মায়ার আতঙ্ক

প্রকাশ: ২ নভেম্বর ২০২২ | ৭:৪০ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২ নভেম্বর ২০২২ | ৭:৪১ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 151 বার দেখা হয়েছে

মায়ার আতঙ্ক
মায়ার সামনে ভক্ত বড়াই করেন না, বরং মায়াকে ভয় পান এবং তিনি কৃষ্ণকে ভয় করেন না।

শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী


ভক্তদের দুশ্চিন্তা হলো, হয়তো সে জড়া প্রকৃতির দিকে আকৃষ্ট হতে পারে এবং কোনোভাবে শ্রীকৃষ্ণের চরণপদ্ম বিস্মৃত হয়ে যেতে পারে। সেটাই ভক্তের একমাত্র ভয়। সেই ভীতিই ভক্তকে পরিশুদ্ধ করে তোলে। কোনো ভক্ত পরমেশ্বর ভগবানকে ভয় করে না। হিরণ্যকশিপু নৃসিংহদেবকে খুব ভয় করতো। অথচ দেবতারা মনে করতো- “তিনি আমাদের রক্ষাকর্তা, তিনি আমার প্রভু।” ভক্ত শুধুমাত্র কৃষ্ণবিস্মৃতিকে ভয় পায়। মায়ার সামনে ভক্ত বড়াই করেন না, বরং মায়াকে ভয় পান এবং তিনি কৃষ্ণকে ভয় করেন না। তিনি সর্বদা কৃষ্ণের চরণপদ্ম আকড়ে থাকেন, ঠিক যেমন শিশু তার মা’কে ভয় করে না এবং সবকিছু থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মাকেই জড়িয়ে ধরে থাকে। কিন্তু শিশু ভয় পায় নতুন কোনো ব্যক্তিকে। ঠিক তেমনই এই জড় জগৎ আমাদের কাছে একটা নতুন বিচিত্র পরিবেশের মতো, এটা অস্বাভাবিক।
ভক্তরা নির্ভীক কারণ অভয়চরণারবিন্দ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণপদ্মে তারা আশ্রিত।
এই নির্ভীকতার জন্যই তাদের সাহস আর মনোবল অটুট থাকে এবং ভগবান চৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্কীর্তন আন্দোলনে ভগবদ্ভক্তির কাজে নিযুক্ত থাকতে পারে, নানা রকম বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও সঙ্কীর্তন আন্দোলনের প্রসার ঘটাতে পারে। তবে মায়ার প্রতি ভয় না থাকা ঠিক নয়। ভক্তদের জানা উচিত, স্বতন্ত্র জীবাত্মার চেয়ে মায়ার শক্তি বেশি এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আশ্রয় বিনা জীবমাত্রই মহামায়ার ফাঁদে পতিত হতে পারে। আর মায়ার রাজ্যে দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। মায়া সর্বদাই আমাদের পিছে ছায়ার মতো লেগে আছে। সকল সময়েই মায়া জীবকে আক্রমণ করছে। এই জড়দেহ থেকে যতক্ষণ না বেরুতে পারছি, ততক্ষণ মায়া ওৎ পেতে থাকবে আমাদের কবলিত করার জন্য। এই জড়জগতে আমরা যতক্ষণ রয়েছি, মায়ার প্ররোচনা থেকে ততক্ষণ আমরা মুক্ত থাকব, এই আশা করতে পারি না। এমনকি অজামিলের মতো শুদ্ধ ব্রাহ্মণও তামসিক আর রাজসিক সঙ্গ দোষে পথভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাহলে কলিযুগের বদ্ধ জীবদের কথা আর কি-ই বা বলার আছে? তারা তো অজ্ঞতার অন্ধকার আর কামনা-বাসনার চোরাবালিতে ডুবে ইন্দ্রিয় তৃপ্তি লাভে তৎপর রয়েছে। এই কলিযুগে যে সব অসাবধানী জীবাত্মা মহামায়ার ভয়াবহ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে অবহেলা করে আর নিতাই-গৌরাঙ্গের পাদপদ্ম প্রেমভরে জড়িয়ে ধরে রাখতে না চায়, তাদের ওপর মহামায়ার আধিপত্য করা তো খুবই সহজ।
যতই দিন যাচ্ছে ততই আমাদের সকলের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা না জেগে পারছে না, যখনই দেখছি উন্নত ভক্তদেরও অনেকে মায়ার কবলে পড়ছে আর শ্রীল প্রভুপাদের দেওয়া অমূল্য সেবা ভক্তিরত্নটিকে অবহেলায় পাশে ফেলে রাখছে। ঐ সব ভক্তদের দৃঢ়চিত্ত এবং একনিষ্ঠ বলেই মনে হতো। পূর্বানুবৃত্তি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, অসাবধানতা এবং অহঙ্কারের ফলেই মহামায়ার কাজ সহজ হয়েছে। মহামায়াকে ভয় না করা বিপজ্জনক। অনেক সময় ভক্তরা বলে, তারা শিশু নয়, তারা নিজেদের সামলাতে পারে, এমনি কত কথা। পরে দেখা যায়, তারা মায়ার কবলে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। এ থেকে আমার মনে ভয় জাগে। আমি কখনো প্রভুপাদ এবং ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর চরণারবিন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চাই না। আমি তোমাদের কাউকেও শ্রীকৃষ্ণভাবনা অনুশীলন থেকে বিচ্ছিন্ন দেখতে চাই না। তৃপ্তি উপভোগের মনোবৃত্তি জাগিয়ে রাখা জীবাত্মাদের কাছে কঠিন ব্যাপার নয়। সে তো অনন্ত কোটি জন্ম ধরে কেবলই সুখ ভোগে ব্যস্ত। আর কিছুই সে জানে না, বোঝে না।
