এই পোস্টটি 415 বার দেখা হয়েছে
নিত্যবদ্ধ এবং নিত্যমুক্ত- এই দু’রকম জীবাত্মার উল্লেখ করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শ্রীমদ্ভাগবতের শিক্ষাকে বিশদভাবে প্রদান করেছেন। নিত্যবদ্ধ জীবকুলকে দু’ভাগে বিভক্ত করা যায়, যেমন-অচল ও সচল। যে সকল জীব চলাফেরা করতে পারে না, যেমন: একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষ, এদেরকে ‘স্থাবর’ বলে জীবকুলের মধ্যে গণ্য করা হয়। আর যে সকল জীব চলাফেরা করতে পারে, যেমন: পশু পাখী, মানুষ প্রভৃতি, তাদের ‘জঙ্গম’ বলে গণ্য করা হয়। এই ‘জঙ্গম’ জীবকে আবার তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়; যারা আকাশে উড়ে তারা খেচর, যারা জলে অবস্থান করে তারা জলচর আর যারা স্থলে চলাফেরা করে তারা স্থলচর। কোটি কোটি স্থলচর জীব রয়েছে আর তাদের মধ্যে মানব জাতি কেবল নগণ্য এক অংশ মাত্র এবং এই নগন্য মানবজাতির অধিকাংশই সম্পূর্ণ আত্মজ্ঞানহীন, শুদ্ধাচারহীন, অশুচি ও নিরীশ্বরবাদী। সংক্ষেপে বলা যায় যে এই ধরণের মানবজাতির প্রায় সকলেই পশুর মতো জীবন যাপন করছে। প্রকৃত সভ্য বা যথার্থ মানব জীবন যাপনকারীদের থেকে এদের বাদ দেওয়া যায়। সদাচারী, ভগবৎ-বিশ্বাসী এবং শাস্ত্র-বিশ্বাসী কিছু মানুষ পাওয়া আজ সত্যিই দুর্লভ। এই ধরনের মূল্যবোধ যাদের আছে তাদের ‘আর্য‘ বলে। এই ‘আর্য’ শব্দ দ্বারা আধ্যাত্মিক প্রগতিতে বিশ্বাসী জগনগণকে উল্লেখ করা হয়। যারা মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে বিশ্বাসী ও শাস্ত্রীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী তারা আবার দুই শ্রেণীতে বিভক্ত- নৈতিক ও অনৈতিক বা নৈতিকতাহীন। যারা নৈতিক, তারা কর্মফল ভোগের জন্য সকাম কর্মের অনুষ্ঠান করে। ইন্দ্রিয় ভোগকারী বিষয়ী বহু কর্মের মধ্যে সামান্য কয়েকজন তত্ত্ববস্তু উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়।
তাদের জ্ঞানী বা মনোধর্মী দার্শনিক বলা হয়। এই ধরনের হাজার হাজার জ্ঞানীর মধ্যে কয়েকজন মাত্র ভগবৎ কৃপার প্রভাবে তাদের মনোধর্মী জ্ঞান থেকে মুক্ত হয়ে শাস্ত্র থেকে জ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করেন। যে জীবাত্মা জড় উপাদনে সংগঠিত বস্তু নয়, সে জড়াতীত চিন্ময় আত্মা। এই তত্ত্ব-দর্শন সম্বন্ধে পুঁথিগত শাস্ত্র-জ্ঞান উপলব্ধিকারী ব্যক্তিকে মুক্ত বলা হলেও বস্তুত মুক্তপুরুষ হচ্ছেন তিনি, যিনি নিজেকে ‘ভগবানের নিত্যদাস’ এই স্বরূপ জ্ঞান উপলব্ধি করেন। এইসকল মুক্তাত্মাগণ শ্রদ্ধা ও ভক্তিপূর্ণ ভগবৎ সেবায় সর্বদাই নিয়োজিত। তাঁদের কৃষ্ণভক্ত বা কৃষ্ণভাবনাময় ব্যক্তি বলা হয়। কৃষ্ণভক্তগণ সবরকম জড় বাসনামুক্ত। ‘জীবাত্মা জড়বস্তু নয়’, এই জ্ঞান প্রাপ্ত ব্যক্তিগণ পুঁথিগত দৃষ্টিতে মুক্ত গণ্য হলেও তাদের হৃদয়ে জড় বাসনা থাকে। তাদের মুখ্য বাসনা হল- পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে একীভূত হওয়া। জড়-জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগের জন্য তারা সাধারণত বৈদিক ক্রিয়া কাণ্ড ও পূণ্যকর্মে বিশেষ আসক্ত। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ কেউ জড়ভোগময় জীবন অতিক্রম করেও ভগবৎ-সত্তায় বিলুপ্ত হয়ে আধ্যাত্মিক রাজ্য ভোগের প্রয়াস করে। কেউ কেউ আবার যোগ অভ্যাসের মাধ্যমে যৌগিক সিদ্ধি কামনা করে। এইসব জড় কামনা বাসনা যতদিন হৃদয়ে থাকবে ততদিন শুদ্ধ ভগবত্তত্ত্ব উপলব্ধি করা যায় না। নিরন্তর এই সব জড় কামনায় চঞ্চল হৃদয় কখনও শান্তি লাভ করতে পারে না। বস্তুত জড় জাগতিক সিদ্ধিলাভের বিন্দুমাত্র বাসনা থাকলেও শান্তি লাভ সম্ভব নয়। কৃষ্ণভক্তরা সম্পূর্ণভাবে বিষয়-বাসনাহীন নিষ্কাম হওয়ায়, তারাই ইহলোকে একমাত্র শান্তচিত্ত। এই সত্য শ্রীমদ্ভাগবতে (৬/১৪/৫) প্রতিপন্ন হয়েছে-
