এই পোস্টটি 391 বার দেখা হয়েছে
গোবর্ধন পর্বত শ্রীকৃষ্ণের ভক্তদের সেবা করার মাধ্যমে
ভগবানের অতি অন্তরঙ্গ এক সেবা করেছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে শ্রীমৎ গিরিরাজ স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত প্রবচনের বঙ্গানুবাদ।
হন্তায়মদ্রিরবলা হরিদাসবর্যো
যদ্ রামকৃষ্ণচরণস্পরশপ্রমোদঃ।
মানং তনোতি সহগোগণয়োস্তয়োৰ্যত্
পানীয়সূযবসকন্দরকন্দমূলৈঃ ॥
অনুবাদ : ভক্তগণের মধ্যে এই গোবর্ধন পর্বত শ্ৰেষ্ঠ! হে সখীগণ, এই পর্বত গোবৎস, গাভী ও গোপগণের সঙ্গে কৃষ্ণ ও বলরামকে পানীয় জল, অত্যন্ত কোমল ঘাস, গুহা, ফল, ফুল ও শাক সবজি—সমস্ত রকমের প্রয়োজনীয় দ্রব্যই সরবরাহ করে। এভাবেই এই পর্বত ভগবানকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছে। কৃষ্ণ ও বলরামের চরণ স্পর্শ লাভ করার ফলে গোবর্ধন পর্বতকে অত্যন্ত উৎফুল্ল মনে হচ্ছে। [ভাগবত ১০/২১/১৮]
সমস্ত ভক্তদের মধ্যে গোবর্ধন পর্বত হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ। হে আমার বন্ধুগণ, এই পর্বত কৃষ্ণ ও বলরামকে তাদের বাছুর গাভী ও সমস্ত রাখাল বন্ধুদের প্রয়োজনীয় জল, নরম ঘাস, গুল্ম, ফল ফুল ও শাক সবজি সরবরাহ করে। এভাবে এই পর্বতটি ভগবানকে শ্রদ্ধা অর্পণ করে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলরামের পাদ স্পর্শের কারণে গোবর্ধন পর্বত হয়েছেন মহিমান্বিত। চৈ.চ অন্ত ১৪/৮৪ ও শ্রীমদ্ভাগবত ১০/২১/১৮ শ্লোকে গোবর্ধন পর্বতের মহিমা বর্ণিত হয়েছে। শ্রীল শুকদেব গোস্বামী কৃষ্ণ ও বলরামের বিভিন্ন ঋতুতে তাদের কার্যাবলীর বর্ণনা করেছেন। তিনি তাদের সারা গ্রীষ্মকাল জুড়ে যে লীলবিলাস করেছিলেন তা বর্ণনা করেছেন। অনুরূপভাবে বর্ষাকাল ও শরৎকালের লীলা বিলাসের কথাও। যখন কৃষ্ণ বলরাম বনে যেতো তখন গোপীরা কৃষ্ণের অতীত স্মৃতি ও তার মহিমা চিন্তা করতেন। যদিও গোপীকারা গৃহে ছিলেন তবুও তারা সর্বদা কৃষ্ণের কথা ভাবতো কেননা তাদের ছিল আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কৃষ্ণের প্রতি প্রগাঢ় আসক্তি। যখন কৃষ্ণ গোবর্ধন পর্বতে যেতেন তখন সবসময় সে সময়কার স্মৃতি নিয়ে আলোচনা হতো। এই শ্লোকে বলা হয়েছে গোপীকারা গভীর আনন্দের সাথে কৃষ্ণের কথা পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করত। হান্ত তারা বলতো অয়ম অধীর অর্থাৎ এই পর্বতটি যদি কোনো কিছুর নিকটেই হয় আমরা বলি এই!। যেমন এই বালক। যদিও গোপীকারা গোবর্ধন পর্বত থেকে অনেক দূরে ছিল তবুও তারা সবসময় তাকে খুব নিকটেই অনুভব করতো। তাই তারা অয়ম অদ্রির এই পর্বত হরিদাসবর্যো অর্থাৎ শ্রীহরি অথবা শ্রীকৃষ্ণের একান্ত অন্তরঙ্গ সেবক। আমরাও শ্রীহরির সেবক হওয়ার প্রচেষ্টা করছি। তাই গোবর্ধন পর্বত থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত কিভাবে শ্রীহরির সেবা করতে হয়। যা শ্রীমদ্ভাগবতে ১০ম স্কন্ধে বর্ণিত হয়েছে। হরি দাস শব্দের অর্থ হচ্ছে ভগবান শ্রীহরির সেবক। যুধিষ্ঠির মহারাজকে হরিদাস বলে অভিহিত করা হয়। কেননা তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণরে মহিমা প্রকাশের জন্য রাজসূয় যজ্ঞ করেছিলেন। এই যজ্ঞে বহু সাধু, যোগী, রাজা ও নেতৃবৃন্দ এসেছিলেন শুধুমাত্র শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করতে নয় সে সাথে যুধিষ্ঠির ও পাণ্ডবদের দর্শন করতে। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি পাণ্ডবদের ভালবাসার কারণে কৃষ্ণ প্রতিদিন তাদের বাড়িতে যেতেন। ভক্তরা শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করার জন্য বহু পথ অতিক্রম করে কৃষ্ণকে দর্শন করতে যেতেন। আর কৃষ্ণ নিজেই পাণ্ডবদের দর্শন দিতে আসতেন। তিনি পাণ্ডবদের সাথে তাদের বন্ধু, গুরু, সেবক এবং তাদের উপদেষ্টা এরূপ বহু ভাবেই ভাব বিনিময় করতেন। তাই মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে বলা হতো হরিদাস। শুধুমাত্র তিনি নয় তার ভ্রাতারাও শ্রীকৃষ্ণের সেবা করতো। এমনকি তাদের পত্নী, জননী এবং সকল নগরবাসীরা সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণসেবায় নিয়োজিত থাকতেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাদের প্রতি খুব সন্তুষ্ট ছিলেন। এইজন্য যখনি মহারাজ যুধিষ্ঠির ও পাণ্ডবদের কথা উপস্থিত হয়, তখন শুকদেব গোস্বামী তাদের হরিদাস বলে অভিহিত করেন। আরেক জন হরিদাসের উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি হলেন উদ্ধব। উদ্ধব ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের জ্ঞাতী ভাই, সর্বোপরি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অতি অন্তরঙ্গ সখা ছিলেন। দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণের সকল সহযোগীদের মধ্যে উদ্ধব ছিলেন ভগবানের নিত্য পার্ষদ। উদ্ধব শ্রীকৃষ্ণের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন ও উপদেশ দিতেন এবং সেবা করতেন। উদ্ধব শ্রীকৃষ্ণের এতটাই অন্তরঙ্গ ছিলেন যে, যখন বৃন্দাবনে কোনো বার্তা পাঠানোর প্রয়োজন হতো তখন বার্তা বাহক হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবকে নির্বাচন করতেন। উদ্ধব বৃন্দাবনে বেশ কয়েক মাস অবস্থান করে শ্রীকৃষ্ণের পূর্ব আবাসস্থল ও পূর্ব স্মৃতি রোমন্থন করেছিলেন। তাই শুকদেব গোস্বামী উদ্ধবকেও হরিদাস বলে অভিহিত করছেন। এরকম আরো হরিদাসের উল্লেখ পাওয়া যায় যেমন- নারদ। কিন্তু গোবর্দ্ধন পর্বতকে বলা হচ্ছে হরিদাসর্যো ভগবানের শ্রেষ্ঠ সেবক। কেন তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হয়? রামকৃষ্ণচরণস্পরশপ্রমোদঃ। প্রমোদঃ অর্থ- উল্লসিত। অর্থাৎ অনেক বেশি আনন্দিত। যখন কোনো সেবক তার প্রভুর সেবায় নিয়োজিত হয় তখন সেবকের আনন্দ অনুভব করা উচিত এবং তার সেবা দ্বারা তার প্রভুর আনন্দ অনুভব করা উচিত। উভয়ের আনন্দ অনুভব করা উচিত। যখন সেবক দেখে যে, তার প্রভু আনন্দ অনুভব করছে তখন সেবকের আনন্দ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। যখন প্রভু দেখে যে, সেবক আনন্দ অনুভব করছে তখন প্রভুর আনন্দ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। এইভাবে সেবক ও প্রভুর মধ্যে প্রতিযোগীতা লেগে থাকে। প্রত্যেকেই চেষ্টা করে অপরকে আরো বেশি আনন্দ দিতে। এইভাবে অপরকে আনন্দ দেওয়ার মাধ্যমে প্রত্যেকেই আনন্দ অনুভব করে। যদি কোনো সেবক আনন্দ অনুভব না করে তবে সে অভিযোগ করবে “ও! আমি আমার প্রভুর সেবা করছি কিন্তু আমার প্রসাদ গ্রহণের সময় পর্যন্ত নেই আমি খুব ক্ষুধার্ত কিন্তু প্রসাদ গ্রহণ করতে পারছি না। আমি খুব ক্লান্ত কিন্তু সেবার জন্য আমি যথেষ্ট বিশ্রাম গ্রহণ করতে পারছি না। তাহলে সে তার প্রভুর যথার্থ সেবক নয়। একজন প্রভুর সেবক হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে কোনো অবস্থাতেই সেবা করে আনন্দ অনুভব করেন। এইরূপ সেবকের যথার্থ উদাহরণ হচ্ছে গোবর্ধন। অনেক সময় প্রশ্ন উঠে “যেহেতু গোবর্ধন ছিল বৃন্দাবনের একটি অংশ মাত্র তাহলে কিভাবে সমস্ত বৃন্দাবন গোবর্ধন পর্বতের নিচে অবস্থান করছিল? আচার্যরা এর উত্তরে বলেন, “গোবর্ধন পর্বত যখন ভগবানের কনিষ্ঠ আঙ্গুলী দ্বারা উত্থিত হয়েছিল তখন ভগবানের অঙ্গুলী স্পর্শে উদ্বেলিত হয়ে নিজেকে অনেক বিশাল রূপে প্রসারিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তখন তার সেবা কি ছিল? তিনি সমস্ত বৃন্দাবনবাসীদের তার নিচে আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে ঝড়ো বাতাস, মুষলধারা বৃষ্টি ও শিলা বৃষ্টি এবং ইন্দ্রের বজ্রপাত থেকে রক্ষার করেছিলেন। কিন্তু তিনি এক মূহূর্তের জন্যও বিচলিত হন নি। ও! আমি ঝড়-বাতাস, শিলা বৃষ্টি, বজ্রপাত দ্বারা আক্রান্ত। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। এরূপ ভাবার পরিবর্তে সে উল্লসিত ছিল কেননা ভগবানের হস্ত পল্লবের স্পর্শ এবং ভগবান ও তার ভক্তদের সেবায় তিনি ছিলেন নিয়োজিত। যেকোনো অবস্থাতেই তিনি আনন্দ অনুভব করেছিলেন কেননা তিনি কৃষ্ণ ও তার ভক্তদের বিশেষ করে কৃষ্ণ বলরাম ও রাধাকৃষ্ণের চরণ স্পর্শ তাকে সর্বদাই আনন্দ প্রদান করতো রামকৃষ্ণচরণস্পর্শপ্রমোদঃ ।
সেবকের দ্বারা সেবকের সেবা
