কাম কভু প্রেম নয়

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০১৮ | ১০:১২ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৮ | ১০:১২ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 1269 বার দেখা হয়েছে

কাম কভু প্রেম নয়

আজকাল শব্দের অপব্যবহার মাত্রে “প্রেম” কথাটি সচরাচর প্রয়োগ হয়। সাধারণত প্রেম বলতে আমরা ভালবাসা বা কামকে বুঝি। আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যুবক-যুবতীর ভালবাসাকে ‘প্রেম’ বলে উদ্দিষ্ট করা হয়; প্রকৃতপক্ষে কিন্তু তা নয়। অনিত্য বস্তুতে যে প্রীতি- শাস্ত্রকারগণ তাকে ‘প্রেম’ বলে মেনে নিতে পারেন না। আজ যাকে ভালবাসছি, কাল যে সে শক্র হবে না সেকথা কি কখনও বলা যায়? যেখানে নিত্যতা খর্ব হয় সেখানে শুধু কামই বিদ্যমান। কামের উৎপত্তি কোথায়? গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,

“ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুংস সঙ্গস্তেসুপজায়তে। সঙ্গাৎ সংজায়তে কাম”।

বিষয়ের চিন্তা করতে করতে যখন আসক্তি হয়, সেই আসক্তি হতে কামের উৎপত্তি। তাহলে দেখা যায়, আমাদের ভালবাসার কারণ হচ্ছে কাম, কামের তাড়নায় একে অপরকে ভালবাসছি। সুতরাং যুবক-যুবতী বা স্বামী- স্ত্রীর ভালবাসাকে কখনও ‘প্রেম’ বলাযাবে না। স্বামী- স্ত্রীর স্বার্থ সেখানে চলে’, তারা পরস্পর স্বার্থে চালিত হয়ে এই ভালবাসার পরিচয় দেয়। যেখানে কামের পুরণে বাধাপ্রাপ্ত সেখানেই তাদের ভালবাসাসমাপ্ত। অর্থাৎ পান থেকে চুন খস্লে যেমন সম্বন্ধ থাকে না, তেমনই এই ভালবাসার সম্বন্ধ। শ্রুতিতে আছে,

“ন বা অরে পত্যঃ কামায় পতিঃ প্রিয়ো ভবতিঃ।

আত্মনন্ত কামায় পতিঃ প্রিয়ো ভবতিঃ।

পতির স্বীয় প্রয়োজনার্থে পতি স্ত্রীর প্রিয় হয় না, কিন্তু স্ত্রীর নিজ কাম আশা বর্তমান। আমরা সকলেই বলি পতিব্রতা স্ত্রী একমাত্র ধর্ম হলো স্বামী সেবা। রমণীর অন্তরে অন্তরতম প্রদেশে নিজস্বার্থ লুক্কায়িত না থাকলে পতিসেবা নিষ্ঠতা সম্ভব হত না। যদি তা নাহতো তবে পতি কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্থ জরাতুর বা ক্লীব হলে সে নিষ্ঠা থাকে না কেন? আবার কোন কোন স্থানে দেখা যায় পতি কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্থ হলেও পতি সেবা সতীনারীর ধর্ম তাই পতিসেবা করতে দেখা গেলেও তা হয়ত পরিণামে স্বর্গাদিকামনাপরা হয় যা দ্বারা এই দেহ ত্যাগান্তে স্বর্গে উভয়ের মহা ভোগীপ্রায় কামোপভোগ করা সম্ভব হবে। এই হলো এই জগতে ভালবাসা বা জড় কাম।

শ্রীমদ্ভাগবতে আমরা প্রহ্লাদ বাক্যে পাই-

অহোমে পিতরৌ বৃদ্ধৌ ভার্যাবালাত্মজাত্মজাঃ। অনাথা মামৃতে দীনাঃ কথং জীবন্তি দুঃখিতাঃ ॥

এবং গৃহাশয়াক্ষিপ্তঃ কৃপনো মৃঢ়ধীরয়ম্ । অতৃপ্তস্তানসুধ্যায়ন্মতোহন্ধ বিশতে তমঃ ॥

