এই পোস্টটি 378 বার দেখা হয়েছে
বৈদিক শাস্ত্রের একটি অংশ হল স্মৃতি শাস্ত্র এই স্মৃতি শাস্ত্রের একটি অংশ হল শাস্ত্র ন্যায় (যুক্তি) শাস্ত্র, বৈশেষিক (পদার্থ বিজ্ঞান) শাস্ত্র, যোগ (অধিবিদ্যা) শাস্ত্র এবং সাংখ্য (দর্শন) শাস্ত্র, ন্যায় ও বৈশেষিক শাস্ত্রকে দু’বোন বলে ডাকা হয়। এই ন্যায় বৈশেষিক শাস্ত্রে প্রায় ৩৭৩টি সূত্র রয়েছে এবং ১২টি অধ্যায় রয়েছে। এই ন্যায় ও বৈশেষিক শাস্ত্রে পদার্থবিদ্যা সহ এ পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনা রয়েছে। প্রচলিত পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহৃত বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের প্রদত্ত সূত্র যেমন-বেগ, বল, ভরবেগ, কঠিন (Solid), স্থিতিস্থাপকতা (elasticity) শব্দ (Sound), আলোক বিজ্ঞান (Optics), শক্তি (Power), কাজ (Work) সহ বিবিধ বিষয় এসব শাস্ত্রে সুস্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যা নিঃসন্দেহে বৈদিক শাস্ত্রের অভ্রান্ততা প্রকাশ করে। শ্রীমদ্ভাগবতম্ থেকেও আমরা মহাবিশ্বের বিভিন্ন গ্রহসমূহের দূরত্ব ও সূর্য চন্দ্ৰসহ পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন রহস্য জানতে পারি যা বৈদিক পদার্থ বিজ্ঞানের মত এক আশ্চর্যময় বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা দেয়। তাই আমাদের এবারকার সংখ্যায় সেসব আশ্চর্যময় বিষয়সমূহই পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হল। প্রথমতঃ পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে অতি পরিচিত কিছু সংজ্ঞা যা বৈদিক শাস্ত্রে হাজার হাজার বছরও পূর্বে লিপিবদ্ধ ছিল তা তুলে ধরা হল ।
[নিচে প্রদত্ত বৈদিক শাস্ত্রের উদ্ধৃতগুলো ‘বৈশেষিক’ শাস্ত্র থেকে গৃহীত ।]
বৈশেষিক সূত্রঃ
১) বলঃ বল হল সেটাই যাহা বস্তুকে স্থানচ্যুত ঘটাতে পারে বা নড়াচড়া করাতে সক্ষম (বৈ. সৃ. ১.১.২০)। বলের অনুপস্থিতে কোন বস্তু কণার কোন পরিবর্তন সাধিত হয় না (বৈ. সু ১.১.৬)
আধুনিকঃ বল হল সেই বাহ্যিক কারণ যাহা কোন একটি বস্তুর স্থির বা গতিশীল অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় বা ঘটাতে চায় ।
২) নিউটনের গতির ৩য় সূত্রঃ প্রত্যেক ক্রিয়া বল বাধাপ্রাপ্ত হয় একটি সমপরিমাণ বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া বলের মাধ্যমে (বৈ.সূত্র ৫.১.১৬-১৮)
আধুনিকঃ ক্রিয়াজনিত বলের ঘাত- প্রতিক্রিয়াজনিত বলের ঘাত। অর্থাৎ-প্রত্যেক ক্রিয়াজনিত বলেরই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া বল আছে ।
৩) বেগঃ ১. বেগ হল ক্রিয়াজনিত বলের একটি বিশেষ কারণ।
২. বেগ বাধাপ্রাপ্ত হয় একটি সমপরিমাণ ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া বলের দ্বারা।
৩. বেগ ক্রিয়ার বলের সমানুপাতিক এবং একটি নির্দিষ্ট দিক বরাবর ক্রিয়াশীল ।
আধুনিক : বেগ : কোন মুহুর্তকে ঘিরে অতি ক্ষুদ্র সময় ব্যবধানে সময়ের সাথে বস্তুর সরনের হারকে ঐ মুহুর্তের বেগ বলে ।
