এই পোস্টটি 270 বার দেখা হয়েছে
সিট নং ৭১
যুগাবতার দাস
এই বছর গৌর পূর্ণিমার এক সপ্তাহ পূর্বে আমার এক গুরুভাই সনাতন রস দাসের সাথে নাসিক থেকে মুম্বাই যাওয়ার সিডিউল হয়েছিল। যখনই আমরা ট্রেনে আরোহন করলাম তখন সেখানে আমাদের সাথে আরেকজন ভক্তের পরিচয় হল যিনি মুম্বাই যাচ্ছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় ছিল যে, সেই ভক্ত- ‘প্রবীণ’, ঠিক আমাদের পাশের সিট রিজার্ভ করেছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের জন্য ট্রেনেও ভক্তসঙ্গের ব্যবস্থা করেছিলেন। আমাদের সিট নং ছিল ৬০, ৬১ এবং ৬৩ ।
সাধারণত আমি ট্রেন ভ্রমণের সময় জপ করিনা তাই আমি পূর্বেই নাসিক মন্দিরে ৮ মালা জপ শেষ করেছিলাম। এখন বাকি ৮ মালা শেষ করার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাকে ভক্তসঙ্গ দেওয়ার মাধ্যমে আশির্বাদ করেছেন। যখনই আমরা তিনজন একসাথে জপ করছিলাম তখন আমি মন্দিরে জপ করার মত একই অনুভূতি লাভ করছিলাম। এই কলিযুগে এটিই হল বিশেষ আর্শিবাদ। কলিসন্তরণ উপনিষদের নবম শ্লোকে ভগবান ব্রহ্মা নারদকে উপদেশ দিয়েছেন, “… যে কেউ যেকোনো স্থানে যেকোনো সময়ে জপ করতে পারে।” কিন্তু ভক্তসঙ্গ থাকলে এটি খুব সহজে সম্ভব হয়, কেননা একাকী থাকলে আমরা সাধারণ বহুদিকে তাকাতে থাকি, এমনকি আত্মাকে জাগরিত করার এই পন্থা অনুসরণের সময় আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। ভক্তসঙ্গের মাধ্যমে ভক্তগণ জেগে ওঠে এবং এই ভক্তসঙ্গ আমাদের গভীর মনযোগের সাথে জপ নিমগ্ন হওয়ার জন্য উৎসাহিত করে। আমি এখনও এই প্রকারের অপ্রাকৃত আশির্বাদের অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকি।
ট্রেনটি ইগতপুরীতে পৌঁছল এবং আমরা তিনজন আমাদের সকালের প্রসাদ সেবনের জন্য পরস্পরের টিফিন বক্স খুললাম। আমাদের বিভিন্ন একাদশী প্রসাদের পদ ছিল এবং আমরা একে অন্যর মধ্যে সমভাবে প্রসাদ ভাগ করলাম। অপ্রাকৃত কৃষ্ণপ্রসাদ গ্রহণ করার মুহূর্তে আমরা অপ্রাকৃত কৃষ্ণকথা আলোচনা করছিলাম। আমি তৎক্ষণাৎ উপলব্ধি করলাম আমরা ট্রেনেও ভক্তসঙ্গে প্রসাদ সেবা করার মুহুর্তে যদি অপ্রাকৃত আনন্দ লাভ করতে পারি, তাহলে বৃন্দাবনবাসী ভক্তগণ কতই না পরমানন্দ এবং কৃপাশীর্বাদ লাভ করছে? আমরা এতই আনন্দভাবে নিমগ্ন ছিলাম যে, আমাদের আশেপাশে সকল যাত্রীগণ আমাদের আলোচনা শ্রবণে যুক্ত হলেন। তাদের মধ্যে আমাদের পাশেই ছিলেন একজন যাত্রী যার সিট নং ৭১। সিট নং ৭১ এর যাত্রী নিজের পরিচয় দিলেন আমাদের কাছে, “আমি নারায়ণ মোর।”
আমরা তাকে আমাদের পরিচিতি দেওয়ার সাথে সাথে কৃষ্ণভাবনামৃতের পরিচিতিও তার কাছে তুলে ধরলাম। কেননা ভগবান চৈতন্য মহাপ্রভু আমাদের আদেশ দিয়েছেন, “যারে দেখ, তারে কহ, ‘কৃষ্ণ’ উপদেশ”। (চৈতন্যচরিতামৃত মধ্য ৭/১২৮) যার সাথে দেখা হোক না কেন, তাকে কৃষ্ণের নির্দেশাবলী এবং কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় জ্ঞান বিতরণ কর।
কেননা সামাজিকভাবে যখন আমরা ট্রেনে ভ্রমণ করি তখন খেলাধুলা, রাজনীতি, খেলার রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়াদি আলোচনা করে কালক্ষেপন করি এবং আমরা আমাদের আত্মা এবং পরমাত্মাকে ভুলে যাই।
তাই মহাপ্রভুর আজ্ঞানুসারে আমরা নারায়ণ মোরের কাছে ‘নারায়ণ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করলাম এবং তিনি হৃদয় উন্মোচন করে কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করলেন। তিনি গৌর পূর্ণিমা উৎসবে নাসিক মন্দির দর্শনের যাওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন। মি. মোরের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য আমি প্রবীণকে অনুরোধ করলাম। গৌর পূর্ণিমা উৎসবের শেষ দিবসে আমি প্রবীণের কাছ থেকে ফোন পেলাম এবং সে জানাল যে, মি. মোর মন্দির দর্শনে এসেছেন। আমি প্রবীণকে বললাম মি. মোরের কাছে জপমালা উপস্থাপন করে জপ করার জন্য অনুরোধ করুন এবং “তাকে মাঝে মাঝে কোন করবেন, কেননা এই জড়জগতে থেকে মানুষ খুব সহজেই ভগবানকে ভুলে যায়।” আমি মি. মোরের এই দিব্য পরিবর্তন নিয়ে বিটিজিতে একটি আর্টিকেল লেখার জন্য মনস্থির করলাম। আর্টিকেলটির নাম হবে “সিট নং ৭১” কেননা এই স্থানেই তিনি চৈতন্য মহাপ্রভুর দিব্য উপহার লাভ করেছেন।
এখন মি.মোরও উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে তার ৭১ নং সিটে পরিভ্রমণটি ছিল তাকে হরিনাম প্রদানের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একটি বিশেষ পরিকল্পনা।
আজ এই প্রবন্ধটি লেখার পূর্বে আমি মি. মোরকে ফোন করলাম। তিনি আমাকে জানালেন, তিনি জপ করছেন এবং তার জপ সংখ্যা বৃদ্ধি করতে চান। আমি সন্তুষ্ট হলাম এবং আমার এই প্রবন্ধটি সেই সকল ভক্তবৃন্দের চরণে নিবেদন করছি যারা যেখানেই যান না কেন এবং যার সাথেই সাক্ষাৎ করেন না কেন, সকলের মাঝেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী প্রচার করেন।
(যুগাবতার দাস মুম্বাইয়ের একটি মেডিকেল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের লেকচারার হিসেবে কর্মরত। তিনি ব্যাক টু গডহেড ম্যাগাজিনের একজন নিয়মিত লেখক)
ত্রৈমাসিক ব্যাক টু গডহেড, অক্টোবর – ডিসেম্বর ২০১৩