প্রণাম নিবেদন সনাতন ধর্মের একটি প্রাচীন সংস্কৃতি। তা সত্ত্বেও প্রণাম কীভাবে নিবেদন করতে হয় কিংবা কোন ধরনের প্রণাম বৈদিক শাস্ত্রে অনুমোদিত সে সম্পর্কে আমরা অনেকেই অবগত নই। প্রণাম নিবেদন কী ও এর তাৎপর্য, প্রার্থনা সহযোগে প্রণাম এবং অনুমোদিত প্রণামের শাস্ত্রীয় দৃষ্টান্ত ও তার সুফল কী?
উর্মিলা দেবী দাসী
শরণাগতি, আত্মসমর্পণ এ শব্দগুলোর মাধ্যমে হয়তো ভেসে উঠছে কোনো যুদ্ধ অথবা আগ্রাসী কোনো পরিস্থিতি, যেখানে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলটি, অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী দলের আসন্ন বিজয়লগ্নে দুঃখ বা হতাশ হয়ে এ প্রকার নিবেদন করছে। মনের মধ্যে দৃশ্যপটের এ প্রতিচ্ছবি নিয়ে আমরা হয়তো ভয়ে কুঞ্চিত হই যখন আমরা ভগবদ্গীতায় পড়ি যে, আমাদের অবশ্যই কৃষ্ণ শরণাগত হতে হবে। শরণাগতি বিষয়ে আমাদের সংশয় বা দ্বিধাগুলি হয়তো বেড়ে যেতে পারে, যখন আমরা ভক্তদেরকে ভগবানের সম্মুখে দণ্ডবৎ নিবেদনের মাধ্যমে শরণাগতির দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে দেখি। কিন্তু যখন পবিত্র বৈদিক শাস্ত্র থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন দৃষ্টান্তের মাধ্যমে জল সিঞ্চন করা হয়, তখন প্রণতি নিবেদন সম্পর্কিত যে শক্ত কুঁড়ি আমরা সংরক্ষণ করে রেখেছি তার উন্মেষ ঘটে এবং তখন সেটি নরম, সুগন্ধিময়, মনোহর গোলাপ হিসেবে প্রকাশিত হবে যা দণ্ডবৎ নিবেদন বিষয়ক এই পারমার্থিক অনুশীলনের ক্ষেত্রে গভীর প্রসন্নতা যোগাবে। একটি সংস্কৃত শব্দে শ্রীল প্রভুপাদ ‘শরণাগতি’ (Surrender) শব্দটির অনুবাদ করেছেন ‘প্রপদ্যতে’, যার আক্ষরিক অর্থ “নিজেকে কারো চরণে সঁপে দেওয়া।”
পরম পারমার্থিক উপলব্ধি গড়ে উঠে তখনই যখন নিজেকে পরমেশ্বর ভগবানের নিত্য ও অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে, তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ বা আত্মনিবেদন করা হয়। নিজেকে এভাবে নিবেদন করা, বা তার শরণাগত হওয়ার ব্যাপারটি অনেকটা মায়ের প্রতি একটি শিশুর ভক্তি প্রদর্শনের মতো। মা ও সন্তানের মধ্যকার একটি সুসম্পর্কের মধ্যে সন্তান স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাস করে যে, তার মায়ের মনে তার প্রতি সর্বশ্রেষ্ঠ আগ্রহ রয়েছে।
পরম পূর্ণ, পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি আত্মনিবেদন বা শরণাগতি ইচ্ছার বলি দান নয়, বরং এটি একটি স্বপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত যে, “কৃষ্ণ নৃত্যের সঙ্গে যথাযথভাবে সাড়া দেওয়া”। পক্ষান্তরে স্বেচ্ছাচারী হয়ে নৃত্য করা নয়। শ্রীল প্রভুপাদ এ বিষয়ে লীলা পুরুষোত্তম গ্রন্থের ৩৩ অধ্যায়ে বলেছেন যে, সমগ্র জগত