গোবর্ধন পর্বত ভগবানের সর্বশ্রেষ্ঠ সেবক ছিলেন কেননা তিনি তার সমস্ত শরীর দিয়ে ভগবান ও তার ভক্তের সেবা করেছিল। তারা তার সমস্ত দেহ জুড়ে বিচরণ করেছিলেন যদি কারো প্রভু তা সমস্ত শরীরে বিচরণ করে তবে সে অবশ্যই আনন্দে উদ্বেলিত হবে। কিন্তু গোবর্ধন পর্বত তার সমস্ত শরীর শুধুমাত্র তার প্রভুর সেবায় নিয়োজিত করেনি। অধিকন্তু তার প্রভু ও প্রভুর ভক্তদের আনন্দ বিধানের জন্য এক উন্মুক্ত প্রান্তরে পরিণত করেছিল নিজের দেহকে। গোবর্ধন পর্বত শুধুমাত্র কৃষ্ণকেই সম্মান করেননি মানং তনোভি অধিকন্তু গাভী, বাছুর এবং রাখাল বালকদের সহগোগণয়োস্তয়োৰ্যৎ গো-অর্থ গাভী এবং বাছুর। গনয়ো অর্থ গোপবালকগণ। গোবর্ধন পর্বত শুধুমাত্র কৃষ্ণ ও বলরামের সেবা করতে চাননি। তিনি ভগবানের ভক্ত সমেত ভগবানকে সেবা করতে চেয়েছেন। গোবর্ধন পর্বত থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত, “আমরা ভগবানকে সেবা করে সন্তুষ্ট করার চেয়ে ভগবানের ভক্তদের সেবা করার মাধ্যমে ভগবানকে আরো অধিক আনন্দ দান করে। শ্রীল প্রভুপাদ তার লীলা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “গোবর্ধন পর্বত ভগবানকে সন্তুষ্ট করার গোপন রহস্য জানতেন।” কিভাবে ভগবানের নিত্য সহচরদের সেবা করার মাধ্যমে ভগবানকে আরো অধিক আনন্দ দান করা যায়। গোবর্ধন পর্বত ভগবান ও তার ভক্তদের সেবার জন্য শুধুমাত্র তার দেহই প্রদান করেননি তার সর্বস্ব প্রদান করেছেন। কিভাবে গোবর্ধন পর্বত ভগবান ও তার ভক্তদের সেবার জন্য সর্বস্ব প্রদান করেছেন, বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ করার মাধ্যমে বিশেষ করে তার দেহ নিঃসৃত জলপ্রপাত কৃষ্ণ, রাখালবালক ও বাছুরদের তৃষ্ণা মিটিয়েছে। তার জলের স্পর্শে কৃষ্ণ ও গোপসখাদের শ্রান্ত শরীর ক্লান্তি মুক্ত হয়েছে। সূর্যবস শব্দের অর্থ- অত্যন্ত কোমল নরম ঘাস। গোবর্ধন পর্বত কিছু ঘাস সরবরাহ করত যা যজ্ঞ সম্পাদনের কাজে লাগতো এবং আরেক প্রকার ঘাস যেগুলো বিশেষ করে নরম ও সুগন্ধ যুক্ত সেগুলো ব্যবহার হতো গাভীর খাদ্য হিসেবে। ঘাসগুলো গাভীকে শক্তি ও সুস্বাস্থ্য প্রদান করতো যার ফলে গাভীগুলো প্রচুর দুধ দান করতো। কন্দর শব্দের অর্থ- হচ্ছে গুহাসমূহ। যখন কৃষ্ণ ও বলরাম অথবা কৃষ্ণ গোপীকারা প্রখর সূর্যতাপের কারণে ক্লান্তি অনুভব করতো তখন গোবর্ধন পর্বতের গুহায় আশ্রয় নেওয়ার মাধ্যমে শীতলতা অনুভব করতো। আবার যখন প্রচুর শীত পড়তো সেই গুহায় অবস্থানের মাধ্যমে উষ্ণতা অনুভব করতো। কন্দমূলৈঃ শব্দের অর্থ- শিকড়। গাভী ও গোপ বালকরা পর্বত থেকে বিভিন্ন শিকড় জাতীয় সবজি, ফলমূল, ফুল ও আরো অনেক ভোজ্য সংগ্রহ করতেন। যখন কৃষ্ণ ও বলরাম গোবর্ধন পর্বতের ওপর হাঁটতো তখন তাদের চরণ স্পর্শে পর্বতের কঠিন শিলা মাখনের মতো গলে যেত। কৃষ্ণ ও বলরাম যখন গোবর্ধন পর্বতের ওপরিস্থিত কোনো শিলা খণ্ডের ওপর বসতো তাদের চিন্ময় দেহ স্পর্শে প্রস্তর খণ্ডটি তৎক্ষণাৎ সিংহাসনের রূপ পরিগ্রহ করতো।
প্রশ্ন: কিভাবে গোবর্ধন তার সেই আনন্দ বহিপ্রকাশ করেছিল?
