এই পোস্টটি 301 বার দেখা হয়েছে
২৭মে, ২০০০ সাল। তমাসজো শহরে রাস্তায় ভক্তরা মিলিত হয়ে হরিনাম সংকীর্তনে মেতে উঠেছিল। পোল্যান্ডের এ শহরটির জনণণ পারমার্থিকভাবে ততটা উন্নত না হলেও ইসকনের হরেকৃষ্ণ প্রচার কার্যক্রম তাদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। তবে এটুকু না বললেই নয় যে, যেহেতু এটি ভগবধাম নয় তাই এখানে ভালো সহায়তাকারী জনগণ যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ক্ষতি | সাধনকারী জনগণও। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল এসব বিপরীত পক্ষীয় গুটি কয়েক জনগণদের প্রায়ই ছিল যুবক। এসব যুবকের কাছে ইসকনের এ হরেকৃষ্ণ প্রচার কার্যক্রম মোটেই পছন্দ নয়। তমাসজোতে সেদিন রাতে একটি বড়সড়ো প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়েছে। আর সেজন্যে শহরজুড়ে দেয়ালে | দেয়ালে লাগানো হয়েছে রঙ-বেরঙের পোস্টার। এসব প্রতিপক্ষ যুবকেরা প্রায় পোস্টারের উপর উল্টো আরেকটি পোস্টার লাগিয়ে দিলেন। তাতে লেখা ছিল, “Attention! Sect! Festival Cenceled!”। কিন্তু তবুও ঠিকই সেদিন রাতে এসব অপপ্রচার সত্ত্বেও প্রচুর লোক সমাগম হয়। ইন্দ্রদুম্ন্য স্বামী মহারাজের নেতৃত্বে তখন সবাই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র নৃত্য-কীর্তনে বিভোর। অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি সময়টাতেই যখন পুরো অনুষ্ঠানটিই জমজমাট হয়ে উঠেছে ঠিক সে সময় বিশাল জনস্রোতের উপর ঠিক মধ্যখানে উপর থেকে একটি বক্সের মতো একটা জিনিস কে যেন ছুড়ে মারল। আর সঙ্গে সঙ্গেই কালো ধোঁয়া বের হতে লাগল। কীর্তন বন্ধ আর লোকজন কিছু বুঝে উঠার আগেই দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে লাগল। ওটা ছিল টিয়ার গ্যাস। পরক্ষণেই প্রায় গোটা বিশেক কালো পোশাক পরিহিত আক্রমণকারী এসে সামনে যাকেই পাচ্ছে তাকেই ভয়ংকর অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মারতে আরম্ভ করল। তাদের হাতে ছিল বেসবলের ব্যাট, লোহার রড এবং লোহার শিকল। অনুষ্ঠানের উপস্থিত অতিথিরা তো রয়েছেই ছোট ছোট বাচ্চারা পর্যন্ত ঐসব দুর্বৃত্তদের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি। নিরাপত্তার দায়িত্বরত ভক্তরা বাধা দিতে গেলে তারাও মারাত্মকভাবে জখম হয়। প্রায় ২০ মিনিটের মত হঠাৎ এ আক্রমণে পুরো অনুষ্ঠানটিই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। স্থানীয় পুলিশদের যখন ফোন করা হয় ওরা আসতে আসতেই ততক্ষণে রক্তগঙ্গা বয়ে যায়। আহতদের অনেককেই তখন তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে নেয়া হয়। সবচেয়ে অবাকের বিষয় হল পুলিশকে এ বিষয়ে রিপোর্ট লিখতে বললে তারা রিপোর্টতো লিখেনি, বরঞ্চ বাকি রাত নিরাপত্তা দিতে তারা অক্ষমতা প্রকাশ করে। প্রকৃতপক্ষে ভক্তরা তাদের এ আচরণে বুঝতে পারেন যে, এ আক্রমণের পেছনে পুলিশসহ নিকটস্থ গীর্জার প্রধানরাও জড়িত আছেন। ঐদিন রাতের এ ঘটনার পর পরের দিন প্রোগ্রাম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
