এই পোস্টটি 1459 বার দেখা হয়েছে
শ্রীশ্রী গিরিরাজ গোবর্ধন পূজার ইতিহাস ও মাহাত্ম্য
গোবর্ধন পূজা ও পরিক্রমার মাধ্যমে ভগবৎধাম প্রাপ্তি হয়। এছাড়াও এদিন গোপূজা কর্তব্য। গোবর্ধন ও গোপূজাকে গোবর্ধন যজ্ঞ বলে। এটি শ্রীকৃষ্ণকে অপরিসীম সন্তুষ্ট করে এবং এর ফলে ধন, ঐশ্বর্য, গাভী এবং সমৃদ্ধি বর্ধিত হয়। গোবর্ধন হচ্ছেন ভগবানের অন্যতম সেবক। প্রকৃত অর্থে স্বয়ং ভগবান নিজেই গোবর্ধনরূপে আবির্ভূত হয়েছেন তাই তাঁর সেবার মাধ্যমে কৃষ্ণপ্রেম লাভ হয়।
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় লীলাভূমি ব্রজমণ্ডলের অন্যতম স্থান গিরিরাজ শ্রী গোবর্ধন। ভগবান তাঁর প্রিয় সখাদের সাথে এই গোবর্ধন পর্বতে ক্রীড়া করেছেন, গোচারণ করেছেন এবং শ্রীমতি রাধারাণীর সাথে লীলাবিলাস করেছেন এই গোবর্ধন পর্বতের উপরেই। শ্রীবৃন্দাবন লীলামৃতের একাদশ উল্লাসে উক্ত হয়েছে-
বৃন্দাবন মধ্যে শ্রেষ্ঠ গিরি-গোবর্ধন।
হরিদাস-বর্য যাঁরে কহে গোপীগণ ॥
হরিপাদপদ্মের স্পর্শপ্রাপ্ত গোবর্ধন পর্বত ‘হরিদাস-বর্য’ নামে খ্যাত। যার অর্থ হচ্ছে শ্রীহরির সেবকগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিত্যধাম শ্রীগোলোক-বৃন্দাবনে শতশৃঙ্গ নামে এক মহিমান্বিত পর্বত বিদ্যমান। এ শতশৃঙ্গ পর্বতই শ্রীমতী রাধারাণীর ইচ্ছায় ভৌম বৃন্দাবনে গোবর্ধন পর্বতরূপে আবির্ভূত হন। কার্তিক-দামোদর মাসের শুক্ল দ্বিতীয়াতে গিরিরাজ গোবর্ধনের পূজা স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রণয়ন করেন।
রামায়ণে উল্লিখিত হয়েছে, যখন ভগবান রামচন্দ্র সেতুবন্ধ থেকে লংকা পর্যন্ত সমুদ্রের উপর পাথরের সেতু নির্মাণ করছিলেন, তখন হনুমান বহু দূর দূরান্ত থেকে পাথর নিয়ে আসছিলেন। তখন ভারতের পশ্চিমে অবস্থিত শাল্মলী দ্বীপে দ্রোণ পর্বতের পুত্ররূপে আবির্ভূত আট কিলোমিটার দীর্ঘ গোবর্ধন পর্বতকে সেতু নির্মাণের জন্য নিয়ে আসতে চান। কিন্তু পথিমধ্যে সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে জানতে পেরে তিনি গোবর্ধনকে রেখে এলেন। তখন শ্রীগোবর্ধন নিজেকে ভগবৎসেবার অযোগ্য ভেবে খুব ব্যথিত হন। তখন ভগবান শ্রীরাম তাঁর নিকটে আবির্ভূত হন এবং বলেন, “প্রিয় গোবর্ধন! তুমি দুঃখিত হয়ো না। যখন দ্বাপরে আমি আমার সকল ঐশ্বর্য নিয়ে স্বয়ংরূপে অবতীর্ণ হব, তখন তোমার মনোরম পৃষ্ঠে আমার সখা এবং গোপিকাদের সাথে বিহার করব।” পরবর্তীতে পুলস্ত্য মুনি কাশীতে তপস্যা করার স্থান হিসেবে গোবর্ধনকে নিয়ে যেতে মনঃস্থ করেন। শর্ত ছিল তিনি কোথাও তাকে নামিয়ে রাখবেন না। কিন্তু বৃন্দাবনের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় গিরিরাজ তাঁর নিত্য আবাসকে চিনতে পেরে ভার বৃদ্ধি করেন, তখন মুনি শর্ত ভুলে