প্লেটোর দর্শন

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২১ | ৭:০৯ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২১ | ৮:৫৫ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 532 বার দেখা হয়েছে

প্লেটোর দর্শন
শ্রীল প্রভুপাদের সঙ্গে কথােপকথন
 
পাশ্চাত্যের প্রাচীন দার্শনিক জগতে প্লেটো ছিলেন সবচেয়ে সৃজনশীল ও প্রভাবশালী চিন্তাবিদ। তিনি ছিলেন সক্রেটিসের অন্যতম শিষ্য এবং Academy in Athens -এর প্রতিষ্ঠাতা। যেটি প্রতিষ্ঠিত হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৭ সালে। শুরু হতে প্রায় সহস্র বৎসরকাল অতিক্রম করে বর্তমানে এটি ইউরােপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসেবে পরিগণিত। এখানে আমরা প্লেটোর নির্দেশিত আদর্শ ও পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত ভগবদ্গীতার নির্দেশনার মধ্যে অদ্ভুত মিল দেখতে পাই। কিন্তু প্রভুপাদ সেক্ষেত্রে একটি বিষয় উন্মােচন করেছেন যে, প্লেটো তাঁর শিক্ষায় আত্মার ধারণা দিয়েছিলেন সেই সাথে ধারণা দিয়েছিলেন শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কেও।

শিষ্য : প্লেটো রাজনৈতিক তত্ত্বের ওপর ব্যাপক কাজ করে গেছেন। তিনি লিখেছিলেন- একটি সমাজ তখনই উন্নতি ও ছন্দময় প্রগতি উপভােগ করতে পারে যখন সমাজ তার অন্তর্ভুক্ত লােক। সম্পদকে তাদের প্রাকৃতিক (স্বাভাবিক) কর্মদক্ষতা অনুসারে প্রতিস্থাপন করে। তিনি মনে করতেন মানুষের উচিত তাদের স্বাভাবিক কর্মদক্ষতা খুঁজে বের করা এবং তাদের সেই কর্মদক্ষতার পূর্ণরূপে ব্যবহার করা। সেটি প্রশাসকরূপে হােক, সামরিক শ্রেণি রূপে হােক বা ব্যবসায়ী শ্রেণি রূপে হােক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সমাজের কখনাে সাধারণ (অতি ভালও নয় মন্দও নয়) ব্যক্তি দ্বারা পরিচালনা হওয়া উচিত নয় তৎপরিবর্তে সমাজের সর্বোচ্চ জ্ঞানী ও ভাল দার্শনিক রাজা বা জ্ঞানী ও ভাল শ্রেণির একটি দলের দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত।

শ্রীল প্রভুপাদ : এই ধারণা বহু পূর্বেই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় লিপিবদ্ধ ছিল। এখানে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, একটি আদর্শ সমাজে চারটি শ্রেণি থাকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এই শ্রেণিবিভাগ সৃষ্টি হয় প্রকৃতির গুণের প্রভাবের দ্বারা। প্রত্যেকেই সেটি মানবসমাজ হােক অথবা পশুসমাজ প্রত্যেকেই সত্ত্ব, রজো, তমাে নামক তিনটি গুণের দ্বারা প্রভাবিত। বৈজ্ঞানিকভাবে এই সকল গুণ বিবেচনায় এনে কর্মীবৃন্দের শ্রেণিবিভাগ করে তাদের সামর্থ্য, গুণ ও কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগানাে হলে সেই সমাজ আদর্শ সমাজ হিসেবে পরিগণিত হয়। কিন্তু একজন তমােগুণ অর্থাৎ যে ব্যক্তি অজ্ঞতার দ্বারা আচ্ছাদিত তাকে দার্শনিক বা চিন্তাবিদের একটি পদে নিয়ােগ দেয়া হলে অথবা এক দার্শনিক বা চিন্তাবিদকে সাধারণ শ্রমিক বা কায়িক শ্রমে নিয়ােজিত করলে সেই সমাজে উন্নয়ন কীভাবে আশাপ্রদ হতে পারে?

