এই পোস্টটি 171 বার দেখা হয়েছে
তনা শুদ্ধির জন্য কৃষ্ণ মাঝে মাঝে স্বাস্থ্যহানির মতো দুর্দশাময় অবস্থায় নিপতিত করেন।
বংশীবিহারী দাস
সাতদিন অসুস্থ থাকার পর, ম্যালেরিয়া জ্বর আমার হাড়গুলোকে বিকল করে দিয়েছে, ক্ষুধা কমিয়ে দিয়েছে, হ্যালুসিনেশন শরীরের দুরবস্থা বাড়িয়ে দিয়েছে। দৈনন্দিন হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করতে আমি রীতিমত সংগ্রাম করছিলাম। কিন্তু ঐ সাতদিনে আমি যা অর্জন করেছি তা অসুস্থ না হলে হয়তো অর্জন করতে পারতাম না।
আমাদেরকে এ সত্য গ্রহণ করতেই হবে যে, একসময় আমরা রোগ-ব্যাধিতে সংক্রমিত হব। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (৮/১৫) ব্যাখ্যা করেছেন, এই জগৎ হল দুঃখের কারাগার তাই আমরা যেই হই না কেন, এতটা আশাবাদী হতে পারি না যে, আমাদের রোগ ব্যাধি হবেই না। এক্ষেত্রে, যদি আমাদের সঠিক মনোভাব থাকে তবে কৃষ্ণভাবনা আমাদেরকে অসুস্থতার সময় আবেগে ভেঙে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে।
শারীরিক অন্যান্য দুর্দশা ছাড়াও আমরা অসুস্থতার দুর্দশা মোটেই পছন্দ করি না কেননা তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে স্তিমিত করে দেয়। আমাদের জীবন কোন বিশেষ কার্যে কেন্দ্রীভূত থাকে, এই যেমন ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা অন্য কোন কাজ এবং তা যদি কোনো কারণে থমকে যায় তখন তা ভীতিকর বলে মনে হয়।
এক্ষেত্রে আমার অসুস্থতা আমার পারমার্থিক জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়েছিল, তাই যখন আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি, আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি, “কেন আমরা ভাবি যে, কৃষ্ণসেবা করার জন্য কেবল সুস্বাস্থ্যই অনুকূল। অসুস্থতা যখন আমাদের স্তিমিত করে দেয় তখনও কি আমরা কৃষ্ণসেবা করতে পারি না?”
অসুস্থতা ভক্তিবিরুদ্ধ হতে পারে না। বরং এটি উচ্চ পারমার্থিক অবস্থা হতে পারে। ভক্তিমূলক সেবাকে যে কোন অবস্থায় অপ্রতিহত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। অন্য কথায়, কোন জাগতিক পরিস্থিতির শক্তি নেই ভক্তিমূলক সেবাকে রুদ্ধ করতে পারে । যদিও আমাদের শরীর ও অসুস্থতা হল জড় বিষয়, পক্ষান্তরে ভক্তিমূলক সেবা হল অপ্রাকৃত। অসুস্থতা হয়তো আমাদের শরীরকে অসাড় করতে পারে কিন্তু সঠিক দৃষ্টিকোণ বা মনোভাবের মাধ্যমে আমরা ঐ অবস্থায়ও আত্মতত্ত্ব স্তরে আচরণ করতে পারি। বৈদিক শাস্ত্রে এরকম অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে।
যেমন নামাচার্য শ্রীল হরিদাস ঠাকুর এমনকি বৃদ্ধ বয়সে অক্ষম অবস্থায়ও প্রতিদিন লক্ষ হরিনাম জপ করতেন। এমনকি মৃত্যুশয্যায় শায়িত হয়ে, শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীমদ্ভাগবত অনুবাদ সেবা অব্যাহত রেখেছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্য
আমার এক ভক্ত বন্ধু তার উপলব্ধি বিনিময় করেন যে, কৃষ্ণ তাঁর প্রতি আমাদের অভিযোগের ঝুঁকি পর্যন্ত গ্রহণ করেন। “ওহ্! কৃষ্ণ আমি তোমার সেবা করার চেষ্টা করছি, আর তুমি আমাকে এরকম সমস্যা দিচ্ছ। তুমি কিরকম ভগবান?” কিন্তু একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে, কৃষ্ণ আমাদের অভিযোগের পরিবর্তে তিনি যত দ্রুত সম্ভব আমাদের জড় চেতনার অবসান নিয়ে উদ্বিগ্ন। এজন্য তিনি আমাদেরকে প্রতিকূল পরিস্থিতি সহ্য করার শক্তিও প্রদান করেন।
একজন ডাক্তারের মতো রোগীর আরোগ্য বিধানের অভিপ্রায়ে কৃষ্ণ আমাদের শুদ্ধতার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। যদি ঐ অবস্থায় তাঁর প্রতি কোনো অভিযোগ বা দোষারোপ করা না হয়, তিনি তাঁর চিকিৎসা অব্যাহত রাখেন। এক্ষেত্রে যদি তিনি কোনো অসহযোগিতামূলক মনোভাব দর্শন করেন, তবে সেটি তাকে চিকিৎসা বন্ধ করতে বাধ্য করে। এজন্য আমাদের উচিত তাঁর প্রতি এই ভেবে কৃতজ্ঞ হওয়া যে, কৃষ্ণ আমাদের কল্যাণের জন্য কত শক্তি ব্যয় করছেন ।
