এই পোস্টটি 278 বার দেখা হয়েছে
সম্রাট শাহজাহান মমতাজের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ আগ্রার তাজমহল তৈরি করেছিলেন। যার শৈল্পিক নিদর্শন, মনোরম কারুকাজ এই বিংশ শতাব্দীর উন্নত আবিস্কারের যুগে এসেও এর খ্যাতি এখনও ম্লান হয়নি। এখনও লক্ষ লক্ষ পর্যটক প্রতি বছর এ অনুপম স্থাপনাটি দর্শন করার জন্য ভীড় জমায়। কিন্তু আপনি জানেন কি, এই পৃথিবীতে আগ্রার এই তাজমহলটি ছাড়াও আরও একটি তাজমহল বিরাজমান? সেই তাজমহলটিও ঠাঁই দাড়িয়ে আছে আমার তাজমহলের মত ভালোবাসার এক গভীর নিদর্শনস্বরূপ। এক্ষেত্রে সেই ভালোবাসার এ নিদর্শন একটু ভিন্ন প্রকৃতির। কৃষ্ণের একজন অন্তরঙ্গ সেবকের প্রতি তার পারমার্থিক সন্তানদের ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ এই তাজমহল। তিনি হলেন ইস্কন প্রতিষ্ঠাতা ও আচার্য্য শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ। তার শিষ্যদের অকৃত্রিম ভালবাসার নিদর্শনসূচক এই তাজমহলটি অবস্থিত উত্তর আমেরিকায় ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে। সেই তাজমহলটির প্রকৃত নাম কিন্তু Prabhupada’s Palace of Gold অর্থাৎ ‘প্রভুপাদের স্বর্ণ প্রাসাদ’ তাজমহল নামটি কিন্তু বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনেরই দেওয়া। এই ম্যাগাজিনটির ঘোষণামতে আমেরিকার তাজমহল অর্থাৎ প্রভুপাদের স্বর্ণ প্রাসাদটি দর্শনের জন্যও প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থী ভিড় জমায়। ষাট-সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়টাতেই এই মনোরম প্রাসাদটি তৈরি করা হয়েছিল। সবচেয়ে অবাকের বিষয় হল এই মনোরম প্রাসাদটি যারা তৈরি করেছিলেন তাদের কারোরই পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। অথচ পূর্ব অভিজ্ঞতা ना. থাকা স্বত্ত্বেও শুধুমাত্র স্থাপত্য সম্পর্কিত গ্রন্থ অধ্যয়নের মাধ্যমেই এটি নির্মিত হয় যার কারুকাজ দেখে দর্শনার্থীরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। ১৯৬৮ সালের দিকে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার নিউ বৃন্দাবন নামক স্থানটি ভক্তরা পছন্দ করেন। এরপর শ্রীল প্রভুপাদের ইচ্ছা অনুযায়ী তার শিষ্যরা প্রস্তুত নেয় এমন একটি নগরী এখানে গড়ে উঠবে যা দেখে বিশ্ববাসী বিস্মিত হয়ে উঁচু উঁচু পাহাড় এবং ঘন অরণ্যের মধ্যে এ প্রাসাদটি নির্মাণ করা রীতিমত অসম্ভব। তবুও তার ভক্তরা এ অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন শ্রীল প্রভুপাদের বিশেষ কৃপাশক্তিতে শক্তিমান হয়ে।
