এই পোস্টটি 538 বার দেখা হয়েছে
মণীশ সিংহ রায়
অনেক সময়েই সাধারণ মানুষেরা এই রকম কথা বলে থাকেন, “ইস্কন শুধু ‘হরেকৃষ্ণ’ করা ছাড়া আর করেটা কি? এতে মানুষের উপকারই বা কি হয়? কত সাধু সন্ন্যাসীদের কত রকম সংস্থা রয়েছে যারা বিভিন্ন মানবিক কল্যাণের কাজে নিেেদও নিয়োগ করেছে। তারা হাসপাতাল তৈরী করছে, স্কুল তৈরী করছে, বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করছে, মানুষের কল্যাণের নিমিত্ত আরো কত কি করছে। কিন্তু ইস্কন এসব করছে না কেন?”
হ্যাঁ, সামাজিক উন্নয়নের জন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল ইত্যাদি তৈরী করা অবশ্যই ভালো কাজ, কিন্তু এই ভালো কাজগুলি মানুষের তাৎক্ষণিক মঙ্গল করে মাত্র, নিত্য মঙ্গল নয়। সর্বোচ্চ পরোপকারটি হচ্ছে জীবের নিত্য মঙ্গেল সাধিত করা যাতে তাকে বারবার এই দুঃখ দুর্দশাময় জড় জগতে ফিরে আসতে না হয়। জড় জগতের মায়ায় আবদ্ধ জীব এই উপকারটির তাৎপর্য সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করতে পারে না বা প্রত্যক্ষভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। কিন্তু এইটিই তাদের একমাত্র আসল উপকার। জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে জীবকে উদ্ধার করাই যথার্থ পরোপকার। এই পরোপকারে দিকে ইঙ্গিত করেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নির্দেশ প্রদান করেছেন-
ভারত ভূমিতে হৈল মনুষ্য জন্ম যার।
জন্ম সার্থক করি কর পরোপকার।।
আমাদের এই ‘ইস্কন’ বা ‘কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন’ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুরই আজ্ঞাবাহক মাত্র। তাই হরিনাম মহামন্ত্রের মাধ্যমে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে জীবকে জন্ম মৃত্যুময় সংসারচক্র থেকে উদ্ধার করাই একমাত্র লক্ষ বা প্রথম কাজ। গীতায় (১২/৬-৭) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বলেছেন-
যে তু সর্বানি কর্মানি ময়ি সংন্যস্য মৎপরাঃ।
অনন্যেনৈব যোগেন মাং ধ্যায়ন্ত উপাসতে।।
তেষামহং সমুদ্ধর্তা মৃত্যুসংসারসাগরাৎ
ঋবামি ন রিাৎ পার্থ ময্যাবেশিতচেতসাম্।।
অর্থাৎ “যাঁরা সমস্ত কর্ম আমাতে সমর্পণ করে, মৎপরায়ণ হয়ে অনন্য ভক্তিযোগের দ্বারা আমার উপসনা ও ধ্যান করেন, সেই সমস্ত ভক্তদের আমি মৃত্যুময় সংসার সাগর থেকে অচিরেই উদ্ধার করি।”
অ্যান করার অর্থ হচ্ছে মনকে ভগবানের পাদপদ্মে একাগ্রভাবে নিবিষ্ট করা। কলিযুগে এইভাবে ভগবানের পাদপদ্মে মনকে নিবিষ্ট করানোর একমাত্র সহজ পন্থা হচ্ছে ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে। এই ভগবন্নাম কীর্তন ও জপ করা। অনুক্ষণ এই নাম জপ ও কীর্তন করার মাধ্যমে আমরা সর্বদা ভগবানের স্মরণের মধ্য দিয়ে ভগবানের কাছে শরণাগতি লাভ করার অনুশীলন করতে পারি। আর এই ভগবানের শ্রীচরণ কমলে শরণাগতি লাভ করাই আমাদের এই মনুষ্য জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য। ভগবৎ শরণাগতি তখনই লাভ হয় যখন আমাদের ভরোগের নিরাময় হয়। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত জড় জাগতিক বস্তু বা ভোগ বাসনার প্রতি আসক্ত থাকি ততক্ষণ আমরা সকলেই ভবরোগী। কিন্তু যতক্ষণ আমাদের জীবনের সকল দুঃখ দুর্দশার কারণ স্বরূপ জাগতিক অনিত্য বস্তু ভোগ বাসনার প্রতি আসক্তি দূর হযে বিরক্তির সূচনা হবে তখনই ভগবানের পাদপদ্মে শরণাগতির দিকে আমাদের অগ্রসর সম্ভব হবে। ‘হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র’ নিয়ত জপ ও কীর্তনের ফলে ধীরে ধীরে জাগতিক অনিত্য ব্সুত ভোগ বাসনার প্রতি আসক্তির নিবৃত্তি হয় এবং এই জীবনের মুখ্য লক্ষ্য অর্জিত হয়ে অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুর সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে পরিণামে ভগবদ্ধামে গতি লাভ করতে পারি। তাই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রজপ ও কীর্তন আমাদের জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণভাবে জাগতিক চোখে বা দৃষ্টিভঙ্গিতে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ বা কীর্তনকে অসামান্য মনে না হলেও ভগবৎ কৃপায় কেউ যদি এই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ ও কীর্তন নিয়মিতভাবে অনুশীলন শুরু করে তাহলে যথাসময়ে এই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রের অসামান্য পারমার্থিক কার্যকারিতা সে হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে। শাস্ত্রে এই মহামন্ত্রকে তাই ভবরোগের মহৌষধ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা যারা এই জড় জাগতিক ভোগ বাসনায় আসক্ত তারা সকলেই ভবরোগী। যেহেতু হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রের অনুশীলন এই ভবরোগের নিবৃত্তি করে তাই এটি ভবরোগের একমাত্র মহৌষধ। ইস্কন তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে বিশ্বজড়ে মানুষের কাছে এই ‘হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র ’ নামক ভবরোগের মহৌষধটি বিতরণের কাজে ব্যাপৃত রয়েছে। সেটিই ইস্কনের মুখ্য ও একমাত্র কাজ।
হাসপাতাল তৈরী করা, স্কুল নির্মাণ করা এগুলি নিশ্চয়ই ভালো কজ এবং গীতায় সেটিরও অনুমোদন রয়েছে। তবে কেন ও কিভাবে সেটি জানতে হবে। এই বিষয়ে শ্রীল প্রভুপাদ গীতার (১২/১১) শ্লোকের তাৎপর্যে উল্লেখ করেছেন-“অনেক সময় দেখা যায় যে, কৃষ্ণভক্তিতে নিরুৎসাহী লোকের হাসপাতল অথবা অন্য কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের জন্য দান করে থাকেন, এইভাবে তারা বহু কষ্টে উপার্জিত অর্থ দান করার মাধ্যমে তাঁদের কর্মের ফল দান করে থাকেন। এই পন্থাকেও এখানে অনুমোদন করা হয়েছে, কারণ এইভাবে কর্মফল দান করার মাধ্যমে চিত্ত নির্মল হতে থাকে এবং চিত্ত নির্মল হলে কৃষ্ণভাবনার অমৃত উপলব্ধি করা যায়।