মৃত্যুঃ একটি বিশেষ আত্মার দেহত্যাগের কাহিনী।

প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৯:৫৩ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৯:৫৩ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 37 বার দেখা হয়েছে

মৃত্যুঃ একটি বিশেষ আত্মার দেহত্যাগের কাহিনী।

মৃত্যুঃ একটি বিশেষ আত্মার দেহত্যাগের কাহিনী।

ধর্মপুত্র শ্রীভদ্রশ্রবার উক্তি দিয়ে শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে,

অহো বিচিত্রং ভগবদ্বিচেষ্ঠিতং

মুন্তং জনোহয়ং হি মিষন্ ন পশ্যতি।

ধ্যায়ন্নসদ্যর্হি বিকর্ম সেবিতুং

নির্হত্য পুত্রং পিতরং জিজীবিষতি।

 (শ্রীমদ্ভাগবত ৫/১৮/৩)

“আহা! কি আশ্চর্য! এই সব মানুষ আসন্ন প্রাণ-অপহারক ভয়ঙ্কর মৃত্যুকে দেখেও দেখছে না! মৃত পিতা বা মৃত পুত্রকে দাহ করে এসে তারা মৃতের ধন-সম্পত্তি দ্বারা অতি তুচ্ছ বিষয়-সুখ ভোগ করবার আশায় জীবন ধারণ করে থাকতে ইচ্ছা করছে।”

মানুষ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয় না। ভগবানের পাদপদ্মে তার মতি হয় না, সে কেবল দুঃখময় জগতে সুখভোগের অন্ধ আশায় জীবন কাটিয়ে যায়, এটাই সবচেয়ে আশ্চর্যকর। আবার যখন মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন তারা জানে না তাদের পরবর্তী গন্তব্য কোথায় হতে যাচ্ছে। নরক, স্বর্গ নাকি অন্য কোন লোকে নাকি অন্য কোন দেহে? এ বিষয়ে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। অনেকেই মৃত্যুর সময় আশা করে যে, প্রিয়জনদের দেখে তাদেরই সামনে মৃত্যুবরণ করাটাই হবে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, আবার কেউ কেউ পরিকল্পনা করে মৃত্যুর পর তার শশ্মান হবে ঐ খানে, কিংবা এক বিরাট শোভা যাত্রা হবে তার মৃতদেহ নিয়ে, কিংবা তার মৃত দেহের সৎক্রিয়ার সময় সবাইকে ভোজ দেবে (এখন ক্রিয়াদিতে আমিষেরও প্রচলন দেখা যায় এবং তথাকথিত মনগড়া নিয়মে এসমস্ত ক্রিয়াদি সম্পন্ন করা হয়) ইত্যাদি কত ধরণের পরিকল্পনা। কিন্তু মানুষ মৃত্যু সম্পর্কে অজ্ঞ হলেও মৃত্যু আসবেই, তার স্ব-মুর্তিতে। কৃষ্ণ বলেছেন, অভক্তদের কাছে মৃত্যু আসে অত্যন্ত ভয়ংকর রূপে আর ভক্তদের কাছে তার বিপরীত। অভক্তরা মৃত্যু ভয়ে ভীত হয় ভক্তদের কাছে মৃত্যু কোন ভয়ের বিষয় নয়। কেননা তারা মৃত্যুকে কিভাবে জয় করতে হয় তার বিজ্ঞান সম্পর্কে অবগত। বৈদিক শাস্ত্রে কিভাবে মরতে হয় এ বিষয়ে অনেক দিক নির্দেশনা রয়েছে।

ভক্তদের মৃত্যু কিভাবে হয় তার একটি কাহিনী পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হল।

