নাথদ্বার হল ভারতের রাজস্থান রাজ্যের মধ্যে, কিন্তু এখানে যে তীর্থযাত্রী আসেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই হলেন গুজরাট রাজ্যের অধিবাসী-নাথদ্বার থেকে মাত্র কয়েক শ’ কিলোমিটার দূরে রয়েছে যে-রাজ্যটির সীমানা। তাই গুজরাটিদের দ্বারাই নাথদ্বারের সকলের ভাব-প্রকৃতি অনেকাংশেই প্রভাবান্বিত হয়ে থাকে।
নাথদ্বার শহরটি এখানকার বিগ্রহকে ঘিরেই বেঁচে রয়েছে। এখানকার চলতি সম্ভাষণ হল “জয় শ্রীকৃষ্ণ!” চারিদিকেই দেখবেন লেখা রয়েছে “জয় শ্রীকৃষ্ণ!” কখনও-বা বল্লভ সম্প্রদায়ের মন্ত্রেও লক্ষ্য করবেন, শ্রীকৃষ্ণশরণং মম-শ্রীকৃষ্ণ আমার আশ্রয় । নাথদ্বারে হরেকৃষ্ণ আন্দোলন বেশ সুপরিচিত, প্রায়ই তো লোকে ‘হরেকৃষ্ণ’ বলেই আমাদের সম্ভাষণ জানিয়েছে। নাথদ্বারে রাজস্থানী গ্রামবাসীদের বেশ ভালভাবেই নজরে পড়ে। প্রাণোচ্ছল, স্বাস্থ্যবান তারা, নিজেদের ভাষাতেই কথা বলে, নিজেদের মতো খাবারদাবার খায়, এবং তাদের পোশাক আশাকও নিজস্ব ঐতিহ্য বহন করে। আর তারা ভগবান শ্রীনাথজীর প্রতি গভীরভাবে ভক্তি রাখে। বছর কয়েক আগেও, বিদেশীদের মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হত না, তবে এখন দেওয়া হয়।
আর যাই হোক্, হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের ভক্তদের সকল সময়েই এখানে ভারি সমাদর। কথিত আছে, বৃন্দাবনের গিরি গোবর্ধন থেকে একটি বিশাল প্রস্তর হতে শ্রীনাথজীর বিগ্রহ স্বপ্রকটিত হন। তাঁর দিব্য শরীরের সম্মুখ ভাগটুকুই পাথর থেকে উৎকীর্ণ হয়ে দৃশ্যমান হয়ে আছে। তাঁর চারিপাশে বেশ সুচারু বেশ আর মনোরমভাবে বস্ত্র জড়িয়ে তাঁকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সারা দিন ধরে বারংবার তাঁর বস্ত্র পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। আবহাওয়া এখানে রাজস্থানের বেশির ভাগ জায়গারই মতো, গ্রীষ্মকালে ভয়াবহ গরম, শীতে তেমনি ঠাণ্ডা। গ্রীষ্মকালে তাঁকে হালকা বেশ ধারণ করানো হয়, শীতকালের মঙ্গল আরতির সময়ে গরম পোশাকে তাঁকে সাজানো হয়, যাতে তাঁর মুখপদ্মটুকুই কেবলমাত্র দর্শন করা যায়।
যদিও মন্দিরে এখন বিজলী বাতি রয়েছে, তবু মন্দিরের মধ্যে এখনও মশাল জ্বালিয়ে শ্রীি দিকে আলো দেখানোর ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন। শ্রীনাথজী তখন দর্শন দেন, তখন তাঁর অধরোষ্ঠের নিচে একটি বড় হীরে ঝলমল করতে থাকে, সেটা নাকি সম্রাট আকবর স্বয়ং অর্পণ করেছিলেন।
মঙ্গল-আরতির পরে দর্শন চলতেই থাকে। মুখিয়াজীরা, যাঁরা এখানকার পূজারী, তাঁরা বিগ্রহের সামনে পর্দা বন্ধ করে দেন, কিন্তু প্রত্যেকেই আরও আরও বেশি করে দর্শন লাভ করতে চায়। এই পর্দাটি তোলা হয়, আবার নামাতে হয় বারংবার।
সবশেষে মুখিয়াজীরা দরজা বন্ধ করে দেন, কিন্তু তবু তাঁকে আরও দর্শন লাভের জন্য হট্টগোল করতে থাকে, আর তাই আবার তা খুলে দেওয়া হয়। জনতা পরমেশ্বরের নামে জয়ধ্বনি করতে থাকে, “জয় কানাইয়ালাল! জয় বংশীধারী।” তারপর শেষকালে দরজা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, এবং বাঁশের বেড়া
নামিয়ে দেওয়া হয় তার সামনে, আর সেইখানেই মঙ্গলারতির পর্ব হয়ে যায়। সমাপ্ত ।
