এই পোস্টটি 265 বার দেখা হয়েছে
আমরা মনের একটি বলয় বা জোনো প্রবেশ করে বাহ্যিক সব কিছু থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারি। সেটি জাগতিক বা পারমার্থিক হতে পারে। তবে পারমার্থিক বলয়ে প্রবেশের মাধ্যমে আমরা সমাধি স্তরে পৌঁছতে পারি।
চণ্ডিদাস
আপনারা হয়তো শুনে থাকবেন? এটি মনের একটি অবস্থা মাঝে মাঝে আমরা যাকে বলি “flow of state” বা কোনো একটি স্তরের ধারা/প্রবাহ। মানুষ মনের এ স্তরের অভিজ্ঞতা লাভ করে যখন তারা যেমন খেলাধুলা, মিউজিক, আর্ট, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, গেইমিং এবং আরো বিভিন্ন কর্মে গভীরভাবে মনোনিবিষ্ট হয়। এটি অনেকটা কোনো এক উম্মত্ত বিজ্ঞানীর মানসিক স্তরের মত যে কিনা কোনো আবিষ্কারের নেশায় এমন গভীরভাবে মনোনিবিষ্ট যে, অনেক দিন ধরে খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো পর্যন্ত পরিত্যাগ করেছেন। এটি একটি শিশুর মানসিক স্তরের মত, যে কোনো কম্পিউটার গেইম খেলার প্রতি এতটায় মনোনিবেশ করেছে যে, শুধু মাউস এবং কিবোর্ড নিয়ে যুদ্ধ করছে।
যদি আপনি এই জোনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকেন তবে জানবেন মন এক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণভাবে ঐ কাজে নিবিষ্ট রয়েছে। আপনার মনোযোগ সম্পূর্ণরূপে অন্য কোনো কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন। আপনি সময় বা বাহ্যিক বাস্তবতার বাইরে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঐ মুহূর্তে সম্পূর্ণ নিয়োজিত । তখন জোনটি আভ্যন্তরীণ নির্মলতা প্রদান করে এবং আপনি ভালো অনুভব করেন। এই ধরনের একটি দৃষ্টান্তমূলক উদ্ধৃতি এখানে প্রদত্ত হল : “আমি গাড়ি নিয়ে একটি সুরঙ্গ পথ ধরে চলছিলাম, আমার তখন অনুভূত হচ্ছিল এমন এক উচ্চস্তরের মনোসন্নিবেশ যার মাধ্যমে আমার কারটি ও আমি একাত্ম হয়ে গেলাম৷” –আর্টন সেন্না (ফর্মূলা ওয়ান রেস্ কার ড্রাইভার, ১৯৬০-১৯৯৪)
ক্লেয়ারসন্ট ইউনিভার্সিটির বিশিষ্ট গবেষেক ড: মিহালি এক গবেষণায় প্রতিপন্ন করেন যে, মানুষের মন যে কোনো সময় একবারে অনেক তথ্য প্রদান করতে পারে। যদি আমরা নিবিড়ভাবে একটি মাত্র কাজে ব্যস্ত থাকি তবে অন্য কিছুতে মনোযোগ দেওয়া গুরুত্ব থাকে না। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি বিখ্যাত ভিডিও গেইম স্টারক্রাফট খেলতে বিশেষভাবে মনোনিবিষ্ট হন তখন আপনার মনের গুরুত্বহীন অন্যান্য সমস্যা যেমন ক্ষুধা, তৃষ্ণা ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করার সামর্থ থাকে না। তখন আপনার সমস্যাগুলো চলে যায় এবং আপনি তখন ভাল অনুভব করেন। ড. মিহালি বলেন, এরকম চ্যালেঞ্জিং কাজে নিযুক্ত হওয়ার জন্য তখন আপনি সবচেয়ে ভাল “flow of state” প্রাপ্ত হন।
কম চ্যালেঞ্জ, কম দক্ষতা : ধরুন, কেউ আপনাকে একইসাথে পাঁচশবার কোনো লাইটের সুইচ অফ করতে বলল। মনে হচ্ছে খুব সহজ কজে তাই না? আমি বাজি ধরতে পারি, একই সময়ে এরকম কোনো কাজ আপনি পূর্বে করেননি কিংবা কৌতূহলও সৃষ্টি হয়নি। আপনি কাজটি করতে দ্রুতই বিরক্ত হয়ে উঠবেন।
