এই পোস্টটি 728 বার দেখা হয়েছে
![গৌরাঙ্গের সন্ন্যাস লীলার রহস্য!](https://csbtg.org/wp-content/uploads/2020/07/final-e1595483137669.jpg)
বঙ্গানুবাদ: মূর্তিমান মাধব দাস
শ্রীচৈতন্য মঙ্গল গ্রন্থের ভূমিকায় শ্রীল লোচন দাস ঠাকুর লিখেছেন:
অনেক রহস্য কথা কহিব তাহাতে
বৈরাগ্য অদ্ভুত প্রভুর উঠে যেনমতে
“আমি তাতে বহু রহস্য কথা বলব, যেমন ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অভূতপূর্ব বৈরাগ্যের রহস্য।”
মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণ হচ্ছে একটি অতি গভীর এবং বহুমুখী বিষয়। তাঁর সন্ন্যাস লীলার রহস্য অনুধাবন করতে হলে প্রথমেই একজনকে বিবেচনা করতে হবে ভগবান যদি সন্ন্যাস নেন তবে তাঁকে তাঁর মাতা শচীদেবী ও নবদ্বীপের সকল প্রেমী ভক্তদের সঙ্গ পরিত্যাগ করতে হবে। কেউ যদি এই বাস্তবতার উপর ধ্যান করেন, তাঁর প্রিয় ভক্তদের সাথে মহাপ্রভুর সম্বন্ধ বিষয়ে কতিপয় বিভ্রান্তিমূলক প্রশ্নের উদয় হয়।
চৈতন্য ভাগবতে (মধ্য ৯/২১৫) ভগবানের উপর শুদ্ধ ভক্তির প্রভাব বর্ণনা করা হয়েছে-]
যাহা হৈতে আপনার পরাভব হয়।
সেই বড় গোপ্য, লোকে কাহারে না কয় ॥
এটিই হচ্ছে ভক্তির অন্তরঙ্গ বৈশিষ্ট্য-এটি ভগবানকে বন্ধী করে। বেদান্ত সূত্রের (৩/৩/৫৩) ভাষ্যে শ্রীল মধ্বাচার্য লিখেছেন- ভক্তিবশঃ পুরুষো ভক্তিরেব “ভূয়সী ভগবান ভক্তির বশীভূত। ভক্তিই হচ্ছে সর্বোত্তম।”
হরিভক্তিসুধোদয়ে (১৪/২৯) ও শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং একই বিষয়টি বর্ণনা করেছেন-
সদা মুক্তোহপি বদ্ধোহস্মি ভক্তেন স্নেহরজ্জুভিঃ।
অজিতোহপি জিতোহৎ তৈরবশোহপি বশীকৃতাঃ।।
“যদি আমি সর্বদা মুক্ত, অজিত ও কারো বশীভূত নই, তথাপি ভক্তের প্রেমরজ্জুর দ্বারা আমি বদ্ধ, জিত ও তাঁদের বশীভূত হয়ে যাই।”
শ্রীমদ্ভাগবতের (৯/৪/৬৩) ভগবান দূর্বাসা মুনিকে বলেছেন-
অহং ভক্তপরাধীনো হ্যস্বতন্ত্র ইব দ্বিজ।
সাধুভির্গ্রস্তহৃদয়ো ভক্তৈর্ভক্তজনপ্রিয়ঃ॥
ভগবান যেহেতু নবদ্বীপে তাঁর শুদ্ধ ভক্তদের প্রেমের দ্বারা বদ্ধ ছিলেন, তাদের পরিত্যাগ করা তাঁর পক্ষে কিভাবে সম্ভব হল? তিনি নিশ্চিতভাবে জানতেন শচীমাতা তাঁর মুখপদ্ম দর্শন না করে বাঁচতে পারবেন না। তাহলে কিভাবে তিনি তাঁর প্রেমময়ী মাতা, তাঁর পত্নী বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী এবং অন্য ভক্তদের ত্যাগ করতে পারলেন?