৮ই মে ২০১০। পুরুষোত্তম মাস। বিহারিনী দেবী দাসী, তার দেহ ত্যাগ করলেন। তিনি শ্রী শ্রীমৎ জয়-পতাকা স্বামী মহারাজের শিষ্য ছিলেন। তার স্বামীর নাম শ্রীমান কৃষ্ণ দয়াল দাস এবং তার ৫ জন পুত্র রয়েছে। তার সবকটি পুত্র সন্তানই বেড়ে উঠেছে কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে। কেউ মায়াপুরের গুরুকুলে শিক্ষা লাভ করে বেড়ে উঠছে। কেউ আবার বিশ্বের কোন না কোন ইসকন মন্দিরে কৃষ্ণভাবনাময় জীবন যাপন করছে। তাকে একজন সফল মাতা এবং তার স্বামীকে একজন সফল পিতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় কেননা তার পুত্ররা সবাই কৃষ্ণভক্ত। একেকজন জগন্নাথ মন্দিরে তার সেবা ছিল ভগবানের জন্য রান্না করা এবং ফুলের মালা তৈরি করা। তাকে দেখা যেত সবসময়ই কোন না কোন সেবায় ব্যস্ত। রথযাত্রার সময় এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উৎসবগুলিতে তিনি হাজার হাজার ভক্তের রান্না করতেন। মাঝে মাঝে ৫ হাজারেরও বেশি লোকের জন্যও তাকে রান্না করতে হত। তার সেবার মনোভাবে কখনো স্বার্থপরতা ছিল না। গত পাঁচ বছর শরীরের বিভিন্ন অসুস্থতা নিয়ে কষ্ট পেলেও তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি মন্দিরে যাওয়ার বাসনা করেছিলেন এবং তার গৃহে যেই আসত না কেন তাকে ভগবানের প্রসাদ দিতেন। তার জীবন ছিল অত্যন্ত সাদামাটা। কিন্তু চিন্তা ছিল সার্বক্ষণিক ভগবানের সেবা করা। দেহত্যাগের কয়েক মাস পূর্বে তিনি তার পুত্রদের অনুপস্থিতির জন্য আবেগপ্রবন হয়ে উঠেন। তখন তার পুত্র গৌর কীর্ত্তন প্রভু তাকে পুন: নিশ্চয়তা দেন যে, এ বিষয়ে কোন উদ্বিগ্ন না হতে। তার উচিত এ অবস্থায় সর্বদা ভগবানের নাম আরও গভীরভাবে জপ করা এবং তার হৃদয়ে ভগবান জগন্নাথদেবকে দর্শন করা। তিনি এ অবস্থায় একমাত্র ভগবানের কৃপা প্রার্থনার কথা বলেন। সবাই আগে থেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছিল বিহারিনী দাসীর দেহত্যাগের সময় হয়েছে। কেননা ইতোমধ্যে স্ট্রোকের কারণে শরীরের অনেক অংশই প্যারালাইসিস আক্রান্ত হয়ে অবশ হয়ে গেছে এবং তার পাশাপাশি অন্যন্য রোগের উপদ্রবও রয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে তার অবস্থা আরও খারাপ হল। দেহত্যাগের তিনদিন পূর্বে তিনি তার স্বামীকে বলছিল কে যেন তাকে ডাকছিল। তিনি তার স্বামীকে বলেছিলেন” আস আস তারা আমাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কৃষ্ণ দয়াল প্রভু তার স্ত্রীকে বলছিল কী হয়েছে ? বিহারিনী দাসী বলেন, “তারা আমাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তার দেহত্যাগের পূর্বের চব্বিশ ঘন্টাই সার্বক্ষণিকভাবে শ্রীল প্রভুপাদের জপ টেপ বাজানো হয় এবং কৃষ্ণ দয়াল প্রভুর পুত্র গৌরাঙ্গ দাস তার চারপাশে শ্রীমদ্ভাগবত এবং ভগবদ্গীতা পড়ছিল। কেউ কেউ জগন্নাথ মন্দির থেকে চরণামৃত নিয়ে আসে। বিহারিনীকে অনেকেই দেখতে আসে। তিনি সবার নিকট থেকে জল পান করেন। সন্ধ্যার দিকে তাকে সামান্য সুস্থ দেখাচ্ছিল। তাঁর পরিবার বিহারিনী দেবী দাসীর কিছু লক্ষন লক্ষ্য করেছিল। যেটা ইঙ্গিত দেয় যে তিনি যেকোন মুহুর্তে দেহত্যাগ করতে পারেন এবং তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, তারা রাতে জেগে থাকবে। কিন্তু এটি কালেরই একটি খেলা ছিল এবং তাদের সবাইকে ঘুমিয়ে রেখেছিল কিছুক্ষনের জন্য। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই তিনি দেহত্যাগ করেন। সবাই তখন বিহারিনী দাসীর দেহ স্পর্শ করলে- তখনও তার শরীর উষ্ণ ছিল। তার চোখগুলো অর্ধ বন্ধ এবং তার মুখ ছিল খোলা। শাস্ত্রানুসারে যখন আত্মা মুখ দিয়ে চলে যায় তখন তা স্বর্গলোক প্রাপ্ত হয়। যদিও ভক্তদের স্বর্গলোক নিয়ে তার নিয়ে কোন আগ্রহ নেই। তাই এর লক্ষণ হল বিহারিনী দাসী তার নিত্যধামে প্রত্যাবর্তন করেছেন। অপরদিকে কোন আত্মা যদি মলদ্বার বা পায়ুপথ দিয়ে গমন করে তবে সেই আত্মা নরক গ্রহগুলোতে পৌছবে। যদি কারও চোখ এবং মুখ খোলা থাকে তবে এ অর্থ হল যে, সেই আত্মার কোন বাসনা অপূর্ণ রয়েছে। বিহারিনী দেবী দাসী এ ধরনের কোন লক্ষনই ছিল না। তার দেহত্যাগের পর দলে দলে ভক্তরা এসে কীর্তন করতে থাকে। তার সৎক্রিয়ার সময় উপস্থিত থাকেন মায়াপুরের দুই পূজারী শ্রীমান জননিবাস প্রভু ও শ্রীমান পঞ্চজাস্ত্রী প্রভু এবং শ্রীমান সঙ্কর্ষন নিতাই প্রভু। তারা সবাই শাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে সিদ্ধান্ত দেন যে তিনি অবশ্যই বৈকুন্ঠলোক প্রাপ্ত হয়েছেন। পরবর্তীতে তাকে সমাধি দেওয়া হয়। পুষ্পাঞ্জলিয় সময় তারা মাতাজীর উদ্দেশ্যে একটি প্রণাম মন্ত্র আবৃত্তি করেন যেটি ব্যবহার করা হয় শুধুমাত্র সেই আত্মার জন্যই যেই আত্মা চিন্ময়জগত প্রাপ্ত হয়েছেন।

