এই পোস্টটি 435 বার দেখা হয়েছে
প্রকৃতির অনবদ্য শিক্ষা থেকে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার সূত্র অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ
১৯৬১ সালে জাপানের টোকিওতে The National Cultural Society of Japan মানব হৃদয়ের উত্থানের জন্য এক অধিবেশনের আয়ােজন করে। এ অধিবেশনের উদ্দেশ্য ছিল মানব হৃদয়ের উত্থানের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করা। সারা পৃথিবী থেকে তারা অংশগ্রহণকারীদের আমন্ত্রণ জানান। শ্রীল প্রভুপাদ যখন বৃন্দাবনে অবস্থান করছিলেন তখন তাঁর এক শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁকে এ সংবাদটি জানান। শ্রীল প্রভুপাদ শুনে এটিকে তার গুরুদেবের বাসনা পূরণের এক সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি পরবর্তীতে বিশ্বশান্তি বিষয়ে তাঁর একটি প্রস্তাবনা আয়ােজকদের কাছে পাঠালে, তাঁরা তার সদুত্তর দেন। The International foundation for cultural of Japan শ্রীল প্রভুপাদের প্রস্তাবনায় সন্তুষ্ট হয়ে ঐ অধিবেশনে তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। ঐ ফাউন্ডেশনের প্রধান সচিব মি. তােসিহিরাে নাকামোে লিখেন, “আপনার প্রস্তাবনা আর ভারতের আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি দুইয়ের প্রতিই আমি শ্রদ্ধাশীল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনার বক্তব্যে সবাই জ্ঞান লাভ করবেন এবং সেই মত এই অস্থির জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে।” শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর বক্তব্যের শিরােনাম দেন, “ভাগবতের পূর্ণ জ্যোতি” এবং এর বিষয়বস্তু আহরণ করার পরিকল্পনা করেন শ্রীমদ্ভাগবতের ১০ম খণ্ডের বিংশতি অধ্যায় থেকে।
যেটি হল বৃন্দাবন ধামের শরতের বর্ণনা। তিনি প্রায় ৫০টি উদ্ধৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা করেন, যাতে ৫০টি চিত্রকর্মও প্রদর্শিত হবে। তিনি অনুধাবন করেন যে, যেহেতু অধিবেশনটি জাপানে অনুষ্ঠিত হবে, সবাই খুব সহজেই এটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। কারণ এ উদ্ধৃতিগুলাে প্রাচ্য দেশের ধাঁচেই রচিত। শ্রীল প্রভুপাদ কোনাে কারণবশত সেই অধিবেশনে যোগ না দিলেও তাঁর রচিত ভাগবতের উদ্ধৃতিগুলাে পরবর্তীতে সংকলন করা হয়। ব্যাক টু গডহেডে প্রভুপাদের সেই সব উদ্ধৃতি ও তাৎপর্য তুলে ধরা হল।
পরমেশ্বরের সাথে আমাদের সম্পর্ক পুণঃপ্রতিষ্ঠা
উদ্ধৃতি-১ : আকাশে মেঘের আগমন, সাথে বজ্র আর বিদ্যুতের ঝলকানি, যেন সঞ্চার করে জীবনদায়ী আশার আলােক। জলভরা শ্যামঘন মেঘের চাদরে আকাশ যেন জড়িয়ে নিয়েছে নিজেকে। মেঘের ভীড়ে সেই বজ্র-বিদ্যুতের ঝলকানি যেন নবজীবনের, নব আশার প্রতীক।
