এই পোস্টটি 308 বার দেখা হয়েছে
আমরা আমাদের সমস্ত আশা কি একজন অব্যর্থ ক্রীড়াবিদের উপর ছেড়ে দেব নাকি ব্যর্থ একাদশের ওপর ?যুগাবতার দাস২৩ মার্চ ২০০৭ তারিখ ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের একটি বিপর্যয়ের দিন। যখন সমগ্র জাতি বিশ্বকাপে ভারতের বিজয়ের জন্য প্রার্থনা করছিল, তখন সেই ভারতীয় ক্রিকেট একাদশ সৈনিকগণ ব্যর্থ হলেন- বিজয় লাভে সমগ্র দেশের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলেন এবং আমাদের পুনরায় আনন্দ উপভোগ করাতে ব্যর্থ হলেন।
দল হেরে যাওয়ায়, কেউ কেউ হয়তোবা তাদের ক্রিকেট হিরোদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছেন এবং কেউ কেউ ভগবানের প্রতিও বিশ্বাস হারিয়েছেন। কিন্তু যখন ১৬টি দেশের মানুষ একইসাথে ভগবানের কাছে তাদের দলের বিজয়ের জন্য প্রার্থনা করে, তখন ভগবানের পক্ষে কিরূপে বিচার করা সম্ভব? পক্ষান্তরে মানুষই ভগবানের উপদেশ ভুলে গিয়ে জড় কামনা পূরণের জন্য ভগবানের পূজা করে এবং ভগবানকে পরাজয়ের জন্য দোষারোপ করে ।
আমরা সকলেই ক্রিকেটের আনন্দ উপভোগ করতে চাই কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সেই আনন্দ নির্ভর করে এগারজন লোকের পারফরমেন্সের ওপর। যাদের পারফরমেন্স কেমন হবে তা কেউ বলতে পারে না, সেই সব তারকাদের প্রতি আমাদের মন, ইন্দ্রিয় অর্পণ করছি কিন্তু যিনি সূর্যের মত তেজস্বী এবং যিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে জানেন, আমরা সেই ভগবানের শরণাগত হচ্ছি না।
আমাদের অবশ্যই গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত : “দিনে ৮ ঘন্টা ক্রিকেট খেলা দেখে অতিবাহিত করা কি মহামূল্যবান সময়ের অপচয় নয়?” যখন সাধুরা ক্রমাগতই আমাদের বোঝাচ্ছেন যে, মানব জীবনের একটি সেকেন্ডও কোটি টাকা খরচ করে পুনরায় পাওয়া সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুশয্যায় থাকা একজন মুমূর্ষ রোগীই জানেন তার জীবনে অবশিষ্ট থাকা প্রতিটি সেকেন্ডের গুরুত্ব কতটুকু এবং তিনি সর্বদাই সেই অবস্থায় তাঁর জীবনে অপচয় করা সময়গুলোর জন্য বিলাপ করতে থাকেন ৷
ক্রিকেট জ্বরম্যালেরিয়া, টাইফয়েড এবং ক্রিকেট হল ভারতের প্রধান রোগসমূহের অন্যতম। যখন আমি জ্বরে আক্রান্ত কোন রোগী দেখি, তখন আমি অন্তর্মুখী দৃষ্টিতে একজন বিষে আক্রান্ত মানুষকে দেখি, যিনি সকল প্রকারের রুচি হারিয়েছেন, তিনি খাওয়া, ঘুমানো, হাঁটা কিংবা কাজ করতে অক্ষম। ঠিক তেমনি একজন রোগী যিনি ক্রিকেট জ্বরে আক্রান্ত তিনি ক্রিকেট চ্যানেলে আঠার মত আটকে থাকেন এবং সেখান থেকে উঠা কিংবা কাজ করায় অপারগতা প্রকাশ করেন। এমনকি তিনি সেইদিন কোনো গঠনমূলক কার্য সাধন থেকে বিরত থাকেন। ধীরে ধীরে এই ধরনের আকর্ষণ এমন চরম মাত্রায় পৌঁছায় যে, তিনি