যুগধর্ম
কেউ বলতে পারে যে, ভগবান তাদের ছেড়ে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন যেন তিনি ছাত্রদের এবং নির্বিশেষবাদীদের প্রচার করতে পারেন এবং এভাবে এই যুগের ধর্ম সংস্থাপন করতে পারেন। যাহোক শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী বর্ণনা করেছেন যে যুগধর্ম প্রবর্তন হচ্ছে ভগবানের বাহ্যিক বা গৌণ বাসনা। তাহলে ভগবানে সন্ন্যাস লীলার অন্তরঙ্গ বা মুখ্য উদ্দেশ্য কি ছিল? শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী বর্ণনা করেছেন-
প্রেমরস-নির্যাস করিতে আস্বাদন।
রাগমার্গ ভক্তি লোকে করিতে প্রচারণ॥
রসিক-শেখর কৃষ্ণ পরমকরুণ।
এই দুই হেতু হৈতে ইচ্ছা উদ্গম॥
“দুটি কারণে ভগবান এই জগতে অবতীর্ণ হওয়ার ইচ্ছা করেন- ভগবৎ প্রেমরসের নির্যাস আস্বাদন করা এবং এই জগতে রাগমার্গ বা স্বতঃস্ফূর্ত অনুরাগের স্তরে ভগবদ্ভক্তি প্রচার করা। তাই তিনি রসিক-শেখর এবং পরম করুণ নামে পরিচিত।” (চৈ. চ আদি ৪/১৫-১৬)
ভাবগ্রহণের হেতু কৈল ধর্ম স্থাপন।
তার মূখ্য হেতু কহি, শুন সর্বজন॥
“শ্রীমতী রাধারাণীর ভাব আস্বাদন হচ্ছে তাঁর অবতরণের মুখ্য কারণ এবং সেই সঙ্গে তিনি যুগধর্ম স্থাপন করেছেন। সেই মুখ্য কারণ আমি এখন বর্ণনা করব, দয়া করে আপনারা সকলে তা শ্রবণ করুন। (চৈ. চ আদি ৪/৫৩)
এই বাঞ্ছা যৈছে কৃষ্ণপ্রাকট্য-কারণ।
অসুরসংহার-আনুষঙ্গ প্রয়োজন॥
এই মত চৈতন্য-কৃষ্ণ পূর্ণ ভগবান্।
যুগধর্মপ্রবর্তন নহে তাঁর কাম॥
“এই বাসনাগুলি যেমন শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের কারণ তেমনই অসুর সংহার কেবল একটি আনুষঙ্গিক প্রয়োজন। আর যুগধর্ম প্রবর্তন হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের আনুষঙ্গিক কারণ।”(চৈ. চ আদি ৪/৩৬-৩৭)
সন্ন্যাসের অন্তরঙ্গ উদ্দেশ্য
জাহ্নবা মাতার শিষ্য শ্রী নিত্যানন্দ দাস তাঁর প্রেমবিলাস গ্রন্থে মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণের অন্তরঙ্গ কারণ বর্ণনা করেছেন। সপ্তম অধ্যায়ে (৮৭-১৩৬) তিনি লোকনাথ গোস্বামীর এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর একটি অন্তরঙ্গ কথোপকথন বর্ণনা করেছেন- একদিন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু গোপনে তাঁর অন্তরের ভাবনা লোকনাথ গোস্বামীর নিকট জানালেন। সমস্ত আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অসন্তোষ যা তাঁর আচরণকে প্রভাবিত করছে সেই সব তিনি তাকে (লোকনাথ গোস্বামীকে) ব্যাখ্যা করলেন।
