এই পোস্টটি 239 বার দেখা হয়েছে
ভগবান যখন চিন্ময় ধাম থেকে মর্ত্যে আবির্ভূত হন তখন তিনি তাঁর সেই নিত্যধামে একটি লীলা করে থাকেন, যাকে নিমিত্ত করে তিনি এই জগতে অবতীর্ণ হবেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই জগতে অবতীর্ণের বিভিন্ন কারণ সম্বন্ধে অন্যত্র আলোচনা হবে। এখন যে কারণকে নিমিত্ত করে এই মর্ত্যলোকে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য ভগবান শ্রীহরি গোলোকে একটি লীলা প্রকট করেছিলেন তা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। একদিন গোলোকে নির্জন মহাবনে ভগবান শ্রীহরি শ্রীমতি রাধারাণীর সঙ্গে বিহারে মগ্ন ছিলেন। তাঁর সেবার বাসনা সম্পূর্ণরূর্পে তৃপ্তি লাভের পূর্বে ভগবান তাঁকে পরিত্যাগ করে বৃন্দাবনে শ্রীরাধিকা তুল্য এক সৌভাগ্যবতী
গোলোক থেকে ভূ-মণ্ডলে
গোপী বিরজার কুঞ্জে প্রবেশ করলেন এবং তাঁকে তাঁর সেবার সুযোগ প্রদান করে অধিক সৌভাগ্যবতী করলেন। এইভাবে রত্নমণ্ডপে শ্রীকৃষ্ণ বিরজার সঙ্গে বিহার করছেন, এই সংবাদ রাধারাণীকে তাঁর সখিগণ জানালেন। শ্রীহরি তাঁকে সেবা থেকে বঞ্চিত করে অন্যত্র গমন করেছেন জেনে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে ক্রন্দন করতে লাগলেন। তারপর তাঁর ভেষটি শত কোটি গোপীদের সঙ্গে করে রাধারাণী তাঁর অতি মনোহর সুবৃহৎ রখে বায়ুবেগে অতি সত্বর সেই স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন, যেখানে বিরজার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ বিহার করছিলেন। সেই স্থানে পৌঁছে রথ থেকে অবতরণ করে রত্ন উত্তপের দিকে গেলেন। দ্বারে লক্ষসংখ্যক গোপে পরিবৃত্ত হাতে একটি বো ধারণপূর্বক শ্রীদামকে দ্বারপালরূপে দণ্ডায়মান দেখলেন। শ্রীরাধা শ্রীদামকে বললেন, “তুমি রতি-লম্পট কিংকর, দ্বার থেকে দূর হও এবং আমাকে ভিতরে প্রবেশ করতে দাও। আমি তোমার প্রভুকে দেখব তিনি কি প্রকারের সুরূপা অন্য প্রিয় কাস্তা লাভ করেছেন।” কিন্তু সেই মহাবলশালী শ্রীদাম রাস্তা অবরোধ করে শ্রীরাধাকে ভিতরে প্রবেশ করতে দিলেন না। তাতে রাধারাণীর সমস্ত সখিগণ অত্যন্ত ক্রোধে অধর কম্পিত করতে করতে মিলিতভাবে শ্রীদামকে বলপূর্বক দ্বারদেশ থেকে অপসারণ করে দিলেন। এদিকে শ্রীহরি কুঞ্জের মধ্য থেকে কুঞ্জের দ্বারদেশের কোলাহল শ্রবণ করতে পারলেন এবং শ্রীরাধা ক্রোধান্বিতা হয়েছেন জানতে পেরে সেই স্থান থেকে অন্তর্হিত হলেন। ভগবান শ্রীহরি অন্তর্হিত হলে শ্রীরাধার ভয়ে ভীত হয়ে বিরজাও সেখানে যোগবলে দেহত্যাগ করলেন। তাঁর সেই পরিত্যক্ত দেহ গোলোকে সেই মুহূর্তে নদীতে পরিণত হল। এই বিরজা নদী গোলোকধামকে বর্তুলাকারে (গোলাকারে) পরিবেষ্টিত করে অবস্থান করল। শ্রীরাধা রতি গৃহে প্রবেশ করে দেখলেন যে, শ্রীহরি সেই স্থান থেকে অন্তর্হিত হয়েছেন এবং বিরজা নদীরূপ ধারণ করেছেন। তারপর তিনি স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, বিরজার সেই নদীরূপ ধারণ করা দেখে সেই নদীর তীরে উপস্থিত হলেন। তিনি বিরজাকে সতী বলে সম্বোধন করে বললেন, “তুমি অতি শীঘ্রই জল থেকে নিজরূপ ধারণ করে আমার সম্মুখে আবির্ভূত হও।” তখন বিরজা রাধার ন্যায় অত্যন্ত সুন্দর রূপ ধারণ করে শ্রীহরির সম্মুখে উপস্থিত হলেন। শ্রীহরি তাঁকে বললেন, “তুমি শ্রীরাধার ন্যায় আমার অত্যন্ত প্রিয়া। আমি নিত্য তোমার ভবনে এসে তোমার সঙ্গে মিলিত হব।” শ্রীরাধার সখিগণ এই সমস্ত বৃত্তান্ত ঈশ^রী শ্রীরাধাকে জানালেন। এই সমস্ত কথা শুনে শ্রীরাধা অত্যন্ত দুঃখে ক্রন্দন করতে লাগলেন এবং ক্রোধ-মন্দিরে গিয়ে শয়ন করলেন। এদিকে শ্রীকৃষ্ণ বিরজার থেকে বিদায় নিয়ে শ্রীদামকে সঙ্গে করে রাধিকা ভবনের দ্বারদেশে উপস্থিত হলেন। তখন শ্রীরাধা রোষভরে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি বললেন, “গোলোকে আমার থেকে বহু উন্নত