লোকে তৎক্ষণাৎ দণ্ডবৎ প্রণতি জানায় এবং তারপর ঝাড় হাতে নিয়ে মন্দির চত্বর আর চারিধার সাফাই করতে লেগে যায়। দেখতে পাবেন লোকে যারা মন্দির ঝাড়ু দিচ্ছে, তারা কেউই মন্দিরের কর্মী নয়। সাধারণ লোকদের মধ্যে থেকেই ভক্তিসেবার মন নিয়ে তারা ঐ কাজে নেমে পড়ে । কেউ না খেয়ে থাকে না শ্রী বিগ্রহের প্রসাদ প্রচুর পরিমাণেই বিতরণ করা হয়ে থাকে। প্রসাদের একটি অংশ সেবকরা এবং মন্দির-কর্মীরা পেয়ে থাকে, তাদের অনেকেই তা বিক্রিও করে। খুব ভোরে মঙ্গলারতি হয়ে যাওয়ার ঠিক পরেই দেখতে পাবেন মন্দিরের ঠিক বাইরেই পূজারীরা স্টীলের থালা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। থালায় মাটির ভাঁড়ে ভর্তি করে সাজানো হরেক রকমের দুগ্ধজাত মিষ্টি, দই, রাবড়ি, ক্ষীর। সকালে একটু বেলার দিকে, পূজারীরা ঝুড়িতে করে প্রসাদ ঢেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে হোটেলে আর ধর্মশালাগুলিতে তীর্থযাত্রীদের কাছে বিভিন্ন ধরনের প্রসাদ বিক্রির জন্য।
পূজারীরা ছাড়াও মন্দিরের বাইরে বাজরেও আপনি দোকানপাট দেখতে পাবেন যেখানে প্রসান কেনা যাবে, আবার ঠেলাগাড়িতে করেও প্রসাদ বিক্রি হচ্ছে দেখবেন এবং রাস্তার ধারে বসেও কত লোক প্রসাদ বিক্রি করছে দেখা যায়।
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে আমরা দেখি যে, শ্রীগোপাল বিগ্রহ, সেই একই বিগ্রহ যাকে শ্রীনাথজী বলে সবাই এখন জানে, তিনি শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীকে বলেছিলেন, “আমার গ্রামে, কেউ না খেয়ে থাকে না।” এখন, এই নাথদ্বারে, যেখানে শ্রীগোপাল আবির্ভূত হয়েছেন, দেখছি কথাটা সত্যি। এমন কি রাস্তার কুকুরগুলো পর্যন্ত এখানে বেশ মোটাসোটা। অবাকের বিষয় যে, পথের কুকুরগুলো পর্যন্ত এত হৃষ্টপুষ্ট। এখানে কুকুরগুলোও প্রচুর পরিমাণে প্রসাদ পায় ভাগ্যবান কুকুর সব!
সারা দিন ধরেই প্রসাদ মেলে, আর সে সমস্ত অনেক রকমের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের। দুপুরের রাজভোগ নিবেদনের পর আপনি পেতে পারেন শালপাতায় ঠোঙায় বোঝাই মুখরোচক নানান সবজি রান্না মাত্র এক টাকায় (তাতে যে সব অনাজাতি উপকরণাদি আছে, সেগুলির চেওে কম দামে) শালপাতার টোকা ভর্তি আচার আপনি পেয়ে যাবেন সে-ও মোটে এক টাকাতেই। আছে নানা ধরনের চাউনি, ফলের সালাদ, আর অতুলনীয় রায়তা- ফলের কুচি, সরষে বাটা আর হালকা দই দিয়ে মাখা। পুরো ঘি-মাখানো বড় বড় চাপাটি থাকে। দু-তিন টাকায়, বিভিন্ন মাপমতো। দেখবেন ভাত, ডাল, তরকারি, ভাজাভুজি আর সিঙাড়া-পকৌড়ি এত বিপুল পরিমাণে যে একজনের পুরো পেটভরা খাওয়ারই মতো যথেষ্ট।
তারপরে আছে দুধ থেকে তৈরি মিষ্টি মিঠাই আর দানা শস্য এবং চিনির তৈরি রকমারি মিঠাই, সবই দিয়ে ঠাসা। প্রকাণ্ড মাপের লাড্ডু, শস্যদানা, ঘি আর চিনি দিয়ে তৈরি একশ টাকায়। কতকগুলো মিঠাইতে কস্তুরী আর জাফরানের মতো দামি দামি উপকরণও থাকে। দামাদামি করে লোকে বেশি দর কষে না। দোকানদার যা-ই বলে, লোকে তাই মেনে নেয়, ব্যস্, তাতেই মিটে যায়। শস্যদানার মেঠাইগুলো আর চিনির রসে মজানো শুকনো খাজা-গজাগুলোর মতো প্রসাদ সবই মাসের পর মাস বেশ থাকে, তাজাভাবে। বিদেশ থেকে কোনও তীর্থযাত্রী নাথদ্বার ঘুরে এলে শ্রীনাথজীর প্রসাদ নিয়ে বন্ধুবান্ধবদের জন্য স্বচ্ছন্দে সাগরপারে চলে যেতে পারেন। স্বয়ং শ্রীবিগ্রহেরই মতো, শ্রীনাথজীর প্রসাদ-সম্ভারও সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে গেছে। হরে কৃষ্ণ।