এই পোস্টটি 313 বার দেখা হয়েছে
কেন আপনার সন্তান আপনার অবাধ্য হয় কিংবা আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করে? আমরা হয়তো ভাবতে পারি যে তারা স্বাভাবিকভাবেই অবাধ্য, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয় ।উর্মিলা দেবী দাসীচলুন আমরা শিশুদের দুর্ব্যবহারের কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব :
নিম্নতর গুণশ্রীমদ্ভগবদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ত্রিগুণ – সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণ সম্পর্কে ব্যক্ত করেছেন। এই জড়জগতের সবকিছুই এদের কোনো একটি বা তিনটিরই সমন্বয়ে গঠিত। যেমন: খাদ্য, কর্ম, খেলাধুলা, গ্রন্থ, পোশাক, জ্ঞান, সম্পর্ক, দিনের নির্দিষ্ট সময় ইত্যাদি সবকিছুই এই ত্রিগুণের মধ্যে অবস্থান করে। সাধারণত সন্তানদের চারপাশের পরিবেশ যদি সত্ত্বগুণের হয় তবে তারা স্বাভাবিকভাবেই ভালোভাবে বেড়ে উঠতে সমর্থ হয় । কিন্তু যারা রজঃ ও তমোগুণের পরিবেশে বেড়ে উঠে, তারা এই দুটি গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উঠে। যেমন— তমোগুণের কোনো পরিবেশে ছেলে-মেয়েরা দেরিতে ঘুমাতে যায় আর ঘুম থেকে দেরিতে উঠে, সংঘর্ষাত্মক ও কুরুচিপূর্ণ চলচ্চিত্র দেখতে অভ্যস্ত হয়, মাংস ও নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে এবং চারপাশের পরিবেশে পরস্পর পরস্পরের মধ্যে অপমান ও মারামারি ইত্যাদি হয়ে থাকে। সত্ত্বগুণ পারমার্থিক উন্নতি লাভে সহায়ক, অন্যদিকে রজঃ ও তমোগুণ প্রতিবন্ধকরূপে কাজ করে।
কপটতাযে সমস্ত শিশুরা পারমার্থিক পরিবেশে বাস্ করে তারা কদাচিৎ দ্বন্দ্বভাবসম্পন্ন হয়ে থাকে। কখনো কখনো শিশুরা অবাধ্য হয় যদি তারা বড়দের মাঝে কপটতা দর্শন করে; যেমন— কৃষ্ণভাবনামৃত শিক্ষা দানে পিতামাতা, শিক্ষক এবং ধর্মীয় পথপ্রদর্শকের অধর্মসুলভ ব্যবহার। এই ধরনের অবাধ্যতার আবির্ভাব ঘটে সাধারণত কৈশোরের শুরুতে, কেননা তখন একটি শিশু বড়দের সমাজিক পরিবেশ উপলব্ধির জন্য বিস্তৃত বুদ্ধিমত্তা লাভ করে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য সব বয়োঃজ্যেষ্ঠরা হয়তো যথাযথ নাও হতে পারেন, তবে সৎভাবে তাদের ভুলগুলো স্বীকার করলে তা শিশু-কিশোরদের কাছে আদর্শরূপে প্রতীয়মান হয়।
ভুল প্রতিক্রিয়াযেসমস্ত শিশুদের সাথে কদাচিৎ স্নেহপূর্ণ আচরণ করা হয় তারা মাঝে মাঝে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য অনিয়ন্ত্রিত আচরণ করে থাকে। আমি দেখেছি অনেক সময় শিশুরা কদর্য বা ন্যাক্করজনক কথা বলে থাকে যাতে বড়রা রাগ প্রদর্শন করে। তখন হয়তোবা বড়রা তাদের প্রতি খারাপ আচরণ করে থাকে, কিন্তু একজন স্নেহ উন্মুখ শিশুর জন্য যেকোনো ধরনের ভাবের আদান-প্রদান প্রয়োজনীয় এবং তা কোনো প্রকারের ভাবের আদান-প্রদান না থাকার চেয়েও শ্রেয়তর। কিন্তু এই শিশুরা যখন উচ্ছৃঙ্খল হয় তখন ভাববিহীন কঠোর নির্দেশনার প্রয়োজন কিন্তু অন্যান্য সময়ে প্রচুর ভালোবাসা এবং স্নেহ প্রদান করা উচিত।
অনিয়ন্ত্রিত জীবনযখন শিশুরা অসুস্থ, ক্লান্ত কিংবা ক্ষুধার্ত হয়, তখন তাঁরা বড়দের মত তাদের প্রয়োজনীয়তার কথা প্রকাশ করে নাা বরং তারা অভদ্র এবং অসহযোগিতামূলক আচরণ করতে পারে। যেসমস্ত শিশুরা নিয়মিতভাবে দেরিতে ঘুমাতে যায়, তারা ক্রমাগতভাবে অবাধ্য হয়ে পড়ে। যেসমস্ত শিশুদের খাওয়া এবং ঘুমানো অনিয়মিত হয়, তারা সবর্দাই ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত থাকে এবং রূঢ় আচরণ করে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় দেওয়া উপদেশ- নিয়ন্ত্রিত খাওয়া ও ঘুমানোই হচ্ছে শিশুদের উত্তম আচরণ গঠনের চাবিকাঠি।
