এই পোস্টটি 9 বার দেখা হয়েছে

ভক্তিবিকাশ স্বামীর সাথে দূর্গম তীর্থ ভ্রমণ
এবারের স্থান : নৈমিষারণ্য
দ্বাপর যুগের শেষের দিকে এবং কলির প্রারম্ভে আশি হাজার ঋষি সৌনক ঋষিকে সাথে নিয়ে একটি যজ্ঞ সম্পাদন করতে চেয়েছিলেন আসন্ন কলিযুগের প্রভাব থেকে সকল জীবদেরকে মুক্ত করার জন্য। এজন্যে তারা ব্রহ্মার কাছে গিয়েছিলেন সাহায্যের জন্য। ব্রহ্মাজী এই ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে উর্ধ্বলোক বসবাস করেন। তারা তখন ব্রহ্মাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় আমরা একটি যজ্ঞ সম্পাদন করতে পারি, যার মাধ্যমে কলির প্রভাব থেকে জীবদের মুক্ত রাখা যাবে?” ঠিক কোন্ স্থানে যজ্ঞ সম্পাদন করলে এটি যথাযথ হবে?” ব্রহ্মা তখন তাদের বললেন, “আমি একটি চক্র পাঠাচ্ছি। আপনারা সেটিকে অনুসরণ করুন এবং এক পর্যায়ে চক্রটি পৃথিবীর যে স্থানে আঘাত হানবে ঠিক সেই স্থানে আপনাদের যজ্ঞ সম্পাদন করতে পারবেন।”——————— তখন ব্রহ্মার পাঠানো সেই চক্রটি ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর নৈমিষারণ্য নামক বনের মধ্যবর্তী চক্রতীর্থ নামক স্থানে আঘাত হানে। কথিত আছে, চক্রটি তখন পৃথিবী ভেদ করে একসময় এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তলদেশে অবস্থিত গর্ভোদক মহাসাগরের দিকে ধাবমান হয়। যখন চক্রটি গ্রহলোকের ৭টির মধ্যে ৬টি গ্রহলোককে ভেদ করে তখন ঋষিগণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যে, যদি এটি মহাসাগরের জলের মধ্যে আঘাত করে তবে তার ফলে পৃথিবী জলে নিমজ্জিত হবে। তাই এই জড়াশক্তির নিয়ন্তা দেবী দুর্গার কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন যাতে তিনি চক্রটিকে আর অধিক অগ্রসর হওয়া থেকে প্রতিহত করেন। এই ইতিহাসটি ব্যাখ্যা করে যে, কেন চক্রতীর্থে অবস্থিত একটি জলাধার তলবিহীন? নৈমিষারণ্যে অবস্থিত এই জলাধারটি এখনও সবার কাছে বিস্ময়। কিভাবে এটি তলবিহীন হতে পারে? শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীমদ্ভাগবতের নৈমিষারণ্য সম্পর্কে বর্ণনা করেন: “বায়বীয় তন্ত্রে উল্লেখ রয়েছে যে, এই ব্রহ্মাণ্ডের কারিগর ব্রহ্মা একটি বিশাল চাকার কথা চিন্তা করেছিলেন, যা এই ব্রহ্মাণ্ডকে পরিবেষ্টন করে থাকবে। সেই বিশাল চক্রের কেন্দ্রটি নৈমিষারণ্য নামক একটি বিশেষ স্থানে রয়েছে। তেমনই, বরাহ পুরাণেও নৈমিষারণ্য সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে, সেখানে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এই স্থানে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার ফলে আসুরিক মনোভাবসম্পন্ন মানুষদের শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। ব্রাহ্মণেরা এই ধরনের যজ্ঞ অনুষ্ঠানের জন্য নৈমিষারণ্যকে পছন্দ করেন।” পরমেশ্বর ভগবান রামচন্দ্র বনবাস থেকে অযোধ্যায় ফিরে এসে এই স্থানে এক যজ্ঞ সম্পাদন করেছিলেন। ঋষিগণ তাকে বলেছিলেন, “রাবন, জন্মগতভাবে একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন, তাই তাকে হত্যা করার দরুন আপনার একটি যজ্ঞ সম্পাদন করা উচিত। যেহেতু এতে আপনার পাপ হয়েছে, অতএব অনুগ্রহপূর্বক একটি যজ্ঞ সম্পাদন করুন।” যদিও ভগবান রামচন্দ্রকে কখনো কোন পাপ স্পর্শ করতে পারে না কিন্তু তবুও ঋষিগণকে সন্তুষ্ট করার জন্য তিনি নৈমিষারণ্যে একটি বিশাল যজ্ঞ সম্পাদন করেছিলেন। নৈমিষারণ্য বিষয়ক আরেকটি ইতিহাস রয়েছে যে, রাবন যখন রাম এবং লক্ষণকে বন্ধী করে পাতাললোকে