এই পোস্টটি 182 বার দেখা হয়েছে
ফ্যাশন, হেয়ার স্টাইল ও সঙ্গীত সংস্কৃতি
শ্রীমতি দেবকী দেবী দাসী
বিশ্বের নির্দিষ্ট দর্শন, আদর্শ ও দূর দর্শিতা অনুসারে জীবন যাপনের মাধ্যমে সংস্কৃতির আগমন ঘটে থাকে । ব্যবহারিকভাবে এর প্রয়োগ ও এর সঙ্গে জীবন যাপনের মাধ্যমে একটি সংস্কৃতি বর্ধিত হয়। এভাবেই সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে থাকে। সংস্কৃতির মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন জীবনও প্রভাবিত হয়। ফ্যাশন, চুলের স্টাইল, গান, খাদ্য, বিনোদন, শিক্ষা, সমস্ত ধরনের শিল্প, চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমাদের মনোভাব, জ্যেষ্ঠ, সন্তান ও মাতাদের প্রতি আমাদের মনোভাব ও আচরণ ইত্যাদি সবকিছুই সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। এখানে উপরোক্ত উদাহরণগুলোর মধ্য থেকে ফ্যাশন, চুলের স্টাইল ও গান সম্পর্কে তুলে ধরা হচ্ছে যাতে করে আমরা সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারি। জাগতিক জীবন ও এর সংস্কৃতিতে বিদ্যমান সবকিছুকে আমরা তিনটি গুণের প্রভাবের অধীন হিসেবে ভাগ করি । সেই গুণগুলো হল সত্ত্ব, রজো ও তমো।
জাগতিক সংস্কৃতিতে ফ্যাশন
তমোগুণ: এই গুণের স্তরে ফ্যাশন হয় নোংরা, ছেড়া, অবহেলিত। দৃষ্টান্তস্বরূপ এখনকার দিনে নতুন প্রজন্ম কিছু নতুন জিন্স পরিধান করে যেগুলোকে কৃত্রিমভাবে পুরানো হিসেবে দেখানো হয়। অনেক কাপড় চোপড় ঠিকভাবে শরীরের সঙ্গে ফিট হয় না, যেমন: হাটু পর্যন্ত প্যান্ট পরিধান এবং যখন কেউ নীচু হয় তখন তার পেছন দিকটার সবকিছু প্রায় দৃশ্যমান হয়। প্রকৃতপক্ষে আমাদের ফ্যাশন ডিজাইনাররা এত এত ধারণা দিতে দিতে তাদের ধারণাগুলো ফুরিয়ে যাচ্ছে। আর তাই তাদের ধারণাগুলো প্রতিনিয়ত অধিক থেকে অধিকতর উন্মাদগ্রস্ত ও তমোগুণের দ্বারা প্রভাবিত ।
রজোগুণ: সেই সমস্ত বস্ত্র পরিধান করা যেগুলোর মাধ্যমে দেহ প্রদর্শন ও বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণ, ইন্দ্রিয়তৃপ্তি ও কাম বাসনার জ্বরকে আহ্বান করে । অত্যন্ত আঁটসাঁট ফিটিং ও অনেকটা স্বচ্ছ উপাদান দিয়ে তৈরি বস্ত্র যা অনেকটা দেহকে প্রদর্শন করার উপর জোর দেয় । এই গুণের স্তরে সূত্রটি হল, বাহ্যিকভাবে প্রদর্শন করা আমি হলাম অত্যন্ত বিশেষ, অতুলনীয় ও অদ্বিতীয় ব্যক্তি। বস্ত্রের মধ্যে যে নামের ব্র্যান্ড ডিজাইন করা থাকে তা ব্যক্তির মিথ্যা অহঙ্কারকে বর্ধিত করে ।
