এই পোস্টটি 238 বার দেখা হয়েছে
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের জনসংখ্যা সম্বন্ধে সমীক্ষা করতে গিয়ে ম্যালথাস এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতবর্ষের পর্যালোচনা করেছেন। আদর্শের বিচারে ভারতবর্ষে ইন্দ্রিয় সংযমের নীতি অনুমোদন করা হয়েছে এবং এ বিষয়ে মানব প্রজন্মের আদি পুরুষ মনু তাঁর সংকলিত মনুসংহিতায় নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ লিপিবদ্ধ করেছেন। ম্যালথাস উল্লেখ করেছেন, “মনু কর্তৃক প্রদত্ত বিধি-নিষেধের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সবরকমের ইন্দ্রিয় তর্পণাদি কঠোরভাবে পরিহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং সততাকে ধর্মীয় আচার- নিষ্ঠার অঙ্গরূপে গ্রহণ করার জন্য গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।” শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, “বৈদিক সাহিত্যে গর্ভনিরোধক প্রণালী অবলম্বনের কোন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। দাম্পত্যজীবনে গর্ভনিরোধক প্রণালীকে সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে চলতে হবে। সৌভাগ্যবশত কেউ যদি সৎ এবং বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন ভাল সহধর্মিণী লাভ করতে পারেন, তা হলে তিনি তাঁর সহযোগিতায় পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন যে, মানব জীবনের উদ্দেশ্য হল কৃষ্ণভাবনায় উন্নতি সাধন করা, কেবল সন্তান-সন্ততি উৎপন্ন করাই নয়। (শ্রীমদ্ভাগবত ৪/২৭/৬ তাৎপর্য)
আধুনিক জন্ম-নিয়ন্ত্রণ নীতির মূল হোতা মার্গারেট স্যানগার (১৮৭৯-১৯৬৬) একবার ভারতবর্ষে এসে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং জন্ম-নিয়ন্ত্রণ নীতিকে সমর্থন করে তাঁর দেশে তার বাস্তব রূপায়ণের জন্য রাজী করাতে চেষ্টা করেছিলেন। স্যানগার লিখেছিলেন, “তিনি এ বিষয়ে রাজী হয়েছিলেন যে, কোন পরিবারে তিনটি বা চারটির বেশি সন্তানের জন্ম হওয়া উচিত নয়। তবে তিনি একথাও বলেছিলেন যে, সেই জন্য দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর তিনটি বা চারটি সন্তানের জন্ম দান করার উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে সহবাসে লিপ্ত হওয়া উচিত নয় এবং সে বিষয়ে সংযম পালন করে চলা উচিত।” স্যানগারের ধারণা যে, “স্ত্রীলোকেদের শারীরিক দাসত্বের কবল থেকে মুক্ত হওয়া উচিত এবং একমাত্র জন্ম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই সেই উদ্দেশ্যটি সিদ্ধ হওয়া সম্ভব।” যাই হোক, বেদে কিন্তু প্রকৃত দাসত্বের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা সকলেই, পুরুষই হোক বা স্ত্রীলোকই হোক জন্ম এবং মৃৃত্যুর অন্তহীন চক্রে আবদ্ধ হয়ে আছি। আমাদের প্রকৃত পরিচয় হচ্ছে এই যে, আমরা সকলেই নিত্য চিন্ময় আত্মা কিন্তু এখন নানাপ্রকার ক্লেশ ও কালের বিধ্বংসী প্রভাবের অধীন এই অনিত্য ক্ষণস্থায়ী জড় শরীরের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে রয়েছি। আমরা জন্ম-জন্মান্তরে একটি জড় শরীর থেকে আর একটি বেদনাময় জড় শরীরে দেহান্তরিত হয়ে চলেছি। জন্মান্তরবাদ কি কেবল একটি বিশ^াস বা ধারণা মাত্র? বেদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই সত্যটি সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এমন কি, পাশ্চাত্য বিজ্ঞানও এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রমাণ (জাতিস্মর বিজ্ঞান প্রভৃতি) সংগ্রহ করেছে, যার মাধ্যমে বোঝা যায় যে, আমাদের একটি চিন্ময় সত্ত্বা আছে এবং মৃত্যুর পরেও যার অস্তিত্ব থাকে। এ বিষয়ে বেদে বলা হয়েছে, আমাদের পূর্ববর্তী জীবনের কর্মফলের প্রতিক্রিয়া ভোগ করবার জন্য আমাদের ফিরে আসতে হয়। সেই জন্য শ্রীল প্রভুপাদ সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘অবৈধ সহবাস গর্ভসঞ্চার করে এবং এই অবাঞ্ছিত গর্ভসঞ্চারই গর্ভপাতের মূল কারণ। যারা এই ধরনের জঘন্য কার্যে লিপ্ত হয়, তারা মারাত্মক পাপে জড়িয়ে পড়ে এবং ফলস্বরূপ পরবর্তী জীবনে তারাও গর্ভপাতের কবলগ্রস্ত হয়ে শাস্তি ভোগ করে। এইভাবে তারা কোন স্ত্রীলোকের গর্ভে প্রবেশ করে এবং একই উপায়ে নিহত হয়। -শ্রীমদ্ভাগবত ৫/৪/৯ তাৎপর্য
গর্ভনিরোধের সময়ে ভৌতিক বা রাসায়নিক বিক্রিয়ার দ্বারা গর্ভস্থ ডিম্বাণুর ক্ষতিসাধন করা হয় এবং তার ফলে সেই গর্ভ জীবের বাসের অযোগ্য হয়ে ওঠে। অধিকাংশ গর্ভ-নিরোধক প্রণালীই এই নীতির ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়ে থাকে। এটি প্রকৃতপক্ষে আরেক ধরনের হত্যা। গর্ভপাতের থেকে অনেক আগের পর্যায়ে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। কেননা, বেদের মতানুযায়ী এই প্রাথমিক পর্যায়েও ডিম্বাণুর মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হয়ে থাকে।
আজকাল সারা পৃথিবী জুড়ে নানা ধরনের জন্ম নিয়ন্ত্রণ প্রণালী প্রাধান্য লাভ করেছে। এই অবস্থার পরিবর্তন করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য একটি কাজ। কিন্তু ইতিমধ্যেই এই ব্যাপারে অনুকূল সাড়া পাওয়া গিয়েছে। সারা পৃথিবীর হাজার হাজার দম্পতি ‘সন্তান উৎপাদনের জন্যই কেবল সহবাসের প্রয়োজন’ কৃষ্ণভাবনার এই প্রণালী অবলম্বন করে স্বেচ্ছায় যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে সংযম পালন করছে এবং তার থেকেও অধিক সংখ্যক অবিবাহিত যুবক-যুবর্তী সম্পূর্ণরূপে ব্রহ্মচর্য পালনের রীতি অবলম্বন করেছেনÑহয় সারা জীবনের জন্য স্থায়িভাবে কিংবা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। বেদের মতানুযায়ী, গর্ভ সঞ্চারের সময়ে পিতামাতার চেতনা অনুসারে সন্তানের চেতনা গঠিত হয়। শ্রীল প্রভুপাদ এ বিষয়ে উপদেশ প্রদান করে বলেছেন, “মানব জন্ম একটি মহৎ বিজ্ঞান। তাই উন্নত মানের জীবন গঠন করার জন্য গর্ভসঞ্চারের সময়ে বৈদিক রীতি অনুসারে ‘গর্ভাধান সংস্কার’ নামক সংস্কার অনুষ্ঠান করা অত্যন্ত প্রয়োজন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করার থেকে উন্নত মানের মানব জীবন গঠন করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ তথাকথিত জন্ম নিয়ন্ত্রণ কেবল অধর্ম, বা নীতিবিরুদ্ধই নয়, তা নিষ্ফলও বটে।” শ্রীমদ্ভাগবত ৩/৫/১৯ তাৎপর্য
তাই শ্রীল প্রভুপাদ উপদেশ দিয়েছেন, “যারা কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন, শিশুহত্যার মতো জঘন্য কার্য থেকে তাদের নিরস্ত্র হওয়া উচিত এবং অত্যন্ত ঐকান্তিকতার সঙ্গে কৃষ্ণভাবনামৃতের আশ্রয় গ্রহণ করার মাধ্যমে পূর্বকৃত সমস্ত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত। যদি কেউ অপরাধশূন্য হয়ে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করে, তৎক্ষণাৎ তার সমস্ত পাপকর্মের প্রায়শ্চিত্ত হতে থাকে, কিন্তু এই ধরনের পাপ কার্য তার আর করা উচিত নয় ।” শ্রীমদ্ভাগবত ৬/১৬/১৪ তাৎপর্য