খালি খাম

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৪ | ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ৩০ আগস্ট ২০২৪ | ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 14 বার দেখা হয়েছে

খালি খাম

অর্থহীন ও বাগ আড়ম্বরপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান খালি খামের মতোই মূল্যহীন।

ব্রজবিহারী দাস


বৈদিক নিয়মাদির মানে কী?

বৈদিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রচলিত রীতিনীতিগুলো আসলে অন্ধ বিশ্বাস, নাকি এর পেছনে বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে? একটি খামের অভ্যন্তরে কিছু মূল্যবান বস্তু থাকে। প্রকৃতপক্ষে খামের ভেতরের বস্তুটিই গুরুত্ব বহন করে, খামটি নয়। একইভাবে আধুনিকতা তথাকথিত ফ্যাশন জোলসে উদ্ভাসিত অর্থহীন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান হল খালি খামের মত। যা সুসম্পন্ন হলেও অসার বা ঠিকভাবে সম্পন্ন না হলেও অপরাধে পরিণত হয়। এটি ঠিক বস্তুহীন খালি খামের মতো। যেটি অন্যকে উপহার দেওয়া মানে তাকে অপমান করা এবং তার কাছ থেকে প্রত্যুপহার পাওয়ার সুযোগ হারানো।

লৌকিক ধর্মের ঊর্ধ্বে গমন:

২৫ বছর বয়সী একজন যুবক নিতিন ব্যক্ত করেছেন কেন সে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলোর প্রতি সন্দিহান। তিনি বলেন, “আমি আমার এক বন্ধুর বিয়েতে গিয়েছিলাম। সেখানে পুরোহিত বর-বধূকে পবিত্র কৃত্যগুলো সম্পন্ন করার জন্য ডাকল এবং অন্যান্যরা বিবাহ অনুষ্ঠান উপভোগ করছিল। পুরো অনুষ্ঠানস্থলটি সংস্কৃত মন্ত্রের ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল। তখন একটি প্রতিবাদী কণ্ঠ শোনা গেল; উপস্থিত অতিথিদের মাঝে একজন সংস্কৃতি বিষয়ক পণ্ডিত/অধ্যাপক বিবাহ-বহির্ভূত মন্ত্রের উচ্চারণ দেখে প্রতিবাদ করেছিল। তিনি সাথে সাথে ঐ মন্ত্রের অর্থসহ বলে দিলেন এবং বললেন যে এ মন্ত্র কারো অন্ত্যষ্টিক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়। এই ঘটনাটি আমাকে ভীষণ মর্মাহত করেছিল এবং উপলব্ধি করলাম যে কেউই এ ধর্মীয় রীতি-নীতি সমূহের ভাবার্থ ও গুরুত্বকে তোয়াক্কা করে না।”

আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় জগা খিচুড়ি:

ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা বিষয়ে নিতিনের এ অবিশ্বাস ও সন্দেহ অকারণ নয়। সে ছোটবেলা থেকে ধর্মের নামে বিভিন্ন সহিংসতা, অসহনশীলতা ও অত্যাচার দেখেছে। ভারতে শ্রী গণেশ পূজায় নারী-পুরুষেরা অত্যন্ত কামার্ত ভঙ্গিতে নাচে এবং গণেশমূর্তিকে একজন বিখ্যাত বলিউড অভিনেতার, রাজনীতিবিদ বা ক্রিকেটারের সাজে সাজানো হয়।
কয়েকদিনের এ উৎসবগুলোতে কেবল ঐশ্বর্যের নির্লজ্জ প্রদর্শনী, অসার আচার ও রাজনৈতিক প্রচারণাই চলে। সেখানে প্রকৃত আধ্যাত্মিকতার কোন ছোঁয়াই থাকে না। ফলে, নিতিনের মতো বুদ্ধিমান তরুণের এ রকম অন্তঃসারশূন্য উৎসাবাদি ও আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হওয়াটা আশ্চর্যের কিছু নয়।

ধর্মীয় রীতিনীতির লক্ষ্য হল হৃদয়ের সুপ্ত প্রেমকে জাগ্রত করা:

ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ধর্মভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয় এবং তা নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে উদ্যাপন করা হয়। এর মাধ্যমে মানুষ ধর্মের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে বা একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। উপরোক্ত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলো যা মানুষকে আমৃত্যু পালন করতে হয় তা প্রচুর সময়, অর্থ ও শ্রমসাপেক্ষ।
যাহোক, এ সকল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের লক্ষ্য হল জীবের হৃদয়ে ভগবানের প্রতি সুপ্ত ভালোবাসাকে জাগরিত করা। “সমস্ত মানুষের পরম ধর্ম হচ্ছে সেই ধর্ম যার দ্বারা ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞানের অতীত শ্রীকৃষ্ণে অহেতুকী এবং অপ্রতিহতা ভক্তি লাভ করা যায়। সেই ভক্তির বলে অনর্থ নিবৃত্তি হয়ে আত্মা যথার্থ প্রসন্নতা লাভ করে। (ভাগবত ১/২/৬)
এ ভক্তি যদিও স্বাভাবিক, কিন্তু তা বর্তমানে জড়চেতনার দ্বারা আচ্ছাদিত। তাই, প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসের প্রতিষ্ঠাতা বা শিক্ষকেরা কিছু আচার-পদ্ধতি প্রণয়ন করেন যার দ্বারা মানুষ ধীরে ধীরে এ জড় চেতনাকে পরিশুদ্ধ করে সে ভক্তিকে প্রকাশিত করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ: ভক্তরা শ্রীকৃষ্ণকে আরতিকালে সুগন্ধি ধূপ, দীপ, জল নিবেদন করেন, এসব দ্রব্য ভগবানকে নিবেদন করার মাধ্যমে ভক্তরা এটা উপলব্ধি করে যে ভগবানই এ সুগন্ধি, অগ্নি জলসহ সবকিছুর উৎস। (গীতা ৭/৪ ও ৭/৯)
ভগবানই যে সবকিছুর উৎস এবং প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুর জন্য আমরা তাঁর উপর নির্ভরশীল এ কথা একজন ভক্ত মনে-প্রাণে স্বীকার করেন। আরতির মাধ্যমে আমরা যে সকল দ্রব্য শ্রীকৃষ্ণকে কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা জানানোর জন্য নিবেদন করি। এভাবে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান গুলো একটি খামের ভূমিকা পালন করে যা আমাদের ভালোবাসা নিবেদন প্রভৃতি বহন করে। আচার-অনুষ্ঠানের এ মোড়কটি অনেক জাঁকজমক হলেও তা যদি ভগবানের প্রতি প্রেমময়ী নিবেদনে পূর্ণ না থাকে তাহলে তা একটি খালি উপহার বাক্সের মতোই প্রতীয়মান হয়।

আমরা কি এ আচার-অনুষ্ঠান ছাড়া চলতে পারি?

