মহামারীতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপায় কি?

প্রকাশ: ৯ জানুয়ারি ২০২১ | ১২:৪০ অপরাহ্ণ আপডেট: ৯ জানুয়ারি ২০২১ | ১২:৪০ অপরাহ্ণ

এই পোস্টটি 421 বার দেখা হয়েছে

মহামারীতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপায় কি?
শ্রীমৎ প্রহ্লাদানন্দ স্বামী

বর্তমান সময়টি মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম নজিরবিহীন কাল। যেখানে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সকলের জন্য প্রতিনিয়ত উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে ভগবানের একজন শুদ্ধ ভক্ত আমাদের কিছু দিকনির্দেশনা দিতে পারেন।
স্বাস্থ্য সুরক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রহস্যটি কি? শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীমদ্ভাবতের প্রথম স্কন্ধের প্রথম অধ্যায়ের ১০নং শ্লোকের তাৎপর্যে লিখেছেন-
”কলিযুগের মানুষের আয়ু অল্প হওয়ার কারণ খাদ্যাভাব নয়। তার কারণ হচ্ছে অনিয়ম এবং অনাচার। সুনিয়ন্ত্রিতভাবে জীবনযাপন করলে, সাদাসিধে খাদ্যদ্রব্য আহার করলে যেকোনো মানুষ সুস্থ ও সরলভাবে জীবনধারন করতে পারে। অত্যাহার, অত্যাধিক ইন্দ্রিয়তৃপ্তি, অন্যের করুণার উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা এক কৃত্রিমভাবে জীবনমান উন্নত করার চেষ্টা মানুষের জীবনীশক্তি শোষণ করে নেয়। তাই তাদের আয়ু কমে যায়।” আয়ুর্বেদ ব্যাখ্যা করে যে, অসুস্থতার অন্যতম প্রধান কারণ হলো মানসিক চাপ বা স্ট্রেস। এমনকি দিনশেষে রাত্রিবেলায় পরিবেশের তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়ার মত প্রাকৃতিক পরিবর্তনেও স্ট্রেস হতে পারে। যখন জাগতিক জীবনে স্ট্রেস সৃষ্টি হয়, তখন দেহের শক্তিসমূহের (দোশা) ভারসাম্যহীনতা দেহকে সাম্যাবস্থায় রাখতে বাধা প্রদান করে। এর ফলশ্রুতিতে রোগের সৃষ্টি হয়। নিয়মতান্ত্রিক জীবনাচরণ এই সমস্ত চাপের প্রভাবকে হ্রাস করে। তাই বলা হয়, একজন ব্যক্তির জীবন যত বেশি নিয়ন্ত্রিত হবে, সে তত বেশি স্বাস্থ্যবান হবে।
সুনিয়ন্ত্রিত জীবনাচরনের জন্য আয়ুর্বেদ দৈনন্দিন এবং মৌসুম অনুসারে বিভিন্ন বিধান নির্দেশ করে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল উপাদানসমূহ হল-
১. আগের দিন রাত্রে প্রস্তুতি গ্রহণ করা
২. ভোরে ঘুম থেকে উঠা
৩. মল-মূত্র ত্যাগ, যাতে করে পাকস্থলী নতুন খাদ্য গ্রহনের জন্য খালি থাকে
৪. স্নান করা, সমস্ত ইন্দ্রিয় ধৌত করা, যেমন: হাত, পা, মুখ, চোখ, নাক ইত্যাদি, যাতে করে শুদ্ধ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আমরা ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ গ্রহণ করতে পারি
৫. ভগবানের বিগ্রহের ধ্যান করা
৬. হালকা ম্যাসেজ বা ব্যায়াম

নিদ্রা

একটি নিখুঁত সকাল শুরু হয় এর আগের রাত্রে ভাল ঘুমের মাধ্যমে। ভাল ঘুমের অনেকগুলি উপকার রয়েছে, যেমন- ঘুম শরীরের শক্তিসমূহের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। ঘুম সকল ইন্দ্রিয় ও মনকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম দেয়। খাদ্য যেমন পরিশ্রমের ফলে শরীর থেকে চলে যাওয়া শর্করা, খনিজ এবং অন্যান্য উপাদানগুলি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে, তেমনি ভাল ঘুম মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে। ঘুম মনকে সতেজ করে এবং মানসিক অনুপ্রেরণা বাড়ায়। গভীর ঘুম ধ্যানের একটি স্বাভাবিক অবস্থা।
ঘুম কেবল শারীরিক ওজন ঠিক রাখতে সহায়তা করে না, এটি দেহে একটি সুস্থ শক্তি গঠনেও সহায়তা করে যা দেহকে দ্যুতি প্রদান করে এবং দৃঢ়তার পাশাপাশি বুদ্ধিমত্তাও সরবরাহ করে। একজন ব্যক্তির কাজের ধরণ নির্ধারণ করে তার কতক্ষণ ঘুমানো দরকার। একজন শ্রমিকের, অফিস কর্মী অপেক্ষা বেশি ঘুম প্রয়োজন। সাধারণত বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ঘুমের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায়। ভগবদ্ভগীতা অনুসারে, ”যে ব্যক্তি প্রয়োজনের চেয়ে অধিক আহার করে, সে ঘুমের সময় খুব বেশি স্বপ্ন দেখে এবং ফলস্বরূপ, তাকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঘুমাতে হয়। প্রতিদিন ছয় ঘন্টার বেশি ঘুমানো উচিত নয়। যে ব্যক্তি চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ছয় ঘন্টার বেশি ঘুমায় সে অবশ্যই তমগুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তমগুণসম্পন্ন ব্যক্তি অলস প্রকৃতির এবং তার অধিক ঘুমানোর প্রবনতা রয়েছে। এই ধরনের ব্যক্তি যোগ অনুশীলন করতে পারে না।