শ্রীকৃষ্ণের দিব্য সংগীতে পরিপূর্ণ। যে সমস্ত আত্মার প্রতিটি ভাবনা, শব্দ, গান ও নৃত্যের মত কৃষ্ণের সাথে ছন্দময়, তারা পরম শরণাগতি অর্জন করে এবং তাদের হৃদয় পরম চিন্ময় আনন্দে উদ্ভাসিত হয়। এমনকি জাগতিকভাবেও আমরা দেখি যে, ছন্দময় নৃত্য প্রদর্শন নৃত্যকারীদের যেমন আনন্দ বিধান করে, তেমনি দর্শকদেরও আনন্দ বিধান করে। নৃত্য দলে তখন প্রতিটি নৃত্যরত ব্যক্তি তাদের ব্যক্তিগত মেধা ও লাবণ্য দলগতভাবে প্রদর্শন করে। শ্রীকৃষ্ণের গানের প্রত্যুত্তরে তার নিকট আত্মসমপর্ণই ভক্তিযোগের চূড়া, যা ভগবানের সাথে প্রেমময়ী ভক্তির সঙ্গে সংযুক্ত।
শ্রীকৃষ্ণের সাথে ছন্দময় হওয়ার অনেক পন্থা রয়েছে। হরিভক্তিবিলাস (১১/৪১৭) গ্রন্থে শরণাগতির ৬টি ভাগ সম্পর্কে বলা হয়েছে; “শরণাগতির ছয় প্রকার লক্ষণ– কৃষ্ণভক্তির অনুকূল যা গ্রহণ করা, কৃষ্ণভক্তির প্রতিকূল বিষয় বর্জন করা, কৃষ্ণ সব সময়ই রক্ষা করবেন এই বিশ্বাস, শ্রীকৃষ্ণকে প্রভুরূপে গ্রহণ করা, সর্বতোভাবে শরণাগত হওয়া এবং দৈন্য।”
শরণাগতি দেহ, মন ও বাক্য প্রকাশের মাধ্যমেও প্রদর্শন করা যেতে পারে। শ্রীল প্রভুপাদ লীলা পুরুষোত্তম গ্রন্থে ১৪ অধ্যায়ে উদ্ধৃত করেছেন, “পরমেশ্বরের প্রতি সর্বোচ্চ শরণাগতি হল, দেহ, মন ও বাক্য দিয়ে তাঁর সেবায় নিযুক্ত হওয়া।” শরণাগত মনের কার্যকলাপ আরো শ্রেণিভুক্ত করা যেতে পারে; “শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তি লাভ করার জন্য তাঁর চিন্তা, অনুভূতি এবং ইচ্ছা তিনি (ভীষ্মদেব) ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরম সত্তায় নিবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন।”
(শ্রীমদ্ভাগবত ১/৯/৩২) তাৎপর্য)।
শরণাগতি প্রদর্শন
এক্ষেত্রে শরণাগতির সকল পন্থা প্রদর্শন করা যেতে পারে, দণ্ডবৎ প্রণতি নিবেদনের মত সরল অথবা সুগভীর দৈহিক আচরণ প্রদর্শনের মাধ্যমে: কৃষ্ণ বা তাঁর ভক্তদের সম্মুখে উপুর হয়ে শুয়ে দণ্ডবৎ নিবেদন করা। প্রভুপাদ ব্যাখ্যা করেন: ‘দণ্ড’ শব্দের অর্থ হচ্ছে লাঠি। শরীরের আটটি অঙ্গ দিয়ে প্রণতি নিবেদন করে কেউ যখন দণ্ডের মতো ভূপতিত হয়, তাকে বলা হয় দণ্ডবৎ। (চৈ. চ. (মধ্য) ১/৬৭ তাৎপর্য)
আটটি দৈহিক অংশ সম্পর্কে হরিভক্তিবিলাস গ্রন্থে (৮/১৬২) বলা হয়েছে,
দ্যোর্ভ্যাং পদ্ভ্যাঞ্চ জানুভ্যামুরসা শিরসা দৃশা।
মনসা বচসা চেতি প্ৰণামোঽষ্টাঙ্গ ঈরিতঃ॥
“বাহুযুগল, চরণযুগল, জানুযুগল, বক্ষঃ, শিরোদেশ, দৃষ্টি, মন ও বচন এই অষ্টাঙ্গ দ্বারা
প্রণতি অষ্টাঙ্গ শব্দে নির্দিষ্ট হয়েছে।”
নববিধা ভক্তির অন্যতম একটি পন্থা হল ‘বন্দনম’। এই বন্দনমের শ্রেণিবিভাগে দণ্ডবৎ রয়েছে। শ্রীল প্রভুপাদ লিখেছেন, “বন্দন অর্থ- প্রণতি বা প্রার্থনা নিবেদন।”