মুক্তানামপি সিদ্ধানাং নারায়ণ পরায়ণঃ।
সুদূর্লভঃ প্রশান্তাত্মা কোটিস্বপিমহামুনে॥
অর্থাৎ, “হে মহামুনে! কোটি কোটি মুক্ত পুরুষ যোগ সাধনায় সকল পরমার্থীদের মধ্যে প্রশান্তাত্মা, বিশুদ্ধ ভগবদ্ভজনে ব্রতী ভক্ত বস্তুত দুর্লভ।”
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বর্ণনা করেছেন যে, ব্রহ্মাণ্ডে কোটি কোটি ভ্রাম্যমান জীবের মধ্যে যিনি গুরু ও কৃষ্ণের কৃপায় ভক্তিলতাবীজ প্রাপ্ত হন, এই ধরণের ভাগ্যবান ব্যক্তি বস্তুত বিরল। একজন পুণ্যাত্মা বা ধার্মিক ব্যক্তি সাধারণত বিভিন্ন মন্দিরে বিগ্রহ উপাসনায় অনুরাগী হয়। কিন্তু যদি অজ্ঞাতসারেও হঠাৎ ভগবান বিষ্ণু বা কৃষ্ণভক্ত বৈষ্ণবকে শ্রদ্ধাপূর্ণ ভক্তি-ভাবময় প্রণতি নিবেদন করে, তাহলে সে তাদের অনুকম্পা প্রাপ্ত হয়ে সেই সময় ভগবদুন্মখী হওয়ার প্রয়োজনীয় বস্তু অজ্ঞাত সুকৃতি অর্জন করে। একথা শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত দেবর্ষি নারদ-এর জীবন কাহিনী থেকে পরিপূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করা যায়। পূর্ব জীবনে বৈষ্ণব সেবার মাধ্যমে নারদ ভগবদ্ভক্তের অনুকম্পা লাভ করে দেবর্ষি নারদে পরিণত হন।
সাধারণত বৈষ্ণবগণ মায়াবদ্ধ জীবদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে থাকেন। বিনা আমন্ত্রণেই ভক্তগণ দ্বারে দ্বারে গিয়ে জনগণের মধ্যে এই দিব্য জ্ঞান প্রদান করেন যে, জীব ভগবানের নিত্য দাস। এই স্বরূপ জ্ঞান জনগণের মধ্যে সঞ্চার করে ভক্ত তাদের অবিদ্যাময় অন্ধকার থেকে উদ্ধার করেন। এই শ্রেণীর ভক্তগণ জনগণের মধ্যে ভগবৎচেতনা বা কৃষ্ণভাবনা বিতরণের জন্য ভগবানের দ্বারা শক্তি সঞ্চারিত হন। এদেরকে অধিকারী গুরুদেব বা আচার্য অনুমোদিত সদ্গুরু বলা হয়।
সদ্গুরুর কৃপাতেই একজন মায়াবদ্ধ জীব ভক্তিলতার বীজ প্রাপ্ত হয়। যিনি ভজন রাজ্যের সর্বোত্তম স্তরে একজন মায়াবদ্ধ জীবকে উন্নীত করতে পারেন, এইরকম সদ্গুরুর পূত সান্নিধ্য লাভ মাত্র ভগবানের অহৈতুকী কৃপা প্রথম অনুভব করা যায়। সেইহেতু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেন যে, শ্রীগুরুদেবের কৃপায় ভগবানের অহৈতুকী প্রসাদ পাওয়া যায় আর ভগবানের কৃপায় শ্রীগুরুদেবের অহৈতুকী প্রসাদ লাভ হয়। এইভাবে গুরু ও কৃষ্ণের কৃপায় ভক্তিলতার বীজ প্রাপ্ত হওয়া যায়। মালী যেমন দুর্লভ গাছের বীজ জমিতে রোপন করে, ঠিক সেই রকম ভক্তিলতার বীজ হৃদয়রূপ ক্ষেত্রে বপন করা কর্তব্য। ঐ বীজ বপনের পর তাতে শুদ্ধ ভক্ত সমাজে ভগবৎ-তত্ত্ব বিজ্ঞান আলোচনায় অংশগ্রহণ ও পূত হরিনামামৃত শ্রবণ কীর্তনরূপ বারী সিঞ্চন করা প্রয়োজন। ভক্তিলতা বীজের অঙ্কুরোদ্গম হলেই তা অবাধে অপ্রতিহতভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। পূর্ণতাপ্রাপ্ত লতা ব্রহ্মাণ্ড ভেদ করে দিব্য ভাবময় ব্রহ্মজ্যোতিতে প্রবেশ করে। এই ভক্তিলতা ব্রহ্মজ্যোতি ভেদ করে ক্রমশ গোলোক বৃন্দাবন ধামে প্রবেশ করে। সেখানে লতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে আশ্রয় গ্রহণ করে।
এটাই হল ভক্তিসেবার চরম উদ্দেশ্য। এই অবস্থায় অধিষ্ঠিত লতা ভগবৎ প্রেমরূপ ফল উৎপন্ন করে। তবে ভগবদ্ভক্তরূপ দিব্য মালীর উচিত ভক্তিলতায় প্রতিদিন শ্রবণ- কীর্তনরূপ জল সিঞ্চন করা। নিয়ত ভক্তিলতায় শ্রবণ-কীর্তনরূপ জল সিঞ্চন করা না হলে লতা শুষ্ক হওয়ার খুবই সম্ভাবনা থাকে। হরেকৃষ্ণ!
মাসিক চৈতন্য সন্দেশ, জানুয়ারি ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত