এই পোস্টটি 596 বার দেখা হয়েছে
নারায়ণের পুত্র ব্রহ্মা, যমরাজ ও ভীষ্মদেবের কি সিদ্ধান্ত?
কমললোচন গৌরাঙ্গ দাস
এভাবেই বিরুদ্ধপক্ষ নানা রকম তর্কের উত্থাপন করে। কিন্তু শ্রীমদ্ভাগবতের শ্লোক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাদের সেই সমস্ত তর্ককে খণ্ডন করে।” (৬২)
“যা অদ্বয়জ্ঞান, অর্থাৎ এক ও অদ্বিতীয় বাস্তব বস্তু, তত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতেরা তাকেই তত্ত্ব বলেন। সেই তত্ত্ববস্তু ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবান, এই তিন নামে অভিহিত হন।” (৬৩) (শ্রীমদ্ভাগবত (১/২/১১)
“হে ভাইসকল, দয়া করে তোমরা এই শ্লোকের ব্যাখ্যা শ্রবণ করে তার অর্থ বিচার কর, একই মুখ্যতত্ত্ব তিনটি বিভিন্ন রূপে জ্ঞাত হন।” (৬৪)
“স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ এক ও অদ্বিতীয় পরমতত্ত্ব। তিনি নিজেকে ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবান, এই তিনটি রূপে প্রকাশিত করেন।” (৬৫)
এই শ্লোকের স্পষ্ট অর্থ তোমাকে তর্ক থেকে বিরত করেছে। এখন শ্রীমদ্ভাগবতের আরেকটি শ্লোক শ্রবণ কর। (৬৬)
তাৎপর্য : শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন বিষ্ণু বা নারায়ণের অবতার এই মতবাদটি শ্রীমদ্ভাগবতের এই শ্লোকটিতে (১/৩/২৮) স্পষ্টভাবে খণ্ডন করা হয়েছে। পক্ষান্তরে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সর্ব কারণের পরম কারণ, আদিপুরুষ পরমেশ্বর ভগবান। এই শ্লোকটির মাধ্যমে স্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয়েছে যে, শ্রীরামচন্দ্র, নৃসিংহদেব, বরাহদেব আদি সমস্ত অবতারেরা হচ্ছেন বিষ্ণুতত্ত্ব। কিন্তু তাঁরা সকলেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অংশ অথবা কলা। (৬৭)
“শ্রীমদ্ভাগবতে সাধারণভাবে সমস্ত অবতারের লক্ষণ ও কার্যাবলী বর্ণনা করা হয়েছে এবং তাঁদের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রকেও গণনা করা হয়েছে। (৬৮)
“শ্রীল সূত গোস্বামী তখন মনে বড় ভয় পেলেন। তাই তিনি প্রতিটি অবতারের বিশেষ বিশেষ লক্ষণ বর্ণনা করলেন।” (৬৯)
“ভগবানের সমস্ত অবতারেরা হচ্ছেন পুরুষাবতারদের অংশ ও কলা। কিন্তু আদি পুরুষ হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। তিনি স্বয়ং ভগবান এবং সমস্ত অবতারের অবতারী।” (৭০)
“এখন বিরুদ্ধপক্ষ হয়ত বলতে পারে, “সেটি তোমার নিজের ব্যাখ্যা, কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন নারায়ণ, যিনি পরব্যোমে বিরাজ করেন।” (৭১)
“তিনি (নারায়ণ) শ্রীকৃষ্ণরূপে অবতরণ করেন। আমার মতে সেটিই হচ্ছে এই শ্লোকের প্রকৃত অর্থ। সুতরাং অন্য আর কোন বিচারের প্রয়োজন নেই।” (৭২)
“এই ধরনের ভ্রান্ত ব্যাখ্যাকারদের আমরা বলি, “কেন এভাবে কুতর্ক করছ? শাস্ত্রবিরুদ্ধ অর্থ কখনও প্রমাণ বলে গ্রহণ করা হয় না।” (৭৩)