ভগবদগীতায় সর্বোচ্চ বুদ্ধিমান শ্রেণি হচ্ছে ব্রাহ্মণরা। তারা সর্বদা অপ্রাকৃত জ্ঞান ও দর্শনের প্রতি লালায়িত। তাই তাদেরকে সর্বোচ্চ পদ দান করা হয়েছে। তাঁদের আদেশ-নির্দেশ অনুসারে ক্ষত্রিয়দের কর্মসম্পাদন করা উচিত। যেমন একজন প্রশাসকের দায়িত্ব হচ্ছে বুদ্ধিমান শ্রেণি কর্তৃক প্রণীত আইনের শাসন যাতে ব্যাহত না হয় সেই উদ্দেশ্যে কর্মসম্পাদন করা। এদের পরের শ্রেণিটি হচ্ছে বৈশ্য। এদের আমরা উৎপাদক শ্রেণিও বলতে পারি। এরা উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, গাে প্রতিপালন ও গাে- প্রতিরক্ষার কাজ করে থাকে। আরেকটি, শ্রেণি রয়েছে যারা কায়িকভাবে শ্রম প্রদান করে অন্যান্য শ্রেণিকে সহায়তা করে। তাদের বলা হয় শূদ্র। এই হচ্ছে বৈদিক সভ্যতা যেখানে রয়েছে। সরল জীবন, কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও গাে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। যদি, তােমার, পর্যাপ্ত পরিমাণ দুগ্ধ, শষ্য, ফল ও সবজি থাকে তাহলেই তুমি খুব সুন্দরভাবে জীবন অতিবাহিত করতে পারবে। শ্রীমদ্ভাগবত, সমাজের এটি, চারটি শ্রেণিকে শরীরের চারটি অঙ্গের সাথে তুলনা করা হয়েছে। ১ম শ্রেণি মস্তক, ২য় শ্রেণি বাহু, ৩য় শ্রেণি উদর এবং ৪র্থ শ্রেণি পদদ্বয়। সমস্ত অঙ্গের সম্মিলিত ক্রিয়া ও সহযােগিতায় শরীর যেমন সুঠাম ও সুন্দর রূপ লাভ করে থাকে তেমনি বিভিন্ন শ্রেণিসমূহ উচ্চতর শ্রেণি অর্থাৎ ব্রাহ্মণের নেতৃত্বে ও নির্দেশনার সহযােগিতাপরায়ণ হয়ে আদর্শ সমাজ গঠন করে। ব্রাহ্মণ কুখনাে রাজনৈতিক বিষয়ে অথবা প্রশাসনিক বিষয়ে আগ্রহী নন। তিনি প্রয়ােজনে উপদেশ দান করেন এক্ষেত্রে কখনাে জড়িত হন না, কেননা তার উচ্চতর কর্তব্য রয়েছে। বর্তমানে কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন সেই ব্রাহ্মণ শ্রেণি তৈরি ও প্রশিক্ষণের কাজ করছে। সেক্ষেত্রে প্রশাসক শ্রেণি যদি আমাদের উপদেশ গ্রহণ করে এবং রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে কৃষ্ণভাবনামৃত পথে পরিচালনা করে তবে সারাবিশ্বেই একটি আদর্শ সমাজ গঠিত হতে পারে।

শিষ্য : কীভাবে অধুনা সমাজ ব্যবস্থাকে আপনি বৈদিক সমাজ ব্যবস্থার আদর্শ হতে পৃথক বলে মনে করছেন?
 
