এই পোস্টটি 1743 বার দেখা হয়েছে
ডা. গৌতম দাশগুপ্ত: ধুমপানের পাশাপাশি পান সেবনও আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। আমাদের দেশে পান দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন অনেক পুরানো ঐতিহ্য। বিয়ে বাড়িতে নিমন্ত্রণ খাওয়ার পর যিনি পান খান না তাকেও দেখা যায় এক খিলি পান মুখে রেখে আপন মনে চিবাতে থাকেন। যারা নিয়মিত পান সেবন করেন তাদের দেখা যায় পান সেবন করার সময় এর নির্যাস বারস ঠোঁট বেয়ে পড়ে যাচ্ছে আর কথা বলে যাচ্ছেন। পান-সুপারি বা জর্দা নিয়ে অনেক কাব্য রচনা করা যাবে ঠিকই কিন্তু এর ক্ষতিকর দিকগুলো অবশ্যই সবারা জানা প্রয়োজন। পানে রয়েছে কিছু টাফেনলস। পান খাওয়ার কারণে ঠোঁট ও জিহ্বাতে দাগ পড়ে যায়। দাঁতে প্রায় স্থায়ী দাগ পড়ে যায়। অনেকেই ভেবে থাকেন জর্দা বা তামাক পাতা ছাড়া শুধু সুপারি দ্বারা পান সেবন করলে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। সবার অবগতির জন্য জানা প্রয়োজন যে তাইওয়ানে অধিকাংশ মানুষ টোব্যাকো সামগ্রী ছাড়া সুপারী দিয়ে পান সেবন করে থাকেন। তাইওয়ানে গবেষণায় দেখা গেছে, সুপারি নিজেও ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান। পানের সঙ্গে যে চুন খাওয়া হয় সেটি হল ক্যালসিয়াম অক্সাইড বা ক্যালসিয়াম হাইড্রো-অক্সাইড। চুনে রয়েছে প্যারা অ্যালোন ফেনল যা মুখে আলসার সৃষ্টি করতে পারে। এ আলসার ধীরে ধীরে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হতে পারে। সুপারি চুনের সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটিয়ে এরিকোলিন নামক একটি নারকোটিক এলকালয়েড বিদ্যমান থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এরিকোলিন প্যারাসিমপ্যাথেটিক আয়ুতন্ত্রের উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এ কারণেই চোখের মণি সঙ্কুচিত হয় এবং লালার নিঃসরনের পরিমাণ বেড়ে যায়। শুধু তাই নয়, চোখে পর্যন্ত পানি আসতে পারে। কাঁচা সুপারি উত্তেজক হিসেবে কাজ করে। সুপারিতে রয়েছে উচ্চমাত্রার সাইকোএকটিভ এলকালয়েড। এ কারণেই উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কাচাঁ সুপারি চিবালে শরীর গরম অনুভূত হয়, এমনকি শরীর ঘামিয়ে যেতে পারে। সুপারিতে রয়েছে এরিকেন ও এরকোলিন এলকালয়েড যা উত্তেজনার দিক থেকে নিকোটিনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অন্য এলকালয়েডগুলোর মধ্যে রয়েছে এরিকাইডিন, এরিকোলিডিন, গুরাসিন ও গুয়াসিন, গুভাকোলিন ইত্যাদি। সুপারি খেলে তাৎক্ষণিক যেসব সমস্যা দেখা যায় সেগুলো হল –
-এ্যাজমা বেড়ে যেতে পারে।
-হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে।
-টেকিকার্ডিয়া না নাড়ির স্পন্দনের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে অস্থিরতা অনুভূত হওয়া।
