এই পোস্টটি 302 বার দেখা হয়েছে
গুয়ানার ইস্কন মন্দির যেন প্রস্ফুটিত পদ্ম
পঞ্চতত্ত্ব দাস
গুয়ানা দেশটি দক্ষিণ আমেরিকার ক্যারিবিয়ান উপকূলে অবস্থিত। এর পশ্চিমে ভেনিজুয়েলা, পূর্বে সুরিয়াম এবং দক্ষিণে বিপুলায়তন ব্রাজিল। গুয়ানার আয়তন প্রায় ব্রিটেন বা ইংল্যান্ডের সমান। জনসংখ্যা প্রায় সাত লক্ষের কাছাকাছি। জনসংখ্যার প্রায় নব্বই ভাগ মানুষই দেশের অভ্যন্তরভাগের চেয়ে উপকুলভাগে বাস করেন। কেননা অভ্যন্তরভাগের স্থান ঘন জঙ্গলে পূর্ণ। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির মধ্যে এই গুয়ানাই হচ্ছে একমাত্র ইংরেজভাষী। গুয়ানা প্রধানত একটি অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত অঞ্চল। ১৯৬৬ সালে এই দেশটি ব্রিটিশদের অধীনতা মুক্ত হয়ে স্বাধীন হয়। সেই সময় থেকেই গুয়ানার সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা চলছে। তবে বিশেষ করে ১৯৮০ সনে হাজার হাজার গুয়ানাবাসী উন্নত জীবন যাপনের লক্ষ্যে পৃথিবীর এদিক ওদিক বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় তিন লক্ষাধিক গুয়ানীজ এখন আমেরিকায় বসবাস করছে। প্রশ্ন জাগতে পারে, যে স্থান ত্যাগ করে মানুষ চলে যাচ্ছে সে স্থানে যাওয়ার হেতু কী? জাগতিক হিসাব নিকাশ অনুযায়ী হয়তো গুয়ানা একটি অনাকাঙ্ক্ষিত জায়গা। কিন্তু বৈষ্ণব কোথাও যাওয়ার জন্য যে বিষয়গুলি বিবেচনা করে তা হল–আমি কি সেখানে গিয়ে পরমেশ্বর ভগবানের সন্তুষ্টি বিধান করতে পারব? আমি কি সেখানে গিয়ে পরমেশ্বর ভগবান ও তাঁর ভক্তদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারব? আমি কি সেখানে গিয়ে ভক্তিপূর্ণ সেবায় স্থিত সাধু ব্যক্তিগণের সঙ্গ লাভ করতে পারব? সেখানে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচাররত ভক্তদের আমি কি কোনো সহায়তা করতে পারব? উক্ত বিবেচিত কারণগুলি ছাড়াও আরও যে দুটো কারণ আমার মধ্যে সেখানে যাওয়ার জন্য কাজ করছিল সেটি হলো গুয়ানার কৃষ্ণভক্তগণ অসাধারণ অতিথিবৎসল, তাই তাঁদের সান্নিধ্যের এক আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। আরেকটি হলো, আমার সহধর্মিনী যৌবনানন্দ দাসীর জন্ম হয়েছিল গুয়ানায়। তাই সেও তার জন্মভূমিকে দর্শন করার জন্য উৎসুক হয়েছিল।
গুয়ানায় আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন) প্রথম স্থাপিত হয়েছিল প্রায় ঊনিশ-কুড়ি বৎসর আগে। কিন্তু প্রথমে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার আয়োজন হয়েছিল ২০০৫ সনের জুলাইয়ে। প্রধানত গুয়ানার ইস্কন কেন্দ্রের উদ্যোগে ও আমেরিকার আলাচুয়ায় ইস্কন কম্যুইনে বসবাসকারী গুয়ানীজ ভক্তদের সহায়তায় এই রথযাত্রা উৎসব সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমরা অর্থাৎ আমি ও আমার পত্নী তাই ঠিক করলাম যে ঐ রথযাত্রার সময়েই গুয়ানাতে যাবো, তাহলে যেমন শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রার সেবায় অংশগ্রহণ করে ভক্তদের সহযোগিতা করতে পারব, তেমনি সেইসঙ্গে গুয়ানা দেশটিও দর্শন করা হবে।