প্রভুপাদ : এখন বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় শুরু হয়েছে ব্যাপক মাত্রার শিল্পায়ন। যার অর্থ এক ব্যক্তিকে অপর ব্যক্তি কর্তৃক শােষণ। যার অর্থ দুর্বল ব্যক্তিকে সবল ব্যক্তির শােষণ। এই শিল্পায়ন বৈদিক সভ্যতায় দেখা যেত না। ভালভাবে বললে এর কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। কিন্তু বর্তমানে এই শিল্পায়নের সাথে যােগ হয়েছে কসাইখানা এবং মাংস খাওয়ার কুপ্রবৃত্তিও। যেটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও অসভ্যতাপূর্ণ। এটিকে মানবসভ্যতা বলা যায় না। বৈদিক সভ্যতায় যখন একজন রাজা রাজ্য শাসনের অনুপযুক্ত হতেন তখন সাথে সাথে প্রত্যাখ্যান করা হয়ে তাকে। যেমন একদা রাজা বীণা অনুপযুক্ত রাজা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিলেন। কারণ তিনি স্বপ্রণােদিত হয়ে যথেচ্ছ পশুপাখি শিকারে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। অবশ্যই ক্ষত্রিয়দের শিকার করার অধিকার রয়েছে কিন্তু কখনাে যথেচ্ছভাবে নয়। কখনােই অপ্রয়ােজনীয়ভাবে বা ইন্দ্রিয়তৃপ্তির উদ্দেশ্যে পশুপাখি হত্যার অনুমােদন দেয়া হয়নি। সেসময় রাজা বীণা ও বর্তমান লােকেদের মত ইন্দ্রিয়তৃপ্তির জন্য পশুপাখি হত্যায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। তখন রাজ্যের বুদ্ধিমান শ্রেণি ব্রাহ্মণরা এ বিষয়ে নিন্দা জ্ঞাপন করেন এবং রাজাকে অভিশাপ দিয়ে হত্যা করেন। আগে ব্রাহ্মণ শ্রেণি অত্যন্ত ক্ষমতাবান ছিলেন শুধুমাত্র অভিশাপ প্রদানের মাধ্যমে তারা যে কাউকে হত্যা করতে পারতেন। তাদের এই সব অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল না। বর্তমানে সমাজের 1. মস্তকটিই (ব্রাহ্মণ) বিলুপ্ত প্রায়। ফলে এটি মৃত শরীর বা মৃত সমাজ। মস্তক শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন প্রচেষ্টা করছে উপযুক্ত ব্রাহ্মণ সৃষ্টি করতে যাতে করে সমাজের সেই মাথাটি পুনঃস্থাপিত হয়। যদি সেটি পুনঃস্থাপন করা হয় তাহলে প্রশাসক শ্রেণি উপযুক্ত ব্রাহ্মণ বা ঈশ্বরভাবনাময় দার্শনিক তাত্ত্বিক ব্যক্তিদের আদেশ নির্দেশ অনুসারে সুন্দরভাবে সমাজ পরিচালনা করতে সমর্থ হবে। একজন ঈশ্বরভাবনাময় ব্রাহ্মণ কখনাে কসাইখানা খােলার ব্যাপারে উপদেশ দান করবে না। কিন্তু বর্তমানে গর্দভ: রাজ্যসরকার কসাইখানা খােলার অনুমােদন দান করছে। যখন পরীক্ষিৎ মহারাজ দেখলেন একজন নির্দয় ব্যক্তি একটি গাভিকে হত্যার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তখন সাথে সাথে পরীক্ষিৎ মহারাজ ঐ পাষণ্ড ব্যক্তিকে তার তলােয়ার দিয়ে হত্যা করতে উদ্ধত হন। তাকে প্রশ্ন করে কে. তুমি? কেনই বা গাভিকে হত্যা করতে চাইছ? তিনি ছিলেন সত্যিকার রাজা। বর্তমান সময়ে অযােগ্য ব্যক্তিরা রাষ্ট্রপ্রধানের পদ দখল করে আছে। যদিও তারা নিজেদের ধার্মিক বলে জাহির করতে চায় তথাপিও তারা গর্দভ ছাড়া অন্য কিছুই নয়। কেন? কেননা তাদের নাকের ডগায় হাজার হাজার গাভিকে হত্যা করা হচ্ছে। যদিও রাষ্ট্র তাদের ভাল সম্মানি দিচ্ছে। রাজ্য সরকারের শাসনব্যবস্থায় গাে-হত্যার উদ্দেশ্যে যদি কসাইখানা খােলে তবে রাজ্য সরকারের উচিত তার প্রতিবাদ করা। অন্যথায় তার পদ হতে পদত্যাগ করা। যতদিন পর্যন্ত লােকে অবগত হবে না যে প্রশাসকরা নিজেরাই গর্দভ। ততদিনই তারা এই ধরনের দুর্ভোগ পেতে থাকবে। আবার এই সমস্ত লােকেরাও গর্দভ কেননা তারা ভােটের মাধ্যমে আরাে বড় গর্দভদের নির্বাচিত করছে। প্লেটোর দর্শন হচ্ছে যে, সরকারকে আদর্শ রূপে পরিগণিত হওয়া উচিত। এটিই হচ্ছে আদর্শ যে কৃষ্ণভাবনাময় মনস্তত্ত্ববিদ ও দার্শনিকরা রাষ্ট্রের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত থাকবে এবং তাদের মন্ত্রণ বা উপদেশ অনুসারে রাজ্য সরকার শাসন করা। রাজ্য সরকারের দ্বারা প্রতিরক্ষা প্রাপ্ত হয়ে ট্ৎগাদক শ্রেণি বুদ্ধিভিত্তিক উপায়ে উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও গাে-প্রতিরক্ষা পালন করে সমাজের বিভিন্ন উপযোগ ও প্রযােজন পূরণ করবে এবং শ্রমিকশ্রেণি এ ব্যবস্থায় তাদের সাহায্য করবে। এই হচ্ছে বৈজ্ঞানিক সমাজ শ্রেণিবিভাগকরণ যেটি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (৪.১৩) বর্ণনা করেছেন।
চাতুর্বর্ণং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্॥
“প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি মানবসমাজে চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি। আমি এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।
 