উত্তর: তার লম্বা লম্বা ঘাসগুলো সমস্ত দেহজুড়ে পরমানন্দে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। তার সমস্ত দেহ জুড়ে বিরাজমান আদ্রতা পরমানন্দের বহিপ্রকাশ, তার প্রস্তরময় দেহ ভেদ করে আসা জল পরমানন্দে তার চক্ষু থেকে নিশ্রিত প্রেমাশ্রুর প্রতিভু। গোবর্ধন পর্বতের সবকিছুই চিরন্তন, জ্ঞানময় ও আনন্দময়।
রাধাকৃষ্ণের সাক্ষাৎ ও সেবা
যদিও কৃষ্ণ এক সময় নিজেকে গোবর্ধন পর্বত বলে ঘোষণা করেছিলেন। এখানে আমরা দেখি যে, গোপীরা গোবর্ধনকে কৃষ্ণের সর্বশ্রেষ্ঠ সেবক রূপে ঘোষণা করেছে কৃষ্ণ রূপে নয় কেন?
গোপীকাদের ভাব ছিল বিচ্ছেদের তারা কৃষ্ণের সাথে সাক্ষাৎ করতে ও সেবা করতে চাইতো। তারা কৃষ্ণের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে পারতো না। তারা শুধুমাত্র কৃষ্ণকে দেখে ও তার সম্বন্ধে শুনে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তাই গোপীকাদের চিন্তা চেতনা ছিল এরূপ কেউ কারো বাসনা পূর্ণ করতে পারে শুধুমাত্র শুদ্ধাত্মাদের করুণায়।
শুদ্ধাত্মা কে? যিনি শ্রীহরির সেবক। গোবর্ধন পর্বত হচ্ছে তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই আমাদের গোবর্ধন পর্বত দর্শন করতে যাওয়া উচিত এবং আমাদের প্রত্যাশা পূরণের জন্য তার কৃপা আশির্বাদ প্রার্থনা করা উচিত। যদি আমরা তার দর্শন লাভের সমর্থ হই তবে কৃষ্ণের সেবা অধিকার লাভ করব। যেহেতু গোপীকারা তাদের বয়োজ্যেষ্ঠ ও আত্মীয় স্বজনদের অধীনে ছিল তাই তাদের কৃষ্ণের সাথে সাক্ষাতের তেমন একটি সুযোগ ছিল না। তারা ভাবতো যদি আমরা আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের বলি আমরা মানসি গঙ্গায় স্নান করতে যেতে চাই এবং হরিদেবকে দর্শন করতে যেতে চাই। শ্রীহরিদেব ভগবান নারায়ণের শ্রীবিগ্রহ। শ্রীকৃষ্ণের একটি রূপ হলো নারায়ণ। যা গোবর্ধন পর্বতের ওপর ছিল। কিন্তু আসলে তারা কৃপা প্রার্থনা করতে যেতে চেয়েছিল হরিদাসের কাছে। একমাত্র হরিদাসের কৃপার মাধ্যমে হরিদেবের কৃপালাভ সম্ভব। তাই তারা গোবর্ধন