পারমার্থিক জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। উপরন্তু তিনি টিভি উপভোগ করার মুহূর্তে ক্ষতিকর খাবার (ফাস্টফুড) গ্রহণ করে থাকেন। ক্রিকেটাররা নিজেদের দেহ সুস্থ রাখার জন্য নিয়মিত শরীরচর্চা করে থাকেন কিন্তু সেই ক্রিকেট খেলার দর্শকগণ সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়ভাবে আট ঘন্টা ম্যাচে একই স্থানে অতিবাহিত করেন এবং মুখে পটেটো চিপস ক্রমাগত গলাধঃকরণ করতে থাকেন।
ক্রিকেট সংক্রমণপ্রতিটি রোগের পেছনে সংক্রামক কাজ করে থাকে এবং ক্রিকেটেও সংক্রামক রয়েছে। ক্রিকেট ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ে অন্যান্য ক্রিকেট আসক্তি থেকে। যেমন খাওয়ায় ক্রিকেট, লেখাপড়ায় ক্রিকেট এবং আলোচনাতেও ক্রিকেট। বিভিন্ন সংবাদপত্র, চ্যানেলসমূহ এই ভাইরাস মজুদ রাখেন। যদি আপনি সেগুলোতে ভ্রমণ করেন তবে সেই রোগ আপনাতে সংক্রমিত হবে। তাই এই ক্রিকেট জ্বর থেকে মুক্ত হতে হলে অবশ্যই এই সমস্ত ভাইরাসের মজুদখানা থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
ক্রিকেট কী আমাদের ধর্ম ?যখনই জ্বরের মাত্রা অধিক বৃদ্ধি পায়, রোগী তখন অলীক অস্তিত্বে বিশ্বাসী হয়। যেমন অনেক ভারতবাসী ক্রিকেটকে তাদের ধর্ম এবং শচীনকে তাদের ভগবান বলে মনে করেন। এই উচ্চমাত্রার জ্বর তাদের মস্তিষ্ককে গ্রাস করে। ক্রিকেটের আনন্দ তখনই শুরু হয়, যখন আমরা ধর্মকে ভুলে যাই। কিন্তু যদি আমরা প্রকৃত ধর্মানুশীলনে রত হই তবে আমরা অসীম আনন্দ লাভ করতে পারব।
ভগবানের সম্মুখে হরিনাম কীর্তন ও নৃত্যে যে অপরিসীম আনন্দ, তা স্টেডিয়ামে আমাদের হিরোগণ কর্তৃক ছক্কা হাকানোর পর আমাদের আনন্দ অপেক্ষা অসীমগুণ বেশি। ক্রিকেটে উইকেট পতনের মত আমাদের জড় নৃত্যের সাথে সাথে আমরা জড় মায়ার অন্ধকূপের এক গভীরতলে পতিত হচ্ছি। যদি আমরা এই জগতে ক্রিকেট খেলা উপভোগেই রত হই, তবে আমরা নিত্যকাল ধরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হব। তখন সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলে আমাদের জীবনটি হবে একটি মেডেন ওভারের মত শূণ্য বা নিষ্ফল। আমরা জানি, সনাতন ধর্ম হচ্ছে আমাদের ধর্ম এবং কৃষ্ণ হলেন ভগবান। ধর্ম হল আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ঠিক যেমন চিনির ধর্ম হল মিষ্টতা। আত্মার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই হল ভগবানের সেবা করা। যখন জীব ভগবানের সেবা করে তৎক্ষণাৎ সে আনন্দ ও সন্তুষ্টি লাভ করে। আমাদের আনন্দ আমাদের পছন্দনীয় দলের বিজয়ের ওপর নির্ভর নয়। যেমন-ভারত ১৯৮৩ সালে একবার বিশ্বকাপ জেতে কিন্তু পরক্ষণেই তারা একনম্বর স্থান হারিয়ে ফেলে। খেলায় আনন্দ লাভের সম্ভাবনা সর্বদাই ৫০ ভাগ বিদ্যমান থাকে। কেননা খেলোয়াড়রা নিজেরাই