কম চ্যালেঞ্জ, উচ্চ দক্ষতা : পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত হাততালি দেওয়া ব্যক্তিটিকে কল্পনা করুন। লোকটি অন্যদের চেয়েও দ্রুত হাততালি দিতে পারে। তিনি এ বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষ। আমি বাজি ধরতে পারি যে, তিনি এটি করার জন্য বহু বছর পর অনুশীলন করেছেন। যদিও সাধারণভাবে হাততালি দেওয়াটা মোটেই কঠিন নয়। হাততালি দেওয়া ব্যক্তিটি বিষয়টি সহজ, সাবলীল এবং মজা হিসেবে দেখে। কিন্তু এটি করতে যে মানসিক বলয়ে সে পৌছেছে সেটি সহজ কোনো ব্যাপার নয়।
উচ্চ চ্যালেঞ্জ, নিম্ন দক্ষতা : ধরুন কোনো ছোট একটি বিমানের একমাত্র যাত্রী হলেন আপনি। চলতে চলতে বিমানের পাইলট হার্ট অ্যাটার্ক করেছে। ঐ অবস্থায় আপনার কোনো ধারণাই নেই বিমানটি কীভাবে চালাতে হয়, যা আপনার জন্য অনেক কঠিন। আপনি তখন পুরোপুরিই উদ্বিগ্ন এবং এ উদ্বিগ্নতার কারণে কোনো মানসিক জোন বা বলয় তৈরি হওয়ার সুযোগ হয় নি।
উচ্চ চ্যালেঞ্জ, উচ্চ দক্ষতা : ধরুন, আপনি একজন পর্বত আরোহী। কোনো খাড়া পর্বত আরোহনের সময় পড়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ না দিয়েই আপনি পর্বত আরোহন করতে পারেন। একটি খাড়া পর্বত আরোহনের জন্য প্রয়োজন বিশাল পরিমাণের দক্ষতা ও প্রচেষ্টা, এমনকি সেটি একজন দক্ষ ব্যক্তির জন্যও। যদি দক্ষ হোন, তবে সেটির “flow of state” এ প্রবেশের জন্য এক আদর্শ ক্ষেত্র।
আমি যখন দৌড়াই তখন মানসিক জোনে প্রবেশ করি। কয়েক মাস পূর্বেও ওয়েলিংটনে একটি ম্যারাথনে দৌড়িয়েছিলাম। এটি আমার জন্য মজার এক অভিজ্ঞতা ছিল। জোনে প্রবেশ করে প্রায় পুরো ম্যারাথন জুড়ে মৃদু হাসছিলাম। যাহোক, অন্য দৌড়বিদদের দৌড় দেখে মনে হয়েছিল দৈনন্দিন অন্যান্য কাজের মতোই। যেমন : ওজন কমানো যেটি মজা পাওয়ার অভিজ্ঞতার চেয়ে নিজের শরীরের ওপর নিপীড়ন বলে মনে হচ্ছিল। যার কারণে তারা সুনির্দিষ্টভাবে জোন বা বলয়ে প্রবেশ করতে পারছিল না। এজন্যে দৌড়ের সময় তাদের চোখে মুখে কষ্টের অভিপ্রকাশ ভেসে উঠেছিল।
আমি গত তের বছর ধরে কৃষ্ণভাবনার প্রাচীন বৈজ্ঞানিক পন্থা অনুশীলন করছি। এই অনুশীলনের অন্যতম একটি অঙ্গ হল জপমালায় পবিত্র হরিনাম জপ ধ্যান। মনকে মন্ত্রের ওপর নিবিষ্ট করতে প্রয়োজন প্রচুর দক্ষতা। কেননা মনকে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন। আমি হরিনাম জপের সময় মাঝে মাঝে বলয়ে প্রবেশ করতে পারি, ফলে আমার উদ্বিগ্নতা, ভাবনা কিংবা জড় বাসনা সব দূরীভূত হয়ে যায়৷ কৃষ্ণভাবনার শিল্প ও বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করে যে, আমরা এই দেহ নই বরং চেতন আত্মা। যে জোন বিষয়ে এতক্ষণ বলা হচ্ছিল, সেটি আমাদের প্রকৃত বিশুদ্ধ চেতনার অবস্থার প্রায় অনুরূপ এবং এ কারণে সেই অবস্থাটি অনেক সুখদায়ক। বলয় চেতনায় রয়েছে অতীত সম্পর্কে শোক না করা ও ভবিষ্যতের জন্য লালায়িত না হওয়া। এ ভবিষ্যতের জন্য লালায়িত হওয়া ও শোক করা অনেক লোকের জন্য উদ্বিগ্নতার অন্যতম উৎস।
তারা এ থেকে পরিত্রানের মাধ্যমে আনন্দের অনুসন্ধান করে। আমাদের পারমার্থিক অবস্থানে এ ধরনের শোক ও লালায়িত হওয়ার প্রবণতা নেই। এ বলয়টি চিন্ময় হতে পারে, কিন্তু প্রায়ই জাগতিক মন পারমার্থিকতার সাথে সংযুক্ত না হয়ে জড় কার্যকলাপে নিবিষ্ট হতে পারে। কারো চেতনা বা উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে বলয় কেন্দ্রীক কার্যকলাপগুলো পারমার্থিক কিংবা জাগতিক হতে পারে।