গুয়ানার বিভিন্ন স্থানে এখন ইস্কনের বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে। সেই সত্তর দশকের প্রথম দিকের সময় থেকেই গুয়ানাতে প্রথম কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারে গিয়েছিলেন শ্রীল প্রভুপাদের প্রথম দিকের দুই শিষ্য শ্রীল হৃদয়ানন্দ দাস গোস্বামী মহারাজ ও শ্রীপাদ মহাবীর দাস প্রভু। পরবর্তীকালে শ্রীল প্রভুপাদের প্রথম গুয়ানীজ শিষ্য শ্রীপাদ ভূতাদি দাস, যিনি একজন দক্ষ সংগঠক ও গ্রন্থ বিতরক রূপে সেসময় খ্যাত ছিলেন, তিনি গুয়ানাতে শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ বিতরণ ও বিভিন্ন কৃষ্ণভাবনাময় অনুষ্ঠানে আয়োজন করতে থাকেন। ১৯৮১ সালে ইস্কনের অন্যতম আচার্য শ্রীল সৎস্বরূপ দাস গোস্বামী মহারাজ গুয়ানায় গিয়ে সর্বপ্রথম সেখানকার কৃষ্ণভাবনাময় আগ্রহী ভক্তদের আনুষ্ঠানিক ভাবে দীক্ষা প্রদান করেন। এছাড়া দক্ষ কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারক শ্রীপাদ অগ্রণী দাস প্রভু ১৯৮০ সনে আমেরিকা থেকে গুয়ানায় কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারে এক নতুন মাত্রা যোগ করেন। তিনি গুয়ানায় এসে সে দেশের প্রতিটি নগর ও শহরে প্যান্ডেল প্রোগ্রাম শুরু করেন। সেখানে থাকত কৃষ্ণকথা, নাটক, বিভিন্ন বৈষ্ণবীয় বিষয় ভিত্তিক স্লাইড প্রদর্শনী এবং সুস্বাদু কৃষ্ণপ্রসাদের সুবন্দোবস্ত ।
পরবর্তীকালে কৃষ্ণভক্তে পরিণত ও হরেকৃষ্ণ আন্দোলনে যোগদানকারী জনৈক গুয়ানীজ মহিলা চন্দ্রাবলী দেবী দাসীর প্রচণ্ড উদ্যম ও তাঁর পারমার্থিক গুণাবলীর জোরে কৃষ্ণভাবনামৃত আরও বিস্তৃতভাবে গুয়ানেতে ছড়িয়ে পড়ে।
তো যে কথা আমি আগে বলছিলাম সে কথায় ফিরে আসা যাক। আমরা অর্থাৎ আমি ও আমার সহধর্মিনী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম যে গুয়ানার প্রথম রথযাত্রার সময়েই আমরা সেখানে যাব। এটা ২০০৫ সনের কথা বলছি। রথযাত্রার বেশ কিছুদিন আগেই আমরা গুয়ানার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমরা ফ্লোরিডার অরল্যান্ডো থেকে বিমানযোগে মিয়ামি ক্যারিবিয়ান সাগর পার হয়ে, গুয়ানার জর্জটাউন বিমান বন্দরে পৌঁছলাম। সম্প্রতি জর্জটাউন বিমান বন্দরটিকে বড় বিমান নামার উপযোগী করে গড়া হয়েছে। আমাদের প্লেন দুঘণ্টা দেরীতে পৌছেছিল। কিন্তু গুয়ানার শ্রীশ্রী গৌরনিতাই আশীর্বাদ মন্দিরের অধ্যক্ষ শ্রীপাদ ত্রিদণ্ডী গোস্বামী দাস প্রভু আমাদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্য ধৈর্য ধরে জর্জটাউন বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি আমাদের থাকা খাওয়া ও ভ্রমণের সমস্ত ব্যবস্থা অতি সুন্দরভাবে করে রেখেছিলেন, এমনকি আমরা এ বিষয়ে কিছু বলার পূর্বেই।