দৈন্যতার শিক্ষা
অসুস্থতা আমাদের পারমার্থিক সম্পর্কে প্রকৃত স্তর প্রকাশ করে যে, আমাদের পারমার্থিক উপলব্ধির স্তর কতটা গভীর। এটি মূলত নির্ভর করে, যে কোন পরিস্থিতিতে কৃষ্ণভাবনা অনুশীলনের বাসনার ওপর। এরকম অবস্থায় আমরা নিজেদের দৈন্য অবস্থার প্রকাশকে দর্শন করতে পারি, যা আমাদের পারমার্থিক জীবনের জন্য সহায়ক। তাই অসুস্থতা আমাদের জীবনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে। আমরা এটিও উপলব্ধি করতে পারি যে, কৃষ্ণ আমাদেরকে এই রকম প্রতিবন্ধক অবস্থায় নিপতিত করেছেন, যাতে আমরা এই জড়জগতে আমাদের জীবন সুখের জীবন, সেই মোহ থেকে বেড়িয়ে আসতে পারি ।
অসুস্থতার সময় আমাদের কার্যকলাপ ও পারমার্থিক অনুশীলন হ্রাস পেলে এবং অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেলে তা আমাদেরকে মিথ্যা অহংকার পরিত্যাগে সাহায্য করে। অপরের সম্মুখে বিনম্র করে তুলতে পারে। কিন্তু কৃষ্ণ আমাদের শুদ্ধতা সম্পর্কের পুনস্থাপনের প্রতি বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। অসুস্থতা ইতিবাচক ভাবে গ্রহণ করতে পারি এই ভাবে উপলব্ধির মাধ্যমে যে, আমরা কতটুকু অসহায়। তাই সর্বাবস্থায় কৃষ্ণের আশ্রয় গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সম্পর্ক উন্নয়ন
আমার পূর্বে এরকম মনোভাব ছিল যে, যদি আমি কারো কাছ থেকে সেবা গ্রহণ না করি, তবে অন্যদেরও আমার কাছ থেকে সেবা প্রত্যাশা করা উচিত নয়। অসুস্থতা আমার এই ব্যক্তিত্বহীনতা ও স্বার্থপরতা শক্ত পাথরকে ভেঙ্গে দিয়েছে। অন্যের প্রতি যত্ন গ্রহণ করা বৈষ্ণব সদাচারের একটি আবশ্যকীয় উপাদান। এটি কৃতজ্ঞতার পথে পরিচালিত করে এবং সে সাথে পারস্পরিক সুসম্পর্ক উন্নয়নে সহায়তা করে। অন্যের কাছ থেকে সেবা গ্রহণ আমাদেরকে বিনম্র করে তুলে এবং বিনিময়ে তাদের প্রতি সেবা নিবেদনে অনুপ্রাণীত করে। আমরা সাধারণত এমনকি জাগতিক জীবনে নিজেদের শক্তিমত্তার নিরর্থকতা সম্পর্কে এবং সেসাথে অন্যের প্রয়োজন সম্পর্কে উপলব্ধি করি, তবে এক্ষেত্রে পারমার্থিক জীবনের কথা আর কি বলার আছে।
মাঝে মাঝে আমাদের ব্যস্ত দৈনন্দিন রুটিন কর্মস্থলে কিংবা ব্যক্তিগত জীবনে একে অপরের সন্নিকটে আসতে দেয় না কিন্তু অসুস্থতা অন্যের প্রতি আমাদের প্রয়োজন ও তাদের প্রার্থনার উপলব্ধির সুযোগ প্রদান করে। যখন আমরা অসুস্থ হই তখন ভক্তরা আমাদের কল্যানের জন্য প্রার্থনা করে ।
অসুস্থতা ভক্তদেরকে আরো নিবিড় ভাবে একে অপরের সান্নিধ্যে নিয়ে আসে। যখন কেউ অসুস্থ হয় তখন তার প্রতি সেবা নিবেদনের প্রয়োজন হয় এবং তখন তার প্রতি আমাদের ভালবাসা প্রদর্শনের একটি সুন্দর সময় চলে আসে। গত পাঁচ বছর ধরে মন্দিরে অনেক অসুস্থ ভক্তদের সেবা করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ঐ সময়ে অনেক ভক্তসঙ্গে আমার বন্ধুত্ব শুরু হয় কিংবা আরো প্রগাঢ় হয়।
যখন আমরা অন্যদের সন্তুষ্ট করি, বিশেষত কৃষ্ণ ভক্তদের তখন কৃষ্ণ তাঁর অপরিসীম কৃপা আমাদের ওপর বর্ষণ করে। তিনি সর্বদা তাঁর ভক্তদের সেবা করতে চান এবং যখন তিনি দেখেন যে এজন্যে আমরা তাকে সহায়তা করছি তিনি তখন প্রসন্ন হন। সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহানুভূতি অর্জনের ক্ষেত্রেও অসুস্থতা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
রোগব্যাধি আমাদের আসক্তিগুলোকে তুলে ধরে। কৃষ্ণ আমাদের শুদ্ধ করছেন এই জন্য আমরা কি আনন্দিত? নাকি আমরা আমাদের শরীর ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো হারিয়ে ফেলব এই জন্যে বিচলিত? একদিন না একদিন আমাদেরকে সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবেই।