“উদ্দেশ্যের আগে বিধেয় উল্লেখ করা উচিত নয়, কেন না তার ফলে সেই বাক্যের আশ্রয় থাকে না এবং তাই তার প্রতিষ্ঠা হয় না।” (৭৪)তাৎপর্য : অলঙ্কারের এই নিয়মটি একাদশী-তত্ত্বের ত্রয়োদশ স্কন্ধে শব্দের আলঙ্কারিক ব্যবহার সম্বন্ধে উক্ত হয়েছে।
আলঙ্কারিক বিচার অনুসারে অজ্ঞাত বিষয়কে বিধেয় এবং জ্ঞাত বস্তুকে অনুবাদ বা উদ্দেশ্য বলা হয়। অজ্ঞাত বিষয়কে জ্ঞাত বস্তুর পূর্বে উল্লেখ করা উচিত নয়, কেন না তা হলে সেই বিষয়ের কোন অর্থ থাকে না।
“অনুবাদ বা উদ্দেশ্য উল্লেখ না করে বিধেয় উল্লেখ করা হয় না। তাই আগে উদ্দেশ্য উল্লেখ করে তার পরে বিধেয় সম্বন্ধে বলা হয়।” (৭৫)
“পাঠকের কাছে বাক্যের যে অংশ অজ্ঞাত, তাকে বলা হয় বিধেয় এবং যে অংশ জ্ঞাত তাকে বলা হয় অনুবাদ।” (৭৬)
“দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ‘এই বিপ্র পরম পণ্ডিত।’ এই বাক্যে বিপ্র হচ্ছে অনুবাদ এবং পাণ্ডিত্য হচ্ছে তার বিধেয়।” (৭৭)
“যেহেতু মানুষটি বিপ্র, তাই তারবিপ্রত্ব সম্বন্ধে সকলেই জ্ঞাত। কিন্তু তার পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে সকলে জ্ঞাত নয়। অতএব আগে মানুষটির পরিচয় প্রদান করে পরে তার গুণের কথা (পাণ্ডিত্য) বলা হয়েছে।” (৭৮)
“তেমনই, এখানে এই সমস্ত অবতারের সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়া গেল কিন্তু তাঁরা যে কার অবতার সেই বিষয়টি অজ্ঞাত থেকে গেল।”(৭৯)
“প্রথমে ‘এতে’ (‘এই সমস্ত’) শব্দে অনুবাদ (অবতারসমূহ) সম্বন্ধে বলা হয়েছে। তার পরে ‘পুরুষ-অবতারদের অংশ’ বিধেয়রূপে উল্লেখ করা হয়েছে।” (৮০)
“তেমনই, শ্রীকৃষ্ণকে যখন অবতারগণের মধ্যে গণনা করা হল, তাঁর সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান তখনও অপ্রকাশিত ছিল। (৮১)
“সুতরাং, অনুবাদরূপে প্রথমে ‘কৃষ্ণ’ শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে এবং সেই অনুবাদের বিধেয়রূপে তাঁর ভগবত্তাকে পরে বর্ণনা করা হয়েছে।” (৮২)
“তার ফলে প্রতিপন্ন হল যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান। এখানে শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া যে অন্য আর কেউ স্বয়ং ভগবান নন, তা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল।” (৮৩)
“শ্রীকৃষ্ণ যদি অংশ হতেন এবং নারায়ণ যদি হতেন তাঁর অংশী, তা হলে শ্রীল সূত গোস্বামীর উক্তিটি বিপরীত হত।” (৮৪)
“তা হলে তিনি বলতেন, ‘সমস্ত অবতারের উৎস নারায়ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং তিনি শ্রীকৃষ্ণরূপে আবির্ভূত হয়েছেন’।” (৮৫)
“বিজ্ঞ ঋষিদের বাক্যে ভ্রম (ভুল করার প্রবণতা), প্রমাদ (মোহগ্রস্ত হওয়ার প্রবণতা), বিপ্রলিপ্সা (প্রতারণা করার প্রবণতা) ও করণাপাটব (ভ্রান্ত ইন্দ্রিয়ানুভূতি) জনিত কোন দোষ বা ত্রুটি থাকে না।” (৮৬)
