শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ অধ্যয়ন করব কেন? (পর্ব – ০৩)

প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২১ | ১১:৪১ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২১ | ১১:৪৪ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 320 বার দেখা হয়েছে

শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ অধ্যয়ন করব কেন? (পর্ব – ০৩)

ড. নিতাই সেবিনী দেবী দাসী

চতুর্শ্লোকী ভাগবত ১৮ হাজার শ্লোক কেন হল?

পূর্বে উল্লেখিত পাঁচটি ভক্ত্যাঙ্গ আমাদের করতেই হবে। ভাগবতের (১/২/১৮) নির্দেশ রয়েছে ‘নিত্যং ভাগবতসেবয়া’ অর্থাৎ-নিয়মিত ভাগবতের সেবা বা শ্রবণ করতে হবে। ভগবানের প্রত্যেকটি সেবার আলাদা আলাদা পদ্ধতি রয়েছে- যেমন প্রসাদ সেবন, প্রসাদ আমাদের মুখের ভিতর দাঁতের মাধ্যমে পিষ্টন করেই সেবন করতে হয়। সেরূপ ভাগবতও আমাদের পাঠ করেই সেবা করতে হয়। এজন্য আপনারা দেখে থাকবেন, পূর্বে বিভিন্ন জায়গায় ভাগবত সপ্তাহ হত (এখনো হয়)। ভাগবত নিজে নিজে পাঠ করার পাশাপাশি ভক্তের শ্রীমুখ থেকেও শুনা উচিত। নিজে নিজে পড়ে আপনি তা ভালভাবে উপলদ্ধি করতে পারবেন না। এজন্যই ভাগবত সপ্তাহের আয়োজন করা হয়। এই সুযোগটি আমরা এখন ফেইসবুক এবং ইউটিউব-এর মাধ্যমে খুব সুন্দরভাবে গ্রহণ করতে পারি। এই ভাগবত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে ব্রহ্মার হৃদয়ে প্রকাশ করান। সেটা ছিল চতুর্শ্লোকী ভাগবত। ব্রহ্মা হলেন এই ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাই তিনি চারটি শ্লোকের মাধ্যমেই তিনি পুরো ভাগবত আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন। এই চারটি শ্লোক থেকেই এই আঠার হাজার শ্লোক এসেছে আমাদের কলিযুগের জন্য। ভগবান সঙ্কর্ষণ (বলরাম) চতুষ্কুমারদের ভাগবত শুনিয়েছেন। চতুঃসনের মধ্যে সনৎকুমার এই ভাগবত প্রচার করেন সাংখ্যায়ন মুনিকে। সাংখ্যায়ন মুনি, দেবগুরু বৃহস্পতি এবং পরাশর মুনিকে ভাগবত পড়িয়েছিলেন। পরাশর মুনি মৈত্রেয় ঋষিকে পড়ান , মৈত্রিয় ঋষি বিদুরকে পড়ান। শ্রীমদ্ভাগবতের তৃতীয় স্কন্ধে মৈত্রেয় বিদুর কাহিনী আমরা দেখতে পাই। পরাশর মুনির উপর পুলস্ত মুনির এক আশির্বাদ ছিল। পরাশুর মুনির পিতাকে এক রাক্ষস দানব বধ করেছিল। তিনি এই রাক্ষসদের নিধন করার জন্য এক যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন। তখন পুলস্ত মুনি বশিষ্ঠ মুনিকে অনুরোধ করেছিলেন পরাশর মুনির যজ্ঞ অনুষ্ঠান বন্ধ করার জন্য। বশিষ্ঠ মুনির অনুরোধে পরাশর মুনি যজ্ঞ বন্ধ করে দেন। পুলস্ত মুনি তখন পরাশুর মুনিকে আশীর্বাদ দিলেন যে, তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ ভাগবত বক্তা হবে।