তাৎপর্য : আকাশের চিত্রটি অসীম ও বিশাল। এটিকে প্রকৃত সত্যের সাথে তুলনা করা যায়। সমস্ত জীব সত্য, কিন্তু তাদের মধ্যে সত্যের যে প্রকাশ তার সাথে প্রকৃতির তিনটি গুণের মিশ্রণ রয়েছে। গভীর ঘন নীল মেঘ সেই অসীম আকাশের একটি তাৎপর্যহীন অংশকে ঢেকে রেখেছে। এই ঢাকা অংশটিকে অজ্ঞতা বা আত্মপরিচয় ভুলে যাওয়ার প্রবণতার সাথে তুলনা করা যায়। যাই হােক, তার মধ্যে এই জড় জগৎকে ভােগ করার প্রবণতা রয়েছে। তমাে (অজ্ঞতা) নামক এই গুণের কারণে সে নিজেকে প্রকৃত সত্য হতে পৃথক বলে মনে করছে এবং তার চিন্ময়কে ভুলে গেছে। যেটিকে (চিন্ময়ত্ব) পরিষ্কার আকাশের সাথে তুলনা করা যায়। তার এই ভুলে যাওয়ার প্রবণতা তার মধ্যে নিজেকে পৃথক ভাবার মিথ্যা অহংকার উৎপন্ন করছে। ব্যক্তিগতভাবে এবং সংকলিতভাবে সে বজ্রের মত আওয়াজ তুলে “আমি এই, এটি আমাদের, এটি আমার। এই মিথ্যা পৃথক ভাবার যে ভাব তাকে বলা হয় রজঃগুণ এবং যে গুণটি পরমেশ্বরের কাছ থেকে জীবসত্তাকে পৃথক করতে চাপ প্রয়ােগ করে সেটি হচ্ছে তমােগুণ। তার মধ্যেও এক ঝলক আলাে নিয়ে আসে আশার আলাে যা দিয়ে যে কেউ চালিত হতে পারে জ্ঞানের পথে তা এটিকে সত্ত্বগুণের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
অনন্ত আকাশ অথবা সুবিস্তৃত প্রকৃত সত্য (ব্রহ্ম) আকাশের মেঘে ঢাকা অংশগুলাে হতে পৃথক নয় কিন্তু পর্যায়গতভাবে আকাশের সেই সকল স্থানের খণ্ডিত অংশের ঘনকালাে মেঘগুলাে হতে পৃথক। সমস্ত মেঘ, বজ্র অথবা বিদ্যুতের আলাে একত্রিত হয়ে সেই অসীম আকাশ বা প্রকৃত সত্যকে ঢেকে দিতে পারে না। জীব মেঘে ঢাকা আকাশের মতই প্রকৃত সত্যের (ব্রহ্ম) ক্ষুদ্র প্রকাশ, যে অজ্ঞতারূপ ঘনকালাে মেঘের দ্বারা আচ্ছাদিত।
দুই ধরনের দার্শনিক রয়েছে অদ্বৈতবাদি এবং অপরটি দ্বৈতবাদী, অদ্বৈতবাদীরা জীব ও পরম সত্যের একত্বে বিশ্বাস করে, কিন্তু দ্বৈতবাদীরা তাদের নিজেদের সত্তাকে পরম সত্য (ব্রহ্ম) হতে পৃথক মনে করে। এই দুই তত্ত্বের উর্ধ্বে একটি তত্ত্ব রয়েছে যেটিকে বলা হয় অচিন্ত ভেদাভেদ তত্ত্ব” অথবা এমন এক পরম সত্য যা এক এবং একই সাথে তার বিপরীত। এই সূত্রটি শ্রীমন্ মহাপ্রভুই প্রথম উত্থাপন করেছিলেন বেদান্ত সূত্রসমূহ ব্যাখ্যার মাধ্যমে। বেদান্ত হচ্ছে সকল দার্শনিকের প্রেরণার উৎস বা মাধ্যম। তাই এটি কোন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির দার্শনিকদের একক সম্পত্তি নয়। যিনি বেদের পরম সত্য অন্বেষণ করেন তাকে বলা হয় বৈদান্তিক। বেদ অর্থ জ্ঞান, তাই যেকোনাে ধরনের জ্ঞান বৈদিক জ্ঞানের অংশ এবং জ্ঞানের সকল শাখার সারমর্মকে বেদান্ত বলে অভিহিত করা হয়। দর্শনকে যেমন সকল বিজ্ঞানের বিজ্ঞান বলা হয় তেমনি বেদান্ত হচ্ছে সকল জল্পনা কল্পনামূলক দর্শনের চূড়ান্ত দর্শন।