এখন জানা যাক, কেন এই প্রাসাদটিকে আগ্রার তাজমহলের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। মূলত পশ্চিম ভার্জিনিয়া এমনিতেই সুপরিচিত তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য এবং ছবির মত উঁচু উঁচু পাহাড়-পর্বতের জন্য। সেরকম একটি পরিবেশে অবস্থিত এ প্রাসাদটি। প্রতিটি গম্বুজ এবং সুদৃশ্য কাঁচের রঙিন জানালা দেখে দর্শনার্থীদেরকে একমুহুর্ত হলেও এর সৌন্দর্য্য সম্পর্কে ভাবতে হবে। হয়ত অবচেতন মনে মনে হতে পারে আমি কি ভুলক্রমে ভারতে অবস্থান করছি? পশ্চিম গ্যালারীতে হাঁটতে হাঁটতে শুরুর দিকেই আপনার চোখে পড়বে সুদৃশ্য রঙবেরঙের মার্বেলের তৈরি জানালা যার মধ্যে সূর্যের
আলো প্রতিফলিত হয়ে চারদিকে রংধনুর এক রঙিন আভা সৃষ্টি করে। এসব জানালায় রয়েছে কাঁচের প্রাধান্যও। এখানে যে ক্রিস্টালগুলো ব্যবহৃত হয়েছে তা অস্ট্রিয়া থেকে আনা হয়েছিল। এর ভিতরে অনেকগুলো কক্ষ রয়েছে যেগুলোর মধ্যে রয়েছে অফিস, সেবকদের কোয়ার্টার এবং রান্নাঘর। প্রাসাদটির সম্মুখে এবং পেছনদিকে ৪টি সুদৃশ্য ময়ূর জানালা বিদ্যমান। যেখানে ১৫০০ পিচেরও বেশি অতি উন্নতমানের কাঁচ ব্যবহার করা হয়েছে। এই প্রাসাদে আরো রয়েছে, প্রভুপাদের স্টাডি কক্ষ। যেটি উত্তর পূর্ব গ্যালারীতে অবস্থিত। ঐ কক্ষে প্রভুপাদের অধ্যয়নরত অবস্থায় একটি মূর্তি অবস্থিত। এই কক্ষের দেয়ালগুলোতে বিভিন্ন ধরনের মার্বেল ব্যবহৃত হয়েছে এর কারুকাজগুলো অর্থাৎ দেয়ালের অলংকারগুলো তৈরি করা হয়েছে খাটি স্বর্ণ দিয়ে। ঐ কক্ষে রাধাকৃষ্ণের অপরূপবিগ্রহ সম্বলিত একটি সুবিশাল বেদী অবস্থিত। যার পার্শ্বে অবস্থিত অতি দুর্লভ চায়নিজ ফুলদানী, সম্মুখে দুটি সিংহ মস্তক, এবং স্বর্ণের প্লেট মধ্যখানে। সিংহকে শুরুদেবের ভগবানের বাণী প্রচারের ক্ষেত্রে ভয়হীন গর্জনের সঙ্গে তুলনা করা হয়। দক্ষিণ-পূর্ব গ্যালারীতে রয়েছে শ্রীল প্রভুপাদের শয়ন কক্ষ। এই কক্ষের দেয়ালগুলো বিখ্যাত ইতালিয়ান বটিসিনো মার্বেল দিয়ে তৈরি এবং দেয়ালগুলো দুর্লভ ফরাসিয়ান মনি দ্বারা খচিত। এর সিলিং গুলোতে অঙ্কিত হয়েছে হাজারো ফুলের সমারোহ। এর বাইরেও এখানে সেগুন বৃক্ষের কাঠের উপর খচিত করা হয়েছে কৃষ্ণের বিভিন্ন শৈশব লীলার দৃশ্যাবলী। মেঝেতে ব্যবহার করা হয়েছে উজ্জ্বল বাদামী রঙের গ্রীক মার্বেল এবং গভীর সবুজ বর্ণের গ্রীস থেকে আনা মার্বেল।
শয়ন কক্ষ এবং বাথরুম ও ড্রেসিং রুম প্রায় পরপরই রয়েছে। এখানে এক একটি বেসিনে তিনশ পাউন্ড ওজনের ধূসর কমলা রঙের মার্বেল ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে যে পাইপার নলসমূহ রয়েছে তা ২২ ক্যারেট স্বর্ণ দিয়ে তৈরি। বেসিনের উপরে যে সুদৃশ্য আয়নাটি রয়েছে তা অষ্টাদশ শতাব্দির স্প্যানিশ আয়না। প্রভুপাদের এই প্রাসাদটিতে ১৭টি দেশের সর্বসাকুল্যে ৫২ ধরনের মার্বেল ব্যবহার করা হয়েছে। ২৫৪ টনেরও বেশী ওজনের এই মার্বেল পাথরগুলো প্রায় ৩৫,০০০ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত। শুধুমাত্র দেয়াল এবং মেঝের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ৫০ ধরনের বিভিন্ন আকৃতির মার্বেল এবং যে মনিগুলো যারা এগুলো খচিত সেগুলো আমা হয়েছে ফ্রান্স, ইতালী, কানাডা এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এগুলোকে