আপনারা গোকর্ণের কথা শুনেছেন। চিত্রকূটে নারদ মুনিকে সান্ডল্য মুনি এই গোকর্ণের কথা শুনিয়েছিলেন। আত্মারাম নামে এক ব্রাহ্মণ ছিল। তিনি তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে বাস করতেন। ওনার পত্মী দুন্দলী ভাল স্বভাব সম্পন্ন ছিল না। প্রায়ই ওনাদের দুজনের মধ্যে ঝগড়া হত। কিন্তু আত্মারামের স্বভাব ভাল ছিল। তাই তারা কোন ভাবে মানিয়ে নিতেন।
কিন্তু তাদের একটা দুঃখ ছিল যে তাদের কোন সন্তান ছিল না। এভাবে আত্মারাম খুব দুঃখ করতে লাগল, মৃত্যুর পর আমার শ্রাদ্ধ কে করবে?
কে আমাকে পুৎ নামক নরক থেকে রক্ষা করবে। এজন্য তিনি একবার নদীর তীরে গেলেন আত্মহত্যা করার জন্য। সে সময় এক সাধু সেখানে উপস্থিত হলেন এবং আত্মারাম সেই সাধুকে তার দুঃখের কথা বললেন। সাধু তখন তাকে বুঝাতে লাগলেন, তোমার বয়স হয়ে গেছে তোমার এখন বানপ্রস্থ নেওয়ার সময় এসেছে।
শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি মহারাজ চিত্রকেতুর কথা বললেন, তুমি তোমার ভাগ্যের উপর হাত দিও না। তোমার কোন সন্তান নেই মেনে নাও, এটাই তোমার প্রতি ভগবানের কৃপা। কিন্তু আত্মারাম নাছোরবান্দা তিনি সেই সাধুর কাছে আশীর্বাদ চাইলেন সন্তানের জন্য।
অবশেষে সেই সাধু একটি আম দিলেন এবং বললেন এই আমটি তোমার স্ত্রীকে দিও তাহলে ওর সন্তান হবে। কিন্তু স্ত্রী তাতে অনীহা প্রকাশ করল। আত্মারামের স্ত্রীর এক বোন ছিল, তিনি বললেন ঠিক আছে আমি এখন গর্ভবতী হয়েছি। নয় মাস পরে সন্তান হলে সেটি তোমাকে দিয়ে দেব। এ কথায় দু’জনে সম্মতি প্রকাশ করে সেই আমটি একটি গাভীকে খাইয়ে দিলেন এবং এই সময় আত্মারাম তীর্থযাত্রায় চলে গেলেন। আত্মারাম যখন ফিরে আসলেন তখন দেখলেন একটি সন্তান হয়েছে, তাতে সে খুব খুশী হলেন।
যে গাভীকে আমটি খাওয়ানো হয়েছিল সেই গাভীটির একটি মানব শিশু জন্ম হল। কিন্তু তার কর্ণযুগল ছিল গাভীর মত। এজন্য ওর নাম গোকর্ণ। দুন্দুলী এবং আত্মারাম নিজের সন্তানের নাম রাখলেন দুন্দুকারী। সে ছিল তার স্ত্রীর বোনের সন্তান। সেই বোনটি ভক্ত ছিল না তাই তার সন্তানটি খারাপ কর্ম করতে লাগল। কিন্তু গাভীর শিশুটি ছিল সাধুর আশীর্বাদ। এজন্য সেই শিশুটি ভাল কাজ কর্ম করতে লাগল।
এক সময় দুন্দুকারী তার বাবাকে বাড়ী থেকে বের করে দিলেন। তখন আত্মারাম গোকর্ণের কাছে গেলেন। তখন আত্মারাম তার পুত্র গোকর্ণের কাছে সবকিছু বললেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন এখন তার কি করা উচিত। গোকর্ণ উত্তর দিলেন, পিতাশ্রী আপনার সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে আপনি এক সাধুর কাছে ভৌতিক জিনিস চেয়েছেন। যখন কোন সাধু সন্তদের সাথে সাক্ষাৎ হয় তখন আমাদের আধ্যাত্মিক বস্তু চাওয়া উচিত। এখন আপনি দুন্দুকারীর কথা চিন্তা না করে বনে যান এবং ভগবানকে লাভ করার চেষ্টা করুন।
