এই পোস্টটি 147 বার দেখা হয়েছে
আমেরিকায় সানফ্রানসিসকো শহরে ৫ এপ্রিল ১৯৬৭ এবং কলাম্বাস শহরে ১৩ মে ১৯৬৯ প্রদত্ত শ্রীজগন্নাথদেবের পুরীধামে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মাহাত্ম্য বিষয়ক নাট্যরচনা প্রসঙ্গে সংলাপের সারমর্ম
হয়গ্রীব: শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখন জগন্নাথপুরীতে যান, তখন তাঁর বয়স কত হয়েছিল?
শ্রীল প্রভুপাদ: জগন্নাথপুরীতে তিনি গিয়েছিলেন চব্বিশ বছর বয়সে। তাঁর সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণের ঠিক গ্রহনের পরেই গিয়েছিলেন। তিনি সন্ন্যাস নেন চব্বিশ বছর বয়সে।
তিনি নানা মন্দির দর্শন করতেন ক্ষীরচোরা গোপীনাথ, সাক্ষীগোপাল, এই সব দর্শন করার পরে শেষকালে শ্রীজগন্নাথদেবের মন্দির যান । তখন বহুলোক মন্দির দর্শনে ঢুকছিল, সেই সময়ে তিনিও ঢোকেন একলা। সেই সময়ে ৫০০ থেকে ১০০০ দর্শনার্থী সর্বদাই মন্দির যেত । ঐ মন্দিরের সেটাই তো বৈশিষ্ট্য ।
মন্দিরে ঢুকে শ্রীজগন্নাথদেবকে দর্শন করে মহাপ্রভুর এমনই গভীর ভাবোল্লাস হয় যে, তিনি অচেতন হয়ে সেখানে পড়ে গিয়েছিলেন । তখন সব লোক স্তম্ভিত হয়ে যায়। সবাই দেখে, এক তরুণ সন্ন্যাসী, অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। সেই সময়ে পুরীধামের এক বিদ্বান পণ্ডিত শ্রীসার্বভৌম ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে । তিনি মহাপ্রভুর অচেতন শরীর দেখে বললেন, “আহা, এ তো অতি অল্পবয়সী সন্ন্যাসী-একে তো সাধারণ মানুষ বলে মনে হচ্ছে না!”
তাই সেই ভট্টাচার্য পণ্ডিত লোকজন ডেকে মহাপ্রভুর অচেতন দেহখানে তুলে সযত্নে সেবার জন্য ঘরে নিয়ে গেলেন জগন্নাথপুরী মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে। সবাই আশ্চর্য হয়ে চিন্তা করেত থাকলেন-মন্দিরের মধ্যে এই অল্পবয়সী সন্ন্যাসী এসে কেমন করে পড়ে গেলেন? এমন ঘটনা তো ঘটে না!
হয়গ্রীব: এর থেকে কি হল? শেষ পরিণাম কি হয়েছিল?
শ্রীল প্রভুপাদ: শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জগন্নাথপুরীধামে গিয়ে এই লীলামাহাত্ম্যের পরিণামে হল কী-সার্বভৌম পণ্ডিতের মতো নির্বিশেষবাদীর শ্রদ্ধা জাগল বৈষ্ণবের ভূমিকায় লীলাবিলাসকারী ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রতি। সার্বভৌম পণ্ডিতের বাড়িতে আলোচনা, যুক্তিতর্ক সব কিছুতে অংশগ্রহণ করে মহাপ্রভু তাঁকে শেষ পর্যন্ত শিষ্য করে নিয়েছিলেন এবং পরে তিনি মহাপ্রভুর শিক্ষালাভ করে মহান ভক্ত হয়েও উঠেছিলেন। তখনকার দিনে সমগ্র পুরীধামে তো বটে, সারা উড়িষ্যা প্রদেশের মধ্যেও তর্কশাস্ত্রের দুর্দান্ত পণ্ডিত বলে সার্বভৌম ভট্টাচার্যের সুনাম ছিল। তিনি কিনা মহাপ্রভুর জগন্নাথধামে অবস্থানকালে সর্বপ্রথমেই তাঁর কাছে শিষ্যত্ব স্বীকার করেন!
তাই শুনে উড়িষ্যার রাজাও দারুণভাবে বিস্মিত হন, কারণ তাঁর রাজসভায় একজন সম্মানিত পণ্ডিত রূপে আসন অলঙ্কৃত করে রাখতেন শ্রীসার্বভৌম ভট্টাচার্য মহাশয়। তাঁকে মহাপ্রভুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে দেখে রাজা নিজেও একজন মহান্ ভক্তে পরিণত হন ।
হয়গ্রীব: শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কাছে? তাঁরা সবাই শিষ্য হয়ে থাকলেন?….রাজা পর্যন্ত……?
শ্রীল প্রভুপাদ: হ্যাঁ, তাঁরা মহান্ ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন।
হয়গ্রীব: উড়িষ্যার রাজা কৃষ্ণভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন? কেমন করে তাঁদের দেখা-সাক্ষাৎ ঘটেছিল, একটু বলবেন?