প্রচলিত প্রবাদ আছে, “বন্ধ্যা কখনো প্রসব বেদনা অনুধাবন করতে পারে না।” আমাদের নিজেদের অসুস্থতা অন্যদের অসুস্থতা অনুভবে সহায়তা করে। যখন কেউ অসুস্থ হয় তখন তার প্রতি সেবা নিবেদনের জন্য আমরা অনুপ্রেরণা পাই।
অসুস্থতা, বিশেষত: দূরারোগ্য ব্যাধি, চিরদিন সবকিছু ভালভাবে অতিবাহিত হবে এরকম মোহময় বুদবুদের ধারণা বিদীর্ণ করে। পাণ্ডুবংশের শেষ উত্তরাধিকারী পরীক্ষিৎ মহারাজ এক সময় জানতে পারেন যে, তিনি আর মাত্র সাতদিনের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করতে যাচ্ছেন। এক সময় আমাদেরকেও এই রকম শুনতে হতে পারে, “আপনার জীবনের আর মাত্র চার মাস বাকী রয়েছে।” কিংবা “এখন থেকে আপনাকে এই ব্যাধি নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে।”
রোগব্যাধি আমাদের আসক্তিগুলোকে তুলে ধরে। কৃষ্ণ আমাদের শুদ্ধ করছেন এই জন্য আমরা কি আনন্দিত? নাকি আমরা আমাদের শরীর ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো হারিয়ে ফেলব এই জন্যে বিচলিত? একদিন না একদিন আমাদেরকে সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবেই। অসুস্থতা তার একটি নিদর্শন প্রদান করে এবং মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ প্রদান করে । পরম বৈষ্ণব সম্রাট কূলশেখর প্রার্থনা করেছিলেন, “হে কৃষ্ণ! আমি প্রার্থনা করি আমার মনরূপ রাজহংস যেন এখনই তোমার পাদপদ্মে ডুব দেয় এবং তাদের পিঞ্জরে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। অন্যথায়, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময় যখন আমার কণ্ঠ, কফ, বাত ও পিত্তে অবরুদ্ধ হবে, তখন তোমাকে স্মরণ করা কি করে সম্ভব হবে?” আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত এমন কৃষ্ণভাবনা এবং দেহগত চেতনা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা করা।
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, যদি কৃষ্ণ আমাদের জন্য কোন কিছু চান তবে তা আমাদের ভালোর জন্যই চান। আমি এরকম অনেক ভক্তের সান্নিধ্যে এসেছি যারা অনুভব করে যে, তাদের কৃষ্ণভাবনাময় জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় ছিল যখন তারা কোন প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। ঐ অবস্থায় অন্যকোন আশ্রয়ের অনুসন্ধান না করে তারা গভীরভাবে কৃষ্ণের আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন এবং অন্য যে কোন সময়ের চেয়েও অধিকভাবে কৃষ্ণের উপস্থিতি অনুভব করেছিলেন। এজন্যেই পাণ্ডবদের মহিমান্বিত মাতা কুন্তিদেবী কৃষ্ণের কাছে বারংবার দুঃখ দুর্দশা কামনা করেছিলেন। এর কারণ তিনি তুলে ধরেছিলেন এভাবে, “দুঃখ দুর্দশাগুলো আপনার সুন্দর মুখমণ্ডল দর্শনে আমাকে অনুপ্রাণীত করে। আমাদেরকে সাহসী কুন্তীদেবীকে অনুকরণ করে, অধিক দুঃখ প্রার্থনা করার প্রয়োজন নেই। পক্ষান্তরে কৃষ্ণের শরণাগত হওয়ার জন্য চেষ্টা করা উচিত।”
দেহের যত্ন গ্রহণ
আমরা যখন সুস্থ হয়ে উঠি কুন্তীদেবীকে অনুকরণ করে পুনরায় অসুস্থতাকে আমন্ত্রণ জানানোর কোন প্রয়োজন নেই। আবার অসুস্থতার সময়ে দুঃখ প্রকাশ করা কিংবা কৃষ্ণকে এজন্য অভিযোগ বা দোষারোপ করা অনুচিত। পারমার্থিক বিষয়গুলোকে আমরা এর মাধ্যমে গ্রহণ করতে পারি। এই মনোভাব আমাদের জন্য চিন্ময় জগতের দ্বার উন্মোচন করবে। যেখানে কোন জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধি নেই।
লেখক পরিচিতি : বংশীবিহারী দাস হিন্দি ভাষায় রচিত ব্যাক টু গডহেড বা ভগবৎ দর্শনের একজন সহ-সম্পাদক হিসেবে সেবা করেন।