ভগবান বললেন “আমার আবির্ভাবের উদ্দেশ্য ও স্বভাব সম্পর্কে নীরব থাকায় আমি অসন্তুষ্ট অনুভব করছি। কিন্তু এই গুহ্যতম বিষয় আমি কাকে বলব? আমি হয়ত নিত্যানন্দ প্রভু এবং অদ্বৈত আচার্যকে সম্মান জানানোর জন্য কিছু ব্যক্তিকে প্রভাবিত করতে পারি। কিন্তু কারা আমার থেকে শুনবে এবং আমার উদ্দেশ্য বুঝবে? কিছু লোক আমার সমালোচনা করে এবং অন্য অনেকে আমার প্রতি বিদ্রুপও করে। শ্রীমতী রাধারাণীর মনোভাব প্রকাশ করে আমি গৌড় দেশে এসেছি।
তাঁর প্রেমকি কৃষ্ণের জন্য শ্রীরাধার অনুভূতি আমি অনুভব করতে চাই। আমার জন্য শ্রীমতী রাধিকা তাঁর পরিবার ও ঐশ্বর্য ত্যাগ করেছে এবং নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আমার সেবায় উৎসর্গ করেছে। আমার চিন্তা করতে করতে সে কৃশও দূর্বল হয়ে গেছে। সে এমনকি নিজের দেহ নিয়েও চিন্তিত নয় এবং সে কখনো অন্য পুরুষের দিকে তাকায় না। আমার সঙ্গ লাভের আশায় সে নিরন্তর আমার সম্পর্কে শ্রবণ ও কীর্তনে মগ্ন থাকে। আমার উপর ক্রোধান্বিত হয়ে সে আমার চরিত্র সম্পর্কে কুঞ্জ ও যমুনা নদীর নিকট অভিযোগ করে কিন্তু আমাকে দর্শন মাত্রই সে তৎক্ষণাৎ তাঁর ক্রোধ ভুলে যায়। আমার এক দিনের বিরহ রাধারাণীর কাছে শত বর্ষের মতো। সে আমার প্রেয়সী, আমরা একত্রে বৃন্দাবনে অপ্রাকৃত লীলাবিলাস উপভোগ করেছিলাম। তাঁর জন্যই আমি বৃন্দাবনে বাস করি। সে আমার প্রাণ এবং আমিও তাঁর প্রাণ।
সখা দাস পিতা মাতা সে রসে বঞ্চিত
সবে সখীগণ জানে যে রসে মোহিত
“আমার সখাগণ, দাসগণ, পিতা ও মাতা-সকলে এই রস থেকে বঞ্চিত। কেবল গোপীগণই এটি অনুধাবন করতে পারেন।” (শ্লোক ১০৮)
গুণে প্রীতে তাঁর স্থানে হইয়াছি ঋণী
তোমা স্থানে লোকনাথ কহিলাম আমি
“হে লোকনাথ! আমি তোমাকে বলছি রাধিকার গুণে ও প্রেমে আমি এতই প্রীত হয়েছি যে, আমি তাঁর প্রতি ঋণী হয়ে গেছি।” (শ্লোক ১০৯)
মহাপ্রভু বললেন, “এই ঋণ হচ্ছে আমার অসন্তোষের একটি কারণ। এখন আরেকটি কারণ শ্রবণ কর। এক ব্রাহ্মণ আমার নিন্দা করে মহা অপরাধ করেছে। সেই ব্রাহ্মণ কৃষ্ণের পরমেশ^রত্ব স্বীকার করেনা। শ্রীকৃষ্ণকে গুরুরূপে স্বীকার না করে সে দেবদেবীদের পূজা করে এই অপরাধের কারণে সে নরকে যাবে।”
“আমার পরিকল্পনা হচ্ছে মাঘ মাসের তৃতীয় দিন আমি সন্ন্যাস গ্রহণ করব এবং গৃহত্যাগ করব। আমি দণ্ডধারী সকল ব্রাহ্মণদের গুরু হব। এই ব্রাহ্মণদের নিমিত্তে, আমি সন্ন্যাস গ্রহণ করব, গৃহত্যাগ করব এবং দেশ হতে দেশান্তরে ভ্রমণ করব।