না! সেগুলো প্রয়োজনীয়। এমনকি আমাদের মত জড়বিষয়ে নিমজ্জিত মানুষের জন্য তা অপরিহার্য। বস্তুগত কার্যকলাপ ও আচার-অনুষ্ঠান একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ঐশ্বর্যমণ্ডিত মন্দির, ঝলমলে বিগ্রহের পোশাক, সমবেত নৃত্য- কীর্তন, ভক্তদের সেবা প্রভৃতি মাধ্যমে প্রতেককে ভগবানের সাথে আরো গভীরভাবে সংযোগ স্থাপনে সাহায্য করে। নোংরা স্থান, খামখেয়ালি ও সদাচারবর্জিত ব্যবহার এবং শৃঙ্খলাহীন অভ্যাসের দ্বারা বিপরীত পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা ভক্তকে চিন্ময়স্তর হতে বিচ্যুত করে। যদিও ভগবানের সাথে একাত্ম হতে আমাদের ভেতরের দিকটিই মুখ্য, কিন্তু বাহ্যিক পরিবেশ ভেতরের দিকটিকে প্রভাবিত করে। মনের ভেতরের ভাবটিই হল আসল, কিন্তু বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানগুলো মনের যথার্থ ভাবকে সুরক্ষা দেয়। তাই বলা হয়, Spirit (চেতনা) ও ritual (আচার-অনুষ্ঠান)-এ দুয়ের সমন্বয়ে হয় Spritual (আধ্যাত্মিক)।
ভগবানের সাথে সংযোগ স্থাপনের বিষয়টি বাদ রেখে যখন বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের দ্বারা আমরা প্রভাবিত হই তখন এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হারিয়ে যায়। ট্রাফিক আইনেরও একটি উদ্দেশ্য রয়েছে; চালককে তার গন্তব্যে যেতে সাহায্য করা। যদি চালক তার গন্তব্য সম্পর্কেই অবগত না হয় তাহলে এত কঠোরভাবে ট্রাফিক আইন মেনে চলাই অর্থহীন। একইভাবে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের লক্ষ্য যদি ভগবানের কাছে ফিরে যাওয়া না হয়, তাহলে ধর্ম পালন করেও সে জড়জগতেই আবদ্ধ হয়ে থাকবে। তখন ধর্ম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যা প্রাপ্য তার বিপরীত প্রাপ্তি ঘটবে; কেবল জড়বন্ধনই দৃঢ় হবে। ভগবানের সাথে ভক্তের প্রেমময়ী সম্পর্ক, সকল জীবকে করুণাময় ভগবানের সন্তান হিসেবে দেখতে ভক্তকে সাহায্য করে। (গীতা ৫/১৮)।
এ দৃষ্টি মিথ্যা অহংকার নাশ করে, হৃদয়কে কোমল করে এবং সকল জীবের প্রতি প্রেম ও দয়া বর্ধিত করে তোলে। যে ব্যক্তি এ ধরনের দৃষ্টি বা অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত হয়নি, সে মানসিকভাবে মিথ্যা সাম্প্রদায়িক দম্ভে ফুলে- ফেঁপে থাকে, এমনকি একই সম্প্রদায়ের ভেতরেও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পার্থক্য ঘটে, এক শ্রেণির মানুষ অন্য আরেক শ্রেণির মানুষদের থেকে অধিকতর ভালো আচার নিষ্ঠ হিসেবে জাহির করতে ব্যস্ত। এতে, তারা উভয়ই এ অনুষ্ঠানসমূহের মূল লক্ষ্য হারিয়ে ফেলে। ফলস্বরূপ, তরুনরা এ সকল অসার ও শূণ্য ধর্ম অনুষ্ঠানের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয় এবং এগুলোকে সমাজের সর্বনাশের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে।
ধমীয় আচারের উদ্দেশ্য ভগবানকে স্মরণ: ষোড়শ শতাব্দীর একজন বৈষ্ণব আচার্য শ্রীল রূপ গোস্বামী ভক্তি অনুশীলনের পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি প্রণয়ন করছেন। তিনি ব্যক্ত করেছেন যে সকল নিয়মাদি পালনের উদ্দেশ্য হল অনুকূলভাবে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করা।

স্মর্তব্যঃ সততং বিষ্ণুর্বিস্মর্তব্যো ন জাতুচিৎ।
সর্বে বিধিনিষেধাঃ স্যুরেতয়োরেব কিঙ্করাঃ॥

“সর্বদা বিষ্ণুকে স্মরণ করা উচিত এবং কখনই তাঁকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়, সমস্ত বিধি ও নিষেধ এই দুইটি কথার অনুগত।” এই শ্লোকটি পদ্ম-পুরাণ থেকে উদ্ধৃত।
প্রত্যেকেরই নিজের আদর্শ আচরণে ফলে শ্রীকৃষ্ণকে সেবা করার বাসনা জাগরিত হয়, হৃদয় মার্জিত হয়, স্বার্থপর চিত্ত নিঃস্বার্থ হয়, অহংকার বিনয়ে রূপান্তরিত হয়, ঈর্ষা প্রশংসায় পরিণত হয়। যদি ধর্ম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ সকল পরিবর্তন সাধিত না হয়। হৃদয়ে কৃষ্ণপ্রেম উদ্দীপন না হয়, তাহলে বহুবর্ষ যাবৎ ধর্মাচরণ করলেও তা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
(ভাগবত ১/২/৮) একজন ভক্ত ঐকান্তিকভাবে নিয়মাদি অনুসরণ করেন কিন্তু সেই সাথে স্থান-কাল পাত্রও বিবেচনা কারণে। উদাহরণস্বরূপ: শ্রীল রূপ গোস্বামী বলেছেন যে শ্রীবিগ্রহকে জাঁকজমক পোশাক পরানো উচিত। কিন্তু আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোতে যখন শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীশ্রী জগন্নাথ, বলদেব ও সুভদ্রা মহারাণীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন আর্থিক অবস্থার দুর্বলতার করেন তিনি বিগ্রহের পোষাকের চেয়ে ভক্তিবর্ধক কার্যক্রম-কীর্তন, দীপ নিবেদন, আরতি এবং প্রসাদ বিতরণ প্রভৃতিতে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। এক্ষেত্রে শ্রীল প্রভুপাদ রূপ গোস্বামীপাদের নিয়মাটিকে স্থান- কাল-পাত্র অনুসারে সমন্বয় করেছেন, কিন্তু ভাবটিকে একই রেখেছেন।
যদি কারো সামর্থ্য থাকে, সে ভগবানকে সমস্ত দ্রব্যাদি সহকারে আরাধনা করতে পারে। যার সামর্থ্য নেই সেও কেবল পত্র, পুষ্প, ফল ও জল দিয়ে ভগবানের পূজা করতে পারে। শ্রীকৃষ্ণের আরেক নাম ভাবগ্রাহী জনার্দন, যিনি বস্তুর দিকে মনোযোগী নন, বরং নিবেদিত বস্তুর পেছনে যে প্রেম-ভক্তি রয়েছে তা-ই তিনি গ্রহণ করেন। তিনি আমাদের অভিলাষ, মনোভাব ইত্যাদি সারবস্তুটিই গ্রহণ করেন। ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠানের সময় যদি আমরা এ বিষয়টি মনে রাখি তাহলে আমাদের শ্রীকৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যটি সাধিত হবে।

আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের চেয়ে সরলচিত্তের নিবেদন অধিক কার্যকরী:

শুষ্ক আচার অনুষ্ঠানের চেয়ে শ্রীকৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করার আগ্রহই তাঁর কৃপা পাওয়ার ক্ষেত্রে অধিক কার্যকরী। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর লীলার মাধ্যমে ৫০০০ বছর আগেই গোপবালক রূপে সেই শিক্ষা আমাদের দিয়েছেন।
একবার কৃষ্ণ তার বন্ধুদেরকে নিকটস্থ যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণদের কাছে কিছু খাবার আনতে পাঠিয়েছিলেন। ব্রাহ্মনেরা আচার-অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন করার কাজে ব্যস্ত ছিল এবং অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে ভোগেরও আয়োজন করেছিল। কিন্তু তারা শ্রীকৃষ্ণের সখাদের অনুরোধ গ্রাহ্য না করে বরং যজ্ঞ সম্পাদনে ব্যস্ত রইল। শ্রীকৃষ্ণই হলেন সমস্ত জ্ঞান ও যজ্ঞের ভোক্তা (গীতা ১৫/১৫), কিন্তু তথাকথিত বিদ্বান ব্রাহ্মণেরা এ গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বটি হারিয়ে ফেলেছিল। কারণ তারা বাহ্যিক আচারকেই প্রাধান্য দিয়েছিল এবং শ্রীকৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় নি। যেমন, একজন ব্যক্তি ওভারটাইম কাজ করেও বেতন নেওয়ার সময় যদি ব্যস্ত থাকে তাহলে তার কাজ করার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়। তদ্রূপ, আমাদের সমস্ত যজ্ঞ ও তপস্যার লক্ষ্য হল শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি অর্জন। এখানে, শ্রীকৃষ্ণ ব্রাহ্মণদের নৈবেদ্য এবং উপহার গ্রহণ করে তাদেরকে কৃপাশির্বাদ প্রদান করতে চাইলেন, কিন্তু তার। আচার-অনুষ্ঠানে ব্যস্ত। কারণ, জাগতিক পাণ্ডিত্য ও দক্ষতার কারণে শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে তাদের ধারণা ঝাপসা ছিল।
সখারা বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসলে শ্রীকৃষ্ণ তাদেরকে ব্রাহ্মণ-পত্নীদের কাছে যেতে আদেশ দিল। ব্রাহ্মণপত্নীরা ব্রাহ্মণদের মত ততটা শাস্ত্রপারদর্শী ছিল না কিন্তু তাদের অন্তর ছিল সরল। ফলে, গোপবালকদের খাদ্য চাওয়ার অনুরোধ পেয়েই তারা গৃহে যা ছিল সবকিছু নিবেদন করল। যদিও তাদের স্বামী পিতা, পুত্রাদি সকলে তাদেরকে যেতে নিষেধ করেছিল, কিন্তু ব্রাহ্মণপত্নীদের কৃষ্ণভক্তি ছিল অপ্রতিহতা। পরবর্তীতে ব্রাহ্মণেরা তাদের ভুল বুঝতে পেরে নিজেদের বিদ্যাকে ধিক্কার দিতে লাগল এবং তাদের পত্নীদের প্রশংসা করতে লাগল। শ্রীকৃষ্ণ হলেন আমাদের নিত্য স্নেহশীল পিতা, যিনি আমাদেরকে তাঁর কাছে ফিরে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমান। যে ব্যক্তি শ্রীকৃষ্ণের সাথে সম্পর্কের কথা ভুলে যায় সে চিন্ময় আনন্দ হতে বঞ্চিত হয়। তার সকল আড়ম্বরপূর্ণ ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত ধর্ম আচরণ সত্ত্বেও সে কেবল মধুর বোতল চাটছে, কিন্তু মধুর আস্বাদন সে কখনো পায় না।

