এই পোস্টটি 26 বার দেখা হয়েছে

পরিবার ও রকমারি সমস্যা
প্রত্যেক পিতা-মাতাই চায় তাদের সন্তান হোক সুশৃঙ্খল। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেন সন্তানরা হয়ে উঠে মা-বাবার অবাধ্য। এ বিষয়ে এবারও পরামর্শ দিচ্ছেন অরুদ্ধা-দেবী দাসী।
[অরুদ্ধা দেবী দাসীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : শ্রীমৎ গোপাল কৃষ্ণ গোস্বামী মহারাজের একজন শিষ্যা তিনি ইউ.এস.এ-তে বসবাস করেন। এবং সেখানে শিশু বিষয়ক বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। ইউ.এস.এ-তে শিশুদের জন্য তার দুটি স্কুল রয়েছে। তার বড় ছেলে রাধিকা রমন দা (ডা. রবি গুপ্ত) অক্সফোর্ড থেকে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৩ বছর বয়সে বইস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন যেখান থেকে তিনি দর্শন এবং গণিতের উপর দ্বৈত বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন। তার দ্বিতীয় ছেলে গোপাল হরি দাস (গোপাল গুপ্ত) সম্প্রতি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে বিজ্ঞান এবং ধর্ম বিষয়ে পি.এইচ.ডির জন্য কাজ করছেন। তিনি ১২ বছর বয়সে বইস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। যেখানে তিনি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এম, টেক এবং একটি ব্যাচেলর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।।
অনেক মা-বাবা আমাকে প্রশ্ন করে, “কিভাবে আপনি আপনার ছেলেমেয়েদের শৃঙ্খলার মধ্যে রাখেন? আসলে এ বিষয়ে ভালোবাসা ছিল শ্রীল প্রভুপাদের শৃঙ্খলা বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ ফর্মুলা। তিনি বলেছিলেন যে, আমরা যদি ছেলেমেয়েদেরকে ভালবাসার মাধ্যমে বা আদর করে কোন কিছু মেনে চলাতে অভ্যন্ত
করতে পারি তবে তা হবে জোড় করা বা শাস্তি দিয়ে শেখানোর চেয়ে অধিকতর উত্তম। যদি ভালোবাসা এবং বিশ্বাস এ দুটোই মা-বাবা এবং সন্তান পরস্পরের মধ্যে বিরাজ করে তখন আপনা আপনিই ছেলেমেয়েরা অনুগত হয়ে উঠবে। কেননা তখন তারা চাইবে তাদের মা-বাবাকে খুশি করতে। এক্ষেত্রে অবশ্যই এই ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত কৃষ্ণ। যখন আমরা গৃহে পরিবারের সবাইকে নিয়ে কৃষ্ণসেবা করি তখন পরিবারের মধ্যে একটি পারমার্থিক বন্ধন প্রতিষ্ঠিত হয়। যেটি জড়জাগতিক তথাকথিত বন্ধন থেকে অধিক শক্তিশালী। শ্রীল প্রভুপাদ একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “. যদি আমরা ছোট ছেলেমেয়েদেরকে কৃষ্ণের প্রতি ভালোবাসার প্রবণতার উন্নয়ন ঘটাতে পারি কিংবা তাদেরকে উৎসাহিত করতে পারি তখন আমরা তাদেরকে উচ্চতর আদর্শে শিক্ষিত করে তুলতে সফল হব। তখন তাদেরকে যাই
করতে বলা হবে তারা তা করার জন্য সর্বদাই হাসিমুখে সম্মত হবে।” (চিঠি, ১৯৭২)
যখন আমরা সন্তানদের কৃষ্ণকেন্দ্রিকভাবে বেড়ে উঠতে দিই তখন তারা চরিত্রগতভাবে সাধুদের মত মহান হয়। জড় জগতের অন্যান্য লোকদের চেয়ে অধিকতর উচ্চ মানসিক সম্পন্ন হয়ে বেড়ে উঠে। শ্রীমদ্ভাগবতে উল্লেখিত মহান মহান চরিত্র তাদের আদর্শ হয়ে উঠে। যেমন-যদি কেউ কোন সন্ত্রাসী, বখাটের সঙ্গ করে তখন সেও অনুরূপ হয়, কিংবা যদি কেউ কোন ব্যবসায়ীর সঙ্গ করে তখন সেও একজন ব্যবসায়ী হতে চেষ্টা করে। তদ্রুপ যদি কেউ মহান গুণাবলীর অধিকারী ভগবানের ভক্তদের সঙ্গ করে তখন সেও সাধুদের মত মহান হয়।