সত্ত্বগুণ: ভদ্র, পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন, সুন্দরভাবে দেহকে আবৃত রাখা বস্ত্রগুলো হল সত্ত্বগুণজাত ৷ যেমন: (লরা অ্যাশলে ফ্যাশন)। এ ধরণের বস্ত্রে কোন অত্যধিক ঝমকালো কিছু নেই এবং এ কারণে অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করে না। দীর্ঘ স্কার্ট, বোতাম ব্যবহৃত ব্লাউজ, পাঞ্জাবী স্যুট (সলোয়ার কামিজ), হাতে ঢিলেঢালা প্যান্ট। পুরুষদের জন্য সাধারণ ও পরিচ্ছন্ন বস্ত্র হল এই গুণের স্তর । আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি যে, বিভিন্ন ধরনের ফ্যাশন কেবলমাত্র ব্যক্তির চেতনাকেই তুলে ধরে না বরং যে বস্ত্র তিনি পরিধান করেন সেই বস্ত্র নির্দিষ্ট গুণকে বিস্তার করে এবং যার মাধ্যমে আমাদের চারপাশের ব্যক্তিদের চেতনাও সূক্ষ্মভাবে প্রভাবিত হয়। পারমার্থিক সংস্কৃতিতে ফ্যাশন যে ফ্যাশন ভগবানকে স্মরণ করিয়ে দেয় সেটি হলো অপ্রাকৃত ফ্যাশন। প্রত্যেক ধর্মে ও পারমার্থিক সংস্কৃতিতে এই পারমার্থিক ফ্যাশন আমরা পরিলক্ষণ করতে পারি। গীর্জায় অবস্থিত খ্রিষ্টান নারীদের বস্ত্র পরিধান ঐতিহ্যবাহী শাড়ী পরিধানের মতোই একই আদর্শ মেনে চলে। অবশ্য এখন অত্যন্ত আধুনিক স্টাইলে কুরুচিপূর্ণভাবে শাড়ি পরিধান করা হয় যা অবাঞ্ছনীয়। খ্রিষ্টান মঠ বাসিনীদের সমগ্র শরীর অর্থাৎ পেছন দিক ও মাথাও আবৃত থাকে। পারমার্থিক সংস্কৃতিতে নারী পুরুষের প্রতি আকর্ষণ হ্রাস করার বিশ্বজনীন আদর্শ বজায় রাখা হয়।
মজার ব্যাপার হলো প্রাচীন যেকোনো পারমার্থিক সংস্কৃতিতে কোনো একনিষ্ঠ ব্যক্তি প্যান্ট ও শার্ট পরিধান করতো না বরং তারা বিভিন্ন ধরনের ঢিলেঢালা বস্ত্র পরিধান করতো। ভক্তিমূলক বস্ত্ৰ এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে করে স্থূল দেহজাত পরিচয় হ্রাস করে মিথ্যা অহঙ্কারকে প্রশমিত করে । যদি আমরা শাড়ী ও ধুতির মতো বস্ত্র পরিধানের সংস্কৃতিকে দূরে রাখি যেটি কৃষ্ণ আমাদের প্রদান করেছেন এবং সেসাথে ভক্তিমূলক সেবার প্রক্রিয়া একনিষ্ঠভাবে অনুশীলন করি তবে আমাদের দেহাত্ম বুদ্ধির চেতনা ও মিথ্যা অহঙ্কার ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে। এটিই হলো কৃষ্ণের সংস্কৃতির শক্তি। ভক্তিমূলক বস্ত্র গ্রহণের মাধ্যমে কৃষ্ণ যে সংস্কৃতি আমাদের প্রদান করেছেন তা গ্রহণ করতে সম্মত হই। তাহলে এর মাধ্যমে আমাদের সবার চেয়ে আলাদা হওয়ার দৃঢ় মনোভাব ধীরে ধীরে দূর হয়। শাড়ি ও ধুতি হলো নিঃসন্দেহে সর্বোচ্চ পারমার্থিক ফ্যাশন কারণ সেগুলো আমাদের গোলক বৃন্দাবনকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং সে সাথে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও বৃন্দাবনের গোপীরা যে দিব্য বস্ত্র পরিধান করতো তা স্মরণ করিয়ে দেয় । শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে (মধ্য ১৪/১৯৫) উল্লেখ করা হয়েছে, “শ্রীকৃষ্ণ যখন লোভাতুর হয়ে শ্রীমতী রাধারাণীর বসনাঞ্চল (শাড়ি) আকর্ষণ করেন, তখন শ্রীমতী রাধারাণী অন্তরে অত্যন্ত আনন্দিত হন, কিন্তু বাইরে তিনি শ্রীকৃষ্ণকে নিবারণ করার চেষ্টা করেন।” শ্রীমদ্ভাগবতের ৪/২১/১৭ নং শ্লোকে উল্লেখিত একটি শব্দ ‘দুকুল অগ্রে’ এর অর্থ ‘ধুতি পরিহিত’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শ্লোকটির অনুবাদ নিম্নে প্রদত্ত হল: “তাঁর (মহারাজ পৃথুর) কেশকলাপ-সূক্ষ্ম কুঞ্চিত, কৃষ্ণবর্ণ ও চিক্কণ; গলদেশ শঙ্খের মতো রেখাযুক্ত। তিনি একটি অতি মূল্যবান ধুতি পরেছিলেন এবং তাঁর দেহের উপরিভাগে ছিল এক অতি সুন্দর উত্তরীয়।”
