এই পোস্টটি 281 বার দেখা হয়েছে
শ্রীপাদ জননিবাস দাস ব্রহ্মচারী: আমাদের নিত্যস্বরূপে আমরা কৃষ্ণের সেবক। কৃষ্ণভাবনার অনুশীলন আমাদের সেটি অনুভূত করায় এবং তৎক্ষণাৎ আমাদের কৃষ্ণদাসরূপ অবস্থান নিয়ে আসে। যখন কেউ কৃষ্ণের সেবায় নিযুক্ত হন, তখন তিনি কৃষ্ণের প্রতি অনুরক্ত হন। যত বেশী আমরা কৃষ্ণের প্রতি অনুরক্ত হই, তত বেশী এই জড়াকর্ষণের প্রতি আমাদের বিতৃষ্ণা আসে তবে কৃষ্ণের সেবায় নিযুক্ত হওয়ার অর্থ এরকম নয় যে, আমাকে বিষয়ভোগ জোর করে ত্যাগ করতে হবে। যখনই আপনি কৃষ্ণের সেবা করবেন অনায়াসে এসব কিছু (যা অপ্রয়োজনীয়) ত্যাগ হয়ে যাবে। কৃষ্ণের সেবা করার মাধ্যমে আমাদের মধ্যে যথার্থ শান্তি বা সন্তুষ্টি নিয়ে আসে। একজন যোগী যদি বৈরাগ্য অনুশীলন করেন তিনি কিন্তু যথার্থ বৈরাগী হতে পারেন না। সেই বৈরাগ্যের মাধ্যমে তিনি শান্তি বা তুষ্টি অনুভব করতে পারেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি সেরকম ভক্তিস্তরে উত্তীর্ণ হচ্ছেন। শ্রীল প্রভুপাদ বলছেন, কৃষ্ণভাবনামৃত অনুশীলনটি হচ্ছে সেই অনুশীলন যা প্রকৃত পক্ষে একটি সুদক্ষ চিকিৎসা এবং যথাযোগ্য পথ্য-এর মাধ্যমে ভবরোগের নিরাময়ের উপায় করা যেতে পারে। এভাবে ভগবান কৃষ্ণের সম্বন্ধীয় যে কথা, লীলা শ্রবণের মাধ্যমে এবং কৃষ্ণপ্রসাদ গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের মন্দবুদ্ধিরূপ যে মন, সেটিকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। “আমাদের সুদক্ষ চিকিৎসার বন্দোবস্ত রয়েছে। আর যথার্থ পথ্যও আছে। কৃষ্ণের কথা শ্রবণটি হচ্ছে আমাদের যথাযোগ্য চিকিৎসা। আর কৃষ্ণপ্রসাদ ভোজন হচ্ছে যথাযোগ্য পথ্য।” শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, এই চিকিৎসাময় পন্থাটিই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃত। এটি যে কেউ অনুশীলন করতে পারেন। যদি আপনাকে বলা হয়, আপনি আসন গেড়ে বসুন। আপনার নাসাগ্রে দৃষ্টিপাত করুন এরকম যদি বলা হয় তাহলে কত সময় একটি মানুষ বসে থাকতে পারবে? কিন্তু আমরা এখানে কাউকে বলি না আপনারা নৃত্য-কীর্তন করুন। কিন্তু তা সত্ত্বে তারা এখানে এসে আপনা থেকেই নৃত্য-কীর্তন করতে শুরু করে দেয়। যখন আমি মহাপ্রসাদের প্লেটটাকে টেবিলের ওপরে নিয়ে আসি তখন সবাই সেটি নেওয়ার জন্যে সামনে ছুটে আসে। এসব স্বাভাবিক। আত্মার ক্রিয়াকলাপ আর আত্মার পথ্য। যদি আমরা বলি এখানে সবাইকে যোগ অভ্যাস করতে হবে, এখানে কোন কৃষ্ণপ্রসাদ নেই। তাহলে এখানে কেউ আসবে না। সবাই বাইরে গিয়ে খেলাধূলা করবে। এখানে কেউ আসবে না। “সবাই বাইরে গিয়ে খেলাধূলা করবে,” এখান থেকে বোঝা যায়, মনকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই দুষ্কর। শ্রীল প্রভুপাদ বলছেন, উন্মত্ত মন। এই উন্মত্ত মনটি সংসারের পরিচালক। শ্রীল প্রভুপাদের সময় একটি চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিল যার নাম ছিল ‘উন্মত্ত সংসার’। শ্রীল প্রভুপাদ যখন সেটি দেখেন তিনি বলেন, “হ্যাঁ, এটি ঠিক”। এই সংসারটাই হচ্ছে উন্মত্ত সংসার। সেটি মজার একটা চলচ্চিত্র ছিল। সত্যিকারে দেখা যায়, এই দৃশ্যমান চলমান জগৎ এটি সত্যিকারে উন্মত্ত। এই উন্মত্ত জগতের মধ্যে সবাই চিন্তা করছে, আমি হচ্ছি একটি পুরুষ, আমি হচ্ছি একটি স্ত্রী, আমি হচ্ছি একটি একটি ইংরেজ, আমি হচ্ছি ভারতীয়, আমি হচ্ছি বিদেশী। সবাই এরকম চিন্তা করছে। এটি হচ্ছে আমাদের উন্মত্ততা। আপনি হচ্ছেন এই শরীরের মধ্যে আত্মা। আত্মা কখনো পুরুষ নয়, স্ত্রী নয়, ইংরেজ নয়, ভারতীয় নয়। তিনি হচ্ছেন কৃষ্ণের নিত্য সেবক। এটি হচ্ছে আত্মার যথার্থ স্তিতি। যখন আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনি কে? কেউ বলবে না, আমি হচ্ছি কৃষ্ণের সেবক। তাই সত্যিকারে দেখতে গেলে এই জগৎটি হচ্ছে উন্মত্ত জগৎ। এটি হচ্ছে আমার স্ত্রী, আমার আত্মীয়স্বজন, আমার ছেলে, মেয়ে। এ সবকিছু হচ্ছে উন্মত্ততা। সকলেই পরস্পরের প্রতি আসক্ত হয়ে আছে।
এই জন্মে যিনি পুরুষ পরবর্তী জন্মে তিনি হয়তো ব্যাঙ হয়ে জন্মাতে পারেন। আর স্ত্রী তিনি হয়তো সাপ হয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারেন। এখন পরস্পরের মধ্যে যে সম্পর্কে আছে তখন তা কিছুই বোঝা যাবে না। আত্মা চুরাশি লক্ষ জীবযোনির মধ্যে ভ্রমণ করছে। মানব শরীর, দেব শরীর, গাছ শরীর, পশু শরীর, বিভিন্ন জলজ জন্তুর শরীর, পোকামাকড়ের শরীর। আমার প্রকৃত পরিচয়টি কি? আমি কি একটি গাছ? না পোকমাকড়। আমি কি জলচর? না পশু, না পাখি, মানুষ? আমি কি? আমার যথার্থ স্বরূপের পরিচয়টি কি? কৃষ্ণের সেবক।
এটি হচ্ছে আমাদের যথার্থ স্বরূপের পরিচয়। এই স্বরূপের পরিচয় নিয়ে কে আলোচনা করেছে সংসারে? কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তরাই এটি আলোচনা করে থাকে। আর সবাই এখানে উন্মত্ত। প্রত্যেকটি দেশেই পাগলাগারদ আছে। পাগলাগারদে গেলে শোনা যায়, কেউ কেউ বলছে আমি হচ্ছি হিটলার, আমি হচ্ছি চার্চিল, আমি অমুক। তারা মনে করছে ঐরকম। পাগলদের তারা তালা বন্ধ করে দেয়। এভাবে পাগলদের আলাদা করে রাখে। বাইরে যে সমস্ত পাগলরা আছে, যারা মনে করছে আমি পুরুষ, আমি স্ত্রী তাদের তো তালা বন্ধ করে রাখা হচ্ছে না।
একসময় একটি জায়গায় এসমস্ত পাগলদের রাখা হয়েছে। বাইরে দিয়ে সমস্ত যাত্রীরা যাচ্ছিল তারা বলছিল, এখানে সমস্ত পাগলারা আছে। কিন্তু বাইরে যে কত পাগল আছে সেটা ওরা জানে না। এটি হচ্ছে ভিতরের আর বাইরের মধ্যে পাগলভাব। যদি আপনি নিজেকে কৃষ্ণের সেবক বলে পরিচয় না দেন তাহলে আপনি সত্যিকারের একজন পাগল। শ্রীল প্রভুপাদ বলেন, তথাকথিত পণ্ডিত, রাজনীতিবিদÑ এরা সবাই ভগবদ্গীতার ভাষ্য লিখে থাকে। কিন্তু তারা কৃষ্ণকে পরম পুরুষোত্তম বলে স্বীকার করে না। তাই তারা হচ্ছে পাগল।