কারো শরীরের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদনের অন্য আরেকটি পন্থা রয়েছে যেখানে শরীরের পাঁচটি অংশ জড়িত, যেগুলো হল হাটুদ্বয়, বাহুদ্বয়, মস্তক, বুদ্ধি, মন ও বাক্য। (হরিভক্তিবিলাস ৪/৩৬১)।
বন্দনমের সবচেয়ে সরল পন্থাটি হল, অঞ্জলী মুদ্রা বা প্রণাম মুদ্রা, যেখানে ভক্ত দুই হাত ভাজ করে সামান্যভাবে মাথা নত করে।
স্বর সহযোগে বন্দনম্
বন্দনমের শ্রেণিবিভাগে যেমন দৈহিকভাবে বন্দনম্ রয়েছে, তেমনি স্বর দিয়ে বন্দনমও রয়েছে। স্বর দিয়ে বন্দনমের প্রথম ভাগটি হল অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে প্রার্থনা, যা নিম্নে উল্লেখ করা হয়েছে-
যুবতীনাং যথা যূনি যূনাং চ যুবতৌ যথা?
মনোহভিরমতে তদ্বন্ মনো মে রমতাং ত্বয়ি ॥
“যুবকদের দর্শনে যুবতীদের মন যেমন উৎফুল্ল হয় এবং যুবতীদের দর্শনে যুবকেরা যেমন উৎফুল্ল হয়, হে কৃষ্ণ! আমার মনও যেন শুধু তোমাতেই সেই রকম আনন্দ লাভ করে।” (বিষ্ণুপুরাণ ১/২০/১৯)
স্বর সহযোগে প্রার্থনার দ্বিতীয় ধরণটি হল বিনম্ৰতা প্রকাশ: “হে প্রভু, আমাদের চেয়ে অন্য কোনো পাপী আর নেই, আমাদের চেয়ে অন্য কোনো অপরাধী আর নেই। এমনকি যদি আমরা আমাদের কৃত পাপকর্মের কথা উল্লেখ করতে যাই তবে আমরা তৎক্ষণাৎ লজ্জিত অনুভব করি। তবে এ সমস্ত পাপকর্ম ত্যাগ করার আর কী কথা!” (পদ্ম পুরাণ, ভক্তিরসামৃত সিন্ধু গ্রন্থে উদ্ধৃত ১/২/১৫৪)
তৃতীয় প্রার্থনাটি যারা কৃষ্ণভাবনায় অগ্রজ তাঁদের জন্য উপযুক্ত। এই প্রার্থনায় প্রণতি নিবেদন যথাযথ সেবার নির্দিষ্ট অনুরোধের সাথে সম্বন্ধযুক্ত। যেমন, ভগবানের দিব্য অঙ্গে পাখা করা।
শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে দেহভঙ্গি সহযোগে বা দেহভঙ্গি ছাড়াও প্রার্থনা সরল তথা মার্জিত হতে পারে, যেমন মহামন্ত্রের ক্ষেত্রে: হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে। পরমেশ্বর ও তাঁর হ্লাদিনী শক্তির নাম উচ্চারণের মাধ্যমে এই ‘হরে কৃষ্ণ’ মহামন্ত্র হল ভগবানের কাছে প্রেমময়ী সেবার জন্য অনুরোধ জানানো।
উপরন্তু বা তার পরিবর্তে, উপরোল্লিখিত বিভিন্ন প্রার্থনাসমূহ ছাড়াও ভক্তরা গুরুদেবের উদ্দেশ্যে দৈহিক শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় প্রায়ই তাঁর মহিমা কীর্তনসূচক প্রার্থনা বলে থাকেন। দণ্ডবৎ নিবেদনের সময় আরেকটি সরল প্রার্থনা হল “হে ভগবান, অনুগ্রহপূর্বক আমার প্রতি কৃপাপরবশ হোন!” বলে প্রার্থনা করে তার উচিত দণ্ডের মতো সাষ্টাঙ্গ প্রণতি নিবেদন করা।” (শ্রীমদ্ভাগবত ১১/২৭/৪৫)
এরপর ভক্তের উচিত ভগবানের সম্মুখে দাঁড়িয়ে দুই হাত জোড় করে প্রার্থনা করা, “শ্রীবিগ্রহের চরণযুগলে মস্তক স্থাপন করে, সে তারপর করজোড়ে ভগবানের সম্মুখে দণ্ডায়মান হয়ে প্রার্থনা করবে, “হে ভগবান, আপনার প্রতি শরণাগত আমাকে অনুগ্রহ করে রক্ষা করুন। মৃত্যুর মুখ গহ্বরে দণ্ডায়মান আমি ভব সমুদ্রে পতিত হয়ে অত্যন্ত ভীত বোধ করছি।” (শ্রীমদ্ভাগবত ১১/২৭/৪৬)
দণ্ডবৎ, পূর্ণ প্রণতি নিবেদনের এই দৈহিক অভিব্যক্তি হল ভক্তিযোগের নকশাসূচক ও অনুভবযোগ্য স্মরণ যার মাধ্যমে ভগবানের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শিত হয় এবং এর মাধ্যমে ভক্তের হৃদয় প্রসন্ন হয়। যখন কৃষ্ণ দেখেন যে, ভক্ত দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদন করছে, তখন তার কোমল হৃদয় প্রসন্নতায় গলিত হয়। তখন ভগবান সেই ভক্তকে সর্বতোভাবে সুরক্ষা প্রদান করেন এবং ভয় থেকে পরিত্রান করে শান্তিপূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেন। যেটি তিনি ভগবদ্গীতায় (১৮/৬৬) প্রতিজ্ঞা করেছেন। ভক্তরা দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদনের মাধ্যমে শান্তি অনুভব করেন এবং ভগবানের প্রেমময়ী সেবায় নিজেকে উৎসর্গের জন্য প্রস্তুত হন। তাই ভক্তিযোগের পন্থা বিষয়ে নির্দেশনা প্রদানকালে কশ্যপ মুনি তাঁর পত্নীকে বলেন, “একশ আট বার মন্ত্র জপ করে প্রভুর মহিমা স্তব করবে, এবং তারপর ভগবানকে প্রদক্ষিণ করে আনন্দের সঙ্গে ভূমিতে দণ্ডবৎ প্রণতি নিবেদন করবে।” (শ্রীমদ্ভাগবত ৮/১৬/৪২)
একজন নারীর কিভাবে পুংসবন অনুষ্ঠান করা উচিত সে বিষয়ে বলতে গিয়ে শুকদেব গোস্বামী বলেন, “ভক্তিবিনম্র চিত্তে ভূমিতে দণ্ডবৎ প্রণাম করে দশবার সেই মন্ত্র জপ করতে হবে এবং তারপর নিম্নলিখিত স্তোত্রটি পাঠ করা উচিত।” (শ্রীমদ্ভাগবত ৬/১৯/১০)
শাস্ত্রীয় দৃষ্টান্ত
ভগবানকে দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদনের তাৎপর্যসূচক অনেক শাস্ত্রীয় দৃষ্টান্ত রয়েছে যেগুলো আমাদের এটি অনুশীলনের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা যোগাবে। প্রথম দৃষ্টান্তটি হল, কশ্যপ মুনির পত্নী দিতি। শত্রুদের ভয় এবং শত্রুদের শক্তিমত্তার প্রতি ঈর্ষা যখন তাঁকে গ্রাস করছিল তখন ভগবানকে দণ্ডবৎ, প্রার্থনা এবং পূজা নিবেদনের মাধ্যমে দিতি পবিত্র হয়েছিলেন এবং তিনি পূর্ণ শাস্তি অনুভব করেছিলেন। আরেকটি সুপ্রাচীন দৃষ্টাত্ত হলেন ধ্রুব মহারাজ, যিনি ভগবানকে দর্শনের উদ্দেশ্যে বনের মধ্যে কঠোর তপস্যা করেছিলেন। তখন তিনি একটি ছোট শিশু ছিলেন মাত্র। যখন ভগবান বিষ্ণু তার সম্মুখে আবির্ভূত হলেন, ধ্রুব মহারাজ পরম ভালোবাসায় ভগবানের প্রতি দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদন করেছিলেন। এরপর যখন তিনি উঠে দাঁড়ালেন, তখন তিনি, “ভগবানকে সম্মুখে দর্শন করে অত্যন্ত বিহ্বল হয়েছিলেন এবং শ্রদ্ধা সহকারে তাঁকে প্রণতি নিবেদন করেছিলেন। তাঁকে দণ্ডবৎ প্রণতি নিবেদন করে, তিনি ভগবৎ প্রেমে মগ্ন হয়েছিলেন। ধ্রুব মহারাজ ভাবাবিষ্ট হয়ে ভগবানকে এমনভাবে দর্শন করছিলেন, যেন তিনি তাঁর চক্ষু দ্বারা ভগবানের সৌন্দর্য পান করছিলেন, ভগবানের শ্রীপাদপদ্ম চুম্বন করে, তিনি তাঁর বাহুর দ্বারা তাঁকে আলিঙ্গন করেছিলেন।” (শ্রীমদ্ভাগবত ৪/৯/৩)
