এই পোস্টটি 348 বার দেখা হয়েছে
কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ
আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য
আমাদের বদ্ধ জীবনধারায় প্রতি পদক্ষেপেই আমরা না জেনে বিভিন্ন রকম পাপ কাজ করে চলেছি। আসলে জন্ম থেকেই আমরা অজ্ঞতার মধ্যে রয়েছি বলে এইরকম অজ্ঞাতভাবে পাপ কাজ করে চলেছি। এখন প্রশ্ন হল, এত অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও এই অজ্ঞতা এত প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে কেন? এর কারণ হল এত বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও সেগুলোতে আত্মতত্ত্ব, অর্থাৎ আত্মার বিজ্ঞান পড়ানো হয় না। সেই জন্য সাধারণ মানুষ অজ্ঞতার অন্ধকারেই ডুবে থাকে। যার ফলস্বরূপ তারা পাপ করে সেই পাপের কর্মফল ভোগ করতে থাকে। শ্রীমদ্ভাগবতে (৫/৫/৫) এই কথাই বলা হয়েছে। পরাভবস্তাবদ্্ অবোধজাতো যাবন্ন জিজ্ঞাসত আত্মতত্ত্বম্। অর্থাৎ যতক্ষণ না পর্যন্ত কেউ আত্মতত্ত্ব উপলব্ধি করতে না পারছে, ততক্ষণ জীবের নির্বুদ্বিতার দশা চলতেই থাকে। শিক্ষা-দানকারী এই সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোও অজ্ঞতার প্রসার ঘটাচ্ছে। যতক্ষণ অবধি না একজনের মনে চিন্তা আসে, ‘আমি কে? ভগবান কি? এই জগৎটা কি? পরমেশ্বর ভগবান ও এই জগতের সাথে আমরা সম্পর্ক কি?’এই সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর যতক্ষণ না খুঁজে পাচ্ছে, ততক্ষণ প্রত্যেকেই পশুর মতো নির্বোধ থাকে এবং বিভিন্ন জীবনের মধ্য দিয়ে নানা প্রজন্মে দেহান্তরিত হয়ে চলে। এটাই হল অজ্ঞতার ফল।
তাই আধুনিক সভ্যতা খুবই বিপজ্জনক। হয়ত সফল ব্যবসায়ী বা রাজনীতিক হয়ে এযুগে একজন নিজেকে সুখী মনে করতে পারেন, অথবা আমেরিকার মতো ধনীদেশে জন্ম পেয়ে কেউ অধিক স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ
করতে পারেন, কিন্তু এসবই অস্থায়ী। তাদের এই সব আপাত সুখী-জীবনের একসময় পরিবর্তন হয়ে যাবে। তাছাড়া আমরা কেউ-ই জানি না, এই জীবনে পাপপূর্ণ আচরণের জন্য পরজন্মে আমাদের কিরকম দুঃখ ভোগ করতে হবে। এজন্য কেউ যদি পারমার্থিক অনুশীলন না করে তবে অবশ্যম্ভাবীভাবে তার জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে। যেমন মনে করুন, শক্তি সমর্থ ও স্বাস্থ্যবান একজন ব্যক্তি কোনও একটি দূষিত পরিবেশে বাস করছে। তবে কি সে সুস্থভাবে জীবন কাটাতে পারবে? যেকোনও মুহূর্তে সে রোগাক্রান্ত হতে পারে। এইজন্য পারমার্থিক তত্ত্বজ্ঞান অনুশীলনের মধ্য দিয়েই আমাদের নিজেদের জীবনের অজ্ঞতা দূর করা উচিত।
অজ্ঞানতাবশত কিভাবে আমরা পাপ কাজ করি, তার একটি সুন্দর উদাহরণ হল খাদ্য গ্রহণ। ভগবদ্গীতায় (৩/১৩) শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে, তার ভক্তরা সমস্ত রকম পাপকর্ম থেকে মুক্ত হন, কারণ তারা ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদিত খাদ্যসামগ্রী প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করেন। সেই সাথে তিনি এও বলেছেন যে, যারা নিজেদের ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য রান্না করে, তারা শুধু পাপই ভোজন করে। প্রকৃতপক্ষে মন্দিরের পরিবেশে আর সাধারণ গৃহস্থ পরিবারে রান্নাবান্না ও খাওয়া দাওয়া আপাতদৃষ্টিতে একই রকম মনে হলেও তাদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। মন্দিরের পরিবেশে রন্ধন ও আহার্য প্রসাদ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা পাপমুক্ত হই। কিন্তু অভক্ত কারও রান্নাবান্না ও খাদ্যগ্রহণ তাকে