একটি তথাকথিত গ্রন্থ লেখার মধ্যে কোনো পারমার্থিকতা থাকতে পারে না, কিন্তু দৃষ্টান্তস্বরূপ একজন সাধু যখন পারমার্থিক জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ গ্রন্থ লিখেন তখন সেটি নিশ্চিতভাবেই পারমার্থিক। এরকম একটি বিষয় নিয়ে স্ত্রী চৈতন্যচরিতামৃতের রচয়িতা কি উদ্ধৃত করেছেন তা দেখা যাক। তিনি বর্ণনা করেছেন যে, কীভাবে তিনি এটি রচনার সময় বলয়ের মধ্যে ছিলেন।
“আমি এখন অতি বৃদ্ধ ও জরাতুর। লেখার সময় আমার হাত কাঁপে। আমি কিছু স্মরণ রাখতে পারি না, চোখে ভালমতো দেখি না, কানেও ভালমতো শুনতে পাই না। তবুও আমি লিখি এবং তা হচ্ছে একটি মস্ত বড় বিস্ময়।”
(চৈ. চ. মধ্য ২/৯০)
কিছু বিস্ময়ের বিষয় হল, এ জোনে নিয়ে কিছু সমস্যা রয়েছে, আপনি যখন খুশি এ জোনে প্রবেশ করতে পারেন না, এটি দুরূহ একটি ব্যাপার। এজন্যে প্রয়োজন অত্যন্ত দক্ষতা ও একই সময়ে চ্যালেঞ্জ এবং প্রচুর সময়সাপেক্ষ। আরেকটি বিষয় হল কোনোটি একটি অস্থায়ী অবস্থা, জোন থেকে নির্দিষ্ট সময় পর বের হয়ে অন্যান্য কার্যকলাপে ফিরে যেতে পারেন।
প্রাচীন যৌগ শাস্ত্র জোনের মধ্যে কৃষ্ণভাবনার পথ সম্পর্ক বিস্তৃত বর্ণনা করে। শাস্ত্রানুসারে ধ্যানের
মাধ্যমে পরম চেতনা কৃষ্ণভাবনার সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারে। এই কৃষ্ণভাবনার পথটি শুরু হয় পুনঃ পুনঃ পবিত্র শব্দ তরঙ্গ শ্রবণের মাধ্যমে। এই পুনঃ পুনঃ প্রক্রিয়া হতে পারে নিঃশব্দে। জপ ধ্যানের মাধ্যমে অথবা উচ্চস্বরে কীর্তনের মাধ্যমে। যত বেশি ভগবানের পবিত্র নাম শ্রবণ করা হবে তত বেশি তা চেতনার ওপর প্রভাব রাখবে, শীঘ্রই যখন আপনি সারাদিন জুড়ে তা স্মরণ করতে শুরু করবেন তখন আপনার ভাব (mood) উন্নত হবে। দৃঢ় অনুশীলনের মাধ্যমে মন্ত্রসমূহ শ্রবণ কীর্তন আপনার দ্বিতীয় প্রকৃতি হয়ে উঠবে। এরূপ কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন আপনাকে একটি স্তরে নিয়ে যাবে যেটিকে বলা হয় সমাধি, বিশুদ্ধ চিন্ময় স্তর বা পূর্ণ ভগবৎ চেতনার স্তর। ঐ স্তরে আপনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে চিন্ময় সম্পর্ক পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারেন এবং শুদ্ধ চিন্ময় চেতনাসম্পন্ন শরীরে অবস্থান করেন। তখন আপনি এই জড় জগতে করেন না। আপনি তখন সম্পূর্ণরূপে সুখী, ও স্থায়ীভাবে পারমার্থিক জোনে অবস্থান করেন। এ বিষয়ে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (৬/২০) ভগবান বলছেন, “যোগ অভ্যাসের ফলে যে অবস্থায় চিত্ত সম্পূর্ণরূপে জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহৃত হয়, সেই অবস্থাকে যোগসমাধি বলা হয়।”
অতএব, সে সমস্ত শুভাকাঙ্ক্ষী পারমার্থিক অনুশীলনকারী, যারা হরিনাম জপ কীর্তন অনুশীলন করেন, যাঁরা সমাধির স্তর লাভের পথে অনুশীলন রত তাঁদের সঙ্গ লাভের মাধ্যমে নির্দিষ্ট বলয়ে প্রবেশের জন্য নিরাপদ, সহজতম পথের কীভাবে অনুসন্ধান করতে পারেন সেটি নিয়ে ভাবুন।
চণ্ডিদাস ১৩ বছর যাবৎ ভক্তিযোগ অনুশীলন করছেন। তিনি কম্পিউটার সাইন্সের ওপর পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং বিজ্ঞান ও পারমার্থিক বিষয়ের প্রতি তাঁর রয়েছে গভীর আগ্রহ। তাঁর সাথে যোগাযোগ করতে এই ঠিকানায় www.deltaflow.com। তিনি শ্রীমৎ দেবামৃত স্বামী মহারাজের একজন শিষ্য ।
ত্রৈমাসিক ব্যাক টু গডহেড, জুলাই – সেপ্টেম্বর ২০১৪