এছাড়াও ইস্কন ভক্তদের অঙ্কিত সমস্ত চিত্রে ভগবান বিষ্ণুকে প্রদর্শন করা হয়েছে হলুদ ধুতি পরিহিত হিসেবে। পুনরায় সংস্কৃতে হলুদ বস্ত্ৰকে বলা হয় পীতম্বর হিসেবে কিন্তু সেটি হলো একটি ধুতি। শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর ভক্ত শিল্পীদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন অনুরূপভাবে ভগবানের বস্ত্রকে তুলে ধরার জন্য। এজন্যে তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে এসমস্ত চিত্রকর্ম অঙ্কনের জন্য তত্ত্বাবধান করেছিলেন। যদি শ্রীল প্রভুপাদ ভগবান বিষ্ণুকে একটি হলুদ ধুতি পরিহিত অবস্থায় প্রদর্শন করার দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে তবে কিভাবে আমরা অস্বীকার করি যে ধুতি একটি পারমার্থিক বস্ত্ৰ নয় । শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর শিষ্যদের ভক্তিমূলক বস্ত্ৰ পরিধান করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন এমনকি প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও। তিনি নিজে সেই দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করেছিলেন। ইউনিফর্মের শক্তি অগ্রাহ্য করা অনুচিত। এটি আমাদের পরিচয় বা ভূমিকাকে তুলে ধরে। এজন্যেই পুলিশ, ডাক্তার, সৈনিক, ফায়ার ব্রিগেড ও অন্যান্য পেশার ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম রয়েছে যার মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে তাদের পদের পরিচয় প্রদান করে। অতএব, একজন ভক্ত যে কৃষ্ণের সেবক সেই দৃঢ় পরিচয় তুলে ধরে বৈষ্ণবীয় বস্ত্র পরিধানের মাধ্যমে। জনসমক্ষে এটি চর্চার জন্য প্রয়োজন উৎসাহ এবং এর মাধ্যমে নিবিড়ভাবে আমাদের পারমার্থিক দৃঢ়তা ও বিশ্বাস বর্ধনে সহায়তা করে। আমরা সবার সামনে উন্মুক্তভাবে উপস্থাপন করতে পারি যে, আমরা হলাম কৃষ্ণের ভক্ত-শ্রীল প্রভুপাদের মিশনের একজন সৈনিক। ভক্তিমূলক বস্ত্র কেবল পরিধানকারীর চেতনাকে উন্নত করে না বরং এটি আমাদের চারপাশের মানুষদের মাঝেও একটি অপ্রাকৃত মানসিক চেতনা সৃষ্টি করে । কথায় আছে, “আমরা আহার করি নিজের সন্তুষ্টির জন্য আর বস্ত্র পরিধান করি অন্যের সন্তুষ্টির জন্য।”
জাগতিক হেয়ার স্টাইল
অভক্তদের জন্য হেয়ার স্টাইল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এজন্যে লোকেরা হেয়ার ড্রেসারদের কাছে গিয়ে লেটেস্ট হেয়ার স্টাইলের জন্য প্রচুর অর্থ ও সময়ের অপচয় করে। প্রতিমাস অন্তর অন্তর চুলের ফ্যাশন ডিজাইনাররা নিত্য নতুন ডিজাইন নিয়ে আসছে। নিম্নে বিভিন্ন ধরনের চুলের স্টাইল সম্পর্কে তুলে ধরা হল যেগুলো জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের সঙ্গে সম্পর্কিত:
