এই পোস্টটি 215 বার দেখা হয়েছে
চিন্ময় সুখ যখন কারাগারে
চট্টগ্রাম কেন্দ্রিয় কারাগারে ঘটে যাওয়া এক চমৎকার ঘটনা!
ক্লিন্টন ঘোষ
“কারাগার” নামটি শুনলে প্রথমেই হয়তো যে কারো চোখে নরকের উদাহরণটি ভেসে উঠবে। কারাগার এবং নরকের মধ্যে শুধু পার্থক্য হলো, নরকে কেবল প্রকৃত অপরাধীরাই প্রবেশ করে। অন্যদিকে পৃথিবীর এই মানবসৃষ্ট কারাগারে সবসময় প্রকৃত অপরাধী নয়, নিরপরাধ কিংবা হয়রানির শিকার ব্যক্তিদেরও প্রবেশ করতে হয়। পৃথিবীর এই মানবসৃষ্ট কারাগারে বন্দি থেকেও যে ভগবান শ্রীজগন্নাথদেবের কৃপা পাওয়া যায় সেরকমই একটি দুর্লভ ঘটনা প্রত্যক্ষ করলো চট্টগ্রাম কেন্দ্রিয় কারাগারের বন্দিরা।
গত ২০ জুন, ২০২৩ খ্রিঃ মঙ্গলবার শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের “রথযাত্রা” উপলক্ষে জগন্নাথের কৃপায় এরকমই এক ব্যতিক্রমধর্মী রথযাত্রার আয়োজন করেন “চট্টগ্রাম কেন্দ্রিয় কারাগার নামহট্ট”। এসময় কারাগারে বন্দি ভক্তরা কারাগার অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণ মন্দির এবং গীতা স্কুল কক্ষে সকালে মঙ্গল আরতি, ভগবান শ্রীনৃসিংহদেবের আরতি, বৃন্দাদেবীর সেবা-পূজা সমাপনান্তে ভগবান জগন্নাথ, বলদেব এবং সুভদ্রাদেবীর অভিষেকের আয়োজন করেন। আম, আপেল, মাল্টাসহ বিভিন্ন প্রকার ফলের রস, দুধ ইত্যাদি দিয়ে ভগবান শ্রীজগন্নাথদেব সহ সুভদ্রাদেবী এবং বলদেবের চিত্রপটে স্লানাভিষেক করানো হয়। অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মন্দিরে আগত সকল বন্দি ভক্তরা হরিনাম সংকীর্তনে বিভোর ছিলেন। স্নানাভিষেক শেষে ভগবানের চিত্রপটকে রথে স্থাপনপূর্বক হরিনাম সংকীর্তনের মাধ্যমে জেলখানার ভেতরে নির্দিষ্ট পথে ভ্রমণ করিয়ে পুনরায় মন্দির অভ্যন্তরে প্রবেশ করানো হয়। সব মিলিয়ে মন্দিরে এই দিন এক দিব্য পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সাধারণত জেলখানায় সকল আসামীদের জীবনযাপন নিয়ন্ত্রিত হয় নির্দিষ্ট “জেল কোড” অনুসারে। তাই বেশির ভাগ প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র কিংবা পূজার সামগ্রী এখানে এক প্রকার দুর্লভই বলা যায়। তবুও এই কারাগারের বন্দি ভক্তদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কোনো অসুবিধা হয়নি। কারণ বন্দি ভক্তদেরকে কারাগারের অনেক কারারক্ষি অফিসার ভক্তরাও সাহায্য করেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, প্রায় দশ বছর যাবৎ বন্দি থাকা শ্রীসজল দাশ যিনি এই কারাগারের ভেতরে প্রতিষ্ঠিত “শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণ মন্দির” এবং গীতা স্কুলের সার্বিক দায়িত্বে আছেন, তিনি জানান, “আমরা শুধু রথযাত্রাই নয়, শ্রীল প্রভুপাদের আদর্শ অনুসরণ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অশেষ কৃপায় বৈষ্ণবীয় পঞ্জিকায় নির্দেশিত প্রায় সকল আচার অনুষ্ঠানই পালন করার চেষ্টা করি। যেমন কিছুদিন আগেও আমরা একুশ রকমের মৌসুমী ফলের রস দিয়ে ভগবান শ্রীজগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা মহানন্দে পালন করেছি। এছাড়াও এখানে আমরা যারা দীর্ঘদিন বন্দি জীবনযাপন করছি এদের মধ্যে আমরা