গিয়ে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য তাঁকে নামিয়ে রাখেন। কিন্তু পরে যখন তিনি তাঁকে নিয়ে যেতে চাইলেন, তখন আর তাঁকে তুলতে পারলেন না। তখন গিরিরাজের কাশী যাওয়ার অনিচ্ছা বুঝতে পেরে তিনি তাঁকে প্রতিদিন তিল পরিমাণ ক্ষয় হওয়ার অভিশাপ দেন। তাই কালক্রমে এই সুউচ্চ পর্বত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। বিভিন্ন শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে, কলিযুগে একসময় গঙ্গাদি পবিত্র নদী ও গিরিরাজ গোবর্ধন অন্তর্ধান করবেন এবং তখন কলির ভয়াবহ প্রকোপ শুরু হবে। তাই যারা এর পূর্বে গঙ্গা এবং গোবর্ধনের দর্শন ও সেবা করবার সুযোগ পাচ্ছেন তারা মহাভাগ্যবান।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পরিকরগণের সাথে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হলেন। তিনি বৃন্দাবনে নানা লীলাবিলাস করেন। একদিন তিনি দেখলেন, তাঁর পিতা নন্দমহারাজসহ অন্যান্য ব্রজবাসী গোপেরা নানা দ্রব্য দিয়ে ইন্দ্রদেবের উদ্দেশ্যে পূজার আয়োজন করেছেন। তিনি তাঁর পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, “হে পিতা! এটি কী শাস্ত্রীয় পূজা নাকি লৌকিক?” নন্দ মহারাজ জানালেন, যদিও শাস্ত্রে এই বিধান নেই, কিন্তু যেহেতু ইন্দ্র তাদের বৃষ্টি প্রদান করেন এবং বৃষ্টির ফলেই গোচারণ ভূমিতে ঘাস উৎপাদিত হয়, যা তাদের গোপালনের জন্য অপরিহার্য, তাই তারা বহুকাল যাবৎ এই পূজা করছেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ বললেন, এই বৃষ্টি ইন্দ্রের জন্য নয়, বরং আপনাদের কৃতকর্মের ফলেই প্রাপ্ত হচ্ছেন। আর উপযুক্ত স্থানে বৃষ্টিপ্রদান ইন্দ্রের জন্য নির্দিষ্ট দায়িত্ব। এমন নয় যে পূজা করলেই তিনি বৃষ্টি দেবেন, আর না করলে দিবেন না। বরং কেউ যদি প্রকৃতই আমাদের উপকার করেন, তবে তা করছেন গিরিরাজ শ্রীগোবর্ধন। এই গোবর্ধনে উৎপন্ন গুল্মাদিই আমাদের গাভীদের প্রিয় আহার্য এবং আমাদের গোধন বৃদ্ধির উপায়। তাই আমাদের উচিত আমাদের প্রিয় পবিত্র গোধন, ব্রাহ্মণ এবং গিরি-গোবর্ধনের পূজা করা। আমরা এসকল দ্রব্য দিয়ে গিরিরাজের পূজা করতে পারি এবং গাভীদের তৃণাদি ভোজন করাতে পারি এবং ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা প্রদান করতে পারি। তারপর তিনি ঘোষণা করলেন-
অন্যেভ্যশ্চাশ্বচণ্ডালপতিতেভ্যো যথার্হতঃ।
যবসং চ গবাং দত্বা গিরয়ে দীয়তাং বলিঃ ॥
স্বলংকৃতা ভুক্তবন্তং স্বনুলিপ্তাঃ সুবাসসঃ।
প্রদিক্ষণং চ কুরুত গোবিপ্রান্ন পর্বতান্ ॥
গাভীদের গোখাদ্য এবং গিরিরাজকে ভোগনিবেদন করা হোক, সমাজে যারা অবহেলিত, চণ্ডাল, পতিত এমনকি কুকুরকেও যথাযোগ্য ভোজন করানো হোক। তারপর সকলে তৃপ্তির সঙ্গে সেই প্রসাদ গ্রহণ করে সুসজ্জিত হয়ে গাভী, ব্রাহ্মণ, অগ্নি এবং গোবর্ধন পর্বতকে প্রদক্ষিণ করবে। আর এভাবে তা গিরিরাজের প্রীতি বর্ধন করবে। (শ্রীমদ্ভাগবত ১০.২৪.২৮-২৯)
