এই পোস্টটি 348 বার দেখা হয়েছে
যন্ত্র, যান্ত্রিক জীবন ও অন্তর্জালে এখন বদ্ধ মানবসভ্যতা। সৃষ্টি হচ্ছে নানা দুর্ভোগ । প্রকৃতিগত মানবীয় প্রভাবের ধারে কাছেও নেই এই আধুনিক সভ্যতাব্রজবিহারী দাসপঞ্চাশ বছর আগে কোনো ছোট্ট শিশুকে যদি প্রশ্ন করা হতো তোমার প্রিয় ব্যক্তি কে? সে উত্তর দিত আমার “ঠাকুর দাদা”। আগামী পঞ্চাশ বছর পর কোনো শিশুকে যদি একই প্রশ্ন করা হয় তবে হয়ত সে উত্তর দেবে “আমার ঠোডা” (রোবট বা যন্ত্রমানবের কল্পিত নাম)। সময়ের সাথে সাথে মানবসৃষ্ট যন্ত্রমানব বা যন্ত্রমানুষের মানবীয় সম্পর্কগুলোর স্থান দখল করে নিচ্ছে। এখন যদি প্রশ্ন করা হয় শেক্সপিয়রের শার্লক হোমস্ কোথায় পাওয়া যাবে? উত্তর আসবে ই-বুকে! (লাইব্রেরিতে নয়), পত্রিকাগুলোও তাদের ই-সংস্করণ বের করে ফেলেছে। এখন আড্ডা আর জমে না বকুলতলা, শিউলিতলা, রমনার বটমূলে; আড্ডা জমে ফেইসবুকে(!)
এই অন্তর্জালের (ইন্টারনেট) মোহজালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছি আমরা। অনেকেই দাবি করছে এতে জীবন সহজ-সরল হয়েছে। তবে সেই সরলের গরলাবস্থা ভেসে উঠছে বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন গবেষণায় (উপস্থাপিত প্রবন্ধে প্রদর্শিত হয়েছে)।
আজকাল অবাধ স্বাধীনতার নামে হাজার বছরের প্রথাগত ঐতিহ্য নারী-পুরুষে বিবাহ প্রথা উলঙ্ঘন করে পুরুষে-পুরুষে, নারীতে-নারীতে বিবাহের দাবি উঠে আর পাশ্চাত্য দেশের সরকার তা যুক্তিযুক্ত(!) এই বিবেচনায় তার স্বীকৃতি দেয়। আবার ঘটা করে তাদের বিয়ের আয়োজনও করে (!) সেদিন হয়তো বিস্ময়ের অবকাশও থাকবে না যেদিন এই গ্রহের মানব অবাধ স্বাধীনতা নামক ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তার সৃষ্ট যন্ত্রমানবকে বিবাহের দাবি করে বসবে আর সরকার তা অতীব যুক্তিপূর্ণ(!) বিবেচনায় স্বীকৃতি দেবে। সত্যিই সেলুকাস! সত্যিই বিস্ময়কর!
অসংখ্য অস্পর্শনীয়, অশরীরি বন্ধুর ভিড়ে সেই সাথে বস্তাভর্তি প্রযুক্তি নির্ভর গেইম এর সমাহার স্বত্ত্বেও একাকীত্ব গ্রাস করছে মানব সমাজকে।
সমাজের সুশীল শ্রেণির ওপর প্রযুক্তির অশুভ প্রভাব ক্রমাগত প্রকট হতে প্রকটিত হচ্ছে। লন্ডনের একজন শিশু অনলাইন গেইমে আসক্ত হয়ে পিতা-মাতার অগোচরে প্রায় ৯০০ ইউরো ব্যয় করে। এই অর্থের যোগান দিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা অসদুপায় অবলম্বন করে। ঘরের কাছেই মুম্বাইতে কিশোর রোহান তার বাবার Paypal একাউন্টের ৫০০০ রুপি হাওয়ায় মিলিয়ে দিয়েছে গেইম সংগ্রহ করতে গিয়ে। যখন তার বাবার কাছে এই বিশাল অংকের অর্থ ব্যয়ের তথ্য গোচরিভূত হয় তখন রোহনের প্রত্যুত্তর ছিল এই অর্থ সে(রোহন) ব্যয় করেছে স্কুলের এক প্রকল্প (অ্যাসাইনমেন্ট) তৈরিতে কিন্তু তারপর তার বাবা আবিষ্কার করে রোহন সেই অর্থ Farmville তে খরচ করেছে। এই Farmville হচ্ছে Facebook এর একটি জনপ্রিয় গেইম।
প্রযুক্তির বিকাশ ও মানুষের অনুভূতি:প্রযুক্তির বিকাশ বর্তমান এই জড় সভ্যতার মানুষের মধ্যে দুটি চরম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে প্রথমটি হল অন্তহীন একাকীত্ব, অপরটি হলো জলের মত টাকা খরচ করার প্রবণতা, অনেকে মনে করছে এটি হয়তো মানসিক শান্তি প্রতিবিধান করবে অথবা যুব সমাজকে বিপথে বা হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড হতে বিরত রাখবে।