এভাবে পরিবারের সবাই বিহারিনী দেবীদাসীর মৃত্যুর সময় তাকে সর্বক্ষণ কৃষ্ণভাবনায় রাখতে সহায়তা করেছিলেন। ঐ চার হাত রূপ মূর্তিগুলো বিষ্ণুমূর্তি ছিল যার বিহারিনী দাসীকে চিন্ময় জগতে প্রত্যাবর্তনের জন্য স্বাগত জানাচ্ছিলেন। ভক্তদের কাছে যমদূত নয় স্বয়ং ভগবান বিষ্ণুমূর্তি আবির্ভূত হন। অভক্তদের জন্য যমদূতের ভয়ংকর সব মূর্তি দর্শন করে মৃত্যু ভয়ে প্রকম্পিত হয়।

সারাজীবনের কর্মের উপর নির্ভর করেই মৃত্যুর অবস্থা নির্ধারিত হয়। তাই বলা হয় যে “সাধন কর ভজন কর মরতে জানলেই হয়।” আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সঙ্গে ইসকন্ প্রতিষ্ঠাতা ও আচার্য অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ সারাবিশ্বকে শিখিয়েছেন কিভাবে মরতে হবে। মানুষ মরতেও জানে না। মরার এই বিজ্ঞানটি শিখে নেওয়া অতীব জরুরী, না হলে মৃত্যুর ভয়ংকর রূপ সবাইকে দর্শন করতে হবে।

হরে কৃষ্ণ।


মাসিক চৈতন্য সন্দেশ , আগস্ট ২০১০ ইং

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।