আমাদের মধ্যে বহু যুগের সুপ্ত শ্রীকৃষ্ণভাবনা পুনরুজ্জীবিত করে তুলে ভগবৎ সেবার মনোবৃত্তি জাগানোর আশ্চর্য জাদু পদ্ধতি হলো শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অহৈতুকী কৃপা, যা শ্রীল প্রভুপাদ আমাদের এনে দিয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণভাবনাকে জাগিয়ে রাখতেই হবে আমাদের এবং অজ্ঞতার অন্ধকার বাড়িয়ে তুলে মহামায়ার প্রভাবের অধীনে আমাদের ভগবৎ সেবার মনোবৃত্তিকে নিদ্রামগ্ন হতে দেব না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভগবৎ-সেবায় প্রেমভাবে নিয়োজিত থাকতে পারলেই আমরা তাঁর চরণাশ্রয় লাভ করতে পারব, ‘মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তিতে’ শুধুমাত্র ভগবানের কৃপাবলেই আমরা মায়ার কবলমুক্ত থাকতে পারি, তা না পারলে ‘দুরাস্তয়া’-খুব কঠিন। ‘আমি শিশু নই’-এসব বলার অবকাশ থাকেনা, কারণ যতক্ষণ না পারমার্থিক জগতে ফিরে যেতে পারছি, ততক্ষণ কৃষ্ণভাবনার গুপ্ত অবস্থায় আবার নিমজ্জিত হয়ে যাবার প্রবল আশঙ্কা থেকে যায়- সেটাই হলো অজ্ঞানতা। মা-বাবাকে না দেখলে শিশু যেমন ভয় পায়, আমাদেরও তেমনি ভয় পাওয়া উচিত। শ্রীল প্রভুপাদ বলতেন, কৃষ্ণের জন্য আমাদের কান্না করা উচিত।
মায়ার কাজ কৃষ্ণের সাথে জীবদের সম্পর্ক ভুলিয়ে দেওয়া। সেটাই হলো জীবের বদ্ধ অবস্থা। তবুও মানুষের বুদ্ধি এবং ক্ষমতা রয়েছে মায়াকে অতিক্রম করার। কিন্তু তা করতে হলে তপস্যা, কৃচ্ছাসাধন, ত্যাগ-স্বীকার করতেই হবে। তপস্যার দ্বারা দিব্যজ্ঞান বজায় রেখে আত্ম-উপলব্ধি সম্ভব। কিন্তু যখন আমরা জপ ও ভক্তিমূলক সেবায় কৃচ্ছসাধন, ত্যাগ ও সাধনা ক্রমশ কমিয়ে দিই, তখন মায়া সুযোগ পেয়ে আমাদের বুদ্ধিকে আবৃত করে পুনরায় জড় কার্যকলাপে নিমজ্জিত করে। অতএব তপস্যা বা কৃচ্ছ সাধনের প্রয়োজন আছে। সেই জন্যেই ভোরে মঙ্গল-আরতিতে অংশ গ্রহণ করা, নিয়মিত জপ করা, গ্রন্থ পাঠ, এই সবই প্রতিষেধক স্বরূপ, মায়ার কবল থেকে দূরে থাকার প্রতিরক্ষা বিশেষ। তপস্যার বিকল্প কিছুই নেই।
হিরণ্যকশিপু ঘোষণা করেছিল, “আমার আদেশ ছাড়া কেউ কোনো রকম সাধনা, তপস্যা, কৃচ্ছ সাধন করতে পারবে না। সবাই ভোগ করুক।” কারো কাছে সে ছিল মহান এক নেতা, তারা তাকে পছন্দ করত। নৃসিংহদেব যখন আবির্ভূত হলেন, হিরণ্যকশিপুর বহু অনুগামী তাকে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু ধার্মিক ঋষি ও মুনিগণ আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে বলেছিলেন যে, সে তপস্যা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল এবং সাত্ত্বিক মানুষদের অত্যাচার করত। ফলে, সাধারণ মানুষ তাদের পারমার্থিক সত্তার পরিচয় ভুলে গিয়েছিল এবং নৃসিংহদেব এসেছেন এটাই প্রতিষ্ঠিত করতে যে, প্রত্যেককে তপস্যা করতে হবে এবং আত্মজ্ঞান উপলব্ধি করতে হবে। নিজেদের জানার জন্য কিছু কৃচ্ছ্রতা পালন করতেই হবে। চেতনার উচ্চ স্তরগুলিতে পৌঁছার উদ্দেশ্যে কিছু অনুশাসন, সংযম মেনে চলতে হবে। যখন আমরা তা করি না, তখনই মায়া আমাদের আক্রমন করে এবং সেটাই হলো সমস্যার মূল। শ্রীল প্রভুপাদ বিশেষ জোর দিয়ে বলে গেছেন, ২৪ ঘণ্টাই ভগবদ্ভক্তির অনুশীলনে দৃঢ় নিবন্ধ হয়ে থাকা দরকার। এমনকি কয়েক মিনিটের জন্যও মহামায়া প্রভাবিত কার্যকলাপের ফলে আমাদের পারমার্থিক জীবনে বিপর্যয় ঘটতে পারে। শ্রীল প্রভুপাদ সতর্ক করে দিয়ে বলতেন, পারমার্থিক জীবন চর্চা হলো ক্ষুরের মতো তীক্ষ্ম আর একটু অমনোযোগ হলেই ঘটে যেতে পারে বিপর্যয়। শ্রীল প্রভুপাদ আমাদের বলে গেছেন প্রতিদিন কমপক্ষে ১৬ মালা হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করতেই হবে-