প্রিয়া তোমার আছে, তুমি তাঁদের কাছে যাও।” এইরূপ শ্রীরাধা শ্রীহরির প্রতি অভিমানপূর্বক বহু ভৎসনা বাক্য ব্যবহার করলেন। পুরদ্বারস্থিত বেত্রধারিনী বহু সখিগণ শ্রীকৃষ্ণকে অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দিলেন না। শ্রীরাধা উত্তোরত্তর তীব্র কটূক্তি ব্যবহার করে শেষে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, “তোমার ব্যবহার মানুষের ন্যায় হয়েছে, অতএব তুমি ভারতবর্ষে মানুষ্যরূপে আবির্ভূত হও।” তিনি সমস্ত সখিদেরকে কড়া নির্দেশ দিলেন, তাঁরা যেন শ্রীকৃষ্ণকে প্রবেশ করতে না দেন। এই কথা বলে শ্রীরাধা গৃহের মধ্যে ফিরে গেলেন। তখন সখিগণ শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, “তুমি কিছুক্ষণের জন্য অন্য গৃহে অবস্থান কর। আমরা ভিতরে গিয়ে শ্রীরাধার ক্রোধ প্রশমিত করার চেষ্টা করব।” বিভিন্ন গোপীগণ শ্রীকৃষ্ণকে উপহাস ছলে বিভিন্ন বাক্য প্রয়োগ করলেন। তা শুনে শ্রীকৃষ্ণ অন্য একটি গৃহে প্রবেশ করে সেখানে অপেক্ষা করলেন। এই সমস্ত দর্শন করে শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় সখা শ্রীদাম তাঁর প্রিয়তম প্রভু ও সখার প্রতি এইরূপ ব্যবহারে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হলেন। তিনি ক্রোধে অধীর হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বহু মহিমা শ্রবণ করালেন এবং শ্রীরাধা ও গোপীগণ যে তাঁরই সৃষ্ট ও তাঁরই দ্বারা পালিত সে কথাও প্রকাশ করে শ্রীকৃষ্ণের বিভূতি বর্ণনা করলেন। তা শ্রবণ করে রাসেশ্বরী শ্রীরাধা গৃহ থেকে বাইরে এসে শ্রীদামকে বললেন, “রে মূঢ়! অসুররা যেরূপ সর্বদা নিন্দা করে, তুমিও সেইরূপ সব সময়ে আমার নিন্দা কর। শ্রীকৃষ্ণ শুধু তোমার, আমাদের নয়! তুমি সর্বদা পিতার স্তুতি কর এবং আমার নিন্দা কর, তোমার বুদ্ধি অসুরদের মতো হয়ে গেছে। তাই তুমি ধরাধামে অসুর যোনিতে জন্ম লাভ কর। “তখন শ্রীদাম ও ক্রোধান্বিত হয়ে শ্রীরাধার প্রতি বললেন, “তুমি মানুষদের মতো ক্রোধাচরণ করছ। তাই তুমি মানুষী হয়ে জন্ম লাভ কর। শ্রীহরির অংশে উৎপন্ন মহাযোগী বৈশ্য বৃন্দাবনে আয়ান (ঘোষ) নামে জন্ম লাভ করবেন। মূঢ়গণ ভূতলে তোমাকে আয়ান-পত্নী বলে জানবে। তুমি গোকুলে শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করে তাঁর সঙ্গে বৃন্দাবনে বিহার করবে। তুমি এখন এক মুহূর্তও তোমার প্রভুর বিয়োগ সহ্য করতে পারছ না। সেই জন্য ভূতলে শ্রীহরির সঙ্গে তোমার একশত বছর বিচ্ছেদ হবে। তারপর প্রভু শ্রীকৃষ্ণকে প্রাপ্ত হয়ে গোলোক বৃন্দাবনে প্রত্যাবর্তন করবে।” একথা বলে শ্রীদাম শ্রীরাধাকে প্রণাম করে প্রভু শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গোলোক যাম পরিত্যাগ করলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ‘শঙ্খচূড়’ নামে তুলসীর পতি হয়ে ভূতলে জন্মগ্রহণ করেন। তারপর শ্রীরাধা অত্যন্ত শোকাতুরা হয়ে শ্রীকৃষ্ণের নিকট গিয়ে অভিশাপের কথা নিবেদন করলেন, শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘‘এই সমস্ত কিছু আমার ইচ্ছায় হয়েছে। বরাহকল্পে আমি ভূলোকে আবির্ভূত হব। তুমিও সেই ধরাতলে জন্ম লাভ করে আমার সঙ্গে বৃন্দাবনে বিহার করবে।” গোলোকে পরস্পরের প্রতি এইরূপ অভিসম্পাত (অভিশাপ) শ্রীকৃষ্ণের একটি লীলামাত্র। এই সব তাঁর ইচ্ছাতে তাঁর লীলার পুষ্টি বিধানার্থে হয়ে থাকে। গোলোক থেকে ধরাতলে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য ভগবান কোন এক সূত্র খোঁজেন এবং তিনি তাঁর সূত্রপাত করে থাকেন। গোলোকে অবস্থিত সমস্ত গোপী ও সখিগণ শ্রীরাধারই প্রকাশ। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রীরাধার প্রেমকে আরও গাঢ় করে তাঁদের লীলাময় ভাবকে বেশী করে আস্বাদনীয় করবার জন্য তাঁরা গোলোকে বিভিন্ন লীলা বিলাস করে থাকেন।