এই পোস্টটি 262 বার দেখা হয়েছে

সাম্প্রতিক কালে ভারত ও বাংলাদেশে নারীদের সতীত্ব হরনের মতো চাঞ্চল্যকর ও দুঃখজনক ঘটনা বেশ আলোচিত ও সমালোচিত। সমাজ এখন নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। বিশেষত সমাজের চোখে যারা তথাকথিত ভদ্রলোক বলে খ্যাত তারাই যখন নারীদের নিরাপত্তা প্রদানের চেয়ে ভোগ লালসায় মেতে উঠে তখন সেটি আরো দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাড়ায়। এখন প্রশ্ন হলো এ থেকে পরিত্রানের উপায় কি কিংবা কেনই বা এ সমস্ত দুঃখজনক ঘটনা প্রতিনিয়তই আড়ালে বা প্রকাশ্যে ঘটে চলেছে? এর জন্য দায়ী কি, কে বা কারা? চৈতন্য চরণ দাসের Sexual Energy on the Riot অবলম্বনে নিম্নের প্রতিবেদনে এ সম্পর্কে বিস্তৃত তুলে ধরা হয়েছে।
নৈতিক অবক্ষয়ের ইতিহাস
যুগ যুগ ধরে মৈথুন শক্তির অব্যবস্থাপক শক্তি সবসময় মানবতার জন্য একটি হুমকি। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অনেক কাহিনি ইতিহাসে রয়েছে যাদের অনিয়ন্ত্রিত মৈথুনময় জীবন-যাপন তাদের জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। অনেক যুদ্ধও সংঘটিত হওয়ার পেছনে দায়ী ছিল অনিয়ন্ত্রত মৈথুন শক্তি । ক্লিওপেট্রা, নেপোলিয়ান ও হিটলারের মতো ব্যক্তিদের জীবনে এই অনিয়ন্ত্রিত মৈথুন সমস্যা সহিংসতার বীজ বপন করে পরিশেষে যেটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয়। আমেরিকার এক রাষ্ট্র প্রধানের অনৈতিক মৈথুন চরিতার্থতার জন্য আমেরিকার কোষাগার থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল প্রচলিত ধর্মগুলো সমস্ত অপশক্তির বিরুদ্ধে উচ্চতর নৈতিক আদর্শ দ্বারা পরিচালিত। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় সেখানেও মৈথুন শক্তির মাধ্যমে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ঘটে। ইউরোপীয়ান রেনেসাঁরও পূর্বে অনেক পোপ নীতিভ্রষ্ট জীবন-যাপন করত, এমনকি অনেকে অবৈধ সন্তানের পিতাও ছিল। অনেক হিন্দু নেতাও একসময় বৈরাগী বা সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিল। এরকম অনেক ব্যক্তি ধর্মীয় ব্যক্তিদের অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সন্ন্যাসী বা মঠবাসী হওয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছিল।
এমনকি বিবাহিত অবস্থাও অনিয়ন্ত্রিত মৈথুন শক্তির বিরুদ্ধে নিরাপদ নয়। জিম ব্যাকার ও জিমি সগাট, টাইগার উডস এর মত ব্যক্তিরা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে হেনস্থা হয়েছেন। ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতেও অনেক সময় শিশু নির্যাতনের খবর মিডিয়ায় পাওয়া যায়।
বিষয়টি সাম্প্রদায়িক বা ধার্মিকতার প্রেক্ষাপটই হোক না কেন সর্বত্রই মৈথুন শক্তির আক্রমনের বিপরীতে কোন সুরক্ষা না থাকলে পতন ঘটে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (১৮/৬৬) এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয় যে, সংস্কারাদির প্রচলনের ঊর্ধ্বে পারমার্থিকতার সারবস্তু গ্রহণ করতে হবে। এই পারমার্থিকতার সারবস্তু মৈথুন শক্তির কুপ্রভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করে। যতক্ষণ পর্যন্ত মৈথুন শক্তির বিরুদ্ধে সুরক্ষিত থাকা না যায় ততক্ষণ এটি যে কাউকে আক্রমণ করতে পারে এবং অনাকাঙ্খিত অপকর্ম করার জন্য বাধ্য করতে পারে।