ভগবানের আইন পালনের মাধ্যমে
সুখ অর্জন
উদ্ধৃতি-২: সূর্যের সেই খরতপ্ত রােদুর যখন জলকে চালিত করে বায়ুপথে শুকিয়ে গিয়ে নদ নদী, হ্রদ, জলাধার, অথবা এতটুকু জল যদি কোথাও থেকে থাকে। তখন সেই জলশূণ্য জন অরণ্য তৃষ্ণার্ত হয়ে চেয়ে থাকে বৃষ্টিপানে, কিন্তু আসে নৈরাশ্য। ঠিক সেই ক্ষণে, আশারবাণী বৃষ্টি হয়ে পতিত হয় পথে প্রান্তরে, এমনকি নির্মম পাথরেও। আর প্লাবিত হয় সমগ্র সমতল।
তাৎপর্য : রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বিভিন্ন জনকল্যাণমুলক সেবা প্রদান করার শর্তে তাদের উপর বিভিন্ন প্রকারের কর আরােপ করে। যেমন আয়কর, বিক্রয়কর, ভূমিকর, বন্দরের শুল্ক, অবগায়ী শুল্ক ইত্যাদি। কিন্তু যখন সকল করের অর্থ একত্র করে বিশাল অংকের অর্থ হয়, তখন সেই অর্থ জনগণের জন্য বিভিন্নভাবে ব্যয় করা হয়। মাঝে মাঝে এমনও ঘটে যে, বৃষ্টি সদৃশ সকল করের অর্থ রাষ্ট্রের পাথর (মর্মর) হৃদয়ের ব্যক্তি বা কর্মকর্তার হাতে পড়ে, যে এই অর্থ যথােপযুক্ত খাতে ব্যয় করতে অসমর্থ, অথবা সে এগুলাে তার ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্যও ব্যবহার করতে পারে। সাধারণ মানুষ মনে করে বৃষ্টির এই অসম বন্টন (পতিত, অনাবাদী ও অপ্রয়ােজনীয় জায়গায় বৃষ্টি পড়া) আমাদের কৃত পাপকর্মের ফলে প্রকৃতির মধ্যে উৎপন্ন ক্রোধেরই প্রতিনিধিত্ব করছে। এখানে একটি সত্য রয়েছে। এইভাবেই রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের নিকট হতে প্রাপ্ত অর্থের সমবন্টন করতে রাষ্ট্রের সৎ নৈতিক ও বিবেক সম্পন্ন নাগরিকের প্রয়ােজন।
তাদের করের অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে যেমন সৎ হওয়া উচিত, সেই সাথে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরূপে পরিচালিত উন্নয়ন কার্যক্রমগুলাে সফলভাবে হচ্ছে কিনা তাও তদারকি করা উচিত।
বর্তমান সময়ের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকদের অভিযােগ করার কোন কারণ নেই, কেননা সম্পূর্ণ প্রশাসনিক ব্যবস্থা তাদের দ্বারা নির্বাচিত। কিন্তু যখন সেই লােকেরা নিজেরাই দুর্নীতিবাজ হয় এবং অসৎ হয়, তখন সম্পূর্ণ প্রশাসন যন্ত্রই দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। যদিও একটি বাজে সরকারের দলের নাম ভাল বা আড়ম্বরপূর্ণ হতে পারে। কিন্তু লােকজন সৎ না হলে যে দলই সরকার পরিচালনা করুক না কেন, সে সরকার ভাল হবে না। অতএব, জনগণের চেতনা উন্নয়ন ঘটানাের জন্য একটি ভালাে সরকার প্রাথমিক প্রয়ােজন। প্রয়ােজন সম্পদের সুষম বন্টনও।