প্রায় ২০-৩০ জন বন্দি ভক্তদের নিয়ে নামহট্টের বিভিন্ন কার্যক্রম যেমন: একাদশী ব্রত পালন, প্রতিদিন সকলকে সাথে নিয়ে অন্তত ১৬ মালা জপ করা, মহাভারত, শ্রীমদ্ভাগবত, রামায়ণসহ বিভিন্ন শাস্ত্র অধ্যয়ন করে থাকি । তাছাড়া গত প্রায় ৩-৪ বছর আগে বহু কষ্ট করে চট্টগ্রামের নন্দনকাননে অবস্থিত শ্রীশ্রী রাধামাধব মন্দির ও গৌর-নিতাই আশ্রমের প্রভুরা আমাদের জন্য প্রায় ১০-১৫টি ব্যাক টু গডহেড ম্যাগাজিন, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথসহ জপমালা ইত্যাদি সরবরাহ করেছিলেন। প্রায় গীতা ক্লাসেই আমরা সেই ম্যাগাজিনগুলো পুনঃ পুনঃ পাঠ করি।
উল্লেখ্য, উক্ত মন্দিরে প্রতিদিন সকালে বন্দি ভক্তদের মাঝে গীতা ক্লাসের মাধ্যমে গীতার জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ক্লাসে প্রায় ৩০ জন ছাত্রের সমাগম ঘটে। কারাগারের এই মন্দিরে ইমন দাশ নামের এক ভক্ত বন্দি আছেন প্রায় পাঁচ মাস হলো। তিনি এখানের সাধুসঙ্গের সংস্পর্শে এসে এখন প্রতিদিন কমপক্ষে ১৬ মালা জপ করেন। পাশাপাশি এখানকার নিত্য সেবা-পূজার সেবায়েতদের অন্যতম হয়েছেন। কথা প্রসঙ্গে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কারাগারে যে কেবল প্রকৃত অপরাধীরাই আসেন তা নয় । এখানে এমন অনেক ভক্ত রয়েছেন যারা বিভিন্নভাবে প্রতিপক্ষের হিংসার স্বীকার হয়ে হয়রানিমূলকভাবে জেল খাটছেন।” মন্দিরের অপর এক প্রবীণ বন্দি ভক্ত শ্রী কাজল শীল বলেন, “আমাদের প্রচেষ্টা হলো এই হরিনাম নামহট্ট সংঘের মাধ্যমে এখানে আসা সকলের মাঝে হরিনামের প্রচার করা এবং ভক্তিযোগ অনুশীলনের মাধ্যমে আমাদের আসল ঠিকানা পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেই গোলক বৃন্দাবনে পৌঁছানোর পথ তৈরী করা। বৈষ্ণবীয় সকল আচার-অনুষ্ঠান এখানে পালন করা অনেকাংশেই অসম্ভব। তবে জেল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় এই অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়।”
প্রায় চার বছর ধরে বন্দি শ্রীসুজন রাজ বলেন, “ভগবানের রথযাত্রা উপলক্ষে আমরা প্রায় দশ দিন আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। যেহেতু এখানে রথ তৈরীর সকল সরঞ্জাম নেই, তাই আমরা এক প্রভুর পরামর্শে একটি প্লাস্টিকের বই রাখার সেফকে রথের অবকাঠামো হিসেবে ধরে রথ তৈরীর পরিকল্পনা করি। রথের চাকা হিসেবে বড় কৌটার ঢাকনাকে ব্যবহারের উদ্যোগ নিই। পরিকল্পনা মাফিক আমি, ইমন প্রভু, রণজিৎ প্রভু, নয়ন প্রভুসহ প্রায় দশজন মিলে চার তাক বিশিষ্ট বুক সেলফের নিচে বিস্কুটের কৌটার ঢাকনা ছিদ্র করে শক্ত করে বেঁধে দিই। প্রত্যেকটি চাকা তৈরী করতে ২টি করে ঢাকনা ব্যবহার করেছি। এক্ষেত্রে জেলে আসামীদের সাপ্তাহিক নাস্তা দেওয়া সুজির পায়েসকে আমরা আঠা হিসেবে ব্যবহার করেছি। চাকা এবং উপরের কাঠামোটি তৈরী হয়ে গেলে আমরা রথের উপরে ভগবান শ্রীজগন্নাথদেবের চিত্রপট স্থাপনের জন্য চিন্তা করি। কিন্তু এক প্রভু বহু দিন আগে প্রায় দেড় ফুট উচ্চতা, এক ফুট প্রস্থ এবং এর উপরে আরও দেড় ফুট উচ্চতার অর্ধ চোঙ্গাকৃতি চূড়া দিয়ে একটি সুন্দর মন্দির তৈরী করেছিলেন। এখানে অবাক করার মতো বিষয় হলো মন্দিরটি সম্পূর্ণ কাগজের তৈরী। একের পর এক পাতলা কাগজকে সুজির আঠার মাধ্যমে জোড়া দিয়ে তৈরী হয় এটি। দেখলে মনে হয় এটা কাঠের চেয়েও শক্ত। অবশেষে সিদ্ধান্ত হয়, এই মন্দিরটি চাকাসহ বুক সেলফের উপরে দড়ি দিয়ে বেঁধে বসিয়ে দিব। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মন্দিরটি স্থাপন করে এরপর পূর্বের সংগৃহীত বেগুনী রঙের কাপড় দিয়ে পুরো কাঠামোটিকে ঢেকে দেবার পর, মন্দিরের চূড়াতে একটি লম্বা কাঠির সাথে বাজারের শপিং ব্যাগের থেকে সুন্দর করে একটি ত্রিভূজাকৃতি ধ্বজা বা পতাকা তৈরী করে সেটি বেঁধে দেয়া হলো। সব মিলিয়ে রথটি আনুমানিক ৭-৮ ফুট উচ্চতা পেলো । সমস্ত কাজ শেষ করার পর ভগবানের এই রথটি দেখে আমরাও আশ্চর্য হই। এতসব দেখে অভিরাম নাথ প্রভু বলেন, “ভগবানের কৃপা ছাড়া এই রথ তৈরী করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তিনি (ভগবান) চেয়েছেন বলেই এটা হয়েছে। আমরা তো কেবলই উপলক্ষ মাত্র।” কারাগার অভ্যন্তরে রথযাত্রায় ভগবান আমাদেরকে সংযুক্ত রেখেছেন। এতে আমরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করি। কারাগারে প্রবেশ করাটা আমাদের জন্য এখন দুঃখের চাইতে সুখেরই মনে হয়।” উল্লেখ্য, এই শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণ মন্দির এবং গীতা স্কুলটি সকল বন্দি ভক্তদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং জেল কর্তৃপক্ষের সদয় অনুমতি সাপেক্ষে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। মাঝখানে বিভিন্ন যৌক্তিক কারণে ২ বার মন্দিরটি বন্ধ হয়ে গেলেও ভগবান তাঁর ভক্তদের জন্য আবার তা খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
বর্তমানে মন্দিরের অভ্যন্তরে শ্রীসজল দাশের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় “আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন)-এর ভাবধারাকে হৃদয়ে ধারণ করে একটি নামহট্ট সংঘ-এর ইউনিট পরিচালনা করছেন। মন্দিরে শ্রীশ্রীরাধামাধব, শ্রীজগন্নাথদেব, পঞ্চতত্ত্ব, শ্রীনৃসিংহদেব, লাড্ডু গোপাল, ষড় গোস্বামী, গুরুপরম্পরার গুরুগণসহ শ্রীল প্রভুপাদ প্রতিষ্ঠিত আছেন। সজল দাশ বলেন, “এই মন্দিরটি কেবল ইসকনের নয়, সকলের। অবশেষে একটি দিব্য রথযাত্রা উৎসব শেষ করে মন্দিরের সকলেই সম্মিলিতভাবে মতামত দেন, আমরা সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই চট্টগ্রাম কেন্দ্রিয় কারাগারের ভেতরে এক নব বৃন্দাবন সাজিয়েছি যা কিনা অত্যন্ত দুর্লভ। তাই আমরা মনে করি আমরা যেভাবেই হোক এখানে এসেছি, তা নিশ্চয় ভগবানেরই কৃপা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। আর এই গুপ্ত বৃন্দাবনের দৃশ্যও আমরা এই ডিজিটাল যুগেও জনসম্মুখে দেখাতেও অসমর্থ কেননা কোনো ক্যামেরা/ডিজিটাল ডিভাইস এখানে বৈধ নয়। সব মিলিয়ে এই দিব্য পরিবেশের স্বাদ যারা পাননি, তাদের জগন্নাথ ছাড়া আর কেউ বুঝিয়ে দিতে পারবেন না। শুভ রথযাত্রা ২০২৩ এরকম একটি দূর্লভ রথযাত্রা দেখতে পেয়ে আমার মানব জীবন ধন্য হলো। হরে কৃষ্ণ।
চৈতন্য সন্দেশ অ্যাপ ডাউনলোড করুন :https://play.google.com/store/apps/details?id=com.differentcoder.csbtg