বিজয়ের শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তাহলে কেন আমরা আমাদের আনন্দ লাভের জন্য এগার জন খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভর করব? কেননা কৃষ্ণ আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন আমরা যদি ক্রিকেট ধর্মসহ আমাদের সমস্ত ধর্ম পরিত্যাগ করে তাঁর শরণাগত হই তবে তিনি আমাদের সর্বোচ্চ আনন্দ প্রদান করবেন এবং আমাদের সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করে চিন্ময়ধামে গমনের সুযোগ প্রদান করবেন।
ডাক্তারগণ আমাদের উপদেশ দিয়ে থাকেন যে, প্রতিরোধ প্রতিকারের চেয়ে উত্তম। আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা তখনই সম্ভব যখন আমাদের প্রতিরোধশক্তি থাকবে এবং আমাদের প্রতিরোধ শক্তি বাড়াতে হলে আমাদের নিয়মিতভাবে পথ্য গ্রহণ করতে হবে, হরিনামের পথ্য গ্রহণ করতে হবে, যেটি আমাদের সকল প্রকারের জাগতিক উৎকণ্ঠা ও আসক্তি থেকে মুক্ত করে শক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। অপ্রাকৃত কৃষ্ণপ্রসাদ গ্রহণ এবং নিয়মিত শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ আমাদের হৃদয়ের সমস্ত ক্লেশ দূর করে। আমাদের জীবনের শেষ খেলা (মৃত্যু) শুরু হওয়ার পূর্বেই চলুন আমরা সেই অব্যর্থ ক্রীড়াবিদের গুণকীর্তন করি যিনি কখনোই কোনো খেলায় হারেন না। এমনকি তিনি শৈশবেও ভয়ংকর পুতনাকে হত্যা করেছিলেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে অঘাসুরকে বধ করেছিলেন। তিনি সাত বছর বয়সে দেবরাজ ইন্দ্রকে এবং আট বছর বয়সে কংসকে পরাজিত করেছিলেন।
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণই একজন প্রকৃত অব্যর্থ ক্রীড়াবিদ, তিনি কখনোই আমাদের হতাশ করবেন না। যদি আমরা আমাদের হিরোরূপে তাঁর শরণাগত হই, তবে তিনি আমাদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছেন আমরা অবশ্যই জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি থেকে মুক্ত হয়ে নিত্য আনন্দ ও মুক্তি লাভ করতে পারব। আমাদের আত্মায় এমন এক সত্ত্বা রয়েছে যা স্বাভাবিকভাবেই কৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলায় পরমানন্দ লাভ করে, যা অত্যন্ত রোমাঞ্চকর। কৃষ্ণ কখনোই পরাজিত হন না, তাই তার এক নাম অচ্যুত। কৃষ্ণ অব্যর্থ খেলোয়াড়, কিন্তু আমাদের তথাকথিত দেবতা সদৃশ ক্রিকেটাররা হলেন ব্যর্থ সৈনিক। তারা ভগবান নন এবং ক্রিকেট আমাদের ধর্মও নয়। হরিনাম জপকীর্তনই আমাদের প্রকৃত ধর্মীয় সেবা এবং শ্রীশচীনন্দন হলেন আমাদের ভগবান।
(যুগাবতার দাস মুম্বাইয়ের কেইএম হাসপাতালের এ্যানাটমি বিভাগের একজন প্রফেসর হিসেবে কর্মরত আছেন এবং তিনি নিয়মিত BTG’র সেবা করছেন )
ত্রৈমাসিক ব্যাক টু গডহেড, জানুয়ারী – মার্চ ২০১৪ |
|