গুয়ানাতে গিয়ে প্রথম কয়েকদিন আমার মনে হয়েছিল আমি যেন ভারতে এসেছি। ভারতের সঙ্গে এখানকার সমাজ জীবনের বহু মিল রয়েছে। রাস্তায় গরু চরে বেড়াচ্ছে চারদিকে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, নারিকেল গাছের বনাঞ্চল এবং ভারতীয় তথা এশিয়া বংশোদ্ভুত মানুষেরা সর্বত্র রয়েছেন। আসলে ব্রিটিশ শাসনাধীনকালে ব্রিটিশরা ভারত ও এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে বহু মানুষকে এখানকার বিস্তৃত ইক্ষু ক্ষেতে কাজ করাবার জন্য দাস রূপে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে দাস প্রথার অবলুপ্তি ঘটলে, এই সকল ভারতীয় দাসেরা পরবর্তীকালে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়ে সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন।
আমরা শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রার প্রায় দু’সপ্তাহ পূর্বেই গুয়ানাতে গিয়ে পৌঁছেছিলাম। তাই রথযাত্রা উৎসব শুরু হওয়ার পূর্বের এই সময়ের ফাঁকে আমরা গুয়ানায় ইস্কনের প্রধান তিনটি মন্দির দর্শন করলাম। সেগুলি হল, ওল্ড ক্রেন রোডে অবস্থিত শ্রীশ্রীগৌর-নিতাই আশীর্বাদ মন্দির, এসকীবো মন্দির এবং উইলিয়ামসবার্গের শ্রীশ্রীরাধাগোকুলচন্দ্র মন্দির। সর্বত্রই মন্দিরের ভক্তগণের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত আন্তরিক। ওল্ড ক্রেন রোডের মন্দিরের অতিথিশালায় সর্বশ্রেষ্ঠ ঘরটি আমাদের থাকার জন্য দেওয়া হয়েছিল। সাধারণত এই ঘরটি কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি বা ইস্কনের নেতৃবৃন্দের জন্য সংরক্ষিত থাকে। এসকীবো মন্দিরে আমাদের এক ভক্ত পরিবারের সঙ্গে থাকতে দেওয়া হয়েছিল এবং তারা আমাদের জন্য দোতলার সবচেয়ে আরামদায়ক ঘরগুলি ছেড়ে দিয়ে একতলায় নেমে এসেছিল। উইলিয়ামসবার্গের মন্দিরে গেলে তারা আমাদের থাকার জন্য জনৈক ডাক্তারের বাড়িতে ব্যবস্থা করেছিলেন। ডাক্তার অবশ্য ঐ বাড়িতে থাকেন না। তিনি ইস্কনের শুভানুধ্যায়ী। তাই কোনো বিশিষ্ট ভক্ত বা দর্শনার্থী এলে যাতে থাকার কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্য তাঁর বাড়িটি ব্যবহারের জন্য বাড়ির চাবি ইস্কন মন্দিরে দিয়ে রেখেছেন।
আমরা অনুভব করছিলাম সমস্ত রকমের ধারণাগত সুযোগসুবিধা যেন আমাদের ওপর বর্ষিত হচ্ছিল।
উইলিয়ামসবার্গে আমরা শ্রীল প্রভুপাদের এক জ্যেষ্ঠ শিষ্য শ্রীপাদ আদিকর্তা দাস প্রভুর সঙ্গে পরিচিত হলাম। তিনি মূলত একজন ব্রিটিশ নাগরিক কিন্তু বর্তমানে আমেরিকার ফ্লোরিডায় ইস্কনের কম্যুনে বসবাস করছেন। ওখানে রাজর্ষি দাস নামে ত্রিনিদাদের এক যুবক ভক্তের সঙ্গেও পরিচিত হলাম। রাজর্ষি সারা ক্যারিবিয়ান অঞ্চল জুড়ে কৃষ্ণভাবনামৃতের শিক্ষা প্রদান করছেন। তিনি বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে অনুষ্ঠান করেও গুয়ানীজদের মধ্যে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার করছেন। আমাদের সঙ্গে আলাপ হবার পর আমাদেরকে ভগবান জগন্নাথ সম্বন্ধে বলার জন্য সে ছয়টি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিল ।