তাৎপর্য : শ্রীমদ্ভাগবতে অবতার ও পুরুষের অংশপ্রকাশসমূহের তালিকা দেওয়া হয়েছে এবং সেই তালিকায় শ্রীকৃষ্ণেরও উল্লেখ রয়েছে।
শ্রীমদ্ভাগবতে আবার এও উল্লেখ করা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন আদিপুরুষ ভগবান, তাই শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্তসমূহ পরমেশ্বররূপে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বই প্রতিপন্ন করে। শ্রীকৃষ্ণ যদি নারায়ণের অংশ প্রকাশ হতেন, তা হলে মূল শ্লোকটি ভিন্নরূপে রচিত হত; তা হলে অবশ্যই তা বিপরীতভাবে বর্ণিত হত। কিন্তু নিত্যমুক্ত ঋষিদের বাক্যে ভ্রম, প্রমাদ, বিপ্রলিপ্সা ও করণাপাটব জনিত কোন দোষ থাকতে পারে না। তাই শ্রীকৃষ্ণ যে পরমেশ্বর ভগবান, এই বর্ণনায় কোন ভুল নেই।
কৃষ্ণই আদি নারায়ণ
এষ বৈ ভগবান্ সাক্ষাদাদ্যো নারায়ণঃ পুমান্।
মোহয়ন্মায়য়া লোকং গূঢ়শ্চরতি বৃষ্ণিষু ॥
শ্রীমদ্ভাগবত (১/৯/১৮)
“এই শ্রীকৃষ্ণ সাক্ষাৎ অচিন্ত্য, আদি পুরুষ। তিনি আদি নারায়ণ, পরম ভোক্তা। কিন্তু তিনি তাঁর নিজের সৃষ্ট মায়াশক্তির প্রভাবে আমাদের মুগ্ধ করে বৃষ্ণিকুলেরই একজনের মতো হয়ে তাঁদের মাঝে বিচরণ করছেন।”
তাৎপর্য : এখানে একজন তত্ত্ববেত্তা মহাজন শ্রীকৃষ্ণের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তাঁকে পরমেশ্বর ভগবান এবং আদি নারায়ণ বলে নির্দেশ করছেন। শঙ্করাচার্যের মতো একজন নির্বিশেষবাদীও শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ভাষ্য রচনা করতে গিয়ে শুরুতে বলেছেন যে নারায়ণ, পরমেশ্বর ভগবান, জড় সৃষ্টি অতীত।
নারায়ণঃ পরোহব্যক্তাদ্ অণ্ডমব্যক্ত-সম্ভবম্।
অণ্ডস্যান্তস্তিমে লোকাঃ সপ্তদ্বীপা চ মেদিনী ॥
(শঙ্কর-ভাষ্য-ভঃ গীঃ)
এই ব্রহ্মাণ্ড একটি জড় সৃষ্টি, কিন্তু নারায়ণ এই প্রকার ভৌতিক সৃষ্টির অতীত।
ভীষ্মদেব হচ্ছেন দিব্য জ্ঞানের তত্ত্ব সম্বন্ধে অবগত দ্বাদশ মহাজনদের অন্যতম। তিনি যে শ্রীকৃষ্ণকে আদি পরমেশ্বর ভগবান বলে প্রতিপন্ন করেছেন, তা নির্বিশেষবাদী শঙ্করাচার্য কর্তৃকও সমর্থিত হয়েছে। অন্য সমস্ত আচার্যেরাও এই উক্তি সমর্থন করেছেন এবং তার ফলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে আদিপুরুষ পরমেশ্বর ভগবান বলে স্বীকার না করার কোন অবকাশ নেই। ভীষ্মদেব বলেছেন যে, তিনি হচ্ছেন আদি নারায়ণ। সে কথা ব্রহ্মাজীও শ্রীমদ্ভাগবতে (১০/১৪/১৪) প্রতিপন্ন করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন আদি নারায়ণ। বৈকুণ্ঠলোকে অসংখ্য নারায়ণ রয়েছেন, যাঁরা সকলেই এক এবং অভিন্ন ভগবান এবং তাঁরা আদিপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের অংশ। শ্রীকৃষ্ণের প্রথম বিস্তার হচ্ছেন বলদেব এবং বলদেব থেকে সঙ্কর্ষণ, প্রদ্যুম্ন, অনিরুদ্ধ, বাসুদেব, নারায়ণ, পুরুষ, রাম, নৃসিংহ আদি বহু রূপ প্রকাশিত হয়। এই সমস্ত অংশপ্রকাশই বিষ্ণু-তত্ত্ব এবং শ্রীকৃষ্ণ এই সমস্ত