বর্তমানে যুগের জন্য নিধারিত ধর্মপন্থা

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রেম অবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বর্তমান কলিযুগের জন্য হরেকৃষ্ণ সংকীর্তনের প্রর্বতন করেছেন, যা শ্রীকৃষ্ণের সাথে আমাদের নিত্য সম্পর্ককে পুর্নজাগরিত করার সরল পন্থা। জপ করার সর্বপ্রথম ফলস্বরূপ আমাদের হৃদয়ের জড়কলুষ পরিমার্জিত হয় এবং সুপ্ত কৃষ্ণপ্রেম জাগরিত হয়। যদিও হরিনাম জপে কোন বিধি নিষেধ নেই। কিন্তু যান্ত্রিকভাবে তোতাপাখির মত জপ করার মাধ্যমে জপের ফল “কৃষ্ণপ্রেম” লাভ করা যায় না। শ্রীল প্রভুপাদ ভক্তদের মাতৃহারা ক্রন্দনরত শিশুর মনোভাব নিয়ে জপ করার শিক্ষা দিয়েছেন। বিপদাপন্ন শিশুর মাকে ডাকার যে অনুভূতি তা কোন অন্ধ-অসার-শুষ্ক ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নয়। বরং তা হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশের আকূল আবেদন। তাই হরিনাম উচ্চারণের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য এ অসহায় ভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পক্ষান্তরে জড় স্বাচ্ছন্দ্যে থাকা মানুষ ঐকান্তিকভাবে দিব্য নাম উচ্চারণ করতে পারে না।

আধ্যাত্মিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

দিব্যশাস্ত্রসমূহ প্রহ্লাদ মহারাজ, গজেন্দ্র, কুন্তিদেবীর মত মহান ব্যক্তি ও শুদ্ধভক্তদের প্রার্থনায় পূর্ণ। একজন ভক্ত এ সমস্ত প্রার্থনা কেবল গৎবাধা নিয়মপালনের জন্য উচ্চারণ করেন না। পক্ষান্তরে, এ প্রার্থনা গুলোর মাধ্যমে সে সমস্ত মহান ব্যক্তিদের হৃদস্থিত ভাবসমূহ লাভ করার প্রয়াস করেন, এবং প্রাথনাগুলোর মমার্থ অনুধাবন করার চেষ্টা করেন। শ্রীকৃষ্ণের কৃপা লাভের বাসনায় একজন ভক্ত পূর্ববর্তী আচার্যদের প্রার্থনাগুলো এবং সেই সাথে নিজের প্রার্থনাও নিবেদন করেন। ইস্কন মন্দির বা কেন্দ্রগুলোতে ভগবানকে ভালোবাসার জ্ঞান ও ব্যবহারিকভাবে ভালোবাসার চর্চা-উভয়ই একই সাথে শিক্ষা দেওয়া হয়। তাই, শ্রীল প্রভুপাদ ইস্কন মন্দিরগুলো একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তুলনা করেছেন।
যদি নিতিনের মতো যুবকেরা ইস্কন মন্দিরগুলো দর্শন করেন, তাহলে ভারতীয় আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডল ও ধর্ম সম্পর্কে তাদের যে সন্দেহ, ও ভুল ধারণা তা দূর হয়ে যাবে। যদি যথার্থ শুদ্ধভক্তদের হাতে সমাজের পরিচালনার ভার ন্যস্ত হয়, তাহলে সকলে শ্রীকৃষ্ণের কাছে তাদের হৃদয় অর্পণ করার শিক্ষা লাভ করতে পারবে।


ব্যাক টু গডহেড অক্টোবর – ডিসেম্বর ২০১৮ হতে প্রকাশিত

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।