শিষ্য : প্লেটো ও সামাজিক শ্রেণিবিভাগটি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তিনি অবশ্য তিনটি শ্রেণির কথা বর্ণনা করেছেন। সেক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণিটি হল অভিভাবক শ্রেণি যারা সমাজের অভিভাবক সমাজে নেতৃত্ব দান করে অপরটি হচ্ছে যােদ্ধা শ্রেণি তারা অত্যন্ত সাহসী। তারা সমাজকে এ প্রতিরক্ষা দান করে। অপরটি, শিল্প শ্রেণি। তারা তাদের সেবা ও কর্মের দ্বারা সমাজকে প্রয়ােজন নিবৃত্ত ও পরিতৃপ্তি প্রদান করে।
 
প্রভুপাদ : সমাজে এই ভিন্ন ধরনের শ্রেণিও রয়েছে। ১ম শ্রেণির: ব্যক্তি সত্ত্বগুণী তিনি ধর্মকর্মে উৎসাহী, ভদ্র ও মার্জিত। ২য় শ্রেণিটি রজোগুণী তারা সাহসী ও তেজোদীপ্ত। অপর শ্রেণিটি তমােগুণী। তাদের জ্ঞান অজ্ঞতা দ্বারা আচ্ছাদিত।
 
শিষ্য : প্লেটোর পর্যবেক্ষণের ভিত্তি নি্ণীত সামাজিক শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে তার অভিমত হল মানুষের তিনটি আন্তব্যক্তিক গুণ রয়েছে বুদ্ধিমত্তা, সাহস ও স্পৃহা। তিনি বলেছিলেন আত্মার এই তিনটি গুণ রয়েছে।
 
প্রভুপাদ : এটি ভুল। আত্মার কোনাে জড়জাগতিক গুণ নেই। আত্মা বিশুদ্ধ । কিন্তু যেহেতু জড়া প্রকৃতি গুণের সংস্পর্শে আসার ফলে সে পােশাকরূপ বিভিন্ন শরীর ধারণ করে। কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই পােশাকরূপ জড় আবরণ দূর করা। আমাদের প্রথম নির্দেশনা হচ্ছে তুমি’ এই শরীর নও। এটি মনে হয় যে, প্লেটো শরীর দ্বারা আচ্ছাদিত আত্মাকে বুঝতে পেরেছিলেন।
 
শিষ্য : প্লেটো বিশ্বাস করতেন মানুষের অবস্থান হচ্ছে জড় ও আত্মা এই দুটির মাঝামাঝি অবস্থা। তাই তিনি শারীরিক উন্নয়নের ব্যাপারে গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন। তিনি মনে করতেন সকালে শৈশব অবস্থা হতে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত এবং শরীরচর্চাকেও শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যাতে শরীর সুঠাম থাকে।
 
প্রভুপাদ : তার মানে ব্যবহারিকভাবে প্লেটো দৃঢ়ভাবে নিজেকে শরীর হিসেবে মনে করতেন। প্লেটোর শিক্ষার ধারণা কি রকম ছিল?
 
শিষ্য : ছাত্রদের প্রাকৃতিক অবস্থান জাগ্রত করা। যার যে প্রতিভা, দক্ষতা, মেধা রয়েছে তা উন্মোচন করা।
 
প্রভুপাদ : তাহলে প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক অবস্থাটা কি?
 