শুধুমাত্র আইফোনের ভাণ্ডারেই রয়েছে ৫০,০০০ এর বেশি গেইমস্। অন্তহীন বিনোদনের বিস্তৃত সমাহার অথবা বৃহৎ পরিসরে আড়ম্বর জৌলুসপূর্ণ উড়োসম্পর্ক (Virtual relationship or Friendship) থাকা স্বত্ত্বেও মানুষ একা ও সত্যিকার বন্ধু বিবর্জিত।
মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. লিন্ডা প্যাগানি এবং তার দল “শিশুদের ওপর দূরদর্শনের (টেলিভিশন) প্রভাব” এই বিষয়ে একটি বৃহৎ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এতে তারা দাবি করেন যে, টিভি দেখতে থাকা শিশুরা ক্রমাগত কম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন ও একা হয়ে পড়ে। ক্যালিফোর্নিয়ার স্টেইট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাবেরি শুভ্রমানিয়াম এবং প্যাট্রিক গ্রিনফিল্ড “শিশুদের মানসিকতার ওপর বৈদ্যুতিক গণমাধ্যমের (Electronic media) প্রভাব” সম্পর্কিত গবেষণা শেষে তার তত্ত্ব, তথ্য, বিচার, সিদ্ধান্ত ও প্রস্তাবনা সম্বলিত “শিশুদের ভবিষ্যৎ” শীর্ষক একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সেখানে তারা বলেন যে এই বৈদ্যুতিক মাধ্যমের সাহায্যে যোগাযোগ (Comunication based on Electronic media) শিশুদের তার বন্ধুদের সাথে সম্মুখ সাক্ষাৎ বা যোগাযোগ অনাগ্রহী করে তুলছে। অনেক মনস্তত্ত্ববিদ এই বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন যে, একে অপরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো (আন্তরিকতা বর্জিত) প্রথাগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে তা লোপ পেতে শুরু করেছে। বস্তুগত বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্টতাকে নিরর্থক বলে মনে করছে আর অবস্তুগত ও যান্ত্রিক বিষয়ের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলছে। যা তাদের অন্তর্মুখী, আত্মকেন্দ্রিক ও অলস করে তুলছে। এটি ক্রমাগত একটি দুষ্টচক্র হয়ে উঠছে। যতই আন্তব্যক্তিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যন্ত্র মানুষের স্থান দখল করে নিচ্ছে, ততই মানুষদের মধ্যে অর্থপূর্ণ মানবীয় সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনা লঘুতর হচ্ছে। কিছু লোক একাকিত্ববোধ করে না। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে চরমভাবে বিপথে গমন ও অন্যের অনিষ্ট সাধন প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। তাদের কাছে শঠতা, অন্যের ওপর অযথা আক্রমণ, অন্যকে ব্যথিত করার মত অনৈতিক আচরণগুলো অস্বাভাবিক থাকে না এবং এই যন্ত্রকেন্দ্রিক জীবন যাপনের ফল হচ্ছে ক্রমাগতভাবে বর্ধমান সামাজিক অবক্ষয়সমূহ। আমরা দেখেছি আমেরিকায় সেই ব্যক্তি যে তার হতাশা হতে উদ্ভূত ক্রোধ প্রশমনের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিল অবলা শিশু ভর্তি স্কুল গাড়িকে। সেই ইরাক ফেরত আমেরিকান সেনাবাহিনীর মানসিক চিকিৎসকটি, সেও তার সহকর্মীর ওপর গুলি চালিয়ে হত্যা করার মাধ্যমে তার হতাশা হতে উত্পন্ন ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিল। এই ধরনের ঘটনাগুলো অহরহ আমেরিকার মত উন্নত দেশগুলোতে ঘটছে। কেন? তার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানবীয় সম্পর্কের অবনতি। যখন বিজ্ঞানীরা প্রচার করে মানুষ হচ্ছে কাকতালীয়ভাবে সৃষ্টি আদিম জটিলতার বৈদ্যুতিক যন্ত্র বিশেষ, তখন মানব ও মানব সৃষ্ট যন্ত্রমানব (রোবট) এর মধ্যে কিইবা পার্থক্য থাকে। তখন মানুষের মনে মানুষ ও যন্ত্রমানুষের মধ্যে যে