অংশপ্রকাশের আদি উৎস। তাই তিনি হচ্ছেন সাক্ষাৎ পরমেশ্বর ভগবান। তিনি জড় জগতের স্রষ্টা এবং সমস্ত বৈকুণ্ঠলোকের অধিষ্ঠাতৃ বিগ্রহস্বরূপ নারায়ণ। তাই মনুষ্য সমাজে তাঁর লীলা মোহজনক। তাই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান বলেছেন যে, মূর্খ মানুষেরা তাঁর পরম ভাব না জেনে তাঁকে একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করে। শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে মোহের কারণ হচ্ছে তাঁর তটস্থা নামক তৃতীয় শক্তির উপর অন্তরঙ্গা এবং বহিরঙ্গা- এই দুই শক্তির ক্রিয়া। জীবেরা হচ্ছে তাঁর তটস্থা শক্তির প্রকাশ এবং তার ফলে তারা কখনো তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তির দ্বারা এবং কখনো বহিরঙ্গা শক্তির দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়। তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তিজনিত মোহের ফলে শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে অসংখ্য নারায়ণরূপে প্রকাশ করে চিজ্জগতে জীবের অপ্রাকৃত প্রেমময়ী সেবা স্বীকার করেন অথবা ভাব বিনিময় করেন। আর তাঁর বহিরঙ্গা শক্তি বিস্তারের মাধ্যমে তিনি তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন যোনিসম্ভূত জীবদের হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য মনুষ্য, পশু অথবা দেবতাদের মধ্যে অবতরণ করেন। ভীষ্মদেবের মতো মহাজনেরা কিন্তু ভগবানের কৃপায় তাঁর এই মোহময়ী প্রভাব থেকে নিষ্কৃতি পান।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর কৃষ্ণেরই ত্রিমূর্তি শুকদেব গোস্বামী বললেন- পরম আদরণীয় উদ্ধবের দ্বারা এইভাবে জিজ্ঞাসিত হয়ে সমস্ত ঈশ্বরগণেরও ঈশ্বর, সমগ্র জগৎ যাঁর নিকট ক্রীড়ানকের মতো এবং যিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব- এই ত্রিমূর্তি ধারণ করেন, সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রেমার্দ্র চিত্তে তাঁর সর্বাকর্ষক মৃদু হাস্য প্রদর্শন করে উত্তর প্রদান করতে শুরু করলেন।
(শ্রীমদ্ভাগবত ১১/২৯/৭)
“গো-ব্রাহ্মণ হিতকারী ব্রহ্মণ্যদেব ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নমস্কার। জগৎহিতকারী শ্রীগোবিন্দকে বারবার নমস্কার। আপনি ব্রহ্মরূপে বিশ্বরচনা করেন, আবার তার স্থিতি হলে বিষ্ণুরূপে পালন করেন এবং অন্তকালে রুদ্ররূপে সংহার করেন-এরূপ ত্রিমূর্তিধারী আপনাকে নমস্কার”।
(বিষ্ণুপুরাণ ১/১৯/৬৫-৬৬)
ভগবান কৃষ্ণ দুই ভাগে বিভক্ত হলেন। তাঁর দক্ষিণার্দ্ধ দ্বিভুজ এবং বামার্দ্ধ চতুর্ভূজ হল।
(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ প্রকৃতি খণ্ড অধ্যায় ২/৫৭)
“নারায়ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান আর তাঁর থেকে ব্রহ্মার জন্ম হয় ও শিবের জন্ম হয়।
(বরাহ পুরাণ)
শ্রীকৃষ্ণের