দেবী অদিতি ভগবানকে পূজা নিবেদনের পর তাঁকে দর্শন করলেন, ধ্রুবের মত তাঁরও অনুরূপ অভিব্যক্তি ছিল : “ভগবান যখন অদিতির নেত্রের গোচরীভূত হয়েছিলেন, অদিতি তখন দিব্য আনন্দে অভিভূত হয়ে সহসা উত্থিত হয়েছিলেন এবং তারপর দণ্ডবৎ ভূপতিত হয়ে ভগবানকে তাঁর সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করেছিলেন।”
“অদিতি ভগবানের স্তব করতে সমর্থ না হয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর নয়নযুগল তখন আনন্দাশ্রুতে পূর্ণ হয়েছিল, সারা দেহে রোমাঞ্চের সঞ্চার হতে লাগল এবং ভগবানের দর্শনজনিত গভীর আনন্দে তাঁর শরীর কম্পিত হতে লাগল।” (শ্রীমদ্ভাগবত ৮/১৭/৫-৬)
দ্বাপর যুগে কৃষ্ণের আবির্ভাবের সময়েও এ দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদনের অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। যখন ব্রহ্মা কৃষ্ণের মধুরতা ও ঐশ্বর্য দর্শন করলেন, তিনি তখন দণ্ডবৎ প্রণতি নিবেদন করেন এবং সে অবস্থায় তাকে একটি স্বর্ণদণ্ড পড়ে আছে বলে প্রতিভাত হচ্ছিল। তিনি তাঁর চতুর্মুখের মুকুট দিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্ম স্পর্শ করেন। অনেক দিব্য পুরুষ যারা দ্বারকা পরিদর্শনে এসেছিলেন, তারা ভগবানকে দর্শন করে দণ্ডবৎ নিবেদন করেন।
কৃষ্ণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সময় কালীয় নাগের পত্নীরা প্রথমে ভগবানের উদ্দেশ্যে দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদন করেছিলেন।
আরেকটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হলেন ষড় গোস্বামীদের অন্যতম সনাতন গোস্বামী, যিনি নিয়মিতই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদন করতেন। তখন তাঁর চর্মরোগের কারণে মহাপ্রভু একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে এভাবে প্রণাম করতেন। এই ঘটনায় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সনাতন গোস্বামীর বিনম্র শরণাগতিতে প্রসন্ন হয়ে তাঁকে আলিঙ্গন করেন এবং ঘোষনা করলেন যে, তিনি স্বর্গীয় সৌরভের ন্যয় আঘ্রান অনুভব করলেন।
ঐ আলিঙ্গনের পরে সনাতন গোস্বামী সুস্থ হয়ে গেলেন। সনাতন গোস্বামীর ভ্রাতা রূপ গোস্বামীও ভগবানকে নিয়মিত দণ্ডবৎ প্রণাম করতেন। এক পতিতা যখন হরিদাস ঠাকুরকে প্রলুব্ধ করতে ব্যর্থ হন, তখন তিনি দণ্ডবৎ প্রণামের মাধ্যমে হরিদাস ঠাকুরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। যদিও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু স্বয়ং কৃষ্ণ, তবুও তিনি তাঁর মাতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদন করতেন।
