বর্তমান সঙ্কট মোচনে শ্রীগৌরাঙ্গই ভরসা

প্রকাশ: ৬ জানুয়ারি ২০২৪ | ৬:৩০ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ৬ জানুয়ারি ২০২৪ | ৬:৪৬ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 124 বার দেখা হয়েছে

বর্তমান সঙ্কট মোচনে শ্রীগৌরাঙ্গই ভরসা

শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী


পরম পুরুষোত্তম ভগবানের কথা সদাসর্বদা শ্রবণ-কীর্তন করতে থাকলে সাধু-সজ্জন মানুষের সকল জাগতিক দুঃখ-দুর্দশার লাঘব হয়, কারণ ভগবানের চিন্তার মধ্যে থাকে তাঁর দিব্য লীলার অমৃত আস্বাদন।
কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ সেই আস্বাদনের প্রতি সাধু-সজ্জন মানুষদের আগ্রহী করে তুলতে চেয়েছেন। যাঁরা বাস্তবিকই সাধু সজ্জন এবং প্রকৃত অর্থে জড়জাগতিক দুঃখকষ্ট থেকে অব্যাহতি পেতে চান, তাঁরা ভগবানের লীলা-মাহাত্ম্য ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে কখনই চিন্তা করেন না, বা কথা বলতে চান না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর ভক্তবৃন্দ সম্পর্কে সদাসর্বদা আগ্রহ-আকুলতা থাকলে জড়জাগতিক দুঃখ-দুর্দশার পীড়ন আর তেমনভাবে দেহ-মনের ওপরে দৌরাত্ম্য করতে সাহস পায় না। কারণ সেগুলি হল মায়ার প্রবঞ্চনা মাত্র, তাই যখনই কোনও মানুষ কৃষ্ণকথা আর কৃষ্ণচিন্তার আশ্রয় নেয়, তখনই মায়াময় দুঃখ-দুর্দশার অনুভূতি কোনো এক দিব্যভাবের স্পর্শে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই হল কলিযুগে জীবনের সকল দুঃখ-কষ্ট নির্মূল করবার রহস্য। আধুনিক সমাজে নানা ধরনের ঔষুধপত্র আবিষ্কার করা হচ্ছে, কিন্তু প্রকৃতিও নিত্য নতুন রোগব্যধির ক্লেশ নিয়ে মায়াময় প্রবঞ্চনা সৃষ্টি করছে। দুঃখ কষ্টের সীমা নেই। কিন্তু এই সমস্ত কিছুরই ঊর্ধ্বে চলে যাওয়ার অতি সহজ পন্থা রয়েছে, সেই পন্থা মোটেই কঠিন নয়, তা হল কেবলমাত্র পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্যলীলা এবং অপ্রাকৃত কার্যকলাপের চিন্তায় মনকে সদাসর্বদা ভরিয়ে রাখা, শ্রীকৃষ্ণের শুদ্ধ ভক্তদের কার্যকলাপ আর চিন্তাধারায় মগ্ন হয়ে থাকা। অন্তত প্রতিদিন দু’এক ঘণ্টা করে কৃষ্ণভাবনাময় গ্রন্থ চর্চা করা মোটেই দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়, অথচ তা করতেই অনেকে সময় পায় না বলে বৃথা আক্ষেপ করে থাকে। কিন্তু আজেবাজে খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনগুলো দূরে ফেলে রেখে সেই সময়টা কৃষ্ণকথা শ্রবণ বা পাঠ করলে আপনা হতেই কৃষ্ণকথায় রুচি জাগতে থাকবে।

আমরা যতই কৃষ্ণকথা শুনব, ততই ভাল লাগবে। রুচি তৈরি করে নিতে হবে, কারণ এটা তো ভাল রুচি, এমন একটা সাত্ত্বিক রুচি, যার চর্চা থেকে ভগবদ্ভক্তি জাগে, যে ভক্তি ভাব সকল সঙ্কট মোচনে সহায়তা করে। তাই শ্রীমদ্ভাগবতে (১/২/১৮) পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, নিত্যং ভাগবতসেবয়া। প্রতিদিন শ্রীমদ্ভাগবতের অমৃত আস্বাদন করতে হবে শ্রবণ কীর্তনের মাধ্যমে। শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণীসম্ভার, আর শ্রীমদ্ভাগবত হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধীয় তত্ত্ব ও লীলাবিলাস কাহিনীসম্ভার। অতএব গীতা-ভাগবত থেকে শ্রীকৃষ্ণের মহিমা শ্রবণ করলে, কৃষ্ণভাবনাময় গ্রন্থাবলী থেকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মাহাত্ম্য অনুধাবন করলে আমরা বাস্তবিকই সমস্ত রকমের দুঃখ-কষ্টের গণ্ডি অনায়াসে অতিক্রম করে যেতে পারি।