আজকালকার বাজারে ভগবদ্গীতার ভাষ্য সম্বলিত ভগবদ্গীতা অনেক পাওয়া যায়। কিন্তু তারা কেউ কৃষ্ণকে ভগবান বলে স্বীকার করে না। অথচ তার যথার্থ যোগী বা রাজনীতিবিদ হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করছে। আর সাধারণ লোক তাদেরকে পূজা করে থাকে।
যদি কেউ পাগলের গুনগান করে থাকে, যদি তার পূজা করে তাহলে বুঝতে হবে যে, যিনি পাগলের গুণগান, পূজা করছেন তিনি আরও বেশি পাগল। শ্রীল প্রভুপাদ বলেন, আমরা এরকম একটি পাগল- জগতের মধ্যে রয়েছি। এটি সত্য কথা। এইরকম পাগলভাব থেকে কিভাব আরোগ্য লাভ করা যেতে পারে? আমাদের মধ্যে একটি দুর্দমনীয় ভাব এসেছে। এটি অনেক জীবন ধরে চলে আসছে। কৃষ্ণভাবনামৃতই হচ্ছে তার ঔষধ। এই উন্মত্ততা থেকে কি করে নিষ্কৃতি লাভ করা যেতে পারে? ‘আমি হচ্ছি কৃষ্ণের নিত্য সেবক,’ সেটি হৃদয়ঙ্গম করা। আর সেই চেতনায় কৃষ্ণের সেবার নিয্ক্তু হওয়া।
এটি যদি হয়, আমাদের উন্মত্ততা তৎক্ষণাৎ দূরীভূত হয়ে যাবে। এই হচ্ছে শুদ্ধ আত্মার পরিচয়, তিনি হচ্ছেন কৃষ্ণের নিত্য সেবক। শুদ্ধ আত্মারূপে যখন আমরা কৃষ্ণের সেবায় নিযুক্ত হই, তখন সমস্ত উন্মত্ততা থেকে আমরা আরোগ্য লাভ করতে পারি। সংসার জগতের মধ্যে সমস্ত সমস্যার তখনই সমাধান হয়ে যায়। এই সংসার জগতের মধ্যে মুখ্য সমস্যটি কি? আমি নিজেকে আত্মসাৎ করে নিচ্ছি। আমার প্রকৃত পরিচয় আমি জানি না।
যখন আমি কৃষ্ণের সেবকত্ব ভাব নিজের মধ্যে নিয়ে আসতে পারব তখন এই সংসারের কোনো সমস্যার দ্বারা আমি প্রভাবিত হবো না। কৃষ্ণ বলেছেন, ব্রহ্মলোক থেকে এই মর্ত্যলোক পর্যন্ত সমস্ত ভুবনেই দুর্দশা আছে। আপনি ব্রহ্মলোক থেকে পাতাললোক বা ত্রিলোকের মধ্যে যেখানেই থাকুন না কেন সেটি হচ্ছে দুঃখালয়। এই চরাচর বিশ্বের যেখানেই আপনি থাকুন না কেন যদি তার মধ্যে আপনি নিজের পরিচয় খুঁজে বের করতে চান তাহলে এটি হচ্ছে দুঃখালয়।
আপনি যদি পরিচয় বুঝতে পারেন আপনি হচ্ছেন কৃষ্ণের নিত্য সেবক, আপনি এই দৃশ্যমান জগতে যেখানেই থাকুন না কেন সংসারের অস্থায়িত্বের দ্বারা আপনি প্রভাবিত হবেন না। কৃষ্ণ বলেছেন, তিনি সবসময় আমার কথা চিন্তা করছেন, আমাতে মন নিবিষ্ট করছেন, তিনি তার এই শরীর ত্যাগ করার পর আমার নিত্যধামে ফিরে আসবেন। তাহলে তাদের এই উন্মত্ত সংসারে এসে পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হবে না।
শ্রীল প্রভুপাদ বলতেন, “এই জগতের যে উন্মত্ততা, এটিকে আরোগ্য করার জন্য কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ হচ্ছে একটি হাসপাতাল।” আর আমরা জানি এই হাসপাতালের স্বনামধন্য ডাক্তার হচ্ছেন শ্রীল প্রভুপাদ। সেখানে সবচেয়ে উন্নতমানের ঔষধ আছে। সেটি হচ্ছে হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র।
চৈতন্য সন্দেশ সেপ্টেম্বর-২০২১ প্রকাশিত