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ॥

তিনি আরও উপদেশ দিয়েছেন যে, কঠোরভাবে চারটি বিধিনিষেধ পালন করতেই হবে, যেগুলো হলো- মাছ, মাংস, ডিম, পেঁয়াজ, রসুন খাবে না, কোনো নেশা করবে না; জুয়া খেলবে না; আর কোনো অবৈধ যৌনচর্চা করবে না। ভগবৎ সেবা চর্চার দৃঢ় মনোভাব নষ্ট করতে পারে কিংবা বিধিবদ্ধ জীবন যাপনের মনোভাবে দুর্বলতা সৃষ্টি করতে পারে, এমন সব কিছুতেই আমাদের ভয় থাকা উচিত।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর ‘শিক্ষাষ্টক’ এ উপদেশ দিয়েছেন যে, প্রেমভক্তি ভরা মন নিয়ে সর্বক্ষণ হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করতে হবে- একথাটা আমরা যেন কখনো না ভুলি। শ্রীল প্রভুপাদ একা ভগবদ্ধামে ফিরে যেতে চাননি, তিনি আমাদেরও নিয়ে যেতে চান। দয়া করে তোমরা এই নীতি নির্দেশগুলি সযত্নে মেনে চল এবং শ্রীল প্রভুপাদ আর শ্র্রীশ্রীনিতাই-গৌরের নিত্য সঙ্গ লাভের অধিকারী হও। অতএব আমাদের গুরু এবং গৌরাঙ্গের চরণপদ্মে আবদ্ধ হয়েই থাকতে হবে। আর তাঁদের চরণকমলে সংলগ্ন থাকার সবচেয়ে সহজ পন্থা হলো, এই জগতে তাঁদের অভিলাষ অভিব্যক্ত করা, আর তা করতে হলে অতি দীনভাবে অথচ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এবং পরম উৎসাহ সহকারে প্রত্যেককে দিতে হবে কৃষ্ণভাবনামৃত।
লেখক পরিচিতি: শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী শ্রীল প্রভুপাদের একজন প্রবীণ সন্ন্যাসী শিষ্য এবং তিনি ইস্‌কন দীক্ষাগুরু। বর্তমানে তিনি ইস্‌কন গভর্নিং বডির কমিশনার এবং তৎসহ ইস্‌কন-এর মায়াপুর, পশ্চিমবঙ্গ আন্তর্জাতিক প্রধান কার্যালয়ের সহ-নির্দেশক। তিনি মাত্র ১৯ বৎসর বয়সে ইস্‌কনে যোগদান করেন এবং বিগত ৫০ বৎসর ধরে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী কৃষ্ণভাবনামৃতের প্রচার করছেন, অগণিত মানুষকে মার্গ প্রদর্শন করেছেন এবং তিনি ব্রহ্মমর্ধ্ব গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের সবচেয়ে প্রবীণতম সন্ন্যাসী যিনি ৫০ বছরের সন্ন্যাস জীবনে গুরু গৌরাঙ্গের সেবায় রত ছিলেন।


 

 অক্টোবর – ডিসেম্বর ২০২২ ব্যাক টু গডহেড

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।