এ স্বল্প পরিসরে আরও অনেক পদার্থগত ধর্ম যেমন সলিড, স্থিতিস্থাপকতা, বায়ুসহ বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে না কিন্তু বৈশেষিক শাস্ত্রে এ সম্পর্কিত ধারণা দেয়া আছে। নিউটনের বেগ সম্পর্কিত ৩টি সূত্রের ব্যাখ্যাও এ বৈশেষিক শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
এই বৈশেষিক কাণ্ড রচনা করেছিলেন কাণ্ড ঋষি। তাই কাণ্ড ঋষির সূত্রসমূহ থেকে নিউটনের গতি সম্পর্কিত ২য় সূত্রের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
নিউটনের ২য় সূত্রঃ কোন একটি বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক এবং বল যে দিকে প্রযুক্ত হয় ভরবেগের পরিবর্তনও সেইদিকে ঘটে।
কাণ্ড এর সূত্র (নিউটনের ২য় সূত্রের ব্যাখ্যা): ১) প্রযুক্ত কর্মের বৃদ্ধিই (গতি) হল বলের মূল কারণ অন্যভাবে বললে বলা যায় গতিতে বৃদ্ধি বা হ্রাসই হল বলের মূল কারণ।
২) এই নীতি হল বলের পরিমাপ সম্বন্ধীয় নীতি। এই নীতি অনুসারে যত দীর্ঘসময় পর্যন্ত বলবিদ্যাগত বল কাজ করে তখন গতিরও পরিবর্তন ঘটে অর্থাৎ এটাই হল ভরবেগ বা মোমেন্টাম (Momentum)
গাণিতিকভাবে এর ব্যাখ্যা দেয়া যায় যা অনেকটা নিউটনের গতির ২য় সূত্রের সাথে সম্পর্ক।
ভরবেগের পরিবর্তনের হার অর্থাৎ একক সময়ে প্রযুক্ত কর্মের বৃদ্ধি তার ক্রিয়ার বলের সমানুপাতিক। এই পরিবর্তন বলের দিকের সাথে সাধিত হয়।
মনে করুন, কোন বস্তুর ভর ‘m’ এবং মধ্যবর্তী সময় ‘t’, বস্তুর বেগ পরিবর্তিত হয়ে ‘u’ হতে ‘v’ তে পৌঁছায় কেননা তার উপর বলের ক্রিয়া ঘটে । তখন প্রাথমিক ভরবেগ = mu
শেষ ভরবেগ = mv ভরবেগের পরিবর্তনের হার =
m(v–u) অতএব, এই ভরবেগের পরিবর্তনের হার =
m(v-u)t = ma
[কাণ্ড এর প্রথম সূত্র হতে] কাণ্ড এর ২য় সূত্র হতে পাই, বল ভরবেগের পরিবর্তনের হারের]
সমানুপাতিক
অথবা, p k ma P
অথবা, p = kma [যেখানে k একটি ধ্রুবক
যদি m = 1 এবং a = 1 তখন
I =k*1*1* অথবা k = 1
অথবা, p = ma
অতএব, একক বল, যা একক ভরের একটি বস্তুর উপর একক ত্বরণ সৃষ্টি করে। বৈশেষিক শাস্ত্রেও একইভাবে লিপিবদ্ধ আছে যে, বল হল কর্মের একটি ফল এবং এটি একটি পদার্থগত পরিমাণ নয়। বৈদিক শাস্ত্রের এ সূত্রসমূহ নিউটনের সূত্র থেকে অধিকতর উচ্চতর। নিউটনের সূত্র এটিকে পরিমাপ করে একটি পদার্থগত পরিমাণ হিসেবে যা অনেকটা অসঙ্গতিপূর্ণ।
চোখের রং ও চোখের রশ্মিঃ কোনটি কোন রং বাছাই করার ক্ষমতা সম্পর্কেও বৈশেষিক শাস্ত্রসমূহ বিভিন্ন বৈদিক শাস্ত্রে স্পস্টতঃ বৈষয়িক শাস্ত্রে বর্ণিত আছে। বৈশেষিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে “প্রকৃত মানব চক্ষু যা তৈরি করা হয়েছে অদৃশ্য তেজকণা দ্বারা” আধুনিক বিজ্ঞানে যাকে বলা হয় চোখের রঞ্জক পদার্থ ।