গুয়ানার বিস্তৃত দর্শকদের মধ্যে পৌছানোর জন্য এই টেলিভিশন হচ্ছে একটি উপযুক্ত ও সহজ পন্থা। মাত্র পনের বৎসর আগেও এখানে কোনো টেলিভিশন ছিল না। এখন এ্যান্টেনা বা স্যাটেলাইট ডিশ অ্যান্টেনা গুয়ানার সর্বত্র বিদ্যমান এবং একটি সাধারণ ব্যাপার। গভর্নমেন্টের লাইসেন্সপ্রাপ্ত বিভিন্ন প্রাইভেট টেলিভিশনের সংখ্যাও সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। গুয়ানার টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান করার বা বিজ্ঞাপনের হারও অত্যন্ত সস্তা। সারা দেশে প্রচারিত একটি ৩০ সেকেন্ড সময় বিজ্ঞাপনের মূল্য মাত্র দেড় ডলার। আর টেলিভিশন চ্যানেলের কর্তৃপক্ষগণও বিভিন্ন নতুন নতুন প্রচারের অনুসন্ধানে থাকেন। রাজর্ষি এইরকম ৩০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার প্রচারের ব্যবস্থা বহু চ্যানেলে করেছিল ।
আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদিনের আরাধ্য শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ নিয়ে ভ্রমণ করছিলাম। সুরতনাথ নামে এক ভক্ত যখন সেকথা জানতে পারল সে কতকগুলি না ফোটা পদ্মফুল আমার শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহকে নিবেদনের জন্য এনে দিল। যেহেতু পদ্মফুলগুলি না ফোটা ছিল, তাই আমি একটু অস্বস্তিতে ছিলাম। সুরতনাথ প্রভু আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে হাসতে হাসতে আমাকে শিখিয়ে দিলেন কিভাবে কৃষ্ণকে নিবেদনের আগে না ফোটা পদ্মকে হাত দিয়ে প্রস্ফুটিত করতে হয়। তিনি আমাকে জানালেন, গুয়ানাতে নানা ধরনের পদ্মফুল হওয়া যায়। সাদা পদ্ম, গোলাপী পদ্ম এবং খুব হাল্কা গোলাপী রঙের দরুণ সুন্দর বেশী দামের পদ্মও পাওয়া যায়।
আমি গুয়ানার বিভিন্ন ইস্কন মন্দিরসমূহ ভ্রমণ করতে করতে যত ভক্তদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছিলাম কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারে তাদের ঐকান্তিকতা এবং তাদের প্রচারে মানুষ কিভাবে সাড়া দিচ্ছে তা লক্ষ্য করে আমার মনে এক ক্রম-প্রস্ফুটিত পদ্মের উদাহরণ উঁকি দিল। বাস্তবিক ভাবেই গুয়ানার ইস্কন মন্দিরগুলি হচ্ছে কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে নিবেদিত পদ্মের মতো। যা ক্রমে ক্রমে প্রস্ফুটিত বা বিকশিত পদ্মের মতো বিস্তার লাভ করছে। গুয়ানার ভক্তদের আচার-আচরণ বাস্তবিকই সৌরভময় প্রকৃত পদ্মের মতোই আকর্ষণীয়। মন্দির ও অন্যান্য প্রকল্পসমূহ যেন পদ্মের এক একটি পাপড়ি যা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণ সৌন্দর্য ও সকল আকর্ষণময়তাকে প্রস্ফুটিত পদ্মের মতোই ধীরে ধীরে গুয়ানাবাসীদের কাছে তুলে ধরেছে।
গুয়ানার ভক্তদের সঙ্গে প্রথম আমি এক নগর সংকীর্তনে অংশগ্রহণ করে গুয়ানাবাসীদের ভগবানের কীর্তনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে অর্থ নিবেদন করার, প্রসাদ গ্রহণ করার ও পারমার্থিক গ্রন্থ সংগ্রহ করার আগ্রহ দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।