উল্লেখ্য, শিশুরা তাদের পিতা-মাতা কি করছে না করছে এসব বিষয় খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে। তাই যদি পিতা-মাতারা শৃঙ্খল হয় তবে ছেলেমেয়েরাও অনুরূপ হবে। আমাদের কোন শিক্ষা শুধুমাত্র বলে শেখানোই উচিত নয় বরঞ্চ তা দৃষ্টান্ত দিয়ে বাস্তবিক আচার-আচরণের মাধ্যমে শেখাতে হবে। যখন পিতা-মাতা ও সন্তানের মধ্যে ভালোবাসা ও বিশ্বাস থাকে তখন সেখানে আনুগত্য থাকবে। তখন শিশু চাইবে তার পিতা-মাতাকে খুশি করতে এবং তখন শৃঙ্খলাও খুব সহজ হয়ে উঠে।
শিশুদের ক্ষেত্রে এটি খুবই স্বাভাবিক যে তারা তাদের মা-বাবাকে খুশি করতে চায়। এক্ষেত্রে যদি তাদেরকে ভালোবাসা দেয়া হয় তখন তারাও চেষ্টা করে মা-বাবাকে খুশি করতে। পিতা-মাতারা যা এজন্যে তাদেক সন্তানদেরকে আরো উৎসাহিত করবে। সন্তানদের তখন তাদের ভালো কাজের পুরস্কার স্বরূপ প্রীতিসহকারে সু-স্বাধু প্রসাদ দিতে পারেন এবং তাদের সকল কাজে সেটা গৃহে কৃষ্ণভাবনার কার্যকলাপেও সাহায্য করার মাধ্যমে একত্রে কাজ করা যায়। সন্তান ও পিতা-মাতা মিলে একসাথে বিগ্রহ সেবা ও জপ করা যায় ইত্যাদি খানের পকে মাবাবার উপর না। কিন্তু তাদের ভালো কাজের প্রতিদান স্বরূপ জাগতিক কোন কিছু যেমন-খেলনা পিস্তল, যুদ্ধবিমান, কুকুর, বিড়াল, স্পাইডারম্যান, টাকা-পয়সা ইত্যাদি জাগতিক বস্তু পুরস্কৃত করা হয় তখন তারা স্বাভাবিকভাবেই জাগতিক জিনিসের প্রতি আসক্ত হয়। তাতে সন্তানের মানসিকতারই ক্ষতি হয়। পক্ষান্তরে কৃষ্ণভাবনামৃত পুরস্কার তাদের জন্য খুবই আনন্দদায়ক হয় এবং তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করাও সহজ হয়। বর্তমানে মা-বাবারা তাদের সন্তানদেরকে ভগবদ্গীতা পড়তে না দিয়ে, মন্দিরে যেতে না দিয়ে কিংবা পারমার্থিক কার্যকলাপে যুক্ত হতে না দিয়ে পক্ষান্তরে তাদেরকে জাগতিক সুযোগ-সুবিধাই দিয়ে থাকে। এভাবে সন্তান তখন ইন্দ্রিয়তৃপ্তি করতে শেখে এবং তার ফলে তারা যদি অবাধ্য হয় কিংবা বড়দের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করে তবে তাতে অবাক হওয়ার কারণ নেই বরং তা স্বাভাবিকই।
সন্তানের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসার নিদর্শন হল তাদেরকে কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে গড়ে উঠতে দেয়া। সন্তানদেরকে জড় বিষয়ের বাসনার স্রোতে ভাসতে দিলে তাদের থেকে আমরা কখনোই ভালো আচরণ আশা করতে পারি না। অপরপক্ষে যখন মা-বাবারা তাদের সন্তানদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে শিশুকালে কোন অতিরিক্ত শাস্তিমূলক ভয় ইত্যাদি প্রদর্শন করে তখন তারা কিন্তু জীবনের এক পর্যায়ে গিয়ে বিদ্রোহী বা অবাধ্য হয়ে যায়। কিন্তু মা-বাবারা যদি তাদেরকে ভালোবাসা, ভাল প্রশিক্ষণ এবং নিজেদের আচরণের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তখন সন্তানরা তাদের দেখেই শৃঙ্খল হয়ে উঠে, কোন কিছু শেখার আগ্রহী হয়ে উঠে এবং সুখী হয়। প্রভুপাদ বলতেন যে, এজন্যে শিক্ষকরা ভীতি ও ভালোবাসা দুটোর সম্মিলিত সহায়তা নিতে পারে।