পর্বত স্থিত হরিদেবের কৃপা প্রার্থনার নিমিত্তে স্বয়ং গোবর্ধন পর্বতের কৃপা প্রার্থনা করতে যেতো যা তাদের কৃষ্ণের সাথে সাক্ষাৎ করতে সমর্থ হতো। সময় আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে, আমাদের অবশ্যই শুদ্ধাত্মাদের সেবা করার মাধ্যমে তাদের কৃপা আশির্বাদ লাভ করা উচিত । শ্রীমদ্ভাগবতের ১ম থেকে ৫ম স্কন্ধ পর্যন্ত এই বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অন্যান্য শাস্ত্র থেকে আমরা জানতে পারি শুদ্ধ ভক্তদের সেবা করার মাধ্যমে তাদের কৃপা বলে বলিয়ান হয়ে ভগবৎ সেবা করা সম্ভব। গোবর্ধন পর্বত হচ্ছে এইরূপ ভক্তদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। যদি আমরা গোবর্ধন কৃপা প্রাপ্ত হই তবে রাধাকৃষ্ণের সেবাধিকার প্রাপ্ত হবো।
দাসানুদাসের সেবা
প্রশ্ন: কেউ বলে গোবর্ধন কৃষ্ণের ভক্ত আবার কেউ বলে গোবর্ধন স্বয়ং কৃষ্ণ?
শ্রীমৎ গিরিরাজ স্বামী: উভয়ই সঠিক। গিরি গোবর্ধন পূজার সময় কৃষ্ণ নিজেকে গিরি গোবর্ধন রূপে প্রকাশ করেছিলেন এবং ঘোষণা করেছিলেন আমি গোবর্ধন পর্বত। আসলে তিনি গোবর্ধন পর্বত এবং গোপীকারা গোবর্ধনের পূজা করেছিলো কৃষ্ণের ভক্ত রূপে (হরিদাসবর্যো) তাই উভয়ই সঠিক। কিন্তু আমি মনে করি সরাসরি কৃষ্ণের করুণা পাওয়ার চেয়ে তার কোন ভক্তের করুণা পাওয়া অনেক বেশি সহজ ও মহিমান্বিত। আমরা দেখি যে, গৌর-কৃষ্ণ চৈতন্য উভয়ই কৃষ্ণ কিন্তু কৃষ্ণ কৃষ্ণপ্রেম প্রদান করেন না। গৌর সেই কৃষ্ণপ্রেম প্রদান করতে সমর্থ। গৌরহরি অনেক বেশি কৃপাময় কেননা তিনি শ্রীহরির সেবকভাবে রয়েছেন। যদি আমরা শ্রীহরির কোনো ভক্তের সেবা করি তবে আমরা শ্রীহরিকে সেবা করার চেয়েও অনেক বেশি সুফল লাভ করি। গৌরহরি নিজেকে গোপীভাবে প্রকাশ করেছেন। চৈতন্য মহাপ্রভু যখন গিরি গোবর্ধন দর্শন করতে আসতেন তখন কৃষ্ণপ্রেম প্রাপ্তির জন্য গিরি গোবর্ধনের কাছে প্রার্থনা করেছেন।
‘বৈষ্ণব’ দেখিয়া প্রভুর অর্ধবাহ্য হইল ।
স্বরূপ-গোসাঞিরে কিছু কহিতে লাগিল ॥ ১০৪ ॥
“গোবর্ধন হৈতে মোরে কে ইঁহা আনিল?