তমোগুণ: এ গুণের চুলের ধরণগুলো হল নোংরা, অবহেলিত, অপরিচ্ছন্ন ও অগোছালো হয়। উদ্ভট চুলের স্টাইল, গোলাপী, নীল, সবুজ ও বেগুণী রঙ দ্বারা রাঙানো, দড়ির মতো ঝুলানো সদৃশ চুলের স্টাইল হল তমগুণের। লোকেরা নিত্য নতুন ধারণার পেছনে ছুটছে যাতে তারা অন্যদের চেয়ে ভিন্ন হয়। আর এজন্যেই তমোগুণের প্রভাবে উদ্ভট সব চুলের স্টাইল পরিলক্ষিত হয়।
রজোগুণ: সেই সমস্ত চুলের স্টাইল যেগুলো দেহ প্রদর্শন ও বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণ করে, ইন্দ্রিয়তৃপ্তি ও কাম বাসনার জ্বরকে আহ্বান করে। এই গুণের স্তরে নারীরা চুল খোলা রাখে যেহেতু চুল হলো পুরুষদের জন্য একটি অত্যন্ত আবেদনময়ী ও আকর্ষণীয় বিষয়! অনেকে কৃত্রিমভাবে চুল রঙ করে অথবা কালো চুলের মধ্যে কিছু চুল ভিন্ন রঙের করে কিংবা কৃত্রিমভাবে চুল কোঁকড়ানো করা। কেউ আবার কিছু উদ্ভট সৃষ্টির মাধ্যমে ছোট চুলের স্টাইল ধারণ করে ।
পুরুষদের ক্ষেত্রে: জেল ও ক্রিম ইত্যাদির ব্যবহার, কৃত্রিমভাবে রঙ করানো, কয়েকটি ভিন্ন রঙের চুল, কোকড়ানো করা ইত্যাদি হর তমগুণের স্তরে যেগুলো নারীদের আকর্ষনের জন্য করা হয়। এরকম চুলের স্টাইল কেবল স্কুল দেহাত্মবুদ্ধির চেতনাকেই বর্ধিত করে না বরং লোকদের দেখানোর মনোভাব সৃষ্টি করে নিজেদের বিশেষ ও অদ্বিতীয় কিছু প্রদর্শন করানোর মাধ্যমে মিথ্যা অহঙ্কারকে বর্ধিত করে। সত্ত্বগুণ: এ গুণের স্তরের চুল হয় পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন, কোনরূপ জমকালো হয় না এবং অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করে না। নারীদের ক্ষেত্রে চুল একত্রে ঝুঁটি বাধা বা পেছন দিকে ঝুটি বাধা, বিনুনি করা হল সত্ত্বগুণজাত । পুরুষদের ক্ষেত্রে চুলের স্টাইল হয় সরল, ছোট, পরিচ্ছন্নভাবে কাটানো, কোনরূপ জমকালো নয় এমন। জাগতিক ফ্যাশনের ক্ষেত্রে এরকম বিভিন্ন ধরনের চুলের স্টাইল হল কেবল ব্যক্তির চেতনার অভিপ্রকাশই নয় বরং সেগুলো যে গুণের স্তরের হয় সে গুণকে বিস্তার করে এবং এভাবে সূক্ষ্মভাবে অন্যদের চেতনাকে প্রভাবিত করতে পারে ।
পারমার্থিক হেয়ার স্টাইল
অধিকাংশ পারমার্থিক সংস্কৃতিতে নারীরা তাদের মস্তক আবৃত রাখে। ইউক্রেনে একজন নারী মস্তক আবৃতবিহীনভাবে কোনো রাশিয়ান অর্থডক্সে প্রবেশ করতে পারে। অন্তত তাকে প্রতীকিভাবে হলেও মস্তকে রুমাল পরিহিত হতে হয়। মাত্র ১০০ বছর পূর্বেও জার্মানীতে এ সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল যে, একজন নারী তখনই জনসমক্ষে যেতে পারত যদি তার মস্তক একটি টুপি দ্বারা আবৃত থাকে এবং সেই টুপির চারপাশে ছোট একটি পর্দা বা গোমটার মত থাকত ।