ভগবদ্ভবর্হিমুখ বলতে গেলে তারা জবাবদেয় যে, আমার বৃদ্ধ পিতা মাতা, অসহায় স্ত্রী, অনাথ পুত্র-কন্যাগণ বর্তমান. আমি যদি তাদেরকে না দেখি তারা কিরূপে জীবনধারণ করবে? এইরূপ গৃহ সংসারাদিতে আসক্তচিত্ত মূর্খগণ মৃত্যুর পর অন্ধতম নরকে প্রবেশ করে। সুতরাং আত্মেন্দ্রিয় প্রীতিবাঞ্ছা লোভে মানুষে মানুষে, জীবে জীবে, একে অপরে যেপ্রেম, সে প্রেম-‘কাম’।

শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী “শ্রী চৈতন্যচরিতমৃত গ্রন্থে বলেছেন-

আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি বাঞ্ছা তারে বলি কাম,-

কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতিবাঞ্ছা ধরে ‘প্রেম’ নাম ॥

অন্তকরণ সম্যক মসৃণিত হয়ে অতিশয় কৃষ্ণে মমতা যুক্তভাবে ঘণীভূক্ত হলে পন্ডিতগণ তাকে ‘প্রেম, বলে থাকে। মহাবদান্যবতার শ্রীমন্মহাপ্রভু যদি অবতীর্ণ না হতেন তবে আমাদের কাছে কে ঐ কাম ও প্রেমের পার্থক্য বুঝাতেন? প্রেম নামক পরমপুরুষার্থ কারই বা শ্রুতিগোচর হয়েছিল? নামের মহিমা কেবা জানাতেন। এই প্রেমকে পাঁচ প্রকারে বিভক্ত করা হয়েছে, যথা- শান্ত, দাস্য,সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর। শান্ত প্রেমিক- নবযোগীন্দ্র, সনক সনাতনাদি চতুঃসন। দাস্যপ্রেমিক- গোকুলের রক্ষক, পত্রকাদি দ্বারকার দারুকাদি, বৈকুন্ঠস্থ দাস্যসেবকগণ, তাছাড়া হনুমানাদি দাসগণ। সখ্যপ্রেমিক- শ্রীদামাদি সখাগণ (বিশ্রম্ব সখ্য), অর্জুনাদি (গৌরব সখ্য)। বাৎসল্য প্রেমিক- শ্রীনন্দ যশোদাদি পিতামাতা অন্যান্য গুরুবর্গ। মধুর প্রেমিক- ব্রজেরগোপীগণ, পুরের মহিষীগণ ও লক্ষ্মীগণ প্রভৃতি।এর মধ্যে একমাত্র ব্রজের গোপগনই সর্বোৎকৃষ্টা মাধুর্য্যরস মন্ডিতা। সুতরাং ‘প্রেম, বলতে আমরা নিষ্কাম কৃষ্ণপ্রেমই একমাত্র প্রয়োজন বলে জানবো। যে প্রেমের মধ্যে নেই জড় কামনা বা কামগন্ধ। অখিল রসামৃত সিন্ধু শ্রীকৃষ্ণের প্রীতার্থে সম্বন্ধযুক্তভাবে যা কিছু করা হয় তাকে “প্রেম” বলা হয়। সেইপ্রেমধন একমাত্র সাধুসঙ্গেই লভ্য হয়। কখনও শুদ্ধনিষ্কাম কৃষ্ণভক্তিরসে ভাবিতমতি পুরুষ পাওয়া গোলেকালবিলম্ব না করে শ্রদ্ধারূপ মূল্য দিয়ে কিনে নিতে হবে। যথাপদ্যবলী দ্বাদশ অঙ্কে

কৃষ্ণ ভক্তিরসভাবিতামতি: ক্রীয়তাং যদি কুতোহপি লভ্যাতে।

তত্র লৌল্যমপি মূল্যমেকলং জন্মকোটিসুকতৈর্ণ লভ্যতে ॥

কোটি জন্মকৃত সুকৃতি দ্বারা যা পাওয়া যায়, এইরূপ কৃষ্ণভক্তিরসভাবিতমতি ভক্ত যদি কোথাও লাভ হয় সংগে সংগে ক্রয় করে লও। আমরা যদি সর্বপ্রকার অভিমান পরিত্যাগ করে কায়, মন, ও বাক্যে নির্মল চিত্তে সাধুগুরু চরণে শরণাগত হতে পারি তবে প্রকৃত কাম ও প্রেমের পার্থক্য কি বুঝতে পারবো। সুতরাং কাম যে প্রেম নয় এ বিষয়ে সন্দেহ কি? হরেকৃষ্ণ।

(মাসিক চৈতন্য সন্দেশ জানুয়ারি ২০১০ সালে প্রকাশিত)

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।