেন এ ভাবনায় হারালেই আর কোন দুঃখ নেই । হরে কৃষ্ণ ॥


চৈতন্য সন্দেশ অক্টোবর-২০০৯ প্রকাশিত

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।