আমার এখনো মনে পড়ে আমার মা আমাদের বলেছিল যে কিভাবে তার মা একবার রাস্তায় বের হয়েছিল মস্তক আবৃত হওয়া ছাড়া, আর তখন সেটি একটি বড় আলোচিত ঘটনা হয়েছিল। এমনকি ৫০ বছর পূর্বেও যেখানে আমি বেড়ে উঠেছি সেই জার্মান গ্রামে সব নারীরা একটি রুমাল দিয়ে মস্তক ঢেকে রাখত। এভাবে মস্তক আবৃত রাখার সূক্ষ্ম ও স্কুল বিভিন্ন প্রভাব রয়েছে। প্রথম যে প্রভাব তা হল এটি দেহগত চেতনা বিদূরিত করে এবং কাম বাসনার জ্বরকে শান্ত করে এবং নারী- -পুরুষের প্রতি পরষ্পরের আকর্ষণ হ্রাস করে। এ বিষয়গুলো যেকোন পারমার্থিক অনুশীলনের জন্য অতি প্রয়োজন। অধিকন্তু এটি একজন নারীকে লজ্জ্বা ও অবনত হওয়ার গুণাবলী চর্চায় সহায়তা করে । এটি মিথ্যা অহঙ্কার প্রশমিত করে এবং আমাদের গর্ব দূর করতে সহায়তা করে। যদিও এর প্রভাবটি সূক্ষ্ম কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী। তাছাড়া আমাদের মস্তক একটি অ্যান্টেনা হিসেবেও কাজ করে। মস্তকের খুলি দিয়ে অনেক টক্সিন বা বিষাক্ত দ্রব্য বেরিয়ে আসে, আর এটি ঘটে বিশেষত রাতে। এজন্যে আমাদের চুল হয়ে উঠে তেলতেলে ও পিচ্ছিল এবং এজন্যে আমাদের বালিশ খুব দ্রুত ময়লা হয়ে যায়। ঠিক একইভাবে আমরা মস্তকের মধ্য দিয়ে সব ধরনের নেতিবাচক শক্তি গ্রহণ করি। মস্তক আবৃত করানোর মাধ্যমে, আমরাও আমাদের কাম দৃষ্টি থেকে নিজদের সুরক্ষা প্রদান করতে পারি। এমনকি যদিও অধিকাংশ পারমার্থিক সংস্কৃতিতে নারীরা তাদের মস্তক আবৃত রাখে তবুও আমরা কিছু স্থানীয় ঐতিহ্যে এর কিছু ব্যতিক্রম দেখতে পাই। দক্ষিণ ভারতে নারীদের মস্তক আবৃত রাখার বিষয়টি অমঙ্গল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু শ্রীমতি রাধারাণী স্বয়ং নিজের দৃষ্টান্তের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন যে, নারীদের মস্তক সর্বদা আবৃত থাকা উচিত কেননা তিনি সর্বদা তার মস্তক ডেকে রাখতেন।
অধিকাংশ পারমার্থিক সংস্কৃতিতে পুরুষরা অত্যন্ত খাটো চুলের স্টাইল ধারণ করে অথবা মুণ্ডিত মস্তক ধারণ করে। আমাদের বৈষ্ণব ঐতিহ্য আমাদের শিক্ষা দেয় শুধু মস্তক মুণ্ডনই নয় শিখাও ধারণ করতে হয়। এখানে সবচেয়ে মজার একটি ব্যাপার হলো পুরুষদের ক্ষেত্রে মস্তক আবৃত রাখার বিভিন্ন ঐতিহ্যও অধিকাংশ পারমার্থিক সংস্কৃতিতে পরিলক্ষিত হয়। যেমন মুসলিম, ইহুদি, হিন্দু, খ্রিষ্টান ইত্যাদি ধর্মীয় ঐতিহ্যে পুরুষরা মস্তক আবৃত রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের টুপি, পাগড়ি ইত্যাদি পরিধান করতো। এর মাধ্যমে ভগবানের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন হয় এবং বিনম্রতা চর্চা করার জন্য এটি সহায়তা করে। যেহেতু চুলের স্টাইল বা ফ্যাশন আধুনিক যুগে পুরুষদের জন্য অধিক প্রভাব বিস্তার করে তাই এখন সেই টুপি ধারণ প্রথা বিলুপ্তির পথে। সুস্পষ্টভাবে যদি কেউ টুপি পরিধান করে তবে প্রচলিত তথাকথিত চুলের স্টাইলের জন্য যত আয়োজন তা ব্যর্থ হবে।