কারণ, কৃষ্ণভাবনা অনুশীলনের ফলে আমাদের মন এই জড় জগতের সমস্ত দুঃখ-দুর্দশার জটিলতা থেকে অন্য এক জগতে উত্তীর্ণ হয়ে যায় বলেই সব দুঃখ ভুলে যেতে পারি-মনপ্রাণ তখন এক নিত্যআনন্দে ভরে ওঠে এবং সেই আনন্দের শক্তি এমনই যে, সমস্ত দুঃখ-কষ্ট তার প্রভাবেই তুচ্ছ হয়ে যায়। সেই আনন্দ চিন্ময় জগৎ থেকে আমাদের সত্তার মধ্যে নেমে আসে। সুতরাং আমাদের শুধু মনস্থির করে নিতে-চিন্ময় আনন্দ লাভের পথে মনকে এগিয়ে দেব কি না। একবার মন ঠিক করে সেই পথে এগুতে থাকলেই শক্তি জাগতে থাকবে। কিন্তু পথিমধ্যে অধীর হলে চলবে না। অস্থিরতা জাগলে, আরও বেশি করে শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ক কাহিনী শ্রবণ কীর্তনে মন দিতে হবে, আরও বেশি করে ভক্তিসেবা অনুশীলন করতে হবে।

পারমার্থিক জীবনচর্চার সেটাই হল সংজ্ঞা-(ভাঃ ১/২/৮) যখনই আমরা আগ্রহ সহকারে ভক্তি বিষয়ক কথা শুনি, তখনই আমাদের পারমার্থিক জীবনচর্যা যথাযথভাবে এগিয়ে চলে। যদি আগ্রহ না জাগে, যদি আকুলতা না জাগে, তা হলে বুঝতে হবে আমরা এখনও ভক্তিমার্গের কনিষ্ঠ পর্যায়ে রয়ে গেছি।

অতএব শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু যে কৃষ্ণভাবনার ধারা বয়ে এনেছেন, শ্রীল প্রভুপাদ এবং অগ্রণী ভক্তগণ যে কৃষ্ণভক্তির প্রসার করতে চেয়েছেন, তার তাৎপর্য এইভাবে উপলব্ধি করতে হবে। গৌরপূর্ণিমা উৎসবের সময়ে ভক্তরা পরিক্রমায় বেরিয়ে কত কষ্ট পান। কিন্তু যখন আমরা শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুর মহিমা শ্রবণ করি, সেই মুহূর্তে আমরা সমস্ত কষ্টকর পরিবেশটা ভুলে যাই। পরিক্রমা থেকে ফিরে এসে আমাদের মুখে হাসি ফোটে। কারণ আমরা অপ্রাকৃত জগতের আনন্দ আস্বাদন করে ফিরে আসি।

নবদ্বীপে শ্রীঅদ্বৈত আচার্য যখন দেখেছিলেন মানুষ ইন্দ্রিয় সুখভোগে মত্ত হয়ে পারমার্থিক আনন্দরসের আস্বাদন থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে, অথচ তারা সবাই জড়জাগতিক দুঃখ-দুর্দশায় নিমজ্জিত হয়ে রয়েছে, তখন তিনি স্বয়ং মহাবিষ্ণুর অংশপ্রকাশ হলেও চিন্তা করেছিলেন, ঐসব বিভ্রান্ত মানুষকে পাণ্ডিত্যের সঙ্কট থেকে উদ্ধার করার জন্যে শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তির আস্বাদন দিতে পারেন একমাত্র স্বয়ং ভগবান। তাই তিনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের প্রার্থনা জানিয়ে ‘গৌরাঙ্গ, গৌরাঙ্গ’ বলে কেঁদেছিলেন, তপস্যা করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, বিভ্রান্ত মানুষের সঙ্কট মোচনে শ্রীগৌরাঙ্গই একমাত্র ভরসা।

বাস্তবিকই, সঙ্কটকালে ক্লেশমুক্তির উদ্দেশ্যে ভগবদ্ভক্তি অর্জন করতে হলে, শুদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম লাভ করতে হলে,স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর ভক্তমণ্ডলীর অহৈতুকী কৃপা অবশ্যই
অর্জন করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং শুদ্ধ ভক্তি প্রদান করতে বিশেষ আগ্রহী নন। কিন্তু শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু ধরাধামে মহাবদান্যশ্রীগৌরাঙ্গ অবতাররূপে অবতীর্ণ হয়ে সেই শুদ্ধ ভক্তি অকাতরে বিতরণ করে গেছেন-তাই শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর ভগবদ্ভক্তি বিষয়ক উপদেশাবলী অতি সহজেই আমরা মেনে চলতে পারি এবং সকল যুগেরই জড়জাগতিক সঙ্কট মোচনের কাজে লাগাতে পারি। যদি আমরা শ্রীগৌরাঙ্গদেবের পদাঙ্ক অনুসরণ করার উদ্দেশ্যে আমাদের জীবন-ধন সব উৎসর্গ করে দিতে পারি, তা হলে সর্ব সঙ্কট মোচনের মহৌষধ যে ভগবদ্ভক্তি, তার ভাবোল্লাসময় সুলক্ষণগুলি সবই একে একে আমাদের মধ্যে জেগে উঠতে পারে।