আমরা সবাই জানি যে, আমাদের চোখ দৃশ্যমান আলোর সমস্ত রং সম্পর্কে অবগত। এর জন্য দায়ী হল তড়িৎচুম্বকীয় বর্ণালী এবং আমাদের শরীরে ৭টি প্রধান এনার্জি ভটিক্স যেটি আমাদের মাথার উপরের দিকে কন্টকে অবস্থিত। এগুলোর ক্ষমতা রাখে লাল, নীল, কমলা, হলুদ, সবুজ, বেগুনী এবং আসমানী ইত্যাদি রঙ চেনার। প্রকৃতপক্ষে এই শিক্ষাটি ভগবান শ্রী রামচন্দ্রের আচার্য্য গুরুকুলে পেয়েছিলেন যা রামায়ণে বর্ণিত আছে। ঋগবেদেও এ বিষয়ে বর্ণিত রয়েছে, “সাতটি ঘোড়া সূর্যের রথকে টানে আর এ ঘোড়াগুলো সর্প দ্বারা বাঁধা হয়েছে’ (ঋগ বেদ ৫.৪৫.৯) এ পদ্যশ্লোকে ঘোড়াগুলো ৭টি আলোক রশ্মির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এ সাতটি রং এর বর্ণনা অথর্ব বেদেও বর্ণিত আছে যে, “সপ্ত সূর্যস্য রাসমহ্য” “সূর্যের সাতটি রশি রয়েছে’।
গ্রহ নক্ষত্রসমূহ ধারণাঃ সূর্যঃ ‘চন্দ্রমা অকগভস্তিব্য উপরিস্টাল্লক্ষয়োজনত” (ভাঃ ৫.২২.৮) সূর্য কিরনের ১,০০,০০০ যোজন (৮,০০,০০০ মাইল) উর্ধ্বে রয়েছেন চন্দ্র ।
নক্ষত্রসমূহ : তত উপরিষ্টদ্বিলক্ষ যোজনতো নক্ষত্রানি (ভা: ৫.২২.১১) “চন্দ্র মণ্ডলের ২,০০,০০০ যোজন (১৬,০০,০০০ মাইল) উপরে অনেকগুলো নক্ষত্র রয়েছে” অর্থাৎ যেগুলো পৃথিবী থেকে ৪০,০০,০০০ মাইল উর্ধ্বে
শুক্রগ্রহের অবস্থানঃ “তত উপরিস্টাদুশনা দ্বিলক্ষযোজনত” (ভাঃ৫.২২.১২) সেই নক্ষত্রমণ্ডলের ২,০০,০০০ যোজন ঊর্ধ্বে শুক্রগ্রহ বর্তমান।
বুধগ্রহের অবস্থানঃ “উশনসা বুধো ব্যাখ্যাতস্তত উপরিষ্টাদ্ দ্বিলক্ষযোজনতো বুধঃ সোমসুত” (ভা:৫.২২.১৩)
“শুক্রগ্রহের ১৬,০০,০০০ মাইল উর্ধ্বে অর্থাৎ ভূতল থেকে ৭২,০০,০০০ মাইল ঊর্ধ্বে চন্দ্ৰ তনয বুধ বিরাজ করেন।”
মঙ্গল গ্রহের অবস্থানঃ “অত উর্ধ্বমঙ্গারকোহপি যোজনলক্ষদ্বিতয় উপলভ্যমান স্ত্রিভিস্ত্রিভিঃ” (ভা.৫.২২.১৪)
“বুধের ১৬,০০,০০০ মাইল উর্ধ্বে অর্থাৎ ভূতল থেকে ৮৮,০০,০০০ মাইল উর্ধ্বে মঙ্গলগ্রহ অবস্থিত”
বৃহস্পতি গ্রহের অবস্থানঃ ৩৩ উপরিষ্টাদ্ দ্বিলস্বাযোজনান্তরগতা ভগবান বৃহস্পতিরেকৈস্মিন (ভা:৫.২২.১৫) “মঙ্গল গ্রহের ১৬,০০,০০০ মাইল ঊর্ধ্বে অর্থাৎ পৃথিবীর ১,০৪,০০,০০০ মাইল উর্ধ্বে বৃহস্পতি অবস্থিত”
শনি গ্রহের অবস্থানঃ “তত উপরিস্টাব্দ যোজনলক্ষদ্বয়াৎ প্রতীয়মানঃ শনৈশ্চর” (ভা.৫.২২.১৬) “বৃহস্পতির ১৬,০০,০০০ মাইল ঊর্ধ্বে অর্থাৎ পৃথিবী থেকে ১,২০,০০,০০০ মাইল উর্ধ্বে শনিগ্রহ অবস্থিত” বৈদিক পদার্থবিজ্ঞানের এই বিশাল ভাণ্ডারে বিশ্বে সমসাময়িক আলোচিত বিগ-ব্যাঙ থিউরীর জটিল ধারা সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়াও বৈদিক শাস্ত্রে চন্দ্রের গতিবিধিসহ নক্ষত্রের গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা, মাধ্যাকর্ষন বলের ধারণাসহ আরো রহস্যময় তথ্য খুব সুন্দরভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে। ভগবদ্গীতায় এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। গত দু’সংখ্যায় বৈদিক পদার্থ বিজ্ঞানের যে বিশাল জগৎ রয়েছে তার খানিকটা অংশ যেটুকু তুলে ধরা হয়েছে তা থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, বৈদিক শাস্ত্র থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান অভ্রান্ত এবং পূর্ণ। পরিশেষে এটিও বলা যায় যে, বৈদিক শাস্ত্র থেকে প্রাপ্ত বিজ্ঞানই হল পরম বিজ্ঞান, আর তার একটি জগত হল অভ্রান্ত এই বৈদিক পদার্থ বিজ্ঞান। হরে কৃষ্ণ।