এ বাহ্য বিচার আর মনে আশয়
শুণ লোকনাথ ইহা কহিলা নিশ্চয়
রাধিকার ভাব লঞা সব প্রয়োজন
কেবা বুঝে কেবা শুনে যেই মোর মন
“এটি আমার বাহ্য বিচার। হে লোকনাথ, শুন! রাধারভাব অঙ্গীকার করাই আমার একমাত্র প্রয়োজন। আমার মনের অবস্থান বুঝতে পারে বা শুনতে পারে এমন কে আছে?” (শ্লোক ১২২-১২৩)
মোর অঙ্গের বরণ বসন রাধা গায়
এই লাগি নীল-বস্ত্রে সুখ অতি পায়
“রাধা আমার অঙ্গের বর্ণের মতো নীল রঙ্গের বসন (বস্ত্র) পরিধান করে অতি সুখ লাভ করে।”(শ্লোক ১২৪)
আমার বিচ্ছেদে পরে অরুণ বসন
আপনাকে নিজ-দাসী মানে সর্বক্ষণ
“কিন্তু আমার থেকে বিচ্ছেদ হলে, রাধা অরুণ রঙয়ের বস্ত্র পরিধান করে এবং নিজেকে সর্বদা আমার দাসী বলে জ্ঞান করে। (শ্লোক ১২৫)
আমার লাগিয়া রাধা আদি সখী-গণ
বিরহে ব্যাকুল হৈয়া ত্যাজিল জীবন
আমিও ত্যাজিব প্রাণ তাহাঁর লাগিয়া
সে দশা হৈবে তুমি শুনিবে থাকিয়া
“আমার বিরহে ব্যাকুল হয়ে রাধা ও গোপীগণ তাঁদের প্রাণ ত্যাগ করেছে। এখন আমিও তাঁর জন্য প্রাণ ত্যাগ করব। হে লোকনাথ, তুমি আমাকে সেই অবস্থায় দেখতে পাবে। (শ্লোক-১২৬-১২৭)
ধরিব তাহার কান্তি পরিব অরুণ বসন
হইব তাঁহার দাস আনন্দিত মন
“শ্রীরাধার অঙ্গকান্তি ধারণ করে এবং বিরহের অরুণ বসন পরিধান করে, আমি তাঁর দাসী হব এবং সুখ লাভ করব।” (শ্লোক ১২৮)
এই লাগি অরুণ বসন দিব গায়
জপিব তাঁহার গুণ কহিলু তোমায় ॥
“বিরহের গেরুয়া (অরুণ) বসন পরিধান করে, আমি রাধিকার গুণমহিমা কীর্তন করব।”
তাঁহার সতেক গুণ নারিব শোধিতে
শত-জন্ম আয়ু যদি হয় পৃথিবীতে
গুণে প্রীতে তাঁর স্থানে হইয়াছি ঋণী
তোমা স্থানে লোকনাথ কহিলাম আমি
“তাঁর অনন্য গুণাবলী বর্ণনা করাও সম্ভব নয়। এমনকি এই পৃথিবীতে শতবার জন্ম পেলেও আমি তা বর্ণনা করতে পারব না। হে লোকনাথ, আমি তোমাকে বলছি তাঁর গুণে ও প্রেমে আমি এতই প্রসন্ন হয়েছি যে, আমি তাঁর প্রতি ঋণী হয়ে গেছি।” (শ্লোক ১৩০-১৩১)
জগৎ ভাসাইব আমি তাঁর যশ কীর্তি
তবে জানি কৃপা মোরে করেন এমতি
“তাঁর যশ কীর্তন করে, আমি জগতকে ভাসাব। তখন রাধিকা আমাকে তাঁর কৃপা প্রদান করবেন।”(শ্লোক ১৩২)
পাইব তাঁহার প্রেম কান্দিব নয়নে
ধূলায় ধূসর হইয়া নাচিব সংকীর্তনে
“তাঁর প্রেম প্রাপ্ত হয়ে, আমি ক্রন্দন করব এবং সংকীর্তনে নাচতে নাচতে ধূলায় ধূসরিত হব।”(শ্লোক ১৩৩)
ইহা বলি ফুকারিয়া কান্দে গৌর-রায়
রাধা বৃন্দাবন বলি ধরণী লুটায়