রেখেছিলেন, তখন হনুমান তাদেরকে উদ্ধার করেছিলেন। তিনি তাদেরকে তার কাঁধে নিয়ে নিম্নলোক পাতাললোক থেকে উর্ধ্বে গমন করে পৃথিবীর নৈমিষারণ্য নামক এ স্থানে ফিরে আসেন। তাই নৈমিষারণ্যের একটি স্থানে হনুমানসহ তার দুই কাঁধের উপর রাম এবং লক্ষণের একটি বড় বিগ্রহ রয়েছে। তীর্থযাত্রীরা এই স্থান থেকে লাড্ডু কিনে তা হনুমানের মুখে রাখেন। যখন আমরা নৈমিষারণ্যে পৌঁছি তখন ছিল রাত। অনেক স্টেশন ঘুরে যখন বাস থেকে এখানে নামি তখন সেখানে অনেক লোকের সমাগম দেখতে পাই। কেননা তখন সেখানে একটি উৎসব চলছিল। সেসময় পূর্ণিমার মত বিশেষ তিথিতে নৈমিষারণ্যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। উত্তর প্রদেশ থেকে অনেক তীর্থযাত্রী এ পবিত্র স্থান পরিদর্শনে আসে। আমরা এরপর গৌড়িয় মঠে অবস্থান করি। মন্দিরটি স্থাপন করেন শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর। তিনি সাধারণত শহরে মন্দিরে স্থাপন করেন কিন্তু তিনি কিছু মন্দির স্থাপন করেছিলেন সেসব স্থানে যেখানে তেমন লোক সমাগম হয়না অথচ খুবই পবিত্র স্থান। আমরা সেই স্থান পরিদর্শন করেছিলাম যেখানে পাঁচ হাজার বছর আগে সূত গোস্বামী শ্রীমদ্ভাগবত বলেছিলেন। সূত গোস্বামী শ্রীমদ্ভাগবত শুনেছিলেন শুকদেব গোস্বামীর কাছ থেকে যিনি রাজা পরীক্ষিতকে তার মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তাকে বর্ণনা করেছিলেন। শুকদেব এটি শ্রবণ করেছিলেন তার পিতা ব্যাসদেবের কাছ থেকে। ব্যাস পরবর্তীতে তা ভাগবত আকারে লিপিবদ্ধ করেন। সূত গোস্বামী যেখানে তা বর্ণনা করেছিলেন তা একটি ছোট পাহাড়ের উপর। যেটি এখনও খুবই মনোরম একটি স্থান। চারদিকে সবুজ বৃক্ষরাজি। আমরা তখন এ স্থানে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেছিলাম হাজার হাজার মহান ও অত্যন্ত তেজস্বী মুনি ঋষিরা এস্থানে একসময় জড়ো হয়েছিল অমল পুরান শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণের উদ্দেশ্যে। আমি উপলব্ধি করছিলাম শ্রীল প্রভুপাদও যেখানে যেখানে শ্রীমদ্ভাগবত বর্ণনা করেছিলেন সেই স্থানও নৈমিষারণ্যের মত পবিত্র হয়েছিল। কেননা শ্রীল প্রভুপাদ সূত গোস্বামী পরম্পরার একজন। এই স্থান এতটাই মাহাত্ম্যপূর্ণ যে, অনেক মহান ঋষি এবং ভগবানের অবতারেরাও পরিদর্শন করেছিলেন। যাদের মধ্যে রয়েছে বলরাম, দধিচি মুনি, পাণ্ডবরা, নিত্যানন্দ প্রভু এবং রামানুজাচার্য্য। বলা হয় যে, শুধুমাত্র নৈমিষারণ্য পরিদর্শন করলে আর অন্য কোন পবিত্র স্থান ‘পরিদর্শনের প্রয়োজন পড়ে না। কেননা এখানে সবকিছুই পরিপূর্ণ।এখানে অনেক পুরাতন বৃক্ষ রয়েছে। ব্যাসদেব যে স্থানে বৈদিক শাস্ত্রসমূহ লিপিবদ্ধ করেছিলেন সেই স্থানে প্রায় পাঁচ হাজার বছরেরও প্রাচীন একটি বটবৃক্ষ রয়েছে। আমরা উপলব্ধি করতে পারি এসব বৃক্ষরা সাধারণ কোন বৃক্ষ নয় বরং মহান মহান ঋষিগণ যারা এখানে এই পবিত্র স্থানে অবস্থান করে সর্বদা ভগবান কৃষ্ণের অতীত অপ্রাকৃত লীলাবিলাসের ধ্যানে মগ্ন। হরে কৃষ্ণ।
বিঃ দ্রঃ ভারতের অবস্থিত এরকম গুরুত্বপূর্ন তীর্থস্থান ভ্রমণের সুযোগ করে দিচ্ছে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন)। তাই আপনিও যদি এসব দুর্গম এবং পবিত্র তীর্থস্থানসমূহ ভ্রমণের অভিলাষী হোন তবে বাংলাদেশে যেকোন ইস্কন মন্দিরে যোগাযোগ করতে পারেন। এতে করে শুধুই ভ্রমণ নয়, সঙ্গে এসব তীর্থস্থানসমূহের দিব্য লীলাবিলাসের কাহিনীসমূহও আপনি যথাযথ শ্রবণের সুযোগ লাভ করবেন।
হরে কৃষ্ণ।
মাসিক চৈতন্য সন্দেশ ,ফেব্রুয়ারী ২০১১ইং