এই পোস্টটি 1663 বার দেখা হয়েছে
১৯৭৫ সালের মে মাসে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরের কৃষ্ণভাবনাময় কেন্দ্রে এক ইহুদি ধর্মযাজকের সাথে কথোপকথন
যাজক: যেটাকে আমি বলতে পারি ধ্যানচর্চা সেরকম কোনও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা আছে কি আপনাদের?
শ্রীল প্রভুপাদ: আমরা নয় রকম উপায়ে ভগবানের পূজা কওে থাকি। একটি হল স্মরণং-ভগবানের কাজকর্মেও কথা মনে মনে চিন্তা করা। সেটাই ধ্যান চর্চা।
যাজক: আপনি জানেন, খ্রিস্টান ধর্মের অতীন্দ্রিয়বাদে ধ্যানচর্চার একটি পদ্ধতির উল্লেখ আছে—যার কথা আভিলার সন্তু থেরেসা তাঁর লেখা ‘ভেতরের বাড়ি’ বইখানিতে বেশ প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করেছেন, কিন্তু প্রকৃত অতীন্দ্রিয় প্রার্থনা সবার জন্য নয়।
শ্রীল প্রভুপাদ: আমাদের অতীন্দ্রিয় প্রার্থনা হল ভগবানের কার্যকলাপের চিন্তা করা। যে কেউ তা পারে।
যাজক: আমাদের পদ্ধতিটা ঠিক অতটা ভগবানের কাজকর্ম নিয়ে চিন্তা করার ব্যাপার নয়–শুধু ভালবাসা পাওয়া, প্রকৃত নিস্তব্ধতা ও প্রশান্তি লাভ করা, যার মধ্যে–
শ্রীল প্রভুপাদ: না। ভগবদ্ভক্তি বা ভক্তিযোগ নিস্তব্ধতার ব্যাপার নয়। নিস্তব্ধতা বা নিবৃত্তি বলতে যা বোঝায় তা হল ভগবানের প্রতি প্রেম-ভালবাসার এক শান্ত পর্যায়। তখন জড়জাগতিক কাজকর্ম আপনার সব স্তব্ধ হয়ে যায়।
যাজক: এই শান্ত অবস্থাটি আপনি আর একটু বুঝিয়ে বলতে পারেন?
শ্রীল প্রভুপাদ: এটি হল নিতান্ত সেই পর্যায় যখন উপলব্ধি হয় যে, ভগবান অতি মহান–সেটাই হল শান্ত সমাহিত অবস্থা। তবে প্রকৃত ভগবদ্ভক্তির সূচনা হয় তখন ঠিক যখন মানুষ বুঝতে পাওে, ‘‘ভগবান যেহেতু মহান, তাই তাঁর সেবা করতে হবে আমাকে। কেন না কেন?” এই পর্যায়টি হল দাস্য অর্থাৎ সেবার মনোভাব। সেটাই হল ভক্তিযোগের সূচনা।
জড়জাগতিক কার্যকলাপ কেবলই আমাদের জন্ম এবং মৃত্যুর আবর্তে আবদ্ধ করে রাখে। একে বলে ‘প্রবৃত্তি মার্গ’–ইন্দ্রিয় উপভোগের জন্য কার্যকলাপ পন্থা। বাঘ এই নিয়ে ব্যস্ত। শুয়োর ব্যস্ত। কুকুর ব্যস্ত। আর যদি কোনোও মানুষ বাঘ আর শুয়োর আর কুকুরদের মতোই ইন্দ্রিয় উপভোগে ব্যস্ত হয়েই থাকে, তাহলে তার পরজন্মে সে ঐ সমস্ত জীব প্রজাতিরই কোনও একটার আকৃতি লাভ করতে পারে।
যাজক: যখন মানুষ কর্তব্য কর্মের উচ্চ স্তরে পৌঁছায়, যখন সে সমগ্র মানবজাতিকে সত্যিই ভালবাসে–
শ্রীল প্রভুপাদ: ওটা মনগড়া কথা–মানসিক জল্পনা মাত্র। কেন আপনি শুধুই মানবজাতিকে ভালবাসবেন? কেন ভালবাসবেন না বাঘকে. কুকুরদের আর অন্য সবরকম প্রাণীকে?
যাজক: যেহেতু, মানবজাতি আমার ভাইবোন।
শ্রীল প্রভুপাদ: কিন্তু বাঘেরা আর কুকুরেরাও তো আপনার ভাইবোন, যেহেতু আপনাদের সকলেরই এক পরম পিতা রয়েছেন–তিনি ভগবান। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদগীতায় (৫/১৮) বলেছেন– বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি। শুনি চৈব শ্বপাকে চ পন্ডিতাঃ সমদর্শিন ॥
যাজক: ওটার কি মানে?
শ্রীল প্রভুপাদ: “যথার্থ জ্ঞানবান পন্ডিত বিদ্যা-বিনয়সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, গাভী, হস্তী, কুকুর ও চন্ডাল সকলের প্রতি সমদর্শী হন।” প্রত্যেকটি জীবসত্তাকে তিনি সমান চোখে দেখেন। অন্যভাবে বলতে গেলে, তিনি আপনার সাথে একটা কুকুরের কোনও আধ্যাত্মিক প্রভেদ বিচার করেন না। আপনার এক আত্মা রয়েছে সেটি মানবদেহে ঢাকা, আর কুকুরদের এক আত্মা রয়েছে যেটি কুকুরের দেহে ঢাকা। তবে আপনাদের দুজনেই আত্মা ছাড়া আর কিছুই নন–ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছাড়া আর কিছুই নন।
যাজক: আপনি কী বলবেন যে, আত্মাগুলির সব বিভিন্ন ধরনের মূল্য মর্যাদা থাকে?
