এই পোস্টটি 202 বার দেখা হয়েছে
স্কন্ধ পুরাণ ও অন্যান্য শাস্ত্র অনুসারে জগন্নাথ পুরীতে প্রায় ৮ জন শম্ভু অর্থাৎ ৮জন মহাদেব রয়েছেন। এদেরকে একত্রে ‘অষ্ট শম্ভু’ বলা হয়। এই অষ্ট শম্ভু হলেন যথাক্রমে যমেশ্বর, লোকনাথ মহাদেব, মার্কেন্ডশ্বর, কপাল-মোচন, নীলকাণ্ডেশ্বর, বট, লোকনাথ, শঙ্খেশ্বর এবং ভনস্বরা মহাদেব। এদের মধ্যে প্রথম পাঁচ জনকে পঞ্চপাণ্ডব নামে অভিহিত করা হয়। বলা হয়ে থাকে যদি কেউ এই অষ্ট শম্ভুকে দর্শন করে তবে তিনি তাদের আশীর্বাদ গ্রহন করেন এবং পরবর্তীতে ভগবান শ্রী বিষ্ণুর দর্শন লাভ সহজতর হয়ে যায়। নিম্নে কয়েকজন শম্ভু বা মহাদেবের বর্ণনা তুলে ধরা হলঃ
শ্ৰী কপাল-মোচন মহাদেব
মাটির নীচ থেকে প্রায় ৪০ ফুট উঁচু কপাল মোচন মহাদেবের এ মন্দিরটি জগন্নাথ মন্দিরের দক্ষিণ গেইটের নিকটে অবস্থিত। একদিন শিব কোন একটি বিশেষ কারণবশত চার মস্তক বিশিষ্ট একজন ব্রহ্মাকে থাপ্পড় মারে। ফলশ্রুতিতে যে হাত দিয়ে শিব ব্রহ্মাকে থাপ্পড় মেরেছিলেন সেই হাতের সঙ্গেই ব্রহ্মার একটি মাথা লেগে থাকে। যেহেতু শিবের কারণে একজন ব্রাহ্মণ হত্যা হয়েছিল। তাকে তাকে ব্রাহ্মণ হত্যাজনিত পাপ তাড়া করেছিল। প্রতিটি স্থানেই এ পাপ তাকে আক্রমন করেছিল এবং তার হাতের সঙ্গে ঐ মাথা লেগেই ছিল। কোনক্রমেই ঐ মাথা শিবের হাত থেকে পৃথক হচ্ছিল না। এক পর্যায়ে সম্ভাব্য সমস্ত জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে একদিন তিনি পুরীধামের মধ্যে এসে পড়েন। তখন হঠাৎ এ স্থানে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তার হাত থেকে ঐ মাথা পড়ে যায় এবং এভাবে পুরী ধামের দিব্য শক্তি ও শ্রী জগন্নাথের অপার কৃপার ফলে শিব ব্রাহ্মণ হত্যাজনিত পাপ থেকে অবলীলায় মুক্ত হন, ‘কপাল’ মানে হচ্ছে ‘কোন লোকের মস্তক’। যেহেতু শিবের হাত থেকে ঐ কপাল বা মস্তক পড়ে গিয়েছিল (মোচন) তাই তখন থেকেই এ শিবের নাম হয় কপাল মোচন মহাদেব। পুরী ধামকে রক্ষার জন্য যে পাঁচ জনকে মূলত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে একজন হলেন এই মহাদেব এবং এ পঞ্চ শিবকে যেহেতু পঞ্চ পাণ্ডব বলেও অভিহিত করা হয় তাই পাণ্ডবদের মধ্য থেকেই এ মহাদেবকে নকুল নামেও অভিহিত করা হয়। এই পঞ্চ শিব দ্বারপাল অর্থাৎ পাহাড়াদার হিসেবে পুরীধামকে সুরক্ষিত করার দায়িত্ব পালন করছেন।
শ্রী লোকনাথ মহাদেব
শ্রী লোকনাথ মহাদেব পাঁচজন মহাদেবের মধ্যে প্রধান পাহাড়াদার হিসেবে পুরীধামকে সুরক্ষা করে চলেছেন। পঞ্চ পাণ্ডবদের মধ্য থেকে ভীমসেন হিসেবেই এই মহাদেব অতি পরিচিত। শুধু পাঁচজন মহাদেব কেন, যে আটজন মহাদেব পুরীধাম রক্ষার জন্য সেবা করছেন তাদের মধ্যেও তিনি প্রধান হিসেবে পরিচিত। এ মহাদেব জগন্নাথ মন্দিরের ভাণ্ডার কক্ষের (স্টোর রুম) রক্ষণাবেক্ষনে নিয়োজিত আছেন। লোকনাথ মহাদেবের এ মন্দিরটি জগন্নাথ মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থিত। এখানে জলের নিচে সর্বদা শয়নরত অবস্থায় লোকনাথ লিঙ্গ অবস্থিত। এ শিব লিঙ্গের দু’পাশে স্বর্ণের তৈরি দুটি সৰ্প রয়েছে। প্রভু শিব এখানে