চৈতন্য সন্দেশ অ্যাপ ডাউনলোড করুন :https://play.google.com/store/apps/details?id=com.differentcoder.csbtg
জাগতিক সঙ্গীত
আমরা সবাই কোন না কোনভাবে গান বাজনা পছন্দ করি। তবে এক্ষেত্রে কোন ধরনের গান বাজনা পছন্দ করি সেটি গুরুত্বপূর্ণ কেননা তা আমাদের চেতনাকে দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত করে। আমরা সবাই জানি শব্দ তরঙ্গ আমাদের চেতনাকে প্রভাবিত করে এবং আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপরও প্রভাব বিস্তার করে।
তমোগুণ: এই স্তরে গান বাজনা হলো শুধুমাত্র বড় বড় শব্দ ও ছন্দ সৃষ্টি করা যেখানে কোন সুর বা কথার বালাই নেই। এজন্যে লোকেরা ভারী ভারী ধাতুর তৈরি যন্ত্র, প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
রজোগুণ: এই গুণের স্তরে গান বাজনা প্রচার করে থাকে নারী পুরুষের মধ্যে আকর্ষণ জনিত বিষয় এবং সে সাথে কাম বাসনার জ্বর বিস্তার করে। এ ধরনের গান বাজনা হলো পপ মিউজিক, রক এন রোল, বলিউড ইত্যাদি।
সত্ত্বগুণ: ক্লাসিক্যাল গান বাজনা হলো এই গুণের স্তরের। প্রতিটা দেশেই ক্লাসিক্যাল মিউজিক রয়েছে। ভারতে সেতার ও তবলা প্রচলিত, ইউরোপে বিধোবেন, মজার্ট ইত্যাদি ক্ল্যাসিক্যাল গান বাজনা প্রচলিত। এ ধরনের গান বাজনা সত্ত্বগুণকে প্রশমিত করে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, গাছপালারা ক্লাসিক্যাল মিউজিকের তালে তালে সবচেয়ে ভালভাবে বেড়ে উঠে পক্ষান্তরে তথাকথিত প্রযুক্তিগত ও রক মিউজিকের তালে তালে গাছপালাদের বেড়ে উঠার প্রবণতাটি ততটা ভাল হয় না। এ সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন গান বাজনা সেই সমস্ত নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের আকর্ষণ করে যারা প্রধানত নির্দিষ্ট গুণের দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হয়। আরো একবার একই কথার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে যে, বিভিন্ন ধরনের গান বাজনা নির্দিষ্ট গুণ প্রসারিত করে, যেটি শ্রবণকারীর চেতনাকে প্রভাবিত করতে পারে।
পারমার্থিক সঙ্গীত সর্বশ্রেষ্ঠ অপ্রাকৃত গান বাজনা হলো হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন। যেটি আমাদেরকে গোলক বৃন্দাবনে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এটিই কেবল অপ্রাকৃত মিউজিক নয় যে গান বাজনা ভগবানের গুণ মহিমা কীর্তন করে সেটি অপ্রাকৃত মিউজিক হিসেবে বিবেচ্য। প্রতিটি ধর্মে ও পারমার্থিক সংস্কৃতিতে ভগবানের গুণ মহিমা কীর্তন করার পন্থা প্রদত্ত রয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ খ্রিষ্টানদের গীর্জায় ভগবানের মহিমা কীর্তন করা নিঃসন্দেহে একটি পারমার্থিক অভিজ্ঞতা কেননা সেগুলো বাইবেলের বিভিন্ন শ্লোকের মাধ্যমে কীর্তন করা হয়। এগুলো ক্লাসিক্যাল মিউজিকের তালে তালে গাওয়া হয়। যাই হোক এটি