এজন্য সাধুদের কাছে ভৌতিক (এ জগতের যেকোনো বস্তু) জিনিস না চেয়ে কৃষ্ণ প্রেম চাওয়া উচিত। বিষয়টা হল এমন যে আমাকে এক হাজার টাকা দিতে পারে তার কাছে আমি এক টাকা চাইছি। দেখুন ধ্রুব মহারাজ এবং প্রহ্লাদ মহারাজ দুজনই নারদ মুনির শিষ্য। তাদের দুজনের প্রাপ্তি আলাদা। একজন ধ্রুবলোক এবং আরেকজন ভগবদ্ধাম। এরূপ কেন হল? গুরুদেব কী পক্ষপাতিত্ব করেছেন? না।
এর কারণ ছিল দুজন গুরুদেবকে আলাদা দৃষ্টিতে দর্শন করেছেন। ধ্রুব মহারাজ গুরুদেবকে দর্শন করে তার পিতার চেয়েও বড় রাজ্য পেতে চেয়েছিলেন, সেই কথা তিনি তার গুরুদেবকে বলেছেন। কিন্তু প্রহ্লাদ মহারাজ তিনি বলেছিলেন আমার জন্য যা কল্যাণকর আপনি কৃপা করে তাই আমাকে বলুন। ওনার কোন ব্যক্তিগত চাহিদা ছিল না। এজন্য আমাদেরকেও ভৌতিক জিনিস চাওয়ার আগে সাবধান থাকতে হবে, যার কারণে আমাদেরকে এই জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হতে হবে। এভাবে গোকর্ণের কথা শ্রবণ করে আত্মারাম বনে চলে গেলেন।
এদিকে দুন্দুকারী তার মাকেও ঘর থেকে বের করে দিলেন। তিনি পরে আত্মহত্যা করেন। গোকর্ণ তার মায়ের জন্য শ্রাদ্ধ করতে কাশীতে চলে গেলেন। এদিকে দুন্দুকারী তার ঘরে পাঁচ বেশ্যা মহিলা নিয়ে এলেন এবং অপকর্ম করতে লাগলেন। ঐ পাঁচ বেশ্যা দুন্দুকারীর সম্পদের লোভে তাকে মেরে ফেলে ঘরের মাঝখানে পুতেঁ দেন। গোকর্ণ ফিরে এসে জানতে পারেন এবং খুব দুঃখ পেলেন। দুন্দুকারীর আত্মা গোকর্ণকে অনুরোধ করলেন তার হীন অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য।
গোকর্ণ আবার কাশীতে গেলেন শ্রাদ্ধ করার জন্য। কিন্তু তাতেও সে মুক্ত হতে পারে নি। তারপর গোকর্ণ কিছু সাধুদের জিজ্ঞাসা করলেন কি করা যায় এখন। সাধুগণ বললেন, সূর্য্য পূজা করার জন্য। সূর্য্য পূজা করার পর সূর্র্য্যদেব প্রসন্ন হলেন এবং বললেন, দুন্দুকারীর আত্মা মুক্ত করার ক্ষমতা আমার নেই তবে আমি তোমাকে বিধান দিচ্ছি। সেটা হল সাতদিন তুমি ভাগবত পাঠ কর তাহলেই তার আত্মা মুক্ত হয়ে যাবে।
এভাবে গোকর্ণ সমস্ত গ্রামবাসীকে একত্রিত করে ভাগবত পাঠ শুরু করলেন। দুন্দুকারী সূক্ষ্ম শরীর দিয়ে ভাগবত শ্রবণের জন্য একটি বাঁশের মধ্যে প্রবেশ করল। ঐ বাশেঁর মধ্যে সাতটি গিট বাঁধা ছিল। এভাবে প্রথম দিন শেষে একটি গিট খুলে যায়। তারপর দ্বিতীয় দিন ২য় গিটটি খুলে যায়। এভাবে সাতদিন শেষে সাঁতটি গিট খুলে গিয়ে চতুর্ভূজধারী এক দিব্য পুরুষ বের হলেন এবং বৈকুণ্ঠে চলে গেলেন।
সবাই দেখে খুব আশ্চার্যন্বিত হলেন। তারা ভাবলেন আমরাও তো শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ ও শ্রবণ করলাম, কেন আমরা মুক্ত হলাম না? তখন দৈববাণী হল “দুন্দকারী খুব সতর্কতা সহিত শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করার ফলে তার আত্মা মুক্তিলাভ করল। আপনারা দুন্দুকারীর মত শ্রবণ করেননি।”

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।