শ্রীল প্রভুপাদ: না, সমস্ত আত্মারই সমান মূল্যমর্যাদা।
যাজক: সেটা আমার পক্ষে স্বীকার করা কষ্ট, কারণ আমি এটা যেভাবে বুঝেছি, মানুষের আত্মা অমর, কিন্তু কোনও পশুর আত্মা তা নয়। কোনও পশুর “আত্মা” আসলে কোন আত্মাই নয়, তা হল জীবনের একটা নিয়মধারা মাত্র, একটা ব্যাপার যাকে অ্যারিস্টটল বলেছিলেন একটা ‘মন’ বা সাইকি।
শ্রীল প্রভুপাদ: না, অধ্যাত্মগত বিচারে চিন্ময় সত্তা রূপে তাদের মর্যাদা সমান, যদিও জড়জাগতিক বিচারে তাদের দেহগুলির বিভিন্ন ধরনের শ্রেনীবিভাগ হয়ে থাকতে পারে। এটা ঠিক যেন মোটর গাড়ির বিভিন্ন শ্রেণীবিভাগেরই মতো। একটা রোলস্্-রয়েস মোটর গাড়িতে বসে মানুষ ভাবে সে বুঝি ভারি মর্যাদাবান, আর একটা র্ফোড কিংবা সেভ্রলে গাড়ির মধ্যে বসে আর একজন লোক মনে করতে পারে, সে বুঝি কত দীনহীন। কিন্তু মানুষ হিসেবে তারা দুজনেই সমান। সেই রকমই, মানুষের দেহ আর কুকুরের দেহ ঠিক বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রেরই মতো, কিন্তু তাদের আত্মাগুলি একই গুণসম্পন্ন–তারা পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণেরই অবিচ্ছেদ্য অংশমাত্র।
যাজক: ওটা বুঝতে পারা কষ্টকর যে, আমার আত্মা এবং আপনার আত্মা পরমাত্মার অংশ–কারণ পরমাত্মা হলেন অনন্ত অসীম, আর আমরা হলাম সীমায়িত। অতএব আমাদের সকলকে একসাথে যোগ করলেই তৈরি করে ফেলতে পারি না।
শ্রীল প্রভুপাদ: না, আমি তা বলছি না। আমরা সীমাবদ্ধ গুণসম্পন্ন জীবাত্মা মাত্র, আর ভগবান হলেন অনন্ত গুণরাজির অধিকারী। যদি সমস্ত জীবাত্মাকে জড় করা হয়, তব তারা সীমাবদ্ধই থেকে যাবে, অসীম অনন্ত মর্যাদা পাবে না। নব্বই কোটি পরার্ধবার শূন্য সংখ্যাটিকে জড় করলেও তার সমষ্টিকে পূর্ণ এক যোগফল হয় না। তাই, আমি বলছি না যে, আমরা একসাথে সমষ্টিগত হলেই ভগবানের সমান হয়ে যাবে। তবে ভগবানের গুণবৈশিষ্ট্য সবই রয়েছে সমস্ত আত্মার মাঝে। ভগবান একটা সমুদ্রের মতো আর আমরা হলাম সমুদ্র জলের বিন্দুর সমান। মহাসমুদ্র্রেই মতো সমমর্যাদা সম্পন্ন রাসায়নিক গুণবৈশিষ্ট্যরাজি জলবিন্দুগুলিতে বিদ্যমান, তবে তা রয়েছে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিমাণে।
যাজক: তাহলে ভগবানের গুণবৈশিষ্ট্যাদির অনুকরণ আমাদের মধ্যে রয়েছে?
শ্রীল প্রভুপাদ: না, না, অনুকরণ নয়। আসলটাই। সমস্ত জীবাত্মারই রয়েছে ভগবানের আসল গুণবৈশিষ্ট্য। ঠিক যেমন একটা সোনার কণাতে স্বর্ণখনির সোনারই সমস্ত বৈশিষ্ট্য থাকে। সোনার একটা ছোট টুকরোও তো নিশ্চয়ই সোনা, তবে সোনার খনিতে যত সোনা আছে, সেই পরিমাণের সমান নয়। অতএব আমাদের দর্শনতত্ত্ব হল ‘অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্ব’, ভগবান এবং তাঁর শক্তিরাজির মধ্যে একই সঙ্গে যে একাত্মতা এবং বিভিন্নতা অচিন্তনীয়ভাবে বিদ্যমান, তারই দর্শন চিন্তা। অন্যভাবে বলতে গেলে, গুণগতভাবে আমরা ভগবানের সাথে একাত্ম, কিন্তু পরিমাণ বিচারে আমরা তাঁর থেকে ভিন্ন। ভগবানের সৃষ্টি ক্ষমতা আছে, আর আমাদেরও রয়েছে সৃজনী শক্তি। ভগবান সৃষ্টি করছেন মহাশূন্যে ভাসমান কোটি কোটি গ্রহনক্ষত্ররাজি, আর আমরা তৈরি করেছি আকাশে ভাসমান বিমান। তা সত্ত্বেও আমরা বেশি মর্যাদা চাই।
যাজক: সেটা অহঙ্কারের পাপে।
শ্রীল প্রভুপাদ: হ্যাঁ , সেটা হল বৃথা অহমিকা। আধুনিক বিজ্ঞানীরা তাদের সুকৃতির জন্য বৃথা অহমিকা পোষণ করছে আর বলছে ভগবানের দরকার নেই “ভগবান বলে কিছু নেই। আমরা সব কিছু করতে পারি।” এটা তাদের মূর্খতা।
মাসিক চৈতন্য সন্দেশ এপিল ২০১০ সাল