মৈথুন শক্তির পুতুল
বৈদিক শাস্ত্রে মৈথুন শক্তির ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে। বৈদিক শাস্ত্রে এরকম অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যে, এমনকি কিছু কিছু দেব-দেবী ও মুনি-ঋষিও এই শক্তির শিকার হন। সৌভরী মুনি ৫০ জন রাজকুমারীকে বিয়ে করেছিলেন এবং ইন্দ্র কর্তৃক এক মুনিপত্নীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার কারণে তাকে অভিশপ্ত হতে হয়েছিল। এই সমস্ত কিছু আজকের পাপারাজ্জিদের জন্য ভালো সংবাদ হতে পারে। এর বিপরীতে বৈদিক শাস্ত্রে এমন নৈতিক অবক্ষয়ের কোনো অস্বাভাবিক বা উৎকট বর্ণনা প্রদান করা হয়নি। পক্ষান্তরে, তুলে ধরা হয়েছে, অনিয়ন্ত্রিত মৈথুন শক্তি কত ভয়ঙ্কর হতে পারে। এটি যে কাউকে মাটিতে পুঁতে ফেলতে পারে।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, রাবন সীতা দেবীকে অপহরণ করেছিল এবং দুঃশাসন দ্রৌপদীর শ্লীলতাহানির অপচেষ্টা করেছিল। বৈদিক শাস্ত্রে শ্রীরামচন্দ্র বা পাণ্ডবদের মত সে সময়ের মহান মহান নেতাদের কথা বর্ণনা করা হয়েছে যারা অনেক প্রতিবন্ধকতা সহ্য করেছিলো যাতে করে সঠিক সময়ে ঐ সমস্ত অনৈতিক চরিত্রের ব্যক্তিরা চিরতরে বিনাশ হয়। যখন এসমস্ত ঘটনা বর্ণনা করা হয় তখন এ থেকে কি শিক্ষা বা বার্তা রয়েছে তাও বর্ণনা করা হয়েছে। এই ঘটনাগুলি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, অত্যন্ত শক্তিশালী মৈথুন শক্তি কিভাবে পুতুলের মত অসৎ চরিত্রের লোকদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। শাস্ত্রে যোগের পরিশুদ্ধিকরণ পন্থা সম্পর্কেও বর্ণিত হয়েছে যা মৈথুন শক্তির ধ্বংসাত্মক প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেই শক্তিকে বরং গঠনমূলক পথে পরিচালিত করে। আমাদের অস্থিত্ব দুই প্রকার: পারমার্থিক ও জাগতিক। যখন মৈথুন শক্তি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে তখন তা লোকদের জাগতিক শরীরকে প্রভাবিত করে যেখানে স্বেচ্ছায় বা বলপূর্বক মৈথুনে লিপ্ত হয়।
অধিকার লঙ্ঘন
সম্মতিবিহীনভাবে নারীদের শরীর কেউ স্পর্শ করতে পারে না এবং এই বিষয়টি পুরুষদের অনুধাবন করা উচিত। অনিয়ন্ত্রিত মৈথুন শক্তি লোকেদেরকে নারীদের ন্যায্য অধিকার লঙ্ঘন করতে উদ্যত করে এবং সেটি হয় দুর্বুদ্ধিপূর্ণভাবে ও নির্লজ্জভাবে। কিন্তু সেই মৈথুন শক্তি সবাইকে আরো একটি অধিকার লঙ্ঘন করতে উদ্যত করে সেটি হল, আত্মার প্রতি আমাদের অধিকার। যখন এই শক্তি আমাদের চেতনাকে আবৃত করে, তখন সেটি আমাদের পারমার্থিক চেতনা থেকে বঞ্চিত করে এবং সে সাথে স্বভাবজাত পারমার্থিক সুখ লাভের অধিকারকে বঞ্চিত করে।