এ ঘটনার দু’সপ্তাহ পরই গোরজৌ উইলকোপোলস্কীতে একটি সফল প্রোগ্রাম সমাপ্তির পর তমাসজোর পাশেই অবস্থিত লড়জে একটি প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়। ভক্তরা তখন ওখানে অনুষ্ঠান চালিয়ে যেতে দ্বিধান্বিত হয়ে পরে। কেননা তমাসজোের সেই দুর্বিসহ এক রাতের ঘটনা এখনো তাদের স্মৃতিতে রয়েছে। ঐদিন রাতের প্রত্যক্ষদর্শীরা তখন লডজে যেতে রীতিমত ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে পরে। এদের ভীত সন্ত্রস্থ হওয়ার আরেকটি কারণও রয়েছে। কেননা স্থানীয়দেরও অনেকেই দুর্বৃত্তকর্তৃক পুনঃ হামলা হতে পারে এ ধরনের পূর্বাভাস দিয়ে আসছিল। ইতোমধ্যে তারা সে ধরনের আলামতও নাকি খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু শ্রীমৎ ইন্দ্ৰদ্যুম্ন স্বামী মহারাজ ভক্তদেরকে বলেন “১৯৭৫ সালে। প্রভুপাদ তার একটি ক্লাসে বলেছিলেন, বৈষ্ণবরা শুধু হরেকৃষ্ণ জপই করে না, প্রয়োজন হলে বিষ্ণুর প্রতিনিধি হয়ে যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত এবং জয়ীও হবেন…… সাধারণত বৈষ্ণব হিংস্র নয়। কিন্তু কৃষ্ণ যদি চান আমাদেরকে প্রয়োজনে হিংসও হতে হবে. ……..” । শ্রীমৎ ইন্দ্ৰদ্যুম্ন স্বামী মহারাজ তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, আমাদরেও ঐসব দুর্বৃত্তকারীদের মোকাবেলার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে তাছাড়া পর্যাপ্ত পুলিশেরও ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি বললেন “এটা কোন ভয় নয়। ভয় যদি হয়ে থাকে সেটা আকাশের মেঘের জন্য, কেননা ইতোমধ্যেই বড় একটি বৃষ্টির আভাস দেখা দিচ্ছে যা পুরো অনুষ্ঠানকেই পণ্ড করতে পারে। শ্রীমৎ ইন্দুদ্যুম্ন স্বামী মহারাজ ভিতরে এক গোপনীয়তা রক্ষা করে ভক্তদের উৎসাহ দিলেন। তার ঐ গোপনীয়তা ছিল পুলিশ প্রধানের মন্তব্য। তিনি বলেছিলেন, “যত রকমের নিরাপত্তাই থাকুক তবুও আমাদের জানা মতে তারা অনুষ্ঠান পণ্ড করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।” তিনি ভক্তদের সঙ্গে টিয়ারগ্যাস সহ প্রয়োজনীয় সেলফ ডিফেন্সিভ অস্ত্রশস্ত্র রাখতে বললেন। কিন্তু মহারাজ তাদের উৎসাহ ভেঙে যাওয়ার ভয়ে তা গোপন রাখেন। লডজের ফেস্টিভ্যালের জন্য ইতোমধ্যে ৫০,০০০ আমন্ত্রণপত্র বিতরণ করা হয়েছে এবং ১০০০ পোস্টার লাগানো হয়েছে । উৎসবের দিনে মহারাজ সহ সবাই ভগবান লক্ষ্মী নৃসিংহদেবের কাছে গভীর প্রার্থনা নিবেদন করেন যাতে করে বৃষ্টি সমস্যা সহ দুর্বৃত্তদের আক্রমণজনিত কোন সমস্যা উৎসবকে পশু করতে না পারে। ধীরে ধীরে যতই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে আকাশ অলৌকিক ভাবে পরিস্কার হয়ে গেল এবং মোটামুটি রকমের জনসমাগম হল। এদিকে পুলিশের সাথে কথা বলার সময় প্রসাদ নিয়ে মন্তব্য করার সময় এক কর্মকর্তা বললেন “মহারাজ, আপনাদের প্রসাদে কোন না কোন অলৌকিক শক্তি আছে যার কারণে বাঘের মত হিংস্র আমাদের পুলিশরা কিরকম নম্র ভদ্র হয়ে হাসাহাসি করছে। তাই আমি বলি কি আপাতত ওদের জন্য আপনাদের প্রসাদ না দিয়ে বাইরের খাবার দিলে ভালো হয়।” মহারাজ তার এ কথা শুনে অত্যন্ত আশ্চর্য হলেন। কৃষ্ণ প্রসাদের এরূপ মহিমা শ্রবণের পরও সত্যিই তাদেরকে প্রসাদ না দিয়ে বাধ্য হয়েই বাইরের খাবার দিতে হল। এরপর মূল অনুষ্ঠানের সময় যখন হরেকৃষ্ণ নৃত্য কীর্তনের তালে তালে সবাই এক আনন্দময় মুহূর্তে ব্যস্ত সেসময় যথারীতি দুর্বৃত্তদের একটি দল এসে ভীড় হয়ে এগুতে এগুতে স্টেজের কাছাকাছি আসতে লাগল। ভক্তদের অনেকেই তাদেরকে চিনেছিল। পুলিশও ধীরে ধীরে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছিল। এদিকে প্রহ্লাদের কোন খেয়ালই নেই। তিনি ব্যস্ত হরেকৃষ্ণের তালে তালে নাচতে এবং জনগণদেরও নাচাতে। ভক্তরা সবাই তখন ভীত সন্ত্রস্ত।
কী হবে? কী হবে? ভক্তরাও যার যার মত আড়ালে রাখা টিয়ার গ্যাস ও প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে প্রস্তুত। ঠিক সে সময় ভক্তরা যা দেখল তা তারা কোনদিন ভাবতেও পারেনি। সবাইকে অবাক করে তারাও স্টেজের সামনে নৃত্যরত জনগণদের সঙ্গে হরেকৃষ্ণ কীর্তন সহকারে নাচতে লাগল। সেইসব যুবক দুর্বৃত্তরা দুই হাত তুলে উদণ্ড নৃত্য করতে লাগল। আর তাদের চোখে মুখে তখন অপরাধের প্রায়শ্চিত্তের এক চেহারা ভেসে উঠল এবং হরিনামের স্বাভাবিক অপরিসীম আনন্দ উপভোগ করতে লাগল। এরপরে যা হল সেটিও গভীর মানবতার মিলনও বলা যায়। ভক্তরাও তাদের সঙ্গে নেচে গেয়ে পুরো অনুষ্ঠানটি উদযাপন করল। এমনকি অনুষ্ঠান যখন শেষ, বহুদূরে যখন তারা হেটে চলে যাচ্ছিল তখন জনশূন্য ঐ স্থানে বসেই ভক্তরা সবাই আবছা আবছা ভেসে আসা তাদের গাওয়া সেই হরেকৃষ্ণ মন্ত্রের সুর শুনছিলেন যেটি তারা সারা রাত গেয়েছিল। মহামন্ত্র অত্যন্ত পাষণ্ডী ধরনের ব্যক্তিদের মনও যে কিভাবে গলাতে পারে তারই প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে রইলেন পোল্যান্ডের এই ভক্তরা। জয় হরিনাম সংকীর্তন কী জয় । হরে কৃষ্ণ ।
শ্রীমৎ ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বামী মহারাজের Diary of a traveling preacher থেকে সংগৃহীত ।