দক্ষিণ ভারতের শ্রীরঙ্গমের সুপ্রাচীন মন্দিরে খোদাইকৃত পাথরের ভাস্কর্যগুলোতেও এই দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদনের ব্যাপারটি দেখতে পাওয়া যায়। চৈতন্য চরিতামৃতে উল্লেখ আছে যে, “স্থানীয় গ্রামবাসীরা গোপাল বিগ্রহকে নিয়মিতই দণ্ডবৎ প্রণতি নিবেদন করতেন। শ্রীল প্রভুপাদও তাঁর শিষ্যদের দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদনের বিষয়টি শিখিয়েছিলেন। সে যেই হোক না কেন, ধনী-গরীব, নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ সকলে এই সহস্র সহস্র বছরের পন্থাটি আজও অনুশীলন করছে এবং এর মাধ্যমে সকলের হৃদয়ে সন্তুষ্টি লাভ করে। এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতের কিছু এলাকায় নারীরা বৈদিক শাস্ত্রানুসারে পূর্ণ দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদনের পরিবর্তে বরং আধুনিক স্থানীয় প্রথা অনুসারে শুধুমাত্র দেহের পাঁচটি অংশ ব্যবহার করে প্রণাম বা দণ্ডবৎ প্রণামের কিছুটা পরিবর্তিত রূপ প্রদর্শন করে। এরকম স্থানীয় প্রথা ইসকনেও প্রসিদ্ধ হয়েছে, যদিও প্রমাণ সাক্ষ্য দেয় যে, প্রভুপাদ নারীদের ক্ষেত্রেও পূর্ণ দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদনের বিষয়টি অনুমোদন করেছিলেন। যেমন আমার গুরুবোন রমনীয়া দেবী দাসী ১৯৭৬ সালে ফ্রান্সে, নিউ মায়াপুরে তাঁর দীক্ষার ঘটনাটি আমার কাছে বর্ণনা করেছিলেন :
“যখন প্রথমে ভক্তদেরকে একে একে প্রভুপাদের কাছে দীক্ষার মালা গ্রহণ করতে বলা হল এবং সে সাথে ৪টি বিধি নিষেধ বিষয়ে বলতে বলা হল, তখন তাঁরা প্রভুপাদের সম্মুখে মাথা নত করছিলেন, যদিও সেটি পূর্ণ দণ্ডবৎ ছিল না। তখন প্রভুপাদ বললেন, যখন মালা নিতে আসবে প্রত্যেকেরই তাঁর সম্মুখে পূর্ণ দণ্ডবৎ নিবেদন করা উচিত। এটি বলার পরপরই আমার পালা ছিল। আমি তখন এক গুরুবোনকে জিজ্ঞেস করলাম আমার কী করা উচিত? আমার কী দণ্ডবৎ দেওয়া উচিত নাকি না? তিনি বললেন, “কেন নয়?” তাই আমি তখন প্রভুপাদের সম্মুখে গেলে পূর্ণভাবে দণ্ডবৎ প্রণতি নিবেদন করি। প্রভুপাদের সম্মুখে একটি শাড়ি মেঝের ওপর পড়ে রয়েছে আমার এরকম একটি ছবি রয়েছে। তখন সেটি দেখে প্রভুপাদ বড় একটি হাসি দিলেন। তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করায় প্রভুপাদ অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছিলেন।”
শ্রীল প্রভুপাদ এক শিষ্যকে লিখেছিলেন (নভেম্বর ১৫, ১৯৭৪), “তুমি গুরুদেবের সম্মুখে পুনঃ পুনঃ প্রণতি নিবেদনের ব্যাপারটিও উল্লেখ করেছ। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন শিষ্যের উচিত গুরুদেবকে দণ্ডবৎ নিবেদন করা, নমস্কার নয়। যত বেশী কেউ শুরুকে প্রণতি নিবেদনে মনোনিবেশ করবে, ততবেশি সে পারমার্থিক প্রগতি সাধন করবে।”