অনুন্নত অনুশীলনহয়তো শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু কিছু মাতা-পিতা এবং শিক্ষকের শিক্ষার কারণে মূলত শিশুরা অবাধ্য, অভদ্র, ক্রোধী এবং অন্যান্য খারাপ আচরণ শিক্ষা লাভ করে। শিশুরা সাধারণত এমনভাবে আচরণ করে থাকে যাতে সে তার আচরণের ফলস্বরূপ কোনো পুরস্কার লাভ করতে পারে। যেমন— যখন শিশুরা তাদের পিতা-মাতাকে অপমান করে কিংবা শাসায় তৎক্ষণাৎ পিতা মাতারা তাদের চাওয়া পূরণ করে দেন, এতে শিশুটি নষ্ট হওয়ার পথে ক্রমাগত অগ্রসর হয়, ঠিক যেমন একটি পশুকে ট্রেনিং দেওয়া হয় দেহটিকে ঘোরাতে এবং লম্ফ দিয়ে উঁচুতে থাকা খাবার সংগ্রহ করতে।
উপলব্ধিহীন প্রকৃতিমাঝে মাঝে শিশুদের আচরণ অসভ্যতা মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা নয়। বিভিন্ন বয়সে শিশুদের স্বাভাবিক আচরণ সম্বন্ধে যেসমস্ত বয়োঃজ্যেষ্ঠদের স্বল্প জ্ঞান রয়েছে তাঁরা শিশুদের ভিন্নতর আচরণ সম্পর্কে নিজেই ভ্রান্তিপূর্ণ মনোভাব পোষণ করতে পারেন।
এছাড়াও প্রত্যেক শিশুই জন্মগত কিছু মানসিকতা নিয়ে আসে। আমরা সাধারণত মনে করি, আমাদের চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের অনুভূতি বা হৃদয়ঙ্গমই হল আদর্শ, কিন্তু পক্ষান্তরে আমাদের সন্তানদের হয়তোবা ভিন্নতর কিন্তু একইভাবে গ্রহণযোগ্য অনুভূতি থাকতে পারে। যেমন- একজন পিতা বা মাতা গম্ভীর, স্বল্পভাষী, অন্তর্মুখী, কর্মমুখী হতে পারে কিন্তু তাদের সন্তান সক্রিয়, চটপটে, বহির্মুখী এবং মানুষমুখী হতে পারে। তখন পিতা-মাতার কাছে মনে হতে পারে যে, তাদের সন্তান বিক্ষিপ্ত, চপলমতি, দায়িত্বজ্ঞানশূন্য এবং অসহযোগী। পিতা-মাতাকে অবশ্যই জানতে হবে যে, প্রত্যেকটি স্বভাব কিংবা চরিত্রকে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত করা যায়। একজন মাতা যিনি ধীরভাবে ভগবানের বিগ্রহের জন্য পোশাক সেলাইয়ে মগ্ন থাকতে ভালোবাসেন; তিনি হয়তো দেখলেন যে তার কন্যা ভগবানের মহোৎসব উদযাপনের পরিকল্পনা করতে ভালোবাসে ।
মন্দ উদাহরণসমূহছোটদের ব্যাপারে বড়দের সর্বাপেক্ষা মারত্মক ভুল হল, ছোটদের সাথে অন্যান্য বয়োঃজ্যেষ্ঠ সুবিবেচনাকারীদের সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া। যদি একজন পিতামাতা শিশুর শিক্ষকের সমালোচনা করে তবে শিশুটি ভাবতে থাকে, “কেন আমাকে শিক্ষকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে বা বাড়ির পড়া শেষ করতে হবে? আমার পিতা-মাতা অবশ্যই আমার পাশেই আছেন।” যে পরিবারে একজন পিতা বা মাতা, তাদের সন্তান এবং অন্য পিতা বা মাতার মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করেন সেই পরিবারের শিশুরা কখনোই সহযোগিতামূলক মনোবৃত্তির বিকাশ সাধন করতে পারেন না।
আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে যাতে আমাদের অসুস্থতা, ক্লান্তি, ক্ষুধা কিংবা মানসিক অশান্তি ইত্যাদির কষ্ট আমাদের সন্তানদের ওপর চাপিয়ে না দিই ।
যখন আমরা আমাদের সন্তানদের নানা অসুবিধার মুহূর্তে তাদের আশ্রয়দাতা কিংবা অবলম্বনরূপে আবির্ভূত হব তখন আমরা বুঝতে সক্ষম হবো যে, পিতামাতা এবং সন্তানদের মধ্যে এমন এক সহজাত সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রয়েছে যা আমাদের এবং তাদের উভয়ের কৃষ্ণভাবনামৃতের প্রগতিতে খুব স্বাভাবিকভাবেই সাহায্য করে থাকে।
(উর্মিলা দেবী দাসী এবং তাঁর পরিবার ক্যারোলিনাতে একটি বালক-বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনা করেন এবং তিনি Vaikuntha Children: a guide to Krishna Conscious education for children গ্রন্থের লেখক)
ত্রৈমাসিক ব্যাক টু গডহেড, অক্টোবর – ডিসেম্বর ২০১৩ |
|