এই পোস্টটি 241 বার দেখা হয়েছে
যে কোনো বিষয় শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে কৃষ্ণভাবনাকে একীভূত করা যেতে পারে, কেননা কৃষ্ণ সর্বত্রই বিরাজমান।
সর্বানন্দ দাস
ইস্কন ডালাসের কালাচাঁদজীর প্রাসাদ মন্দির ও রেঁস্তোরার অদূরেই টিকেজি একাডেমির খেলার মাঠে রঙিন পোশাক পরিহিত হয়ে ক্ষুধে শিক্ষার্থীরা ছুটোছুটি করছে আর খেলাধূলা করছে। বিদ্যালয়টি এখনও ক্ষুদ্র পরিসরে রয়েছে। কিন্তু বলিষ্ঠ একাডেমিক ও পারমার্থিক কর্মসূচী, উচ্চ প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও এক সফল শিক্ষা প্রদানের ইতিহাস অবলম্বনে এটি একটি মনোরম ও শান্ত পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত ।
বিদ্যালয়টি মূলত প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। শ্রীল প্রভুপাদ এটি প্রতিষ্ঠা করেন, যিনি অভিপ্রায় করেছিলেন যে, এটি হবে এমন একটি বিদ্যালয় যেখানে প্রেমপূর্ণ দৃঢ় ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করবে। এটি শিক্ষার্থীরা উন্নত চরিত্র গঠন করতে ও ভগবানের প্রতি প্রেমপূর্ণ সেবা নিবেদনের মনোভাব গড়ে তুলতে এবং সেসাথে এ জগতে একজন দায়িত্ববান সফল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত ইস্কনের সেসময়ের একমাত্র এই গুরুকুলটি কিন্তু অব্যবস্থাপনার কারণে কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ তাকে।
১৯৮০ সালে শ্রীল প্রভুপাদের অন্যতম প্রিয় শিষ্য শ্রীমৎ তমাল কৃষ্ণ গোস্বামীর মাধ্যমে সেই ডালাস গুরুকুল পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন একটি স্থানে। তিনি নতুন কার্যকরী পন্থা প্রয়োগ সাধনের মাধ্যমে তার শিষ্যবর্গদের প্রচেষ্টায় সবকিছু নতুন আঙ্গিকে গঠন করেন। ক্ষুধে শিক্ষার্থীদের একটি উপযুক্ত পরিবেশে যত্ন প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করাই ছিল সবার জন্য সর্বোত্তম সেবা।
এজন্যেই প্রথমে বিদ্যালয়ে তৎকালীন প্রিন্সিপ্যাল বৃষ্ট দাস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (WHO) আমন্ত্রন জানান শিশু নিরাপত্তা বিষয় সচেতনতা সৃষ্টির জন্য। তার তত্ত্বাবধানে শিশুদের নিরাপত্তা বিষয়ে কঠোর ও কার্যকরী পদক্ষেপ গঠন করা হয় যা একটি কার্যকরী ব্যবস্থাপনার নিদর্শন হিসেবে পরিগণিত হয়।
১৯৮৭ সালে জয়ন্তী দেবী দাসী বিদ্যালয়টির প্রিন্সিপ্যাল পদে নিযুক্ত হওয়ার পর একটি নতুন যুগের সূচনা হয়। বোর্ডিং বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে চালু করা হয় ডে স্কুল। পূর্বে অপ্রশিক্ষিত শিক্ষকদের কারণে যে ভ্রান্তি ঘটেছিল তার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে বিবিধ কার্যকরী পন্থা গ্রহণ করা হয়।
অবশেষে ২০০১ সালে বিদ্যালয়টি একটি লিগ্যাল প্রাইভেট বিদ্যালয় হিসেবে নতুন নামে যাত্রা শুরু করে। নাম হয় টিকেজি একাডেমি।
এভাবে সমস্ত ভুল ভ্রান্তি ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে টিকেজি একাডেমি এখন পেশাদারিত্ব ও চাইল্ড কেয়ারের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, উত্তর আমেরিকার ইস্কনের বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম শীর্ষ বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
বৈদিক শিক্ষা পদ্ধতি সমন্বিত গুরুকুলের আক্ষরিক অর্থ হল ‘গুরু গৃহ’, যেখানে শিক্ষার্থীরা একটি প্রেমপূর্ণ, দৃঢ়বদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে গুরু বা শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করে। এই গুরুকুল শিক্ষার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল, আমরা যে জগতে বাস করি তার জন্য সুচরিত্রবান, ভগবৎ সেবার প্রতি প্রেমভাব সমন্বিত দায়িত্ববান নাগরিক গড়ে তোলা। বিদ্যালয়ে যে সমস্ত দর্শন শিক্ষা প্রদান করা হয় তা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ ও শ্রীমদ্ভাগবতের মতো বৈদিক শাস্ত্রের শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এরকম অভূতপূর্ব পারমার্থিক ভিত্তির কারণে শিক্ষার্থীদের উচ্চমানের পারমার্থিক শিক্ষা লাভও সহজতর হয়।