(ভগবদ্ভগীতা ৬/১৬ তাৎপর্য)

এক কথোপকথনে শ্রীল প্রভুপাদ বলেন যে, ”বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন সময়কাল ঘুমের প্রয়োজন হতে পারে। তবে যেকোনো ক্ষেত্রেই এটি কমানোর চেষ্টা করা উচিত।” একইভাবে ঘুমও। ঘুমাও, কারণ তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু দিনে চব্বিশ ঘন্টা ঘুমাবে? না, এটা না। যেকোনো স্বাস্থ্যবান ব্যক্তির জন্য দৈনিক ৬ থেকে ৮ ঘন্টা ঘুম যথেষ্ঠ। এমনকি ডাক্তারেরাও বলেন, কেউ যদি দৈনিক ৮ ঘন্টার বেশি ঘুমায়, তবে সে অসুস্থ। সে অবশ্যই দূর্বল। স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি ছয় ঘন্টার কাছাকাছি ঘুমায়। এটা যথেষ্ঠ। আর কেউ যদি চায়, তবে ঘুম আরো কমানো যেতে পারে। ঠিক যেমনটি গোস্বামীরা করেছিলেন। তাঁরা মাত্র দেড় ঘন্টা বা সর্বোচ্চ দুই ঘন্টা ঘুমাতেন।

(শ্রীমদ্ভাগবতম্ ১/৫/৩৫ প্রবচন,
বৃন্দাবন, ১৬ আগস্ট ১৯৭৪)

অত্যাধিক ঘুম মানসিক ভারসাম্যহীনতা বা শারীরিক সমস্যার কারণ হতে পারে, যেমন- বদহজম, অঙ্গ বিক্ষেপ, অতিরিক্ত হুড়োহুড়ি ইত্যাদি। শারীরিক পরিশ্রম ঘুম আনতে সাহায্য করে শারীরিক ব্যায়াম নিদ্রাহীনতার বিভিন্ন কারণসমূহকে কমিয়ে দেয়, মানসিক চাপ, উদ্বেগ, ধকল ইত্যাদি। মস্তিষ্ক শান্ত হলে স্বাভাবিকভাবেই ঘুম আসে।

শয্যা ত্যাগ

সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠার অনেকগুলি উপকার রয়েছে। তার মধ্যে একটি হল, শরীর খুব সহজেই সূর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রিয়াশীল থাকে। শেষ রাত্রে শরীরে ভাটা (আয়ুর্বেদ অনুসারে শরীরের একধরনের সুপ্ত শক্তি) প্রাধান্য পায় এবং ফলশ্রুতিতে ভাল ঘুমের বিঘ্ন ঘটে থাকে। যেহেতু ভাটা দৈহিক নিঃসরণের সাথে সম্পর্কিত তাই ভোর হওয়ার পূর্বেই শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ অপঃসারণ করা ভাল।

পেট খালি করা

অগ্নিকুণ্ডে আগুন ভালোভাবে প্রজ্জ্বলিত হবে যদি আপনি প্রথমে ছাই পরিষ্কার করেন। একইভাবে, যদি খাওয়ার আগে শারীরিক বর্জ্য অপসারণ করা হয়, তবে খাবারটি খুব ভালোভাবে হজম হবে।

স্নান ও প্রক্ষালন

শরীরের দূষিত উপাদান নিঃসরণের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ত্বক। যদি ত্বক স্বাভাবিকভাবে তার কাজটি করতে পারে তবে বর্জ্য অপসারণের অন্যান্য অঙ্গ যেমন-কিডনি ও পরিপাকতন্ত্রের বোঝা কমে যায়। নিয়মিত স্নান এবং প্রক্ষালন এই প্রক্রিয়াটিতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে।