অনন্তদেবের আশ্রয়ের নিচে অবস্থান করছেন। ফাল্গুন মাসের একাদশী তিথিতে এই লিঙ্গ জল থেকে উত্তোলনের মাধ্যমে লোকনাথ মহাদেবের পূজা করা হয়। পুরাণ মতে একদা শ্রীরাম সীতা দেবীকে খোঁজ করার জন্যে শ্রীলঙ্কায় যাওয়ার পথে পুরী ধামের শবর পল্লী’ নামক স্থানে থেমেছিলেন। তিনি যেহেতু ক্ষত্রিয় রাজা ছিলেন তাই রামচন্দ্র প্রতিদিন এখানে শিবের পূজা করেছিলেন। যা হোক তখন ‘শবর পল্লীতে’ কোন শিব লিঙ্গ না থাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা শ্রী রামচন্দ্রকে ‘লাউ’ নামে একটি সবজি উপহার দিয়েছিলেন। যেটির আকৃতি অনেকটা শিব লিঙ্গের মতই দেখতে। এরপর থকে ওখানকার বাসিন্দারা লাউকে ‘লাউকানাথ’ নামে ডাকত। তখন থেকে শিব লিঙ্গকে ডাকা হয়ে থাকে লোকনাথ হিসেবেই। প্রভু লোকনাথ পাপ দূরীভূত করা, রোগ নিরাময় এবং ভক্তদের বিভিন্ন রকমের দুঃখ দুর্দশা নিরাময়ের জন্য খুবই বিখ্যাত। তাই হাজার হাজার লোক এ মন্দিরে আসে প্রভু লোকনাথকে পূজা করার জন্য।
যমেশ্বর মহাদেব
যমেশ্বর মহাদেবের এ মন্দিরটি টোটা গোপীনাথ মন্দিরের উত্তরে এবং জগন্নাথ মন্দিরের দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ হারাচান্দি সাহীর শেষ প্রান্তে যমেশ্বর টোটা নামক স্থানে অবস্থিত। মন্দিরটি মাটির নীচ থেকে শুরু করে প্রায় ৪০ ফুট উঁচু এবং চারপাশে উঁচু পাথরের তৈরি শক্ত দেয়াল বিদ্যমান। শ্রী যমেশ্বর মহাদেবের বিজয়া বিগ্রহ হচ্ছে একটি শ্রী হরি হরা মূর্তি। এই মূর্তি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথকে দর্শন করতে যায়। এই বিজয়া বিগ্রহ ধাতু দিয়ে তৈরি এবং চারটি হাত রয়েছে। তার দু’হাতে শঙ্খ এবং চক্র ও অন্য দু’হাতে যথাক্রমে ‘দামারু’ এবং ত্রিশূল রয়েছে। প্রতি বছর লক্ষ্মী-নারায়ণ এ মন্দিরে আসেন তাদের বিবাহ অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য। প্রতি মাসের অমাবস্যা তিথিতে ভগবান শ্রী জগন্নাথের বিজয়া বিগ্রহ অর্থাৎ শ্রী নারায়ণ রূপে ‘মহোদধী’ সাগরে স্নান করার পর এ যমেশ্বর মহাদেব মন্দির দর্শনের জন্য আসেন। এখানে মহাদেব অর্থাৎ শিব যমেশ্বর নামে পরিচিত। কেননা তিনি এখানে ‘যমরাজ’কে নিয়ন্ত্রণ করেন। যাতে করে জগন্নাথ পুরী বসবাসরত প্রতিটি জীবের উপর যমরাজের নিয়ন্ত্রন না থাকে। যমেশ্বর এখানে প্রতিনিয়ত শ্রীক্ষেত্র পাহাড়া দিচ্ছেন এবং ভগবানের প্রেমে প্রতিনিয়ত আনন্দে নৃত্যরত অবস্থায় রয়েছেন। তিনি পুরীতে বসবাসরত লোকদের যমরাজের প্রভাব থেকে রক্ষা করে থাকেন। এখানে যমরাজ কারও বিচার করতে পারে না এবং পুরীর প্রত্যেকেই মুক্ত জীব বলে এ যমেশ্বরকে ‘মুক্তিশ্বর’ নামেও ডাকা হয়ে থাকে। পঞ্চ পাণ্ডবদের নাম অনুযায়ী পঞ্চ শিবের মধ্যে তাকে মহারাজ যুধিষ্টির হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। এছাড়াও জগন্নাথ পুরীতে রক্ষণাবেক্ষণেরত অন্যান্য পাহাড়াদার হনুমান ও শিবের বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলী পুরী পরিদর্শনের মাধ্যমে জানতে পারেন এবং লীলাময় স্থানসমূহ দর্শন করতে পারেন। হরে কৃষ্ণ।