শিষ্য : সৎ ও নৈতিক অবস্থান, অন্য কথায় প্লেটো মনে করতেন সকলের উচিত সুশিক্ষিত হয়ে এমনভাবে কর্মসম্পাদন করা সেটি যে পন্থাতেই হােক সেটি যেন স্বাভাবিক নৈতিক মূল্যবােধকে জাগ্রত করে ।
 
প্রভুপাদ : কিন্তু নৈতিক মূল্যবােধই যথেষ্ট নয়। কেননা সাধারণ মূল্যবােধতাে আত্মাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে না। অবশ্য এই জড়জগতে সাধারণ নৈতিকতাগুলাে সর্বোচ্চ নীতি হিসেবে গৃহীত হয়। কিন্তু এখানে অন্য একটি অবস্থা রয়েছে যেটিকে বলা হয় অপ্রাকৃত অবস্থা (বাসুদেব স্থিতি)। মানুষের সর্বোচ্চ পূর্ণতা এই স্তরেই নিহিত এবং ভাগবতম এই বিষয়টিই নিশ্চিত করছে।
যাহােক যেহেতু পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মধ্যে বাসুদেব অবস্থা সম্পর্কে কোনাে জ্ঞান নেই, তাই তারা নৈতিকভাবে ভালগুণগুলােকেই উচ্চস্তরীয় নৈতিক অবস্থা মনে করে থাকে। কিন্তু এই ভাল গুণ বা সত্ত্বগুণটিও এই জড়জগতে নিম্নস্তরীয়গুণ বা রজো ও তমােগুণের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। তুমি এখানে সর্বোত্তম ভাল গুণ বা শুদ্ধ সত্ত্ব খুঁজে পাবে না। শুদ্ধসত্ত্ব অবস্থা হচ্ছে। অপ্রাকৃত অবস্থা। যেটি আদর্শ অবস্থা। এটি পালনে তপশ্চর্যা অবলম্বন করতে হয় (তপস্য ব্রহ্মচর্যে শমেন চ দমেন চ)। এক্ষেত্রে একজন ব্যক্তিকে ইন্দ্রিয়, মনের তপশ্চর্যা ও নিয়ন্ত্রণ শিক্ষা অনুশীলন করতে হয়। যদি কারাে অঢেল অর্থ থাকে তবে সমাজসেবায় ব্যয় করতে হয়। সে সাথে কায়, মন, বাক্যে পরিচ্ছন্ন হতে হয় এভাবে একজন ব্যক্তি পর্যায়ক্রমে শুদ্ধসত্ত্ব অবস্থায় উত্তীর্ণ হতে থাকে। এই শুদ্ধসত্ত্ব অবস্থায় উত্তীর্ণ হবার অপর একটি পন্থা আছে। সেটি হচ্ছে যদি কেউ কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করে তবে সকল ভাল গুণগুলাে স্বাভাবিকভাবে তার মধ্যে বর্ধিত হতে থাকবে। স্বাভাবিকভাবেই সে তপশ্চর্যাপূর্ণ জীবন পরিচালনায় সমর্থ হবে। তার মন ইন্দ্রিয়সমূহকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হবে। জনহিতকর কাজে ব্রতী হবে। এই কলিযুগে, জনসাধারণের মধ্যে তপশ্চর্যার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার উৎসাহ নেই। পূর্বে একজন ব্রহ্মচারীকে অবশ্যই তপশ্চর্যা শিক্ষা করতে হতাে। এমনকি সে রাজকীয় পরিবার হতে আসুক বা শিক্ষিত পরিবার হতে আসুক পারমার্থিক গুরুর নিকট একজন ব্রহ্মচারী নিজেকে অত্যন্ত বিনয়ী ও সেবকরূপে স্বীকার করত। গুরুর আদেশ শিরােধার্য করে যেকোনাে কাজ করতে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকত। ব্রহ্মচারী গুরুর জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে ভিক্ষা সংগ্রহ করত। নিজের জন্য কিছুই চাইত না। কারণ তখন পারমার্থিক গুরুরা সেই সমস্ত ভিক্ষার্জিত অর্থ নিজেদের ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য ব্যবহার করতেন না, বরং তারা সকলে কৃষ্ণের কাজে ব্যবহার করতেন। এটিই হচ্ছে তপশ্চর্যা। এখানেও ব্রহ্মচারী তপশ্চর্যা পরিলক্ষণ করতে পারে। কেননা তারা পারমার্থিক গুরুর নির্দেশ প্রতিপালন করায় তাদের মন এবং ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রিত।
বর্তমানে তপশ্চর্যা অত্যন্ত কঠিন। তাই মহাপ্রভু কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণের পন্থাটি প্রত্যক্ষভাবে দিয়ে গেছেন। এই প্রক্রিয়ায় একজন ব্যক্তিকে শুধু সরলভাবে “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে এই মহামন্ত্রটি জপ করতে হবে এবং পারমার্থিক গুরুর নির্দেশিত কিছু বিধিমালা অনুসরণ করতে হবে। তাহলেই সে অতি দ্রুত শুদ্ধসত্ত্ব অবস্থানে স্থিত হতে পারবে ।
 