গোপেরা শ্রীকৃষ্ণের কথামতো গিরিরাজ গোবর্ধনের পূজা করতে লাগলেন। ব্রাহ্মণগণ স্বস্তিবাচন করলেন এবং গাভীদের সতেজ তৃণ ভোজন করানো হলো। সকলে গিরিরাজকে ভোগ নিবেদন করলেন। তাঁর নিকট বিশাল অন্নকূট, ব্যঞ্জন, দুধ, দধি, ঘি, মাখন, নবনীত, মিষ্টদ্রব্য, পায়েস, সুবাসিত, শীতল ও নির্মল জল নিবেদিত হল। তারপর গাভীদের সামনে রেখে সকলে গিরিরাজকে পরিক্রমা করলেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ একটি বিশাল শরীর ধারণ করে গোবর্ধন পর্বতের উপর প্রকাশিত হলেন। তিনি বলতে লাগলেন, “আমিই গিরিরাজ গোবর্ধন” এবং বিশাল হস্ত প্রসারণ করে সেই নিবেদিত দ্রব্যাদি গ্রহণ করতে লাগলেন। তিনি ভোগ গ্রহণ করে তাদের গো-সম্পত্তি ও রক্ষা প্রদানের আশীর্বাদ করলেন। এদিকে শ্রীকৃষ্ণ ব্রজবাসীদের সাথে নিয়ে পর্বতোপরি অধিষ্ঠিত গিরিরাজকে বন্দনা করতে লাগলেন। এভাবে লোকশিক্ষক এবং সমস্ত সৃষ্টির গুরু, সমস্ত বেদের ঈশ্বর পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা শ্রীগোবর্ধন গিরিরাজের পূজা প্রবর্তিত হলো।
পদ্মপুরাণে বর্ণিত হয়েছে, “ব্রজভূমিতে গিরিরাজের নিকটে গিয়ে পূজা নিবেদন করবে, কিন্তু দূরদেশে থাকলে গোময় দিয়ে পর্বত নির্মাণ করে অথবা গোবর্ধন শিলার অর্চনা করবে। গোবর্ধন পূজা ও পরিক্রমার মাধ্যমে ভগবৎধাম প্রাপ্তি হয়। এছাড়াও এদিন গোপূজা কর্তব্য।” গোবর্ধন ও গোপূজাকে ‘গোবর্ধন যজ্ঞ’ বলে। এটি শ্রীকৃষ্ণকে অপরিসীম সন্তুষ্ট করে এবং এর ফলে ধন, ঐশ্বর্য, গাভী এবং সমৃদ্ধি বর্ধিত হয়। গোবর্ধন হচ্ছেন ভগবানের অন্যতম সেবক। মূলত স্বয়ং ভগবান নিজেই গোবর্ধনরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁর সেবার মাধ্যমে কৃষ্ণপ্রেম লাভ হয়। কোনো এক সময় এক মহাপাতকী রাক্ষসও বৈষ্ণবের মাধ্যমে গোবর্ধন শিলা স্পর্শপ্রাপ্ত হয়ে গোলোক-বৃন্দাবনে বাস করার অধিকার প্রাপ্ত হন।
এদিকে দেবরাজ ইন্দ্র গোপেদের দ্বারা পূজা না পেয়ে অহংকারের বশবর্তী হয়ে ব্রজভূমি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করবার সংকল্প করলেন। তিনি প্রলয়কালে ব্রহ্মা- ধ্বংসের জন্য নিয়োজিত সংবর্তক বায়ু ও সংবর্তক মেঘকে সেখানে প্রেরণ করলেন। তারা অন্য মেঘদের সঙ্গে নিয়ে ভয়ংকর প্রলয়-ঝড় ও বারিবর্ষণ সৃষ্টি করল। সেই বৃষ্টির কণাগুলোর আকৃতি ছিল বিশাল বিশাল হাতির মতো। ব্রজভূমি জলে মহাসমুদ্রের মতো হয়ে উঠল। শুধু বৃষ্টিই নয়, পর্বতের মত বিশালাকৃতির শিলাখ-ও নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। ব্রজবাসীগণ তখন মহাভয়ভীত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের নিকট উপস্থিত হয়ে বলতে লাগলেন (শ্রীমদ্ভাগবত ১০.২৫.১৩),