গুয়ানার বাড়িঘরের নির্মাণ শৈলীর ধাঁচটি বেশ অন্যরকম। ওখানকার অধিকাংশ বাড়িই দোতলা এবং কাঠের তৈরি। একতলায় সাধারণত রান্নাঘর, স্টোররুম ইত্যাদি সাংসারিক কাজের ঘর এবং দোতলায় থাকে প্রধানত শোয়ার ঘর বা অন্দরমহল। প্রায় সব বাড়ির সামনেই একটু জায়গা রয়েছে এবং তা কাঠ বা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা এবং সামনে গেট রয়েছে। কীর্তনের দলসহ গ্রন্থ-বিতরণকারীরা এই গেট থেকেই তাদের উপস্থিতি ঘোষণা করে বাড়ির বাসিন্দাদের আহ্বান জানান এবং তাদের সঙ্গে কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রন্থ বিষয়ে কথা বলেন। কখনও কখনও দেখেছি কোনো কোনো বাড়িতে গৃহের সদস্য বা বাড়ির কর্তা পূর্ব থেকেই গ্রন্থ কিনবেন বলে বা কৃষ্ণসেবায় দান করবেন বলে বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আছেন।
রথযাত্রার বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে ভক্তরা ভালো একটি পরিকল্পনা নিয়েছিল। যে পথ দিয়ে রথ যাবে সেই সেই পথের দু’ধারের বাসিন্দাদের কাছে গিয়ে তাদের বাড়ির চত্বরে অল্প সময় কীর্তন ও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর এই হরেকৃষ্ণ আন্দোলন বিষয়ে কিছু কথা বলার সুযোগ প্রদানের আবেদন রাখছিল ভক্তরা। অধিকাংশ পরিবারই এই সুযোগ প্রদানে রাজি হয়েছিল ।
যদিও এখানকার ভারতীয় বংশোদ্ভুত জনসাধারণ শত বৎসরের অধিক সময় ধরে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন কিন্তু তাদের আচার-আচরণে এখনও বৈদিক সংস্কৃতি প্রবাহমান। সংকীর্তন দলের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আমি লক্ষ্য করেছি অধিকাংশ বাড়িতেই তুলসীগাছের বাগান রয়েছে। কোনো কোনো বাড়িতে আরাধ্য তুলসীদেবী মঞ্চও রয়েছে। পথে যেতে যেতে আমি একটি দোকানের সাইন বোর্ডে অর্জুন নামটি দেখেছি। গুয়ানার রাষ্ট্রপতির নামও ভরত জগদেও । রাষ্ট্রপতির নামটি ঋষভদেবের পুত্র ভরত মহারাজের নামটি মনে করিয়ে দেয়। বৈদিক সাহিত্যের বর্ণানুযায়ী যাঁর নামে এই গ্রহের নাম একদিন ভারতবর্ষ ছিল ।
এই বর্তমান যুগ যা কলহ ও ভণ্ডামীর যুগ বা কলিযুগ নামে অভিহিত, এর প্রভাব গুয়ানাতেও রয়েছে। গুয়ানার অর্থনীতির বেশ খানিকটাই নির্ভর করে এখানে প্রস্তুত ‘রাম’ নামক বিশেষ প্রকারের মদের রপ্তানির ওপর। জনসাধারণের একটি অংশও সুরাসক্ত হওয়ার পরিণামে দুর্দশা ভোগ করছে। কলির প্রভাবে এখানে বর্ণ ও জাতিগত বিদ্বেষও রয়েছে। এশীয় ভারতীয় ও কালো মানুষদের মধ্যে সংঘর্ষের সম্পর্কও রয়েছে। গুয়ানার নির্বাচনের সময় কে জাতীয় সরকার গঠন করবে এই নিয়ে দুই দলের মধ্যে সংঘর্ষ ভয়ংকর আকার ধারণ করে।