দীর্ঘমেয়াদী সুপারি খেলে ওরাল সাবমিউকাস ফাইব্রোসিস হতে পারে। ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা বা স্কোয়ামাস সেল কারসনোমা হতে পারে। মূলত আমাদের দেশে মুখের ক্যান্সারের মধ্যে স্কোয়ামাস সেল কারসিনোমা বেশি দেখা যায়। আমাদের দেশে পানের সঙ্গে তামাক পাতা ব্যাপকভাবে গৃহীত হচ্ছে। জর্দা পছন্দ মতো না হলে অনেকেই আবার মান অভিমানও করে থাকেন। দেখা যাচ্ছে পান বিক্রেতারা নির্বিচারে ১০/১২টা উপাদান দিয়ে পানের খিলি বানাচ্ছেন তথাকথিত সুস্বাদুর জন্য। বলাবাহুল্য ঐসব তথকথিত মুখরোচক উপাদানগুলোর উৎপত্তি, ব্যবহারিক প্রয়োগ, ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে সচেতন মহলও মাথা ঘামায় না। ক্যান্সার গবেষণায় আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএারসির মতে, যারা পানের সঙ্গে তামাক জাতীয় দ্রব্যাদি গ্রহণ করেন তাদের সাধারণের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি সম্ভবনা থাকে ওরাল ক্যান্সারের রোগী হওয়ার ক্ষেত্রে। পানের সঙ্গে যে ধরণের তামাক সামগ্রী গ্রহণ করা হয় তা খুবই বিপদজ্জনক। তুলনামূলকভাবে এরেকোলিন এলকালয়েডের চেয়ে তামাক সামগ্রীর এলকালয়েড ও নিকোটিনের অধিক মাত্রায় নেশা ও বিষাক্ত ধর্মা থাকে। তাই জর্দা যত সুগন্ধি মিশ্রিত হোক না কেন তা জীবনের সৌরভ ধীরে ধীরে বিলীন করে দেয় তা লাল রঙের বলে পান খেলে খুব কম ময়ের মধ্যে মুখ লাল হয়ে যায়। খয়ের তৈরি করা হয় এ্যাকাসিয়া ক্যাটেচু নামক বৃক্ষের কাঠ থেকে। খয়ের এসট্রিনজেন্ট হিসেবে কাজ করে মুখের অভ্যন্তরের মিউকাস মেমব্রেনকে সঙ্কুচিত করে। অনেকেই বিচিত্র পদ্ধতিতে পান সেবন করে থাকেন। কেউ কেউ পানের ছোবড়া ও রস পর্যন্ত খেয়ে ফেলেন। পান খাওয়ার এক পর্যায়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ পানের কিছু অংশ গালের এক পাশে রেখে আবার কিছুক্ষণ পর খেতে দেখা যায় অনেকটা জাবরকাটার মত। অনেকেই এভাবে পান গালের এক পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। এদের ক্ষেত্রে গালের এক পাশে আলসারসহ ক্যান্সার পর্যন্ত দেখা দিতে পারে। পানের নেশা থেকে মুক্তি লাভের আশায় অনেকেই প্যাকেটজাত পান-মসালা কিনে চিবাতে থাকেন। কিন্তু ধারণাটি আসলে সম্পূর্ণ ভূল। তারা মিডিয়ার রংচঙ্গে বিজ্ঞাপনের গোলকধাঁধায় পড়ে প্রতারিত এবং ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পান-মসলার সঙ্গে মেনথল মিশিয়ে মুখের অভ্যন্তরে ঠান্ডা অনুভূতির সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষকে বোকা বানানো হচ্ছে। পানের নেশা ছাড়ানোর জন্য কিছু কার্যকর পদ্ধতি রয়েছে, যা ব্যক্তি বিশেষে কখনই একই ধরনের হয় না। শুধু এটুকু বলা যায়, সব ধরনের নেশা থেকে মুক্তি পেতে আপনাকে সুন্দর জীবনবোধের অধিকারী হতে হবে। চুন, খয়েরী, সুপারী, জর্দা, তামাক পাতার নেশায় বুদঁ না হয়ে সুন্দর জীবনবোধের মাধ্যমে আপনিও পারেন সমাজ তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে।
সূত্র : দৈনিক আজাদী, ২৩ মার্চ ২০১১