কৃষ্ণ কৃষ্ণ মহাভাগ ত্বনানথং গোকুলং প্রভো।
ত্রাতুমর্হসি দেবান্নঃ কুপিতাৎ ভক্তবৎসলঃ ॥
“হে কৃষ্ণ, হে মহাভাগ, হে ভক্তবৎসল, হে মহাশক্তিশালী, আমাদের প্রতি কোপান্বিত ইন্দ্রের হাত থেকে তোমারই প্রতিপাল্য গোকুলকে রক্ষা কর।” তখন শ্রীকৃষ্ণ ইন্দ্রের দুরভিসন্ধি ও অহংকারমত্ততার কথা বুঝতে পেরে নিজ যোগমায়া বিস্তার করে গোকুলবাসীদের রক্ষার ব্যবস্থা নিলেন। তিনি ব্রজবাসীদের বললেন, “আমরা ইন্দ্রের যজ্ঞ বন্ধ করে গোবর্ধনের যজ্ঞ শুরু করেছিলাম, তিনি বিশাল শরীর ধারণ করে আমাদের নৈবেদ্য গ্রহণ করেছিলেন, তিনি আমাদের রক্ষার অঙ্গীকার করেছেন, তাই চলুন আমরা তাঁর কাছে যাই, তিনি আমাদের রক্ষা করবেন।” তিনি তাদের নিয়ে গোবর্ধন তটে এসে উপস্থিত হলেন এবং খেলাচ্ছলে শিশু যেমন ছত্রাক তুলে ধরে, তেমনি করে অবলীলাক্রমে গোবর্ধন পর্বতকে তুলে ধরলেন এবং ব্রজবাসীদের সেখানে আশ্রয় নিতে আহ্বান করলেন। শ্রীকৃষ্ণ সাতদিন ধরে গিরিরাজকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং ব্রজবাসীগণও তাঁর নিকটে এসে অবস্থান করতে লাগলেন। কিন্তু তখনও ইন্দ্র দম্ভবশত বারিবর্ষণ করতে থাকলে তিনি শেষনাগ ও সুদর্শন চক্রকে স্মরণ করলেন। তখন সহস্রকোটি সূর্যের চেয়েও অধিক কান্তিবিশিষ্ট সুদর্শন চক্র গিরিরাজের উপরে উঠে বারি শোষণ করতে লাগলেন আর শেষনাগ পর্বতের পাদদেশে বেষ্টন করে বন্যার জল আটকাতে থাকলেন। আর ব্রজবাসীগণ চকোরের মত শ্রীকৃষ্ণের মধুর বদন দর্শন করতে লাগলেন। তখন ইন্দ্র কুপিত হয়ে বজ্র নিক্ষেপ করলে শ্রীকৃষ্ণের প্রভাবে বজ্রসহ ইন্দ্রের পুরো হাতটিই অসাড় হয়ে গেল। (শ্রীগর্গসংহিতা গিরিরাজ খণ্ড ৩.২০-২৫)
এভাবে সাতদিন অতিবাহিত হলে শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে সুদর্শন চক্র ইন্দ্রকে তার সঙ্গীদের সাথে দূরীভূত করলেন। ইন্দ্র ভয়ভীত হয়ে পলায়ন করলেন। তার দর্পচূর্ণ হলো। তখন দেবগুরু বৃহস্পতি তাকে এসে ভর্ৎসনা করতে লাগলেন। তারপর ব্রহ্মার উপদেশে তারা গাভীমাতা সুরভীকে সঙ্গে নিয়ে গোবর্ধন পর্বতের নিকটে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তার অশ্রুজলে শক্রকু- নামক সরোবর সৃষ্টি হলো। গাভীলোকের গাভীগণ দুধ দ্বারা এবং ঐরাবত আকাশগঙ্গার জল দ্বারা ভগবানের মহাঅভিষেক সম্পন্ন করলেন। আর এদিকে আকাশ নির্মল হলো, নিত্যনতুন ফুল-ফলের দ্বারা সবকিছু শোভিত হলো, পাখিরা কুজন করতে লাগলেন এবং ব্রজভূমি কৃষ্ণের কৃপাদৃষ্টিতে আগের ন্যায় সুশোভিত হয়ে উঠল। ব্রহ্মণ্যদেব গোবিন্দ, যিনি গাভী ও ব্রাহ্মণদের রক্ষা করেন, সেই শ্রীকৃষ্ণ ব্রজবাসীদের রক্ষা করলেন এবং গিরিরাজের মহিমা প্রকাশিত করলেন।