সম্প্রতি গুয়ানার রাজধানী জর্জটাউনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইস্কন একটি কৃষ্ণভাবনাময় যুবকেন্দ্র স্থাপন করেছে। আমি কল্পনা করতে পারি এখানে কালো ও এশীয় ভারতীয় শিক্ষার্থীরা দেহগত বৈষম্য ভুলে একসঙ্গে আনন্দে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করবে। কেননা ভগবানের ভক্তগণ জানেন যে, দীর্ঘস্থায়ী ও প্রকৃত বন্ধুত্বের রহস্যটি হচ্ছে, ভগবান কৃষ্ণের বন্ধু হয়ে ওঠা এবং প্রেম ও ভক্তির সঙ্গে তাঁর পবিত্র নাম কীর্তন করা। ঠিক যেমন “প্রকৃত শান্তির সূত্র নিবন্ধে শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন–“আমরা একজন বন্ধুর অনুসন্ধান করছি, যিনি আমাদের শান্তি ও সুস্থিরতা প্রদান করবেন, আর সেই বন্ধুটি হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ। আমরা যদি তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করি তবে আমরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারব যে, সকলেই হচ্ছে আমাদের বন্ধু। ভগবান সকলের হৃদয়ে অবস্থান করেন আর আমরা যদি তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করি তাহলে আমাদের অন্তর থেকে তিনি আমাদের পরিচালনা করবেন যাতে আমরা পরস্পর বন্ধুভাবাপন্ন রূপে আচরণ করি। আমরা যদি পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করি তাহলে অমারা কিছু সুবিধা প্রাপ্ত হব অথবা আমরা যদি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করি, সকলেই আমাদের বন্ধু হবে। যদি সকলেই হৃদয়ঙ্গম করতে পারে যে ভগবান হচ্ছেন সকলের বন্ধু এবং তিনি হচ্ছেন পরম মালিক, তবে পৃথিবী শান্তিময় হয়ে উঠবে। এটিই হচ্ছে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সিদ্ধান্ত।”
রথযাত্রার দিনটি যতই এগিয়ে আসছিল ভক্তদের উৎসাহ উদ্দীপনা ও ব্যস্ততা ততই বেড়ে উঠছিল। প্রতিবেশী দেশগুলি যেমন সুরিনাম, ত্রিনিদাদ থেকেও রথযাত্রা উপলক্ষে ভক্তরা উইলিয়ামবার্গে এসে পৌছেছিল। ফলে উইলিয়ামসবার্গে মন্দিরটি ভক্তদের কর্ম চঞ্চলতায় পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। রথটিকে সাজানোর জন্য অসংখ্য ফুল ও মালা আনা হয়েছিল। উৎসব প্রাঙ্গনে অসংখ্য দর্শনার্থীর সংখ্যা অনুমান করে প্রচুর প্রসাদ রান্না করা হচ্ছিল ।
রথযাত্রার দিন মন্দিরে সকালের প্রবচনের সময় ভক্তরা সবাই জগন্নাথদেবের রথযাত্রার গুরুত্ব বিষয়ে আলোচনা করেন। এই বিশেষ দিনটিতে ভগবান স্বয়ং মন্দির ছেড়ে বেরিয়ে আসেন তাঁর যাত্রাপথের দু’ধারে সমবেত দর্শনার্থী জনসাধারণকে কৃপাশীর্বাদ প্রদান করার জন্য। যেহেতু ভক্তরা একথা জানেন, তাই তারাও যত বেশী সংখ্যক দর্শনার্থী ভগবানের সংস্পর্শ লাভ করে কৃপা প্রাপ্ত হতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হন। ভগবানের রথারোহণ কালে মনে প্রাণে ভক্তিতে সিঞ্চিত হয়ে ভক্তগণ হরেকৃষ্ণ কীর্তন করতে থাকেন। পাঁচ মাইল ব্যাপী দীর্ঘ এই রথযাত্রা বেলা তিনটায় শুরু হয়ে সমুদ্রোপকূল বরাবর প্রধান সড়কপথ দিয়ে পরিভ্রমণ করে পুণরায় ইস্কনের উইলিয়ামসবার্গ মন্দিরে ফিরে