আরও বেশী পাপময় কর্মফল আবদ্ধ করে। প্রকৃতপক্ষে মন্দিরের পরিবেশে সকল প্রকার রন্ধন ও আহার্য দ্রব্য শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন করে প্রসাদ রূপে গ্রহণ করা হয় বলে সেখানে কোন রকম পাপ প্রবেশ করতে পারে না। কৃষ্ণভাবনাময় সংশ্লিষ্ট কাজকর্মের বাইরে আপনি যা কিছুই করুন কেন তা জড়া প্রকৃতির দোষে আপনাদের আবদ্ধ করে। এইাভাবে বিভিন্ন কাজকর্ম না জেনে করার ফলে আপনি পাপকর্মে জড়িত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু একটু সচেতনভাবে চললেই আমরা এই পাপকর্ম থেকে নিজেদের সরিয়ে পুণ্য কাজ করতে পারি।
কিন্তু অনেকে পুণ্য কাজ করতে গিয়ে জটিলতার আবর্তে জড়িয়ে পড়েন। যদি জটিলতার আবর্তে জড়িয়ে পড়েন যদি কোনও ব্যক্তি পুন্যবান হন, তিনি পরজন্মে কোনও ধনী বা সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নিতে পারেন বা হয়ত উচ্চশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। এগুলো সবই পুন্য কর্মের ফল। কিন্তু আপনি পুন্যবান বা পাপী যাই হোন না কেন, আপনাকে কোনও একজন মায়ের গর্ভে প্রবেশ করতেই হবে। আর সেটিই হবে ভয়ানক দুর্দশা। সেখানে আপনি ধনী বা সম্ভ্রান্ত যে পরিবারেই জন্মান না কেন, অথবা কোনও পশু গর্ভে জন্ম নিন, আপনাকে জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধির আবর্তন চক্রের মধ্য দিয়ে কষ্ট ভোগ করতেই হবে এটাই আমরা বারবার ভুলে যাই।
কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের প্রকৃত উদ্দেশ্যই হল আপনাকে জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার সুযোগ দেওয়া। কিন্তু আপনি যদি পাপকর্ম করতেই থাকেন আর সেই সাথে পাপপূর্ণ আহার গ্রহণ করেন, তবে উপরিউক্ত চারটি দুর্দশা চলতেই থাকবে। আর পাপকর্মের প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত পাবেন শুধুমাত্র শ্রীকৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। যেরকম শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবদ্গীতায় (১৮/৬৬) বলে গেছেন,
“সর্বপ্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব। শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণের একটি পন্থা হল, এমন কিছু খাদ্য হিসেবে গ্রহণ না করা যেটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন করা হয়নি।এই বিষয়ে আমাদের বিশেষ যত্নবান হতে হবে।
মনে রাখবেন, যদিও আমরা কোনও পাপকর্ম করে থাকি, তবু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে ভক্তিভরে আহার্য নিবেদনের পর সেই প্রসাদ আহার রূপে গ্রহণ করলে, পাপকর্মের বিষময় ফলভোগের থেকে অব্যাহতি পেতে পারি। আর এইভাবে যদি আমরা শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণ করি তবে তিনি আমাদের সকল প্রকার পাপকর্মের প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা করবেন। এটি স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতিশ্রুতি।
এইভাবে আত্মসমর্পন করলে ভগবদ্ভক্ত মৃত্যুর পর কোথায় যন? শূণ্যবাদী দার্শনিকরা যেমন বলেন, তেমন করেই কি একজন ভক্তের জীবন শেষ হয়? না। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, মাম্ এতি অর্থ্যাৎ সে আমার কাছে আসে।” আর সেখানে দিয়ে কী লাভ হয়? তার উত্তর শ্রীকৃষ্ণ দিয়েছেন, “মামুপেত্য পুনর্জন্ম দুঃখালয়মশাশ্বতম্ নাপ্নুবন্তি” অর্থাৎ “আমার কাছে যে ফিরে আসে তাকে আর এই দুঃখময় নশ্বর সংসারে জন্ম নিতে না। সেটিই সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।