আমাদেরকে চিন্ময় জগতে উন্নীত করবে না। একটি সাধারণ প্রশ্ন হলো যদি রক মিউজিকের তালে কীর্তন করা হয় সেটিও কি রজোগুণের হয়, নাকি সেটা অপ্রাকৃত মিউজিক? এক্ষেত্রে উল্লেখ্য কথার চেয়ে সুর বা ছন্দ আমাদের চেতনাকে দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত করে। প্রায়শই আমরা এমনকি গানের কথার প্রতি গুরুত্ব দিই না। এভাবে রক মিউজিকের তালে যে কীর্তন হয় সেটি মহামন্ত্রের প্রভাবকে সূক্ষ্মভাবে আবৃত করে রাখে ।
যদিও এই প্রকার কীর্তন বিশেষ বিশেষ স্থানে প্রযোজ্য হয় যেমন যে সমস্ত নতুন ভক্ত রক মিউজিকের প্রতি আসক্ত তাদের জন্যই এই ধরনের মিউজিক প্রযোজ্য। যদি কোন নতুন ভক্ত রক মিউজিকের তালে কীর্তন শোনে এবং একইভাবে ভক্তিমূলক পন্থার সঙ্গে একনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকে তবে যথা শীঘ্রই মহামন্ত্রের প্রতি তার রুচির পরিবর্তন হবে। তারা তখন রক মিউজিকের তালে যে কীর্তন হয় তার প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলবে ক্রমান্বয়ে ঐতিহ্যবাহী উচ্চতর স্বাদ বর্ধিত করবে।
উপসংহার
আমরা যে এখানে ফ্যাশন, চুলের স্টাইল ও গান বাজনাগুলো সম্পর্কে জানলাম সেগুলো একইভাবে শিক্ষা, শিল্প, বিনোদন, খাদ্য সহ আরো বিভিন্ন দৈনন্দিন বিষয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমরা যদি পারমার্থিক জীবনে ঐকান্তিকভাবে প্রগতি সাধন করতে চাই তবে আমাদের অবশ্যই দৈনন্দিন জীবনে পারমার্থিক সংস্কৃতির মাঝে থাকতে হবে। এগুলোই আমাদের পারমার্থিক দর্শন ও আদর্শ সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। যদি আমরা জাগতিক তথাকথিত সংস্কৃতির প্রভাবকে আমাদের জীবনে আশ্রয় দিই তবে সেই তথাকথিত সংস্কৃতির দর্শন বলবৎ হবে অথচ এই দর্শনই আমরা পরিত্যাগ করতে চাই। এভাবে জাগতিক সংস্কৃতি আমাদের পারমার্থিক প্রগতিকে ব্যতিগ্রস্থ করবে।
লেখক পরিচিতি: শ্রীমতি দেবকী দেবী দাসী ১৯৫৮ সালে জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং এরপর দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর ১৯৮৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার সিউনিতে ইস্কনের সান্নিধ্য লাভ করেন। তিনি বছরের ৬ মাস ভারত ও বাংলাদেশে প্রচার করেন এবং বাকী ৬ মাস পশ্চিম ইউরোপ, ইউক্রেন ও মালডোবাতে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার করে থাকেন। ইতোপূর্বে তিনি নেপাল বাংলাদেশের বিভিন্ন কৃষ্ণভাবনার প্রজেক্ট ও তীর্থস্থান উন্নয়নের জন্য সারা বিশ্ব থেকে তহবিল সংগ্রহ করেন। বেশ কয়েক বছর তিনি জিবিসি কমিটি ফর ডেভোটি কেয়ারের একজন নিবেদিত সদস্য হিসেবেও সেবা করেন। ২০১৪ সালের মার্চে দ্যা ইনস্টিটিউট ফর স্পিরিচুয়াল ক্যালচার প্রতিষ্ঠা করেন ।
ব্যাক টু গডহেড, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৮ হতে প্রকাশিত