এই পোস্টটি 1284 বার দেখা হয়েছে
পঞ্চাশ বছর আগে একজন উদ্যমী তরুন শ্রীচৈতন্য মহপ্রভুর মিশন পূর্ণ করার লক্ষ্যে শ্রীল প্রভুপাদের সেবায় আত্মোৎসর্গ করেন। ১৯৬৮ সালের ৩০ জুনে ১৯ বছর বয়সী জয় মাথা মুণ্ডন করে, ধুতি-চাদর পরে সান ফ্রান্সিসকো শহরের রাজপথে শ্রী জগন্নাথের রথের দড়ি টানতে থাকেন (এ রথ নির্মাণে তিনি শ্রীপাদ জয়ানন্দ প্রভুকে সহযোগিতা করেন)। কেউ কোনদিন কল্পনাও করতে পারে নি যে, সেদিনের ১৯-বছরের জয় আজ ‘শ্রীল জয়পতাকা স্বামী মহারাজ’ নামে পরিচিতি লাভ করবেন এবং সারাবিশ্বে হাজার হাজার রথযাত্রার নেতৃত্ব দেবেন।
শ্রীল জয়পতাকা স্বামী ১৯৪৯ সালে আমেরিকার উইস্কিনসন প্রদেশের মিলওয়াকিতে জন গর্ডন এর্ডম্যান নামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতামহ ছিলেন কোটি কোটি ডলারমূল্যের কোম্পানির মালিক। কিন্তু জীবনের শুরুথেকেই জয় অন্যকিছুর সন্ধান করতেন। তিনি সর্বদা ঈশ্বরের সন্ধান করতেন এবং জীবনের গভীর অর্থ খুঁজে বেড়াতেন। তিনি এমন একটি পথ ও শিক্ষকের অন্বেষণ করছিলেন, যার দ্বারা তিনি হৃদয়ের ভাব প্রকাশ করতে পারবেন। “আমি একটি আধ্যাত্মিক পথের অন্বেষণ করছিলাম। পূর্বে আমি বুদ্ধবাদ, ইহুদিধর্মমত, যোগপন্থা ও নক্ষত্রবিচার প্রভৃতি চর্চা করেছি। অবশেষে আমি বুঝতে পারলাম আমার একজন গুরু প্রয়োজন। ১৯৬৮ সালে গর্যন জন সারাবিশ্বে কৃষ্ণভাবনার শিক্ষা বিতরণকারী ও ইস্কন প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য কৃষ্ণকৃপাশ্রীশ্রীমূর্তি শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের কাছ হরিনাম দীক্ষা গ্রহণ করেন। গর্ডন জনের নাম হয় শ্রী জয়পতাকা দাস ব্রহ্মচারী।
“আমি মন্ট্রিলে যাই, শ্রীল প্রভুপাদের সাক্ষাৎ লাভ করি। তিনি আমাকে অনেক কৃপা করেন, আমি দৃঢ়সংকল্প হই এবং অবশেষ দীক্ষা গ্রহণ করি।”
এমন এক শুদ্ধ মার্গের সন্ধান পেয়ে গভীরভাবে সে মার্গের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাভ করে তিনি প্রতিদান স্বরূপ তা সর্বত্র বিতরণ করার এক তীব্র প্রেরণা হৃদয়ে অনুভব করলেন। এবং এরপর তাঁর কৃতিত্বসমূহকে একটি উপাখ্যান/কাহিনীও বলা যেতে পারে।
এভাবে তাঁর ৫০ বছরের দীর্ঘ কালের সেবার মানসিকতা সম্পর্কে বলে শেষ করা যারে না। সারাবিশ্বে তিনি গুরু, শিক্ষক, পথপ্রদর্শক ও তত্ত্বাবধানকারী হিসেবে হাজার হাজার মানুষের কাছে অত্যন্ত সমাদ্রিত ও পূজিত, ইস্কন ফুড ফর লাইফ ও নামহট্ট উন্নয়ন প্রভূতি কর্মকান্ডের দ্বারা তিনি অসংখ্যা মানুষের জীবনকে পরিবর্তন করেছেন। ১৯৭০ সালে শ্রীল প্রভুপাদ স্বয়ং যজ্ঞানুষ্ঠানের মাধ্যমে জয়পতাকা দাসকে সন্ন্যাস দীক্ষা প্রদান করেন। তিনি ছিলেন শ্রীল প্রভুপাদের ১২ তম সন্ন্যাসী শিষ্য।
এরপর তিনি প্রচারের জন্য ভারতে আসেন। ৪৮ ঘন্টা ধরে মন্ট্রিল-লন্ডন-ব্রাসেলস-বোম্বে-কলকতা ভ্রমণ শেষে ভারত পৌঁছেন। এটি ছিল ইতিহাসের “সবচেয়ে সস্তা বিমান ভ্রমণ”। প্রচারের সুবিধার্যে তিনি বাংলা ভাষা আয়ত্ত্ব করেন এবং শীঘ্রই জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে তিনি সুবিশাল শোভাযাত্রার আয়োজন করেন যেখানে ২৫,০০০ ভক্ত ও ১৬৮ টি কীর্তন দল অংশগ্রহণ করেছিল। শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীল জয়পতাকা স্বামীকে প্রতি মাসে কমপক্ষে ১০,০০০ বড় গ্রন্থ এবং ১,০০,০০০ ছোট গ্রন্থ বিরতণের নির্দেশ দেন। তিনি এর জন্য বিভিন্ন মার্কেট, মঞ্চানুষ্ঠান, উৎসব ও নামহট্টে বিতরণ কার্য শুরু করেন। তিনি শুধু শহরাঞ্চলে নয়, গ্রামে-গঞ্জেও প্রচারের আয়োজন করেন। তিনি ইস্নেরর খাদ্য বিতরণ কর্মসূচির “ফুড ফর লাইফ” এর সভাপতি নিবাচিত হন। ১৯৭৩ সালে শ্রীল প্রভুপাদ জয়পতাকা মহারাজের প্রসাদ বিতরনের রিপোর্ট পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হন। ১৯৭৪ সালে মায়াপুরে একটি ‘প্রসাদ বিতরণ স্থল’ নির্মাণ করেন যেখানে থেকে একসাথে এক হাজার ভক্তের প্রসাদ বিতরণ করা যায়।
১৯৭৮ সালে যখন বন্যায় সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ তলিয়ে গিয়েছিল, তখন বাড়ির ছাদে ও গাছে উপরে আশ্রয় নেওয়া বন্যাদুর্গত মানুষদের বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহের জন্য তিনি নিজেই নৌকা চালিয়ে পসাদ বিতরণ করেছেন। এটা ও এরকম অসংখ্য নিস্বার্থ জলসেবার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ জয়পতাকা মহারাজকে ভারতীয় নাগরিকত্ব কাজে জোরালো আবেদন করেন। ১৯৭৮ সালে তা সরকার কর্তৃক মজুর করা হয়।
তিনি নামহট্ট প্রচার মন্ত্রী ও নামহট্ট উন্নয়মন্ত্রীও নির্বাচিত হন। এছাড়া তিনি বিশ্ব হিন্দু ফেডারেশ-এর সহ-সভাপতি হন। নামহট্ট উন্নয়ন এর একটি কাঠামো হিসাবে তিনি ভক্তিবৃক্ষ পদ্ধতিও চালু করেন। শ্রীল জয়পতাকা মহারাজ বাংলা বিহার ও উড়িষ্যা অধীভুক্তও পূর্ব ভারতের জিবিসি (গভনিং বডি কমিশনার) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০-১৯৯৯ সালে দক্ষিণ-পূর্ব যুক্তরাষ্ট্রে ও দক্ষিণ আমেরিকার জিবিসি হিসেবে সেবারত ছিলেন। এছাড়া, ইকুয়েডর, পেরু, বলিডিয়া, চিলি, জিবিসি ও দূর পাচ্যের সহ-জিবিসি হিসেবেও তিনি নিয়োজিত ছিলেন। ভারতে থাকাকালীন মহারাজ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের নগরাদি গ্রামে সংকীর্তন ও গ্রন্থ বিতরণের মাধ্যমে প্রচার বিস্তার ঘটান। ভারতের নাগরিকত্ব লাভের পর তিনি বিভিন্ন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ও গণ্যনান্য ব্যক্তিবর্গের দ্বারা অভিনন্দিত ও তাঁদের দেশ ভ্রমনের জন্য আমন্ত্রিত হন। এরপর শুরু হয় তাঁর অন্তহীন বিশ্ব ভ্রমণ।
২০০৮ সালে তিনি গুরুতর স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। ডাক্তারেরা তাঁর বেঁচে থাকার জন্য শতভাগের মাত্র ১ ভাগ আশা ব্যক্ত করেছিলেন, তখন তার শরীরের অর্ধাংশ অচল হয়ে পড়ে। কিন্তু শরীরের বিবিধ প্রতিকূলতা সত্বেও তিনি বিশ্বভ্রমণ, প্রচার কর্মসূচির আয়োজন, আধ্যাত্মিক সাফারির আয়োজন ও নামইং ভক্তিবৃক্ষ প্রতিষ্ঠার এখানো অবিচলভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ভক্তদেরকে বিভিন্ন ধরনের প্রচার কার্যক্রম আয়োজননেও বিভিন্নভাবে সাহায্য করে যাচ্ছেন, যা একজন শারীরিক বাধাগ্রস্ত ব্যক্তির পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব। কিন্তু কোন বাধাই তার মিশনকে রুদ্ধ করতে পারে নি।
২০০৮ হতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি হুইল চেয়ারেই প্রায় ৭,৮২,৯০৬ কি.মি পথ ৩২৫ টি ফ্লাইটে ভ্রমণ করেছেন। ১৪২৭ টি সভাতে যোগদান করেছেন, স্থলপথে ২৫,৯৪২ কি.মি ভ্রমণ করেছেন এবং ১৪১১ টি প্রবচন প্রদান করেছেন। তাঁর মতো এমন অদ্ভুতকর্মা ও বিশ্ব পরিবর্তনকারী ব্যক্তি সম্পর্কে এত সংক্ষেপে বলা মোটেই সহজ কাজ নয়। কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও ভেবে দেখার বিষয়টি হল তিনি মানুষ হিসেবে কখনো বিন্দুমাত্রও বদলাননি। বিভিন্ন ধরনের মানুষ, পরিবেশ, জীবনযাত্রা ও সংষ্কৃতির সান্নিধ্যে আসলেও তিনি তার দ্বারা প্রভাবিত হননি, বরং তার স্বীয় দিব্যভাব বজায়ে রেখেছে যার দ্বারা অন্যরা শুদ্ধ হয়েছেন।
এমনকি, আজও তিনি একই রকমভাবে আন্তরিকতার সাথে হৃদয়ের কথা বুঝে কথা বলেন। এমন কোন স্থান খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে মহারাজ গমন করেননি। গুরু কৃষ্ণ ও সাধুদের কাছ থেকে প্রাপ্ত যেকোন সেবা তিনি কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল আভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের প্রতি প্রতিপূর্ণ নিবেদন হিসেবেই সম্পাদন করেন। হরেকৃষ্ণ!
(মাসিক চৈতন্য সন্দেশ আগষ্টে ২০১৮ সালে প্রকাশিত)