বিভক্ত করা হয়েছে প্রায় বিশ হাজারেরও বেশি খতে এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন আকৃতির সুদৃশ্য ডিজাইনে রূপ দেয়া হয়েছে। এখানে যে মন্দির কক্ষটি রয়েছে তার পিলারগুলো তৈরি মার্বেল দিয়েই এবং অনন্য ডিজাইনসমূহ ভারতীয় বিভিন্ন বিখ্যাত মন্দির এবং ইউরোপিয়ান সম্ভ্রান্ত গৃহের আঙ্গিকেই তৈরি। দক্ষিণের প্রবেশপথে অনেকগুলো সেগুন কাঠের দরজা রয়েছে যেগুলোতে হাতি, পদ্ম এবং অতি মনোরম বিভিন্ন পুষ্প দ্বারা খচিত। এখানে প্রতিটি দরজার উপরে বিভিন্ন কারুকাজ রয়েছে যার প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছে খাঁটি স্বর্ণের ব্যবহার। এই কারুকাজগুলোতে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের পাতা রয়েছে যা ৮,০০০ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত। অনেক মেঝেতে বিভিন্ন রঙের পাকিস্তানি মনি ব্যবহার করা হয়েছে। গম্বুজগুলোতে খোদাইকৃত রয়েছে শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বিভিন্ন লীলাবিলাস। শ্রীল প্রভুপাদের স্বর্ণের ব্যাসআসনও প্রতিটি দর্শনার্থীর মন কেড়ে নেয় শুধু তাই নয় এই কক্ষে ২,০০০ এরও বেশি মার্বেল ও মনি টুকরো এবং ৪,০০০ এরও বেশি খণ্ড খণ্ড ক্রিস্টালের ব্যবহার চোখ জুড়িয়ে যায়। তাছাড়া এর চারপাশে বিস্তৃত যত ধরনের গোলাপ ফুলের বাগান রয়েছে তা গোটা আমেরিকার জন্যও দুর্লভ সৃষ্টি কর্ম। কেননা এখানে অনেক দুর্লভ গোলাপ ফুল দেখতে পাওয়া যায়। হাজার হাজার রঙ বেরঙের ফুলে সজ্জিত এর চারপাশ দেখে মনে হয় এ যেন স্বয়ং গোলকবৃন্দাবন।
এখানে শ্রীল প্রভুপাদের যে সমাধিস্থল রয়েছে তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা শ্রীল প্রভুপাদ এক সময় বলেছিলেন “আমি ইতোমধ্যেই এখানে অবস্থান করছি এবং সর্বদা অবস্থান করব আর তাই যেই এই সাধিস্থল পরিদর্শন করে সে নিশ্চিতভাবেই একটি অদ্ভুদ অনুভূতি নিয়েই প্রত্যাবর্তন করে। শ্রীকৃষ্ণের আশীর্বাদ গ্রহনের জন্য এ স্থানটি তাই খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক দর্শনার্থীর কাছেই এ স্থানের মাহাত্ম্য নিয়ে অনেক ঘটনাবলী রয়েছে। অলৌকিক এসব ঘটনাবলী নিয়ে ইতোমধ্যেই অনেক গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। আমেরিকার এই তাজমহল শুধু মনোরম সৌন্দর্য্যের জন্যই বিখ্যাত নয় এ স্থানের রয়েছে অনেক মহিমাও। বলা যায় সারা বিশ্বের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য বিশেষত কৃষ্ণভক্তি পালনরত সকল শুদ্ধ ভক্তদের কাছে শ্রীল প্রভুপাদের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ কিছু অনভিজ্ঞ ভক্তদের কষ্টার্জিত এ উপহার সম্রাট শাহজাহানের গড়া তাজমহলের চেয়ে অনন্ত গুন মূল্যবান। কেননা এটি যে শ্রীল প্রভুপাদেরই স্বর্ণ প্রাসাদ যার অন্য নাম আমেরিকার তাজমহল। হরে কৃষ্ণ ।
চৈতন্য সন্দেশ অক্টোবর-২০০৯ ইং প্রকাশিত