TKG শব্দটি শ্রীমৎ তমাল কৃষ্ণ গোস্বামীর সংক্ষিপ্ত রূপ। শ্রীমৎ তমাল কৃষ্ণ গোস্বামী ছিলেন একজন প্রগতিশীল, প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর গুরু, যার সাথেই তাঁর সাক্ষাৎ ঘটেছিল তিনি তার হৃদয় ও মন জয় করেছিলেন। এই TKG অ্যাকাডেমির প্রাতিষ্ঠানিক ও পারমার্থিক আদর্শের পেছনে রয়েছে তার ব্যক্তিগত নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধান। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও দিক নির্দেশনা প্রদান করার জন্য, কারিকুলামের যথার্থতা সহ বিদ্যালয় ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর জন্য একটি যথাযথ কমিউনিটি সৃষ্টির জন্য তিনি প্রচুর সময় ব্যয় করেছিলেন।
একটি যথাযথ ভারসাম্য
গুরুকুলের শিক্ষার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটি অনেকেই করে থাকেন যে, এই শিক্ষাপদ্ধতিতে কিভাবে পারমার্থিক ও জাগতিক শিক্ষার মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করা হয়? এ প্রশ্নের উত্তরে TKG একাডেমির লিডারশিপ প্রশিক্ষণ প্রদানকারী বিশেষজ্ঞ শ্রীমান নিত্যানন্দ প্রভু বলেন, “এটি ভারসাম্যের প্রশ্ন নয়, বরং একটি একিভূতিকরণের প্রশ্ন। যেকোনো বিষয় শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে কৃষ্ণভাবনাকে একিভূত করা যেতে পারে, কেননা কৃষ্ণ সর্বত্রই বিরাজমান। অন্য কথায়, শিক্ষার এই দুটি প্রেক্ষাপট পারস্পরিকভাবে স্বতন্ত্র নয়। আমার সমস্ত শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে লক্ষ্য হলো সবকিছুকে কৃষ্ণের সঙ্গে সংযুক্ত করা। এই লক্ষ্যকে স্মরণ করে ওপরের এলিমেন্টারি ক্লাসের বাৎসরিক শিক্ষাপদ্ধতিতে পাঁচটি বিষয় প্রয়োগ করা হয়। এই পাঁচটি বিষয় শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সঙ্গে সম্বন্ধীয়, যেমন –ঈশ্বর, জীব, প্রকৃতি, কাল ও কর্ম। প্রতিটি টার্মের জন্য এক একটি স্বতন্ত্র বিষয় রয়েছে। ক্লাসে যা কিছু শেখানো হয় তা নির্দিষ্ট টার্মের প্রতিপাদ্য বিষয়ের সঙ্গে সম্বন্ধসূচক। কারিকুলামের সঙ্গে পর্যায়ক্রমিক একিভূতকরণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে সেবা কার্যচক্রের সুযোগ লাভ করে।”
পারমার্থিক কর্মসূচী
TKG একাডেমির পারমার্থিক কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে শ্রীল প্রভুপাদ প্রদত্ত সারাবিশ্বের হরেকৃষ্ণ মন্দিরে প্রচলিত পারমার্থিক কার্যক্রম থেকে। পারমার্থিক কর্মসূচীর লক্ষ্য হল TKG একাডেমির মূল আদর্শকে অনুপ্রাণিত করা। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা একটি প্রেমপূর্ণ পরিবেশে পারমার্থিক গুণাবলী অর্জন করে। প্রতিদিন প্রত্যুষে, শিক্ষার্থীরা তাদের দিন শুরু করে সকালের সাধনা ক্লাসের মধ্য দিয়ে। শিক্ষার্থীরা সংস্কৃত প্রার্থনা আবৃত্তি করে, স্বতন্ত্রভাবে বিগ্রহ পূজা-অৰ্চনা সম্পাদন করে এবং হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র ও বৈদিক কাহিনিসমূহের ওপর ধ্যান অনুশীলন করে। গুরুকুলের বিগ্রহসমূহের পূজা অর্চনা সম্পাদনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি স্বাভাবিক আসক্তি লাভ করে। শুক্রবারের পারমার্থিক কার্যক্রমে মন্দিরের পূজারীরা যেভাবে পুজা-অর্চনা করে ঠিক সেরকমভাবে শিক্ষার্থিরা বিগ্রহের যথাবিধ পুজা অর্চনা করার সুযোগ লাভ করে। প্রত্যুষের সাধনা ক্লাস শেষ হয় শিক্ষার্থীদের একে অপরের প্রতি ও তাদের শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে। প্রত্যুষের এই কার্যক্রম অন্যান্য দিনের প্রাতিষ্ঠানিক ক্লাসসমূহের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষ বিশেষ বৈষ্ণবীয় ছুটির দিন ও উৎসবের সময় TKG একাডেমি মন্দিরের যথাবিধ কার্যক্রমসমূহে অংশগ্রহণ করে। মিডিয়া, গবেষণা, নাটক ও চিত্র শিল্প প্রদর্শনী এবং সাহিত্যমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিশেষ বিশেষ দিবস সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করে। উৎসবের প্রস্তুতি সেবা ও অন্যান্য ইভেন্টগুলোতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণও লক্ষ্যণীয়।
এক অনুগামী ছাত্রের অভিজ্ঞতা
ডালাসের হরে কৃষ্ণ কমিউনিটিতে বড় হয়েছিলেন নারায়ণ। তার ভ্রাতা জনার্ধনের সাথে তিনি বাল্যবয়সে টিকেজি একাডেমিতে ভর্তি হন এবং সেখানে প্রাক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত অধ্যয়নরত ছিলেন। নারায়ণ ও তার সহধর্মিনী লরা মেয়ারের কনিষ্ঠ সন্তান ইথান টিকেজি একাডেমিতে প্রাক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তার পিতা মথুরানাথ দাস ও মাতা লীলার বৈষ্ণব গুণাবলীর সম্মিলিত রূপ যেন এই ভক্ত। তিনি সম্প্রতি কর্মরত আছেন স্পোর্টস ওবারমেয়রর ডিজাইন মার্চেন্ডাইজ পরিচালক হিসেবে। পূর্বে তিনি ডালাসে সেন্ট বার্নাড স্পোর্টসের হয়ে কর্মরত ছিলেন। এই কারণে বছরের বিভিন্ন সময় তাকে বিভিন্ন দেশে পরিভ্রমণ করতে হয়। তার সমগ্র পেশাগত সাফল্যের পেছনে টিকেজি একাডেমির শিক্ষাকেই গর্বের সাথে স্মরণ করেন। তিনি একসময় সেখানে দু’জন নিষ্ঠাবান ভক্ত রুপানুগা দাস ও মাতা জয়ন্তীর অধীনে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় টিকেজি একাডেমি থেকে প্রাপ্ত কোনো কোনো শিক্ষা তিনি নিজের জীবনে প্রয়োগ করেছেন কিনা? উত্তরে তিনি বলেন, “আমি শিখেছি জগতে লোকেদের সাথে কিভাবে আচরণ করতে হয়। রুপানুগ প্রভু ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাপরায়ন একজন ব্যক্তি।”
তিনি এটিও উল্লেখ করেন যে, কিভাবে গুরুকুল তাকে শিখিয়েছিল “সবকিছুকে প্রশ্ন কর”। এই হল কৃষ্ণভাবনার দর্শনের ভিত্তি, অথাতো ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা। গুরুকুলের শিক্ষার্থীরা শুধু প্রাত্যহিক নিয়ম কানুনই অনুসরণ করে না, বরঞ্চ তাদের কাছে প্রত্যাশা করা হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা গ্রহণ করা ও প্রশ্ন করার বিষয়টি কিভাবে কোনোকিছু উত্তম, ভিন্ন ও উন্নত হতে পারে এ সম্পর্কে বিচার বিবেচনা প্রত্যাশা করা হয়। তিনি বলেন, “এই মনোভাবই আপনাকে জগতে সম্মুখে নিয়ে যাবে।
এমনকি তার পণ্য বিক্রি ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রেও তিনি তার গুরুকুলের শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। এজন্যে তিনি সানন্দে স্মরণ করেন একসময় ডীপ এলামে কিভাবে শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থাবলী বিতরণ করতেন, “প্রচার আমাকে শিখিয়েছিল কিভাবে বিক্রি করতে হয়!”
“বিনম্ৰতা গুণ সম্পর্কে গুরুকুল আমাদের যে শিক্ষা প্রদান করে, তা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।” এই সমস্ত কারণে নারায়ণ অনুভব করে যে, গুরুকুলের শিক্ষার্থীদের রয়েছে বিশেষ দক্ষতা। তারা নির্ভিকভাবে যেকোনো প্রতিবন্ধকতা গ্রহণ করতে প্রস্তুত। দৃষ্টান্তস্বরূপ তিনি বলেন, চাকরির স্বার্থে এডোব ইলোস্ট্রেটর শিখতে অন্যদের যেখানে দুই বছর লেগেছিল, সেখানে তিনি দু’মাসেরও কম সময়ের মধ্যে তা করায়ত্ত করেছিলেন।
আজ তার সন্তানও সেই হরে কৃষ্ণ বিদ্যালয়ে এবং সেসাথে তারা টিকেজি একাডেমির পরিবারের সদস্য। এখনও নারায়ণ তার শৈশবে টিকেজি একাডেমির প্রতি দক্ষিণা স্বরূপ প্রতি মাসে ১ হাজার ৫০০ ডলার প্রদান করে থাকেন।