বিগ্রহের ধ্যান

শরীর যেমন শুদ্ধ রাখতে হয়, একইভাবে মনকেও পবিত্র রাখতে হয়। আয়ুর্বেদের চরক সংহিতা অনুসারে, পরমেশ্বর ভগবানের পবিত্র নাম জপ হচ্ছে মনকে শুদ্ধ করার সর্বোত্তম পন্থা। যার গলায় গুরুতর সমস্যা আছে, যাকে সাপে কেটেছে বা যে বিষ গ্রহণ করেছে, তার কেবল একজন দক্ষ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাতে ঘুমানো উচিত। অনিয়মিত ঘুমের কারণে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, যেমন- সাইনোসাইটিস, মাথা ব্যাথা, ক্ষুধামন্দা, এমনকি জ্বরও। সাধারণত দিবা নিদ্রার অভ্যাস করা উচিত নয়। তবে গ্রীষ্মকালে লম্বা দিনে নাতিদীর্ঘ বিশ্রাম নেওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে, অপর্যাপ্ত ঘুমও অনেক সমস্যার কারণ হতে পারে, যেমন- শরীরে ব্যথা, মাথা ভারী হওয়া, অত্যাধিক হুড়োহুড়ি, বদহজম, তন্দ্রাচ্ছন্নতা ইত্যাদি।
আয়ুর্বেদের একজন আধিকারিক ভগভাতার মতে, ”যে ব্যক্তি ব্রহ্মচর্য অনুশীলনকারী, ইন্দ্রিয় তর্পন থেকে বিরত এবং যিনি আত্ম সন্তুষ্ট, তিনি উপযুক্ত সময়ে স্বাভাবিক ঘুম পাবেন।”
নিম্নলিখিত উপায়ে অনিন্দ্রার প্রতিকার কারার যেতে পারে:
১. নিয়মিত খাওয়া, ঘুমানো, কাজ করা এবং বিনোদনের অভ্যাস অনিদ্রা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে। প্রতিদিনই একই সময়ে ঘুমাতে যান এবং একই সময়ে শয্যা ত্যাগ করুন।
২. অনিদ্রা দূর করতে গ্রীষ্মকালে তিলের তেল এবং শীতকালে সরিষার তেল দ্বারা মাথা, ঘাড় এবং পায়ের তালুতে ম্যাসাজ করা যেতে পারে।
৩. গরম জলে স্নান সারতে পারেন
৪. আধা চামচ ঘি সহ এককাপ গরম দুধ গ্রহণ করুন
৫. কানে এক বা দুই ফোঁটা তেল দিন
৬. পরমেশ্বর ভগবান এবং তাঁর অপ্রাকৃত লীলাবিলাসের ধ্যান-শান্তিপূর্ণ ঘুম আনতে সাহায্য করে।

হালকা ম্যাসেজ এবং ব্যায়াম

আমাদের শরীরে অনেকগুলি চ্যানেল রয়েছে, যাদেরকে বলা হয় স্ট্রোটাস। যখন এইসমস্ত চ্যানেলগুলি পরিষ্কার ও খোলা থাকে তখন এগুলির মাধ্যমে খুব সুন্দরভাবে শরীরের প্রতিটি কোষে পুষ্টি বিতরণ এবং কোষ থেকে বর্জ্য পদার্থ অপসারণ করা সম্ভব হয়। হালকা ম্যাসেজ ও ব্যায়াম এই চ্যানেলগুলি খুলতে ও পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। সঠিক ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীর ও মনের মধ্যে প্রাণ বা জীবনীশক্তি গ্রহণের সক্ষমতা বাড়ে। এইভাবে, ব্যায়াম ইন্দ্রিয়সমূহকে প্রাণবন্ত করে, হজম শক্তি উন্নত করে এবং সর্বোপরি, শারীরিক মঙ্গল সাধন করে।

প্রাতঃরাশ

যেহেতু শরীর পরিষ্কার হয়ে গেছে এবং হজমের আগুন জেগে উঠেছে, এখন যেকোন ব্যক্তি দৈনন্দিন কার্যকলাপ সম্পাদনের নিমিত্তে শক্তি পাওয়ার জন্য খাদ্য গ্রহণ করতে পারেন। খাবার গরমকালে হালকা এবং শীতকালে ভারী হতে পারে। এই সরল রুটিনটি অনুসরণ করলে আমরা রোগ-ব্যাধি প্রতিরোধ করতে অনেকটাই সক্ষম হবো এবং আমাদের শক্তির মাত্রাও অনেক বেশি থাকবে। ফলশ্রুতিতে, আমরা মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দূর করে উৎসাহের সাথে আমাদের ভক্তিমূলক সেবাটি সম্পাদন করতে পারবো।

(স্বাস্থ্যের উপর শ্রীল প্রভুপাদ ও ভক্তদের লেখা Hope this Meets You in Good Heath, আপনি আমাজন ডট কম, বার্নস এবং নোবেলাস থেকে সংগ্রহ করতে পারেন। এছাড়াও অর্ডার করতে পারেন নিচের ঠিকানায়- ইস্‌কন যোগপিঠ, ২৭ জাইর্বাতোভা, লুজলমানা, স্লোভেনিয়া-১০০০)

মাসিক চৈতন্য সন্দেশ, ডিসেম্বর ২০২০ সংখ্যা

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।