তখনকার দিনের রাজারা রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে জ্ঞাত এমন উন্নত ও আদর্শ শিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। আর গ্রামের নাগরিকেরা সমাজের জাগতিক ও পারমার্থিক উন্নতির জন্য বৈদিক জ্ঞানের আলােকে আত্ম উপলব্ধির নীতিগুলাে শিক্ষা লাভ করতেন। ফলে নাগরিকেরা ঈশ্বর ভাবনাময় হত এবং তাদের সকল চুক্তি ও কাজে সৎ থাকত সেই সাথে রাজারাও রাষ্ট্রের কল্যাণার্থে দায়িত্ববান থাকত। একই নীতি বর্তমানে গণতান্ত্রিক দলগুলােও গ্রহণ করছে, দায়িত্বজ্ঞানহীনদের ভােটের আওতামুক্ত করে দায়িত্ববানদের সরকারের জন্য ভােটের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। কিন্তু মহাবিশ্ব পরিচালনার ক্ষেত্রে যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা সেখানে শুধু একটি দলই রয়েছে। সেটি ভগবানের ভক্তদের নিয়ে গঠিত এবং পরমেশ্বর ভগবান সেখানে বিভিন্ন দায়িত্ববান দেবতাদের বিভিন্ন গ্রহ ও তাঁর প্রবর্তিত মহাবৈশ্বিক সূত্রগুলাে যথার্থ প্রয়ােগ ও পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ তার স্বীয় নির্বুদ্ধিতার জন্য দুঃখ ভােগ করছে। নির্বুদ্ধিতা কি? ভগবদ্গীতায় বলা হচ্ছে জনগণের জন্য করা উচিত। পরমেশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য যজ্ঞ করা উচিত।
অন্নাদ্ ভবন্তি ভূতানি পর্জন্যাদন্নসম্ভবঃ।
যজ্ঞাদ্ ভবতি পর্জন্যো যজ্ঞঃ কর্মসমুদ্ভবঃ॥
অনু খেয়ে প্রাণিগণ জীবন ধারণ করে। বৃষ্টি হওয়ার ফলে অন্ন উৎপন্ন হয়। যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার ফলে বৃষ্টি উৎপন্ন হয় এবং শাস্ত্রোক্ত কর্ম থেকে যজ্ঞ উৎপন্ন হয়। (ভ.গী.-৩.১৪)
পরমেশ্বর ভগবান সর্বত্র ব্যাপ্ত আছেন। তাই মানুষের উচিত কীভাবে যজ্ঞ করতে হয় তা শিখে নেয়া এবং এই যজ্ঞ করার মাধ্যমে তারা সর্বব্যাপ্ত পরম সত্যকে সন্তুষ্ট করতে পারে। এখানে ভিন্ন ভিন্ন যুগের জন্য ভিন্ন ভিন্ন যজ্ঞ নির্ধারণ করা হয়েছে এবং বর্তমান এই লৌহ শিল্পের যুগের যে যজ্ঞ সেটি ঈশ্বর ভাবনার জন্য মনকে আলােকিত করে। এই যজ্ঞকে বলা হয় সংকীর্তন যজ্ঞ অথবা হারানাে চেতনা ফিরে পাওয়ার জন্য নিজেকে আন্দোলিত করা বা প্রার্থনা করা। শীঘ্রই যদি কেউ পারমার্থিক ভজন, কীর্তন, নৃত্য ও প্রসাদ সেবনের মাধ্যমে এই আন্দোলন গ্রহণ করে, তখন সে স্বাভাবিকভাবেই বিনম্র এবং সৎ হয়।