“এরূপ বলে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন। “রাধা” “বৃন্দাবন” বলতে বলতে ভূমিতে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। (শ্লোক ১৩৪)
ঋণ পরিশোধ
চৈতন্য চরিতামৃত (আদি ৪/১৭৭-১৮০) তে কৃষ্ণ কিভাবে গোপীদের প্রতি ঋণী হয়েছেন তা বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে-
কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা এক আছে পূর্ব হৈতে।
যে যৈছে ভজে, কৃষ্ণ তারে ভজে তৈছে॥
“আগে থেকে শ্রীকৃষ্ণের একটি প্রতিজ্ঞা আছে, যে যেভাবে তাঁর ভজনা করবেন, তিনিও তাঁর প্রতি সেভাবেই আচরণ করবে।”
যে যথা প্রপদন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ
“যারা যেভাবে আমার শরণাগত হয় সেভাবেই আমি তাদের পুরষ্কৃত করি। হে পার্থ সমস্ত মানুষই সর্বতোভাবে আমার পথ অনুসরণ করে।”
সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হৈল গোপীর ভজনে।
তাহাতে প্রমাণ কৃষ্ণ-শ্রীমুখবচনে॥
“ব্রজগোপিকাদের ভজনে শ্রীকৃষ্ণের সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয় তা শ্রীকৃষ্ণ নিজেই স্বীকার করেছেন।”
ন পারয়েহহং নিরবদ্যসংযুজাং
স্বসাধুকৃত্যং বিবুধায়ুষাপি বঃ।
যা মাহভজন্ দুর্জয়গেহশৃঙ্খলাঃ
সংবৃশ্চ্য তদ্বঃ প্রতিযাতু সাধুনা॥
“হে গোপীগণ! আমার প্রতি তোমাদের নির্মল সেবার ঋণ আমি ব্রহ্মার আয়ুষ্কালের মধ্যে পরিশোধ করতে পারব না। আমার সঙ্গে তোমাদের যে সম্পর্ক তা সম্পূর্ণভাবে নিষ্কলুষ। তোমরা দুদ্য সংসার-বন্ধন ছিন্ন করে আমার আরাধনা করছো। তাই তোমাদের মহিমান্বিত কার্যই তোমাদের প্রতিদান হোক।”
উপরে যেমন নিত্যানন্দ দাস কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, শ্রীমতী রাধারাণী ও গোপীদের ঋণ পরিশোধ করার জন্য মহাপ্রভু একমাত্র যে উপায়টি দেখছিলেন তা হল সন্ন্যাস গ্রহণ করা। কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারে, ঋণ পরিশোধের জন্য সন্ন্যাস গ্রহণের কি প্রয়োজন? গোপীদের ঋণ পরিশোধের জন্য গৃহত্যাগ ও নবদ্বীপবাসী ভক্তদের ত্যাগ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় কি ছিল না? উত্তর রয়েছে ভগবদ্গীতায় (২/৪১) সেখানে কৃষ্ণ প্রেম পথের প্রকৃতি বর্ণনা করেছেন-
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিরেকেহ কুরুনন্দন।
বহুশাখা হ্যনন্তাশ্চ বুদ্ধয়োহব্যবসায়িনাম্॥
“যারা এই পথ অবলম্বন করেছে তাদের নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি একনিষ্ঠ। হে কুরুনন্দন, অস্থিরচিত্ত সকাম ব্যক্তিদের বুদ্ধি বহু শাখাবিশিষ্ট ও বহুমুখী।”