বিশ্বরূপ, চতুর্ভুজ ও দ্বিভুজ
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে কে, তা কেউই জানতে পারে না। কেউই বুঝতে পারে না কিভাবে তিনি তাঁর চতুর্ভুজ রূপ নিয়ে তাঁর জনক-জননীর সামনে আবির্ভূত হলেন এবং তার পরেই তাঁর দ্বিভুজ রূপে রূপান্তরিত হলেন। বেদ অধ্যয়ন করে কিংবা দার্শনিক জল্পনা-কল্পনা করে এসব ব্যাপার বুঝতে পারা খুবই কঠিন। এখানে তাই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কেউই তাঁকে দেখতে পায় না কিংবা এসব তত্ত্ব-উপলব্ধিতে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু যাঁরা বৈদিক শাস্ত্রের অভিজ্ঞ ছাত্র, তাঁরাই কেবল বৈদিক শাস্ত্রের মাধ্যমে নানাভাবে তাঁকে জানতে পারেন।
শ্রীকৃষ্ণের সবিশেষ দ্বিভুজ ও চতুর্ভূজ রূপ অর্জুনকে প্রদর্শিত বিশ্বরূপ থেকে সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন।চতুর্ভুজধারী নারায়ণ রূপ এবং দ্বিভুজধারী শ্রীকৃষ্ণরূপ হচ্ছেন নিত্য ও অপ্রাকৃত, কিন্তু অর্জুনকে যে বিশ্বরূপ দেখানো হয়েছিল তা হচ্ছে অনিত্য। সুদর্শন শব্দটির অর্থ ‘দর্শন করা অত্যন্ত দুষ্কর’। অর্থাৎ তাঁর সেই বিশ্বরূপ কেউই দর্শন করেননি। ভগবান এখানে এটিও বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, তাঁর ভক্তকে তাঁর সেই রূপ দেখাবার কোন প্রয়োজনও হয় না। অর্জুনের অনুরোধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই রূপ দেখিয়ে ছিলেন, যাতে ভবিষ্যতে কেউ যদি ভগবানের অবতার বলে নিজেকে প্রতিপন্ন করতে চান, তাহলে তিনি সত্যি সত্যি ভগবানের অবতার কি না তা জানবার জন্য মানুষ তাঁকে তাঁর বিশ্বরূপ দেখানোর কথা বলতে পারে।
শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বিশ্বরূপ থেকে চতুর্ভূজ নারায়ণ রূপে রূপান্তরিত হলেন এবং তার পরে তাঁর প্রকৃত স্বরূপ দ্বিভুজ শ্যামসুন্দরে রূপান্তরিত হলেন। এর থেকে বুঝা যায় যে, বৈদিক শাস্ত্রে তাঁর যে চতুর্ভুজ এবং অন্যান্য রূপের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, তা সবই শ্রীকৃষ্ণের দ্বিভুজ রূপ থেকে প্রকাশিত হয়েছেন। দ্বিভুজ শ্যামসুন্দর মুরলীধর শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সব কিছুর উৎস। নির্বিশেষ ব্রহ্মের কথা তো দূরে থাক, তাঁর এই সমস্ত রূপ থেকেও শ্রীকৃষ্ণ স্বতন্ত্র। শ্রীকৃষ্ণের চতুর্ভূজ রূপ সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, তাঁর অভিন্ন চতুর্ভূজ প্রকাশ (যাঁকে মহাবিষ্ণু নামে সম্বোধন করা হয়, যিনি কারণ সমুদ্র শয়ন করে আছেন এবং যাঁর শ্বাস-প্রশ্বাসের ফলে অগণিত ব্রহ্মাণ্ডের প্রকাশ হচ্ছে এবং লয় হচ্ছে), তিনিও পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অংশ-প্রকাশ।