বিনম্রতা শৃঙ্খলার প্রথম সূত্র। মানুষেরা ঈশ্বরের আইনের প্রতি অনুগত নয়। ফলে বৃষ্টি বা সম্পদ কোনােটাই সমভাবে বন্টিত হবে না। যে ব্যক্তি অবাধ্য তার মধ্যে কোন ভালগুণ থাকতে পারে না। যখন অবাধ্য জনগণ, অবাধ্য নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হয় তখন সম্পূর্ণ প্রশাসনিক পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়ে এবং একটি ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হয়। এটি একটি অন্ধ লােক দ্বারা আরাে কিছু অন্ধ লােকদের পথ প্রদর্শন বা পরিচালনা করার মতই। তাই রাষ্ট্রের কর সাধারণ জনগণের ভাল চরিত্র তৈরিতে ব্যয় করা উচিত। এটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে সুখ শান্তি নিয়ে আসবে।
সমস্ত আইনের পেছনে আইনপ্রণেতা
উদ্ধৃতি-৩ : বিদ্যুতের আকর্ষনে অথবা বাতাসের শক্তিতে, আকাশের মেঘরাশি নেমে আসে ধরিত্রীতে, জলের যােগান দিয়ে শীতল করে আর্ত লােকের তাপিত হৃদয়ভার, এটি তাদের জীবনের সার। মেঘ নামে মানবের মাঝে ছেড়ে আকাশের ঠিকানা, যেন কৃপা হয়ে নেমে আসে পরমেশ্বরের করুণা। আনে হিত, সেইতাে সর্বাকর্ষক, সকলের সুহৃদ।
তাৎপর্য: আমাদের সবসময় মনে রাখা উচিত যে ঈশ্বর আমাদের প্রতি সর্বদা দয়াশীল। ঈশ্বরের প্রাকৃতিক আইন ক্রমাগত উল্লঙ্ঘন করা সত্ত্বেও ঈশ্বর এতই দয়াশীল যে, তিনি আমাদের প্রতিপালন করছেন আমাদের প্রয়ােজনগুলাে সরবরাহ করার মাধ্যমে। জল সকল জীবের জীবন পরিচালনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কেননা জল ছাড়া আমরা না শষ্য উৎপাদন করতে পারব, না তৃষ্ণা মেটাতে পারব। অন্য উদ্দেশ্যেও জলের অবাধ প্রবাহের প্রয়ােজন রয়েছে। তাই ঈশ্বর জগতে তিন চতুর্থাংশ স্থান জল দ্বারা পূর্ণ করে দিয়েছেন এবং সেগুলােকে সংরক্ষণের জন্য লবণাক্ত করে দিয়েছেন। লবণাক্ত জলকে বিশ্লিষ্ট করা যায় না, তাই এটিও তাঁর সরবরাহ আয়ােজনেরই অংশ। পরমেশ্বর শক্তিশালী সূর্যকে নিয়ােজিত করেছেন পৃথিবী নামক গ্রহের জলকে বাষ্পীভূত করে মেঘে রূপান্তর করতে, অতঃপর সেই জল উড়ে গিয়ে জমা হয় পর্বতশৃঙ্গে। যেভাবে আমরা সম্ভাব্য ক্ষেত্রে বা প্রয়ােজনের জন্য জল, জলের ট্যাংক বা পাত্রে জল জমা করি। সংরক্ষণের অংশ হিসেবেই সেই জলকে শীতল করে বরফে রূপান্তর করা হয়, যাতে করে সেই জল বয়ে গিয়ে পৃথিবীতে অনর্থক প্লাবন সৃষ্টি না করে। সেই বরফ ধীরে ধীরে গলতে থাকে, আর বড় বড় নদী হয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। দিতে থাকে সুপেয় মিষ্টি জল। আবার সেই জলধারা ছুটে চলে সমুদ্রের দিকে। সেখানে আবার হয় তার সংরক্ষণ। অতএব ঈশ্বরের প্রকৃতি প্রদত্ত আইন অন্ধ নয় বা কোন দুর্যোগও নয়, যেটি অন্ধ ও সীমাবদ্ধ জ্ঞানী ব্যক্তিরা বলে থাকে। এই সকল প্রাকৃতিক আইনের পেছনে ঈশ্বরের সূক্ষ্ম মস্তিষ্ক রয়েছে। যেমন রাষ্ট্রের সকল আইনের পেছনে রয়েছে একজন আইনপ্রণেতা। আমরা রাষ্ট্রের সাধারণ আইনগুলাের পেছনে আইনপ্রণেতাকে দেখি বা না দেখি অবশ্যই আমাদের স্বীকার করতে হবে এখানে একজন আইনপ্রণেতা রয়েছে। কোন জড় বস্তুই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে না। অতএব আমাদের ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করতে হবে। সেই পরমেশ্বরই প্রকৃতির সকল আইনের প্রণেতা। ঈশ্বর ভগবদ্গীতায় বলেছেন তার অধ্যক্ষতায় জড়া প্রকৃতির সকল কাজ সম্পাদিত হচ্ছে।