শিষ্য : প্লেটো মনে করতেন রাষ্ট্রের উচিত নাগরিকদের বহুমুখী শিক্ষায় পারদর্শী করে তােলা তার শিক্ষাদানের প্রক্রিয়াটি ছিল ঠিক এরকম। জীবনের প্রথম তিন বছর শিশুরা খেলবে এবং শারীরিকভাবে শক্তিশালী হবে। তিন থেকে ছয় বছর বয়স পর্যন্ত তারা ধর্মীয় উপাখ্যান ও শিক্ষা লাভ করবে। সাত হতে দশ বছর বয়স পর্যন্ত শরীরচর্চা প্রশিক্ষণ নেবে। দশ হতে তের বছর বয়স পর্যন্ত পড়ালেখা করবে। চৌদ্দ হতে মােল বছর বয়স পর্যন্ত কবিতা ও সঙ্গীতচর্চা প্রশিক্ষণ নেবে। জেল হতে আঠার বছর পর্যন্ত গণিত শিক্ষা নেবে। আঠার হতে বিশ বছর তারা সামরিক প্রশিক্ষণ নেবে। বিশ বছর হতে পঁয়ত্রিশ বছর পর্যন্ত যারা বিজ্ঞান ও দার্শনিক বিদ্যায় পারদর্শী তারা বিদ্যালয়ে অবস্থানপূর্বক তাদের শিক্ষা চালিয়ে যাবে এবং যােদ্ধাদের সামরিক পেশায় যুক্ত হয়ে যুদ্ধবিদ্যা অনুশীলন করতে হবে ।
 
প্রভুপাদ : এই শিক্ষাপদ্ধতি কি সকলের জন্য প্রযােজ্য? নাকি ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির জন্য ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাপদ্ধতি প্রযােজ্য?
 
শিষ্য : না, এটি সবার জন্য প্রযােজ্য। একমত পােষণ করতে পারি না। পারমার্থিক গুরু শিষ্যের আগ্রহ ও দক্ষতা বিবেচনায় এনে তাদের শিক্ষা দান শুরু করবেন। তার অবশ্যই এই ধরনের বােধগম্যতার সক্ষমতা থাকতে হবে যে, এই বালকটি কোন শিক্ষার জন্য উপযুক্ত? সে কি সামরিক প্রশিক্ষণের উপযুক্ত? প্রশাসনিক কাজে উপযুক্ত নাকি দার্শনিক শিক্ষায় উপযুক্ত এবং অতঃপর তিনি ছাত্রের দক্ষতা, প্রতিভা ও সক্ষমতা অনুসারে উপযুক্ত শিক্ষা প্রদানে সচেষ্ট হবে। যে ছাত্রের মধ্যে দার্শনিক শিক্ষা গ্রহণের সক্ষমতা রয়েছে কেন সে সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করে দুই বছর অপচয় করবে? কেন সে অন্যান্য বিষয়গুলাে নিয়ে সময় অপচয় করবে? অর্জুন ক্ষত্রিয় পরিবার হতে এসেছিলেন, তাই তিনি এবং তার ভাইদের কখনাে দর্শন শিক্ষা দেননি তাদের গুরু। তাদের শিক্ষক দ্রোনাচার্য একজন ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাদের ধনুর্বেদ (সামরিক শিক্ষা)………..
 
প্রভুপাদ : এটি খুব ভাল ব্যবস্থা নয়। যদি কোনাে ছেলে তাত্ত্বিক ও দার্শনিক বিদ্যায় পারদর্শী হয় তবে সে কেন সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে যাবে?
 
শিষ্য : হ্যাঁ। প্লেটো বলেছেন, প্রত্যেকেরই অন্তত দুই বছর সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
 
প্রভুপাদ : এটি খুব ভাল ব্যবস্থা নয়। যদি কোনাে ছেলে তাত্ত্বিক ও দার্শনিক বিদ্যায় পারদর্শী হয় তবে সে কেন সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে যাবে?
 
শিষ্য : হ্যাঁ। প্লেটো বলেছেন, প্রত্যেকেরই অন্তত দুই বছর সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
প্রভুপাদ : কিন্তু কিছু ব্যক্তিকে তাদের জীবনের দুটি বছর অপচয় করতে হবে যেখানে জীবনের দুটি দিনও অপচয় করা উচিত নয় এটি অবান্তর ও অসম্পূর্ণ ধারণা।
 
শিষ্য : প্লেটো বলতেন এভাবে বিভিন্ন কলায় শিক্ষা দানের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি কোন বিশেষ কলাতে দক্ষ সেটি জানা যাবে। তার একটি সঠিক ধারণা ছিল যে, ব্যক্তির মধ্যে কোনাে না কোনাে বিষয়ে ভাল ও পরিপূর্ণ দক্ষতা রয়েছে।
 
প্রভুপাদ : হ্যাঁ এবং আমরাও সেটা বলছি। কিন্তু সেজন্য সবাইকে একই ধরনের প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করতে হবে এই প্রক্রিয়ার সাথে আমরা যদি তার গুণ ব্রাহ্মণের মতাে হয়। পারমার্থিক গুরুর সে ব্যাপারে অত্যন্ত দক্ষ হতে হবে, যাতে তিনি শিষ্যের সেই প্রতিভা খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী তাকে দ্রুত প্রশিক্ষিত করতে পারেন। এটিই হচ্ছে পরিপূর্ণ শিক্ষা।
 
শিষ্য : প্লেটো বিশ্বাস করতেন সকল শিক্ষা অনুশীলন না করালে একজন ব্যক্তি সর্বোত্তম দক্ষতা কোনােটিতে রয়েছে সেটা বেরিয়ে আসবে না।
 
প্রভুপাদ : না, এটি ভুল। কারণ আত্মা যেহেতু চলমান (পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করে) তাই সে তার প্রতিভাগুলাে পূর্বজন্ম হতে প্রাপ্ত হয়।
আমার মনে হয়, প্লেটো আত্মার দেহ হতে দেহান্তরের প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবগত ছিলেন না। বৈদিক সংস্কৃতি অনুসারে জন্মের পর জ্যোতিষী একটি শিশুর কুষ্ঠি গণনা করা উচিত যে, সে কোন শ্রেণি হতে এসেছে। কুষ্ঠি গণনা যদি ভাল একজন জ্যোতিষী দ্বারা গণনা করা হয় তবে তিনি বলতে পারেন শিশুটি কোন শ্রেণি হতে এসেছে এবং কীভাবে তাকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। প্লেটোর ধারণাটি অসম্পূর্ন । কেননা সেটি জল্পনা-কল্পনাকে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। তিনি ব্রহ্মবিদ্যা দেননি। ব্রহ্মবিদ্যা হচ্ছে দার্শনিক শিক্ষা, একজন ব্যক্তি সকল কিছুরই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা উচিত নয়। এটি সময়ের অপচয় মাত্র। যদি কারাে উৎপাদনমুখী ব্যবসা বা কৃষিকাজে আগ্রহ থাকে তবে তাকে সে শিক্ষায় শিক্ষিত করা উচিত। কারাে দার্শনিক বিদ্যা দেওয়া উচিত। কেউ যদি সামরিক শিক্ষায় আগ্রহী হয় তবে তাকে সামরিক শিক্ষা দেয়া উচিত এবং কারাে সাধারণ গুণ থাকলে সে শূদ্র অথবা শ্রমজীবী হিসেবে থাকতে পারে। শ্রীমদ্ভাগবতমে নারদমুনি বলছেন, সমাজের চারটি শ্রেণিকে তাদের প্রতিভা ও গুণ অনুসারে স্বীকৃত করা হয়েছে। তিনি বলছেন, তাদের সেই বিশেষ গুণ ও প্রতিভা অনুসারে তাদের প্রশিক্ষিত করা উচিত। এমনকি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তি শূদ্র হিসেবে পরিগণিত হতে পারে যদি তার গুণটি ও আচরণ শূদ্রের মতাে হয়। আবার শূদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তি ব্রাহ্মণ হিসেবে গণ্য হতে পারেন।
 
 
ত্রৈমাসিক ব্যাক টু গডহেড, এপ্রিল-জুন ২০১৩

 

 

 

 

 

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।