প্রভুপাদ কখনো চাইতেন না যে শিক্ষকরা ছেলেমেয়েদেরকে কোন কিছু শেখানোর জন্য ভয়ংকর কোন শাস্তি বা জোড় প্রয়োগ করবেন। বরঞ্চ অনুগত হওয়া শেখানোর জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণই যথেষ্ট। প্রভুপাদ বলতেন, “শুধুমাত্র তাদেরকে কৃষ্ণভাবনাময় কার্যকলাপে নিয়োজিত করতে হবে যাতে করে তারা সর্বক্ষণ যেকোনভাবেই হোক কৃষ্ণকে স্মরণ করতে পারে। এটি কোন যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়।” (চিঠি-১৮ নভে ১৯৭২)
আরেকটি কথোপকথনে শ্রীল প্রভুপাদ বলেন, “মাবে। মাঝে কঠোরতারও প্রয়োজন রয়েছে। যদি তারা কোন বিষয়ে অনুগত না হয় তখন তাদেরকে ভৎসনা করার প্রয়োজন পড়ে।”
শিশুদের একটি স্বাভাবিক বৃত্তি হল তারা খেলতে চায়। সবসময় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করাও ঠিক নয়। খেলাধুলার সময় আমরা তাদেরকে কৃষ্ণভাবনার সঙ্গে সম্পর্কিত এমন খেলাধুলায় ব্যস্ত রাখতে পারি। এতে তখন তাদের মানসিক চেতনার উন্নয়ন ঘটে।
অনেক সময় বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও শিশু একই খারাপ কার্যকলাপ বার বার করে। যখন এটি হয় তখন তাদের উপর আমরা অনেক নির্যাতন চালাই, শাস্তি দিই। এটি মোটেই ঠিক নয়। ড. গীতায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে যদি জীবকে উচ্চতর স্বাদ দেয়া হয় তখন নিম্নতর স্বাদ আপনি আপনি চলে যায়। তাই এক্ষেত্রে শাসন প্রয়োগ না করে, উচ্চতর স্বাদ কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত করলে তাদের খারাপ মনোভাব/আচরণ ধীরে ধীরে চলে যাবে।
ব্যক্তিগতভাবে আমার ছেলেমেয়েদের কখনোই শাস্তি দিইনি শুধুমাত্র বকা-ঝকা বা কথার মাধ্যমে তাদের দুষ্টুমি বা খারাপ কার্যকলাপ সংশোধন করতাম। আমি তাদের জন্য যথাযথ কৌশল প্রয়োগ করতাম। এর মাধ্যমে তারা উপলব্ধি করত যে, যদি তারা খারাপ আচরণ/কার্যকলাপ করে তবে কৃষ্ণ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হবেন।
শ্রীল প্রভুপাদ শিশুদেরকে প্রসাদ না দেয়ার মাধ্যমে সময়ে সময়ে তাদের অপরাধের শান্তি দিতেন। তিনি কখনো শারীরিক শাস্তি বা মারধর করার মাধ্যমে জোড় করার বিরুদ্ধে ছিলেন। এ কৌশলটি বৈদিক মতাদর্শেরও বিরুদ্ধে। যার মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের উল্টো খারাপ কিছু করার প্রবণতা থাকে এবং কৃষ্ণভাবনাময় থেকে দূরে সরে আসার আশংকা থাকে।
শ্রীল প্রভুপাদ বলেছিলেন, শিশুদেরকে প্রশিক্ষিত করা উচিত কৃষ্ণভাবনাময় তপস্যার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে খুব ভোরে মঙ্গলারতি করার মত তপস্যা করাই যথেষ্ট। তাছাড়া নৃত্য- কীর্তন করা, সুস্বাধু প্রসাদ আস্বাদন করাটা তারা খুব উপভোগ করবে।
এমনভাবে শিশুদের জন্য পরিবেশ গড়ে তোলা প্রয়োজন যাতে করে আসলেই তারা যথার্থ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। তার জন্য কৃষ্ণভাবনাময় পরিবেশ হল সর্বোচ্চ পন্থা।
হরে কৃষ্ণ।
মাসিক চৈতন্য সন্দেশ , ফেব্রুয়ারী – ২০১১ ইং