ময়াধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়তে সচরাচরম্।
হেতুনানেন কৌন্তেয় জগদ্ বিপরিবর্ততে ॥
হে কৌন্তেয়! আমার অধ্যক্ষতার দ্বারা জড়া প্রকৃতি এই চরাচর বিশ্ব সৃষ্টি করে। প্রকৃতির নিয়মে এই জগৎ পুনঃ পুনঃ সৃষ্টি হয় এবং ধ্বংস হয়। (ভ.গী-৯/১০)
প্রকৃতি একটি শক্তি মাত্র। এর পশ্চাতে একটি শক্তি ঘর ও একটি উন্নত বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মস্তিষ্ক রয়েছে। যেমন একটি বৈদ্যুতিক শক্তিঘরে একজন প্রকৌশলী থাকেন এবং তিনিই তার মস্তিষ্কের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে শক্তিঘরের সমস্ত কিছুর সংযুক্তি, বিযুক্তিও পরিচালনা করেন। এই জড়া প্রকৃতি সুন্দর ও সুনিপুণভাবে ক্রিয়া করছে, কারণ তার পশ্চাতে পরমেশ্বরের অধ্যক্ষতা রয়েছে। বৈদিক মন্ত্র (অথর্ববেদ) একই সিদ্ধান্তটি নিশ্চিত করছে। শুধুমাত্র পরমেশ্বরের অধ্যক্ষতায় জড়া প্রকৃতির আইনসমূহের উৎপত্তি ও প্রতিপালন হচ্ছে। জীবের অব্যর্থ প্রয়ােজন ও সময় অনুসারে পরমেশ্বর এই জগতে তাঁর করুণার প্রকাশ স্বরূপ বৃষ্টি বর্ষণ করছেন। তখনই জল প্রদান করছে যখন বাস্তবিকভাবেই জগতের জীবেরা জলের তৃষ্ণায় মুমূর্ষ হয়ে ওঠে। সন্দেহাতীতভাবেই ঈশ্বর করুণাময় কিন্তু আমাদের সর্বোচ্চ প্রয়ােজনীয় মুহুর্তেই তিনি তার করুণা প্রদর্শন করেন। কেননা যথেচ্ছভাবে তার করুণা পেতে থাকলে আমরা তাকে ভুলে যাব। তাই আমাদের সর্বদা ঈশ্বরকে স্মরণ রাখতে হবে যদি আমরা নিজেদেরকে অব্যাহত দুর্যোগ হতে মুক্ত রাখতে চাই। আমরা তার সাথে চিন্ময় সম্পর্কের দ্বারা যুক্ত। পূর্বে বর্ণিত, আমাদের ভুলে যাওয়ার প্রবৃত্তি সত্ত্বেও ভগবদ্গীতা নিশ্চিত করছে আমরা এই প্রকৃতির আইনের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন গুণ রূপ শৃঙ্খলের দ্বারা আবদ্ধ। কিন্তু যখন আমরা পরমেশ্বরের শরণাগত হব, তখন আমরা এই জড়া প্রকৃতির শৃঙ্খলটি অতিক্রম করতে সমর্থ হব।
দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া ।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে ॥
অনুবাদ : আমার এই দেবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমণীয়া। কিন্তু যারা আমাতে প্রপত্তি করেন, তাঁরাই এই মায়া উত্তীর্ণ হতে পারেন। (ভ. গী.-৭/১৪)
সৎ, চিৎ ও আনন্দই জীবনের মুক্তি
