এই পোস্টটি 206 বার দেখা হয়েছে
“ভক্তগণের মধ্যে এই গোবর্দ্ধন পর্বত শ্রেষ্ঠ। হে সখীগণ, এই পর্বত গোবৎস, গাভী ও গোপগণের সঙ্গে কৃষ্ণ ও বলরামকে পানীয় জল, অত্যন্ত কোমল ঘাস, গুহা, ফল, ফুল ও শাক-সব্জি-সমস্ত রকমের প্রয়োজনীয় দ্রব্যই সরবরাহ করে। এভাবেই এই পর্বত ভগবানকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছে। কৃষ্ণ ও বলরামের চরণপদ্মের স্পর্শ লাভ করার ফলে গোবর্দ্ধন পর্বতকে অত্যন্ত উৎফুল্ল মনে হচ্ছে।’ (শ্রীমদ্ভাগবত ১০.২১.১৮)।
বর্তমান ভারতের মথুরা রাজ্য হতে ২০ কি.মি. পশ্চিমে গোবর্দ্ধন পর্বত অবস্থিত। এটি ব্রজমণ্ডল বৃন্দাবনের অধিক পরিদর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটি। কারণ বর্তমানে ৫০০০ বছর পূর্বের পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাবিলাসের স্থানসমূহের মধ্যে মাত্র তিনটি স্থান অবিকল বর্তমান রয়েছে। সেগুলো হল, বৃন্দাবনের ধূলিকণা, যমুনা নদী এবং গোবর্দ্ধন পর্বত। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ঘোষণা করেছেন যে, তিনিই স্বয়ং গিরিরাজ গোবর্দ্ধন। তাই কৃষ্ণভক্তরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে গোবর্দ্ধন পূজা করে থাকেন। যার সূচনা হয়েছে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মাধ্যমে। সেই লীলাটি অত্যন্ত দিব্য মনোহরপূর্ণ । বৃন্দাবনে একবার স্বর্গাধিপতি ইন্দ্রের পূজার প্রস্তুতি চলছিল । কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ, বৃন্দাবনবাসীদের ইন্দ্রের পরিবর্তে গিরিরাজ গোবর্দ্ধন পূজা করার সুপরামর্শ দিলেন। এতে তাঁরা সম্মত হলেন এবং মহাসমারোহে গোবর্দ্ধনের পূজা ও প্রদক্ষিণ করলেন। কিন্তু এতে দেবরাজ ইন্দ্র রুষ্ট হলেন এবং শ্রীকৃষ্ণকে সাধারণ বালক বলে মনে করে, বৃন্দাবনবাসীদের উপযুক্ত শান্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে ভীষণ ঝড়বাদলের সৃষ্টি করলেন। কিন্তু বালকরূপী শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনবাসীদের রক্ষার্থে একটি ছোট মাশরুম উত্তোলনের ন্যায় সমগ্র গোবর্দ্ধন পর্বত উত্তোলন করলেন। অনবরত সাত দিন, সাত রাত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার বাম হাতের কনিষ্ট আঙ্গুল দ্বারা গোবর্দ্ধনকে ধারণ করে ছিলেন এই সাতদিন যাবত বৃন্দাবনবাসীরা কোন রকমের ক্ষুধা তৃষ্ণা অনুভব করলেন না, তাঁরা কেবল অপলক দৃষ্টিতে ছোট্ট কৃষ্ণের গোবর্দ্ধন উত্তোলনের অপূর্ব দৃশ্য অবলোকন করলেন। তখন থেকেই গোবর্দ্ধন পূজা উৎসব শুরু হয় । যা এখনও সারাবিশ্বব্যাপি পালিত হচ্ছে। এছাড়া গোবর্দ্ধন পর্বতে স্থায়ীভাবে ষড়ঋতুর অবস্থান নেওয়া শুরু হয়।
ব্রজে গোবর্দ্ধনের আবির্ভাব :
গর্গ সংহিতা মতে, সত্যযুগে সোমালী দ্বীপের সন্নিকটে পর্বতরাজ দ্রোণাচল বাস করত। তার পুত্র হলেন গোবর্দ্ধন পর্বত। একবার পুলস্ত্য মুনি দ্রোণাচলের নিকট আসেন। তখন পুলস্ত্য মুনি গোবর্দ্ধনকে দেখে ভাবলেন যে, শান্তিপূর্ণ সাধনভজনের জন্য তিনি কাশীতে (বর্তমান বারানসী) গোবর্দ্ধনকে নিয়ে যাবেন। পুলস্ত্য মুনী দ্রোণাচলকে এই প্রস্তাব দিলে অভিসম্পাতের ভয়ে তিনি তাঁর প্রিয় পুত্রকে মুনীর সাথে যাওয়ার ব্যাপারে সম্মতি দেন। অন্যদিকে গোবর্দ্ধন পর্বত একটি শর্তে মুনীর সাথে যেতে রাজি হন। শর্তটি হল মুনী তাঁকে যেখানে প্রথম রাখবেন গোবর্দ্ধন সেখানেই বিরাজ করবেন এবং অন্যত্র গমন করবেন না। পুলস্ত্য তাতে রাজি হলেন এবং তাঁর যোগশক্তি বলে হাতের তালুতে গোবর্দ্ধন পর্বতকে তুলে কাশীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। কিন্তু নিত্য ধাম ব্রজে প্রবেশ করা মাত্রই গোবর্দ্ধনের মনে কৃষ্ণবিরহের উৎপত্তি হল এবং তিনি অত্যন্ত ভারী হয়ে উঠলেন। পুলস্ত্য কোন প্রকারেই তাকে বহন করতে না পেরে অগ্যতা সেখানেই তাঁকে রাখলেন। এরপর পুলস্ত্য স্নান, আহার ও বিশ্রাম সম্পন্ন করে পুনরায় গোবর্দ্ধনকে তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও তুলতে পারলেন না। গোবর্দ্ধন সেই স্থান পরিত্যাগ করতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করল। এতে পুলস্ত্য মুনী রেগে গিয়ে গোবর্দ্ধন কে অভিশাপ দিলেন যে, প্রতিদিন গোবর্দ্ধনের আকৃতি থেকে তিলবৃক্ষের (সরিষা) বীজসম অংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। কৃষ্ণলীলা সন্নিকটে বুঝতে পেরে গোবর্দ্ধন এই অভিশাপ মাথা পেতে নিলেন। তখন থেকেই কৃষ্ণ বিরহে ও ঋষির অভিশাপের কারণে গোবর্দ্ধন প্রতিদিন হ্রাস প্রাপ্ত হচ্ছে। সেই সময় গোবর্দ্ধনের আকৃতি ছিল দৈর্ঘ্য-১১৫ কি.মি. (৬৪ মাইল) বিস্তৃতি, ৭২ কি.মি. (৪০ মাইল) এবং উচ্চতা ২৯ কি.মি. (১৬ মাইল)। বর্তমানে গোবর্দ্ধনের উচ্চতা মাত্র ২৫ মিটার এবং বিস্তৃতি ২৯ কি.মি. (১৬ মাইল)। আদি বরাহপুরাণ অনুসারে, পরবর্তীতে ত্রেতাযুগে লঙ্কায় গমনের উদ্দেশ্যে শ্রীরামচন্দ্র ভক্ত বানরগণ সেতু নির্মাণ করছিলেন। ভক্তশ্রেষ্ঠ হনুমান রামচন্দ্রের নির্দেশে সেতু নির্মাণের উদ্দেশ্য গোবর্দ্ধনের নিকট গমন করেন। ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের সেবার উদ্দেশ্য গিরিরাজ তৎক্ষনাৎ হনুমানের সাথে গমন করতে সম্মত হন। কিন্তু সেতুর সন্নিকটে পৌঁছানোর পূর্বেই দৈববাণী ধ্বনিত হয় যে, “সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে এবং আর কোন পাথরের প্রয়োজন নেই” । দৈববাণী শ্রবণ করে হনুমান ব্যথিত হন এবং গোবর্দ্ধনকে স্ব-স্থানে রেখে আসেন। এতে গিরিরাজ অসুখী হলেন এবং বললেন, “তুমি আমাকে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের চরণকমলের স্পর্শ থেকে বঞ্চিত করেছ”। গিরিরাজ তৎক্ষণাৎ অভিশাপ দিতে উদ্যত হলেন। হনুমান ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। গিরিরাজের কষ্ট উপলব্ধি করে শ্রীরামচন্দ্র তৎক্ষণাৎ ঘোষণা করলেন” এই সকল সেতুর পাথরগুলো আমার চরণপদ্মের স্পর্শ লাভ করেছে। হে গোবর্দ্ধন, দ্বাপর যুগের শেষে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং অবতীর্ণ হয়ে তোমার নিকটে সখাপরিবৃষ্ট হয়ে খেলায় মত্ত হবেন এবং হাতের স্পর্শে তোমাকে উত্তোলনের মাধ্যমে ইন্দ্ৰদর্প চূর্ণ করবেন, তোমার পূজা আরম্ভ করবেন এবং কলিযুগে তোমার আরাধনায় ভক্তরা দিব্য প্রেমভক্তি লাভ করবে।”
গোবর্দ্ধনের আকৃতি
গোবর্দ্ধনের আকৃতি ময়ূরের মত । রাধাকুণ্ড ও শ্যামকুণ্ড হচ্ছে তাঁর চোখ। ডানঘাটি ও মানসীগঙ্গা হচ্ছে তাঁর দীর্ঘ গলদেশ । মুখারবিন্দ স্থান হচ্ছে তাঁর মুখ। কুসুম সরোবর হচ্ছে তাঁর মুখমণ্ডল এবং পুনচেরী হচ্ছে তাঁর পিঠ এবং লেজের পালক ।
আগামী ৩০শে অক্টোবর চট্টগ্রামস্থ শ্রীপুণ্ডরীক ধামে, ১লা নভেম্বর সীতাকুণ্ডের বারৈয়াঢালা “শ্রীশ্রীরাধামাধব” ইস্কন মন্দিরে এবং ২রা নভেম্বর প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরে শ্রীশ্রীগিরি গোবর্দ্ধন পূজা, অন্নকুট ও শ্রীল প্রভুপাদের তিরোভাব তিথি উদযাপিত হবে।
আশা করি আপনারা সকলে গোবর্দ্ধন পূজা ও অন্নকুট উৎসবে অংশগ্রহণ করে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিশেষ কৃপা প্রাপ্ত হবেন । হরেকৃষ্ণ