পাঞা কৃষ্ণের লীলা দেখিতে না পাইল ॥ ১০৫ ॥
শ্লোকার্থ : সমস্ত বৈষ্ণবদের দেখে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অর্ধচেতনা হল এবং তিনি স্বরূপ দামোদরকে বলতে লাগলেন, “গোবর্ধন থেকে কে আমাকে এখানে নিয়ে এল? কৃষ্ণলীলা দেখেও আমি দেখতে পেলাম না।
ইঁহা হৈতে আজি মুই গেনু গোবর্ধনে।
দেখোঁ, যদি কৃষ্ণ করেন গোধন-চারণে ॥ ১০৬ ॥
“আজ আমি এখান থেকে গোবর্ধনে গিয়েছিলাম এবং খুঁজে দেখছিলাম কৃষ্ণ গোচারণ করছে কিনা।”
গোবর্ধনে চড়ি’ কৃষ্ণ বাজাইলা বেণু।
গোবর্ধনের চৌদিকে চরে সব ধেনু ॥ ১০৭ ॥
“গোবর্ধন পর্বতে উঠে শ্রীকৃষ্ণ বাঁশী বাজাতে লাগলেন এবং তখন গোবর্ধনের চতুর্দিকে গাভী সমূহ চারণ করছিল।
বেণুনাদ শুনি’ আইলা রাধা-ঠাকুরাণী।
সব সখীগণ-সঙ্গে করিয়া সাজনি ॥ ১০৮ ॥
“শ্রীকৃষ্ণের বংশীধ্বনি শুনে, শ্রীমতী রাধারাণী তাঁর সমস্ত সখীদের নিয়ে, অত্যন্ত সুন্দর সজ্জায় সজ্জিত হয়ে, সেখানে এলেন।”
রাধা লঞা কৃষ্ণ প্রবেশিলা কন্দরাতে।
সখীগণ কহে মোরে ফুল উঠাইতে ॥ ১০৯ ॥
“শ্রীমতী রাধারণীকে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ একটি কন্দরে প্রবেশ করলেন এবং তখন সখীরা আমাকে ফুল তুলতে বললেন।”
হেনকালে তুমি-সব কোলাহল কৈলা।
তাঁহা হৈতে ধরি’ মোরে ইঁহা লঞা আইলা ॥ ১১০ ॥
“সেই সময় তোমরা সকলে কোলাহল করতে শুরু করলে এবং সেখান থেকে আমাকে ধরে এখানে নিয়ে এলে।”
কেনে বা আনিলা মোরে বৃথা দুঃখ দিতে।
পাঞা কৃষ্ণে লীলা, না পাইনু দেখিতে!” ১১১ ॥
“কেন অনর্থক আমাকে দুঃখ দেওয়ার জন্য তোমরা আমাকে এখানে নিয়ে এলে? কৃষ্ণের লীলা দর্শন করার সুযোগ পেয়েও আমি তা দেখতে পেলাম না।” [চৈ.চ.অন্ত ১৪/১০৪-১১১]
যদি আমরা গোবর্ধন পর্বতে উপনীত হয়ে তার কৃপা আশির্বাদ প্রার্থনা করি তবেই আমরা যথার্থ ভগবদ্ভক্ত হতে পারবো। আজ আমরা সবাই মিলে গিরি গোবর্ধনের কাছে প্রার্থনা করছি “হে প্রভু, আপনি কৃপা করে আমাদের অভিষ্ট পূরণ করুন।”
লেখক পরিচিতি : শ্রীমৎ গিরিরাজ স্বামী ইস্কনে যোগদান করেন ১৯৬৯ সালে এবং ১৯৭৮ সালে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। ৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি প্রভুপাদের তত্ত্বাবধানে মুম্বাইয়ে ইস্কন টেম্পল কমপ্লেক্স নির্মাণ কার্যের তত্ত্বাবধান করেন। তিনি ইস্কন জিবিসির একজন সদস্য এবং ভারত আফ্রিকাসহ সারা বিশ্বের মানুষকে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রদান করছেন।