উদ্ধৃতি-৪ : বর্ষার বর্ষণে স্নাত হয়ে দিক-দিগন্ত, অরণ্য-প্রান্তর হয় প্রাণবন্ত, সবুজাভ উচ্ছল। ঠিক যেন শীর্ণকায় জড় বিষয় বিষয় লাভের আশায়, নেমেছিল ঘাের তপস্যায়। অবশেষে পেয়ে তার আকাঙ্ক্ষিত ফল, হয়ে ওঠে পরিপুষ্ট, স্বাস্থ্যবান, সুন্দর।
তাৎপর্য : বর্ষা ঋতুর একটি সবুজাভ পরিবেশ রয়েছে কিন্তু এটি ক্ষণিকের। এটি খুবই আনন্দদায়ক হতে পারে, কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে এটি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে না। ঠিক একইভাবে, জড় বিষয় লাভে উৎসুক যােগীর তপস্যালব্ধ ফলও বেশিক্ষণ থাকবে না। কিন্তু যারা মানসিকভাবে সুস্থ ও প্রকৃতিস্থ তারা এই ধরনের ক্ষণলভ্য ফল লাভের আশা পরিহার করেন। তারা জানেন, এই ধরনের তপস্যা এবং ক্ষণস্থায়ী অর্জন সময় ও শক্তির অপব্যয় ব্যতীত কিছুই নয়। জড় লাভ-ক্ষতি আসলে জীবের বিশেষ বিশেষ জড় শরীর কাঠামাে প্রাপ্তি অনুসারে নির্ধারিত হয়। এখানে ৮৪ লক্ষ প্রজাতির প্রাণ রয়েছে এবং প্রত্যেক প্রকারের শরীরের কাঠামাে নির্দিষ্ট এমনভাবে গঠন করা হয়েছে যাতে সেই শরীরস্থ আত্মা নির্দিষ্ট প্রকারে বিষয় উপভােগ বা দুর্ভোগ সহ্য করতে পারে। ধনী ব্যক্তির সন্তানের আনন্দ বা দুর্ভোগ, দরিদ্র ব্যক্তির সন্তানের আনন্দ বা দুর্ভোগ থেকে পৃথক হয়। যদিও মানুষ দুর্ভোগ থেকে মুক্তির জন্য বিভিন্ন তপস্যা করে থাকে, কিন্তু প্রাপ্য দুর্ভোগ সতর্কবার্তা না দিয়েই আমাদের সামনে উপস্থিত হবে। এমনকি যদি আমরা আমাদের দুর্ভোগ এড়িয়ে ক্ষণস্থায়ী জড় আনন্দ উপভােগ করতে সক্ষম হই, তারপরও এটি তেমন কোনাে তাৎপর্য বহন করে না। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে চিন্ময়ত্ব ও চিরস্থায়ী আনন্দ লাভ করা। শুধুমাত্র সেই উদ্দেশ্যে, সেই চুড়ান্ত অর্জনের জন্য আমাদের যে কোনাে ধরনের কৃচ্ছসাধন বা তপশ্চর্যা করা উচিত। মানব শরীর কাঠামাে প্রাপ্ত হলেই কেবল মাত্র চুড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়। চিরস্থায়ী আনন্দ তখনি সম্ভব যদি কেউ জড় আনন্দ হতে মুক্ত হয়। জড় শৃঙ্খল মানে তিন ধরনের দুঃখ প্রাপ্তি। মানব জীবন এই সকল দুঃখ থেকে মুক্ত হবার জন্যই। আমাদের কখনাে ঋতুভিত্তিক ফুলের মত হওয়া উচিত নয় যে বর্ষায় সতেজ হয়ে ওঠে আর শীতে হয় শুষ্ক। অজ্ঞতার মেঘে আচ্ছাদিত হয়ে প্রফুল্ল হওয়া বা ক্ষণস্থায়ী সতেজতা উপভােগ করা কোনােটিই কাম্য নয়। আমাদের উচিত পরিচ্ছন্ন আকাশে চন্দ্র-সূর্যের কিরণের মতাে উদ্ভাসিত হওয়া। চিন্ময় মুক্তি, পূর্ণজ্ঞান এবং আনন্দময় আবহই হচ্ছে আলােকিত আত্মার অন্তরের আকাঙ্ক্ষা। আমাদের উচিত এই অন্তহীন আনন্দের আকাঙ্ক্ষায় অভিলাষিত হয়ে যে কোনাে প্রকার কৃচ্ছসাধন বা তপশ্চর্যায় আগ্রহী হওয়া।
ত্রৈমাসিক ব্যাক টু গডহেড, জুলাই -সেপ্টেম্বর ২০১৩