আমি মূল ঐতিহ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করতে চাই, কেননা জাগতিক পদমর্যাদাকে অগ্রাহ্য করে, যখন কেউ দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদন করে তখন তার এরকম ভাবাবেগ অনুভূত হয়। যেটি শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তার ‘ভজন রহস্য’ গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন, “স্বয়ং নিজেকে এবং এই জগতে তৎপরবর্তী যৎ সামান্য আমি অধিকার করি সবকিছুই আমি এখন তোমার পাদপদ্মে নিবেদন করছি।”
স্কন্ধ পুরাণের বিবৃতি: “কোনো ব্যক্তি ভগবান বিষ্ণুর সম্মুখে নত হলে যত সংখ্যক ধূলিকণা তার শরীরে সজ্জিত হয় তার সহস্র গুণ সম পরিমাণ সময় পর্যন্ত বিষ্ণুলোকে তিনি মহিমান্বিত হন।” (হরিভক্তিবিলাস ৮/৩৭১) এবং শ্রীল রূপ গোস্বামীপাদ আমাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, এ প্রকার অনুশীলন যে ফল প্রদান করে তা হল: “যে ব্যক্তি ভগবানের বিগ্রহের সম্মুখে একবার নত হয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন, তিনি পুনরায় এই জড়জগতে ফিরে আসেন না। কেননা তিনি সরাসরি কৃষ্ণলোকে গমন করেন।” (ভক্তিরসামৃতসিন্ধু, অধ্যায়-৯)। হরিভক্তিবিলাস উদ্ধৃতি দেয় “একজন ভক্ত যিনি ভূমিতে পতিত হয়ে ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে দণ্ডবৎ প্রণতি নিবেদন করেন, তখন সে স্থানেই তার সমস্ত পাপ পতিত হয়ে যায়। সেগুলো পুনরায় সেই স্থান থেকে কখনো উত্থিত হবে না।” নিন্মের উদ্ধৃতিটি আশ্চর্যকর যে, “শঠতা সহকারে শাঙ্গর্ধনা হরিকে প্রণাম করলেও শত জন্মার্জিত পাপপুঞ্জ আশু ধ্বংস হয়ে থাকে।” (হরিভক্তিবিলাস ৮/৩৭০) এই প্রকার আশ্চর্য ফলাফল দেখে আমাদের অবাক হওয়া উচিত নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবদ্গীতায় (৯/৩৪) বলেছেন, “তোমার মনকে আমার ভাবনায় নিযুক্ত কর, আমার ভক্ত হও, আমাকে প্রণাম কর এবং আমার পূজা কর। এভাবেই মপরায়ণ হয়ে সম্পূর্ণরূপে আমাতে অভিনিবিষ্ট হলে, নিঃসন্দেহে তুমি আমাকে লাভ করবে।”
বাহ্যিকভাবে দণ্ডবৎ নিবেদনকে হয়তো সরল ও প্রথাগত মনে হতে পারে। কিন্তু মনোযোগ ও যত্ন সহকারে এটি সম্পাদন করলে তা জীবাত্মা ও প্রিয় ভগবানের সাথে ভক্তিপ্লুত শরণাগতির শাশ্বত বন্ধনে আবদ্ধ করে।
(উর্মিলা দেবী দাসী এবং তাঁর পরিবার ক্যারোলিনাতে একটি বালক-বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনা করেন এবং তিনি Vaikuntha Children: a guide to Krishna Conscious education for children গ্রন্থের লেখক)
ত্রৈমাসিক ব্যাক টু গডহেড, জানুয়ারী – মার্চ ২০১৪