সর্বাকর্ষক পরমেশ্বর ভগবানের সাথে আমাদের নিত্য প্রেমময়ী সম্পর্ক বিদ্যমান। যখন আমাদের চেতনা শুদ্ধ হয়, তখন চিন্ময় শক্তি অপ্রাকৃত প্রেমের সহিত হৃদয়ে পরমেশ্বর ভগবানের সাথে সেই দিব্য সম্পর্ক প্রতিস্থাপন করে পরম সুখ পায়। কিন্তু যখন আমরা শ্রীকৃষ্ণের সাথে আমাদের সম্পর্কের কথা বিস্মৃত হয়ে জড় পদার্থের মাঝে আনন্দ খুঁজি তখন সেই চিন্ময় শক্তি মৈথুন শক্তি রূপে ভ্রান্তভাবে পরিচালিত হয়। এজন্যে বৈদিক শাস্ত্র ভক্তিযোগের একটি পদ্ধতিগত পন্থা প্রদান করে যা অতৃপ্তিময় মৈথুন শক্তিকে চিন্ময় শক্তির পথে পরিচালিত করে। ভারসাম্যহীন মৈথুন শক্তি আমাদের পারমার্থিক এবং জাগতিক কল্যাণের ক্ষেত্রে হুমকি স্বরূপ। এই হুমকি সর্বদাই রয়েছে, বর্তমান সংস্কৃতি এটিকে আরো আন্দোলিত করেছে এবং কর্তৃত্বপরায়ন করে তুলেছে।
আজকাল মিডিয়াও যৌনতাকে তাদের প্রধান যন্ত্র বানিয়ে লোকেদের মনকে উত্তেজিত করছে। বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও মুভিগুলোতে এর ব্যাপকতা লক্ষ্যণীয়, অর্থাৎ এর মাধ্যমে বার্তাটি হল আমরা প্রকৃতপক্ষে মৈথুন শক্তির দাঙ্গা বা বিশৃঙ্খলাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
উপরোক্ত এই বিশ্লেষণ আমাদের সমাজের প্রতি দায়িত্বের অবহেলাকে প্রতিফলিত করে। আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের কার্যকলাপের জন্য অভিযুক্ত এবং এজন্যে কেউ ভুল করলে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু শাস্তি প্রথার চেয়েও অধিক কার্যকরী হল স্থায়ী সামাজিক সংশোধন পন্থা। মৈথুনশক্তির এই দাঙ্গায় কেউই সুরক্ষিত নয়-প্রত্যেকেই শিকারে পতিত হতে পারে।
এক্ষেত্রে অবশ্যই যারা মৈথুন নির্যাতনের প্রধান লক্ষ্য তাদের সুরক্ষার প্রয়োজন। এজন্যে প্রয়োজন শক্ত আইন, নিশ্চিদ্র প্রহরা ও কঠোর শক্তিমত্তার প্রয়োগ এবং পাশাপাশি জাগতিক ও পারমার্থিক ভারসাম্য ঠিক রেখে সামাজিক সংস্কৃতির যথাযথ কৌশল অবলম্বন করে সম্মিলিতভাবে মৈথুন শক্তির আক্রমণকে পরাভূত করার জন্য লড়াই করতে হবে।
আমাদের প্রত্যেককেই নিজের চেতনাকে পারমার্থিকতায় রূপান্তরিত করতে হবে এবং তখন আমরা একটি ভারসাম্যপূর্ণ সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারব। এক্ষেত্রে বৈদিক জ্ঞান আমাদেরকে আলো ও শক্তি প্রদান করতে সর্বদা প্রস্তুত। বৈদিক শাস্ত্র আমাদেরকে প্রয়োজনীয় অন্তদর্শন ও কৌশল প্রদান করে। যত বেশি আমরা উচ্চতর আভ্যন্তরীন পারমার্থিক সুখ আস্বাদন করব, তত বেশি আমরা মৈথুন শক্তির দাঙ্গা বা বিশৃঙ্খলা প্রতিহত করার জন্য শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হব এবং এভাবে তা সমাজ তথা প্রত্যেকের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।
লেখক পরিচিতি : চৈতন্যচরণ দাস শ্রীমৎ রাধানাথ স্বামী মহারাজের একজন শিষ্য। তিনি ইলেক্ট্রনিক ও টেলিকমিউনিকেশনের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন। এবং পুনে মন্দিরে ব্রহ্মচারীরূপে শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি এ পর্যন্ত আটটি গ্রন্থ লিখেছেন।