শ্রীল প্রভুপাদ: সার্বভৌম ভট্টাচার্য যখন রাজাকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কথা শোনালেন, তখন রাজা জানতে চেয়েছিলেন, “কেমন সন্ন্যাসী তিনি? শুনলাম আপনি তাঁর শিষ্য হয়েছেন।” তখন সার্বভৌম ভট্টাচার্য বলেছিলেন, “হ্যাঁ, তিনি সাধারণ সন্ন্যাসী নন। আমি যতদূর বুঝেছি তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং।” সার্বভৌম পণ্ডিতের কথা সবাই মানত। তাই রাজা যখন শুনলেন, সার্বভৌম পণ্ডিতের মতো মানুষ বলছেন, শ্রীচৈতন্যদেব স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, তখন তিনিও মহাপ্রভুর ভক্ত হয়ে গেলেন। তখন শ্রীজগন্নাথ পুরীধামে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য রাজার আদেশে সব কিছু মঞ্জুর হয়ে গেল। রাজার লোকেরা, বহু লোক…..চারশ পাঁচশ লোক রোজই মহাপ্রভুর দর্শনে আসতে লাগল। সকলেই এসে তাঁকে অনেক কিছু নিবেদন করত-খাবার-দাবার, টাকা-পয়সা, থাকবার জায়গা। আর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বিনা বাধায় শ্রীজগন্নাথ পুরীর মন্দিরে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র সংকীর্তনের আয়োজন শুরু করে দিলেন। সেই সঙ্গে তিনি মহানন্দে নৃত্য করতেন শ্রীজগন্নাথদেবের প্রীতিসাধনের জন্য। তাঁর উদ্যোগে শ্রীজগন্নাথপুরী মন্দিরে প্রতি সন্ধ্যায় চারটি সংকীর্তন দল জমায়েত হত। প্রত্যেক দলে থাকত চারটি মৃদঙ্গ এবং আটটি করতাল। একটি দল থাকত সামনে, একটি দল পিছনে, একটি দল বাম পাশে এবং আর একটি দল ডান পাশে এবং মাঝখানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নৃত্য করতেন এবং ঔ চারটি সংকীর্তন দলও”
হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ॥
হয়গ্রীব: মহাপ্রভু যখন দক্ষিণ ভারতে গিয়েছিলেন, তখন?
শ্রীল প্রভুপাদ: হ্যাঁ, তিনি সন্ন্যাস গ্রহণের পরে সারা ভারতবর্ষ পরিক্রমায় গিয়েছিলেন ছয় বছর। তার মানে ৩০ বছর বয়স অবধি তিনি পর্যটনে ছিলেন। আর সেই ৩০ বছর বয়স থেকে ৪৮ বছর বয়স পর্যন্ত ১৮ বছর তিনি থাকতেন শ্রীজগন্নাথপুরীধামে। মন্দিরেই তিনি জপ-সংকীর্তন করতেন এবং সেখানেই দর্শনার্থীদের দর্শন দিতেন। বিষয় করে রথযাত্রা উৎসবের সময় বঙ্গদেশ থেকে প্রায় ৪০০/৫০০ ভক্ত যেতেন তাঁর দর্শন লাভের আকাঙ্ক্ষায় এবং তাঁরা পুরীধামে একটানা মাস চারেক থাকতেন-জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর-এই চার মাস। তার পরে তাঁরা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ, উপদেশ, আদেশ মাথায় নিয়ে ফিরে আসতেন।
এইভাবে ১৮ বছর যাবৎ শ্রীজগন্নাথদেবের লীলাক্ষেত্র পুরীধামে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অবস্থান করে অসামান্য পদ্ধতিতে কৃষ্ণভাবনামৃত পরিবেশনের পথ প্রদর্শন করেছিলেন। সেখানেই তিনি অপ্রকটিত হন।
শ্রীল প্রভুপাদ: রাত্রে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কৃষ্ণবিরহের বেদনায় উন্মাদের মতো হয়ে যেতেন, মন্দিরের মেঝেতে মাথা ঠুকতেন । কখনও তিনি তাঁর নখের আঁচড়ে কৃষ্ণনাম লিখতেন, আবার কখনও তাঁকে দেখা যেত শ্রীজগন্নাথপুরী মন্দিরের গোশালায়। কখনও তাঁকে দেখা যেত সমুদ্রের ধারে। একদিন দেখা গেল তিনি সাগরের জলে পড়ে গেছেন আর কোনও জেলের জালে আটকা পড়েছেন। জেলের জালে যখনই তিনি আটকা পড়েন এবং জেলে যখন তাঁকে স্পর্শ করে, অমনি সেই জেলেও
হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ॥
ঠিক সেই সময়ে মহাপ্রভুর একান্ত পার্ষদ শ্রীস্বরূপ দামোদর সাগরের তীরে এসে দেখেন জেলেটা নাচছে। তিনি তখনই বুঝলেন-নিশ্চয়ই এটা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কোনও লীলা। না হলে জেলেটা অমনভাবে ‘হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ’ বলে সমুদ্রের ধারে নাচতে শুরু করে দিয়েছে কেন! তিনি জেলেটাকে বললেন, ‘কই দেখি, তোমার জালে কি ধরেছ?’ দেখেন-সেখানে অচৈতন্য অবস্থায় আটকা পড়েছেন মহাপ্রভু স্বয়ং! শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু চেতনা ফিরে পেয়ে স্বরূপ দামোদরকে বলেন, “কেন এখানে আমাকে আনা হয়েছে? আমি রাসনৃত্য দেখছিলাম মহা সুখে!”
ঠিক ঐ ধরনের প্রেমোন্মাদনা নিয়েই তিনি জগন্নাথদেবের মন্দিরে একদিন প্রবেশ করেছিলেন-আর বেরিয়ে আসেননি। “কোথায় কৃষ্ণ, কোথায় কৃষ্ণ?” বলে কাঁদতে কাঁদতে তিনি শ্রীজগন্নাথদেবের বিগ্রহের মাঝে লীন হয়ে গিয়েছিলেন। শ্রীজগন্নাথদেব আর শ্রীকৃষ্ণ তো অভিন্ন।