প্রেমের আদান প্রদানের ক্ষেত্রে কৃষ্ণ স্বভাবতই বহু শাখাবিশিষ্ট, কারণ অগণিত ভক্তগণ বিবিধ প্রকার মনোভাব নিয়ে তাকে আরাধনা করে যেমন-দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য এবং মাধুর্য। সেজন্য কৃষ্ণকে প্রত্যেকের ভাব অনুসারে উপযুক্তরূপে বিনিময় করতে হয়। যাহোক, কৃষ্ণের প্রতি গোপীদের মতি হচ্ছে ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি-একনিষ্ট মতি। তারা ভগবান নারায়ণের প্রতিও আকৃষ্ট নন।
তারা এমনকি কৃষ্ণকে মথুরা, দ্বারকা কিংবা কুরুক্ষেত্রেও দেখতে চান না। তারা কেবল বৃন্দাবনে যমুনার তীরে কেলিকদম্ব বৃক্ষের নীচে বংশীবাদনরত নন্দদুলাল কৃষ্ণের সেবা করতে চান। শিক্ষাষ্টকের সর্বশেষ শ্লোকে মহাপ্রভু শ্রীমতি রাধারাণীর একনিষ্ট মনোভাব প্রকাশ করেছেন, মৎপ্রাণ নাথুস্তু স এব নাপরঃ “হে কৃষ্ণ! তুমিই আমার একমাত্র প্রাণনাথ। তুমি ছাড়া আমি আর কাউকে জানি না।”
কৃষ্ণের প্রতি অনন্য, নিঃস্বার্থ ভালবাসার কারণে গোপীরা সবকিছু পরিত্যাগ করেছেন। তারা তাদের গৃহ, পরিবার, পতি ও সন্তানদের ছেড়ে গভীর রাতে কৃষ্ণের পানে ছুটে গেছে। তাই গোপীদের ঋণ পরিশোধ করতে কৃষ্ণও সবকিছু পরিত্যাগ করেছেন এমনকি তাঁর গৃহ মাতা এবং পত্নীসহ প্রিয় ভক্তদের সঙ্গ তিনি ত্যাগ করেছেন।
তিনিও ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি-একনিষ্ঠ মতি হয়েছেন। সবকিছু ত্যাগ করে, বিরহের গেরুয়া বসন পরিধান করে, রাধারাণী যেভাবে তাঁর জন্য ক্রন্দন করে তিনিও সেভাবে ক্রন্দন করেছেন। এটিই হচ্ছে মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণের অন্তরঙ্গ কারণ। তাঁদের ঐকান্তিক ভক্তিতে গোপীগণ কৃষ্ণের জন্য পাগল হয়েছেন এবং তা করার দ্বারা তারা ভগবানের গুণকীর্তন করেছেন। তাদের ঋণ পরিশোধের জন্য কৃষ্ণ মহাপ্রভুরূপে এসেছেন। রাধারাণীর একনিষ্ট ভক্তির উচ্ছ্বসিত ভাব গ্রহণ করে বিপ্রলম্ভ প্রেমের উন্মাদনা অনুভব করেছেন। তিনি জগৎবাসীকে গোপীদের প্রেমের গভীরতা শিক্ষা দিয়ে তাদের মহিমা কীর্তন করেছেন। বাসুঘোষ তাই লিখেছেন-
যদি গৌর না হইত, তবে কি হইতো
কেমনে ধরিতাম দে
রাধার মহিমা প্রেমরস সীমা
জগতে জানাতো কে
“যদি শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু না আসতেন আমাদের কি অবস্থা হতো? আমরা কিভাবে জীবন ধারণ করতাম? শ্রীমতী রাধারাণীর মহিমা ও তাঁর প্রেম রসের সীমা জগৎবাসীকে কে জানাতো?”