আসে। অন্যান্য ইস্কনের রথের মতোই এখানেও ফোল্ডিং রথ তৈরি করা হয়। রথের সামনে একদল ভক্ত মহামন্ত্র কীর্তন করেছিলেন এবং আরেকদল ভক্ত রথের পিছনে নৃত্য-কীর্তন করছিল। রথ এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে জগন্নাথকে নিবেদিত প্রসাদ পথের দু’ধারের দর্শনার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছিল। ঐ সময় রাস্তার গাড়ি ইত্যাদি পরিবহন পথে থেমে গিয়েছিল এবং বিভিন্ন বাড়ি ও দোকান থেকে মানুষেরা রথের শোভাযাত্রা দেখার জন্য বেরিয়ে এসেছিল। মন্দিরে রথ ফিরে এলে সান্ধ্যকালীন বিশেষ অনুষ্ঠানসমূহ শুরু হয়। ঐ উৎসবানুষ্ঠানে শ্রীপাদ নারদঋষি প্রভু এবং শ্রীপাদ রাজর্ষি দাস প্রভু শ্রীজগন্নাথদেবের লীলাবিষয়ক প্রবচন প্রদান করেন। সকলকে ভগবান কৃষ্ণকে নিবেদিত শুদ্ধ ও সুস্বাদু খাবার পেটভরে খাওয়ানো হয়। ভক্ত জনসাধারণ সকলেই কৃষ্ণের পবিত্র নাম কীর্তনে অংশগ্রহণ করে। বৈষ্ণব যুব দল দ্বারা পরিচালিত ‘কিভাবে ভগবান জগন্নাথ বহু যুগ আগে এই ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন’ এই বিষয়ক চিত্র প্রদর্শনী জনসাধারণকে আকর্ষণ করে। দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির মাধ্যমে গুয়ানাতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা অবশেষে বাস্তব রুপে পেল এবং এর ফলে হাজার হাজার গুয়ানাবাসী পারমার্থিক কল্যাণ লাভ করলেন।
রথযাত্রার পরদিন আমি শ্রীপরমাত্মা দাস প্রভু, শ্রীহরিদাস প্রভু প্রমুখ পুরানো ভক্তদের সঙ্গে বিকেল বেলাটা কাটালাম। তাঁরা আমাকে গুয়ানায় কৃষ্ণভাবনামৃতের ইতিহাস সম্বন্ধে বলছিলেন। তারা স্মরণ করছিলেন প্রথমে এক নদীর ধারে কুঁড়ে ঘরের মন্দির তৈরি করে গুয়ানায় কৃষ্ণভাবনামৃতের যাত্রা শুরু হয়েছিল। উক্ত ভক্তগণ স্মৃতিচারণ করছিলেন, গুয়ানায় কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের উদ্দেশ্যে তারা সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পারমার্থিক দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করেছিলেন। বিশেষ করে তারা সবাই শ্রীপাদ অগ্রণী দাস প্রভুর অবদানের কথা বললেন। তিনি ব্যাপকভাবে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের জন্য বহু অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন।
অবশেষে গুয়ানীজ ভক্ত বন্ধুদের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধভাবে পরস্পরকে অভিনন্দন জানিয়ে আবার গুয়ানাতে ফিরে আসার কথা দিয়ে আমরা আমেরিকা ফিরে যাবার প্লেন ধরার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। গুয়ানার হরেকৃষ্ণ ভক্তদের উষ্ণ আন্তরিকতা ও আতিথেয়তা আমার মনে চির জাগরক থাকবে। আশা করি কৃষ্ণের কৃপায় আবার আমি গুয়ানার ভক্তদের কাছে যেতে পারব। গুয়ানার হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের অতিথি বৎসল অপূর্ব ভক্তবৃন্দের জয় হোক।
এপ্রিল-জুন ২০১৫ ব্যাক টু গডহেড