বাস্তবিকই, কৃষ্ণপ্রেম অর্জন করা জন্মজন্মান্তরের সাধনা। কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অচিরেই তা আমাদের নাগালে এনে দেন। সারা জগতের সঙ্কট মোচনের জন্যে, সমস্ত মানুষকে ভগবদ্ভক্তির পথে অতি সহজে আকৃষ্ট করার জন্যে, তিনি যে সংকীর্তন আন্দোলনের পরিকল্পনা করেছিলেন, তা সহজলভ্য, অথচ আশু ফলপ্রদ।

ইতিহাসে দেখি, শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু ১৪৮৬ সালে আবির্ভূত হন আর ১৪৯২ সালে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করলেন-এটা কোনও আকস্মিক ব্যাপার বলে আমি মনে করি না। শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুর প্রকটকালেই আমেরিকা আবিষ্কার হল, আর সেই আমেরিকাতেই শ্রীগৌরাঙ্গের নামকীর্তন আন্দোলন প্রসারে ১৯৬৫ সালে গিয়েছিলেন শ্রীল প্রভুপাদ এই গৌরভূমি ভারতবর্ষ থেকে। শ্রীল প্রভুপাদের জয় হোক! তিনি আমেরিকা থেকে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের প্রতিনিধি হয়ে সারা পৃথিবীতে গৌরাঙ্গবাণী প্রচারে বেরিয়ে পড়েছিলেন-গিয়েছিলেন ইউরোপে, অস্ট্রেলিয়াতে, হংকং-এ, আফ্রিকায়, রাশিয়ায় এ সবই শ্রীগৌরাঙ্গের দিব্য পরিকল্পনা মতোই হয়েছে, তা মানতেই হবে।

আমরা যদি শুধুই সুখ-শান্তি অর্জনের দিকে ঝুঁকে পড়ি, কিছুটা জড়জাগতিক স্বাচ্ছন্দকেই আঁকড়ে থাকতে চাই, তা হলে আমাদের শুদ্ধ অমৃতের আস্বাদন থেকে, কৃষ্ণভাবনামৃত থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকতে হবে। আর তার ফলে আমাদের মন হবে চঞ্চল-ঐসব অনিত্যসুখ-স্বাচ্ছন্দের বাসনা থেকেই জাগবে আমাদের চাঞ্চল্য। কিন্তু শ্রীগৌরাঙ্গবাণী অনুসরণ করে আমরা যদি শ্রীকৃষ্ণভক্তি অর্জনের উদ্দেশ্যে, ভগবদ্-প্রেমের সন্ধানে আত্মনিয়োগ করি, তা হলে আপনা থেকেই আমাদের অপ্রাকৃত সুখ-শান্তি আসবে। যেকোনো অবস্থাতেই আমরা থাকি না কেন, কৃষ্ণভাবনা চর্চা করার সঙ্গেসঙ্গেই আমাদের মাঝে প্রকৃত সুখের উন্মেষ ঘটতে থাকবে, সে-বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই। আসলে, ভগবদ্ভক্তি চর্চার মধ্যেযে প্রকৃত সুখের আস্বাদন রয়েছে, তারই সন্ধান করছে প্রতে ̈কে, কিন্তু যথাযথ আগ্রহের স্বল্পতায় এবং শুদ্ধ ভক্তের কৃপার অভাবে অনেকে তা অর্জন করতে পারছে না।

অথচ শ্রীগৌরাঙ্গদেব প্রবর্তিত হরেকৃষ্ণ সংকীর্তন যজ্ঞের মাধ্যমে কলিযুগের সব রকম সঙ্কট আর বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়া যায়, একথা শ্রীল প্রভুপাদ বিশ্বব্যাপী অগণিত মানুষকে আজ বোঝাতে পারলেও, এখনও বহু লোক দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে রয়েছে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন, সুখী হতে হলে শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিবিধানের উদ্দেশ্যে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করতেই হবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রীত হলে তাঁর কাছ থেকেই দিব্য সুখের ধারা সবার ওপরে নেমে আসবে। শ্রীল প্রভুপাদ বলেছিলেন, ভগবদ্ভক্তি চর্চায় আগ্রহী হতে হলে চিন্ময় ভাবনার একটা ক্ষুধা থাকা চাই। কেবল মনে মনে ভাবলেই হয় না, লোক দেখানো অনুকরণ করলেই চলে না। সত্যিকারের আকুলতা, যথার্থ পিপাসা, কৃষ্ণলীলার অমৃত আস্বাদনে তীব্র ক্ষুধা জাগাতে হবে। হরেকৃষ্ণ সংকীর্তন আন্দোলন সারা পৃথিবীতে নানাভাবে সার্থকতার মাধ ̈মে সেই কাজ করে চলেছে। কারণ এ ছাড়া মানুষকে সমূহ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার অন্যকোনও পন্থা নেই।


মাসিক চৈতন্য সন্দেশ মার্চ ২০২২ হতে প্রকাশিত

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।