তাই ব্র্রহ্মসংহিতায় (৫/৪৮) বলা হয়েছে- “মহাবিষ্ণু, যাঁর মধ্যে অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ড প্রবেশ করছে এবং কেবল মাত্র যাঁর শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেগুলি আবার তাঁর মধ্য থেকে প্রকাশিত হচ্ছে, তিনিও হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের অংশ-প্রকাশ।” তাই পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সবিশেষ রূপ শ্যামসুন্দর শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরম আরাধ্য এবং তিনি হচ্ছেন সৎ, চিৎ ও আনন্দময়। তিনিই হচ্ছেন শ্রীবিষ্ণুর সমস্ত রূপের উৎস, তিনি হচ্ছেন সমস্ত অবতারের রূপের উৎস এবং তিনি হচ্ছেন আদিপুরুষ। সেই তত্ত্ব ভগবদ্গীতায় সর্বতোভাবে প্রতিপন্ন হয়েছে।
বৈদিক শাস্ত্রে (গোপালতাপনী উপনিষদ ১/১) উল্লেখ আছে- “আমি শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি জ্ঞাপন করছি, যাঁর অপ্রাকৃত রূপ হচ্ছে সৎ, চিৎ ও আনন্দময়। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি, কারণ তাঁকে জানার অর্থ সমগ্র বেদকে জানা এবং সেই কারণেই তিনি হচ্ছেন পরম গুরু।” তার পরে বলা হয়েছে, কৃষ্ণো বৈ পরমং দৈবতম্ “শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান।” (গোপালতাপনী ১/৩) একো বশী সর্বগঃ কৃষ্ণ ঈড্যঃ- “সেই একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান এবং তিনিই আরাধ্য।” একোহপি সন্ বহুধা যোহবভাতি- “শ্রীকৃষ্ণ এক, কিন্তু তিনি অনন্ত রূপ ও অবতারের মাধ্যমে প্রকাশিত হন।” (গোপালতাপনী ১/২১)
ব্রহ্মসংহিতায় (৫/১) বলা হয়েছে- “পরম পুরুষোত্তম ভগবান হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর নিত্য, জ্ঞানময় ও আনন্দময় একটি শরীর আছে। তাঁর কোনও আদি নেই, কেন না তিনি সব কিছুরই উৎস। তিনি হচ্ছেন সকল কারণের কারণ।”
অন্যত্র বলা হয়েছে, যত্রাবতীর্ণং কৃষ্ণাখ্যং পরং ব্রহ্ম নরাকৃতি– “সেই পরমতত্ত্ব হচ্ছেন সবিশেষ পুরুষ, তাঁর নাম শ্রীকৃষ্ণ এবং তিনি কখনও কখনও এই জগতে অবতরণ করেন।” তেমনই, শ্রীমদ্ভাগবতে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সমস্ত অবতারের বর্ণনা করা হয়েছে এবং সেই তালিকায় শ্রীকৃষ্ণের নামও আছে। কিন্তু তারপর সেখানে বলা হয়েছে যে, এই শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের অবতার নন, তিনি হচ্ছেন স্বয়ং পরম পুরুষোত্তম ভগবান (এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্)। তেমনই, ভগবদ্গীতায় ভগবান বলছেন, মত্তঃ পরতরং নান্যৎ– “আমার পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রূপের থেকে উত্তম আর কিছুই নেই।” ভগবদ্গীতায় তিনি আরও বলেছেন, অহমাদির্হি দেবানাম্- “সমস্ত দেবতাদের আদি উৎস হচ্ছি আমি।” ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে ভগবৎ-তত্ত্ব অবগত হওয়ার ফলে অর্জুনও সেই সম্বন্ধে বলছেন, পরং ব্রহ্ম পরং ধাম পবিত্রং পরমং ভবান্- “এখন আমি সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পেরেছি যে, তুমি হচ্ছ পরম পুরুষোত্তম ভগবান, পরমতত্ত্ব এবং তুমি হচ্ছ সকলের পরম আশ্রয়।” তাই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন, তা ভগবানের আদি স্বরূপ নয়। তাঁর আদি স্বরূপে তিনি হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। সহস্র সহস্র হস্ত ও পদবিশিষ্ট তাঁর যে বিশ্বরূপ, তা কেবল তাদেরকেই আকৃষ্ট করবার জন্য যাদের ভগবানের প্রতি প্রেমভক্তি নেই। এটি ভগবানের আদি স্বরূপ নয়। যাঁরা ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত, যাঁরা ভগবানের সঙ্গে অপ্রাকৃত রসে প্রেমভক্তিতে যুক্ত, বিশ্বরূপ তাঁদের আকৃষ্ট করে না। শ্রীকৃষ্ণ-স্বরূপে ভগবান তাঁর ভক্তদের সঙ্গে অপ্রাকৃত প্রেম বিনিময় করেন। তাই অর্জুন, যিনি সখ্যরসে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে যুক্ত ছিলেন, তাঁর কাছে এই বিশ্বরূপের প্রকাশ মোটেই আনন্দদায়ক ছিল না। বরং, তা ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল। অর্জুন, যিনি হচ্ছেন ভগবানের নিত্য সহচর, অবশ্যই দিব্য দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। তিনি কোন সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তাই, তিনি বিশ্বরূপের দ্বারা আকৃষ্ট হননি। যারা সকাম কর্মের দ্বারা নিজেদের উন্নীত করতে চান, তাদের কাছে এই রূপ অতি আশ্চর্যজনক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু যাঁরা ভক্তিযোগে ভগবানের সেবায় রত, তাঁদের কাছে শ্রীকৃষ্ণের দ্বিভুজ রূপই হচ্ছে সবচেয়ে প্রিয়।
(গীতা ১১/৫৪ তাৎপর্য)
স্বরূপবিগ্রহ কৃষ্ণের কেবল দ্বিভুজ।
নারায়ণরূপে সেই তনু চতুর্ভুজ ॥
শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম, মহৈশ্বর্যময়।
শ্রীভূ-নীলা-শক্তি যাঁর চরণ সেবয় ॥
(শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃত আদি ৫/২৭-২৮)
শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ-বিগ্রহ দ্বিভুজ, কিন্তু নারায়ণরূপে তিনি চতুর্ভুজ। শ্রীনারায়ণ তাঁর চারটি হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ধারণ করেন এবং তিনি মহা ঐশ্বর্যমতি। শ্রী, ভূ ও নীলা শক্তি নিরন্তর তাঁর শ্রীপাদপদ্মের সেবা করেন।
লেখক পরিচিতি: শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামীর কাছ থেকে ১২ মার্চ ২০১৭ সালে শ্রীধাম মায়াপুরে দীক্ষা গ্রহণ করেন কমললোচন গৌরাঙ্গ দাস। তিনি দীর্ঘ যাবৎ ২০১৪ সাল থেকে চৈতন্য সন্দেশ ও ব্যাক গডহেড এ প্রকাশনায় বিভিন্ন সেবায় নিয়োজিত আছেন। বর্তমানে ব্যাক টু গডহেড এর সহকারী ব্যবস্থাপক ও ডিজাইনার হিসেবে সেবা করছেন। সে সাথে তিনি সরাসরি ও অনলাইনে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার করছেন।
ব্যাক টু গডহেড অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০২১ প্রকাশিত