মানসিকতার এক বৃহৎ বৈসাদৃশ্য রয়েছে সেই বিষয়টি অনুধাবন করার ক্ষমতা লোপ পেতে শুরু করে। অপরটি হচ্ছে নাস্তিক্যবাদের প্রসার যখন ঈশ্বরের সাথে মানুষের কোনো সম্বন্ধ থাকে না। তখন মানুষ তার অপরাধ জনিত কর্মের ফল প্রাপ্তির ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে না। অনেক ব্যক্তিই ইন্টারনেট (অন্তর্জাল) ও টেলিভিশন (দূরদর্শন) এগুলোকে পছন্দ করে তার কারণ এগুলো তাদের “আমি নিয়ন্ত্রক” এই অনুভূতি উপভোগ করার সুযোগ করে দেয়। একটা বোতামে চাপ দিয়ে আমরা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে বসে সমস্ত তথ্য যোগাড় করতে পারি বা হাজার হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থান করা ব্যক্তির সাথে কয়েক সেকেন্ডে যোগাযোগ করতে পারি। আমরা যখনই চাই তখনি আমাদের পছন্দানুযায়ী প্রদর্শনী (রিয়েলিটি শো, নাটক, নাচ, গান) উপভোগ করতে পারি। এই পরাবাস্তব আমাদের হৃদয়ের অবচেতনভাবে এই উপলব্ধি পরিবর্ধন করে যে “বাহ্! আমার এক চাপে এত কিছু হবে!” যেটি “আমি নিয়ন্ত্রণকর্তা” এটি ভাবার প্রবণতাকে বেশি করে উৎসাহিত করে। তখন সে ভাবতে শুরু করে আমি আমার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। যন্ত্র বা যান্ত্রিক বস্তুকে নিয়ন্ত্রণ করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় মানুষ সবসময় তার হৃদয় আমি নিয়ন্ত্রণকর্তা এই ভাব ধারণ করে রাখে। তখন এটি আমাদের দ্বিতীয় স্বভাব হয়ে ওঠে। যাই হোক, অন্য মানুষের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই আমরা একটি বোতামে চাপ দিয়েই তার কথা বার্তা, অঙ্গ-ভঙ্গি আচার- আচরণ থামিয়ে দিতে পারি না। এটি অসম্ভব। মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, আবেগ ও অনুভূতি রয়েছে। তাই একে-অন্যের প্রতি প্রেম, আবেগ ও অর্থপূর্ণ সম্পর্ক উপভোগের জন্য একজন মানুষকে অন্য মানুষের জন্য সময় বরাদ্দ রাখতে হয়। একজন আরেকজনকে হৃদয় থেকে বুঝতে হয়, হতে হয় ধৈর্যশীল ও রাখতে হয় সহ্য করার ক্ষমতা। ধন্যবাদ প্রযুক্তিকে সে অতিদ্রুত মানুষের স্থান দখল করে নিচ্ছে। এখন আমাদের কাছে একে অন্যের জন্য সময় নেই, তার চেয়ে সময় দিচ্ছি দূরদর্শন বা অন্তর্জালে জড়িয়ে পড়ার জন্য। মানুষের প্রতি মানুষের দূরত্ব বাড়ছে প্রেমময় সম্পর্কগুলো প্রলম্বিত হচ্ছে, রূপ নিচ্ছে প্রহসনে।
সঠিক প্রভাবে প্রভাবিত হোনবৈদিক সাহিত্য, সম অধিকারের ভিত্তিতে নারী-পুরুষের অনুশীলনের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করা হত তাদের জীবনে আগত সৌভাগ্য ও অনাকাঙ্খিত দুর্যোগগুলো মোকাবেলার জন্য। দৈনন্দিন প্রার্থনা, সমবেতভাবে পরমেশ্বরের পূজার্চনা এবং একে অপরের প্রতি সেবা ও সাহায্যের মনোবৃত্তি চর্চার মাধ্যমে একটি ছন্দময় সম্পর্ক গড়ে তুলত। বৈদিক সাহিত্য উপদেশ দিচ্ছে আমাদের জীবনে আগত সুখ অথবা দুঃখগুলোর প্রতি সমভাবাপন্ন হতে। শাস্ত্র শিক্ষা দিচ্ছে, মানব জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে পরমেশ্বরের সাথে প্রেমময় সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানো। চরম আবেগিকতা ক্রোধ আমাদের হৃদয়কে দূষিত করে তখন পরমেশ্বরকে স্মরণ রাখা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। যারা অবিরত টিভি দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে যেখানে প্রদর্শনীর নামে অর্থহীন বিষয়গুলোকেও কৌতুকপূর্ণভাবে বিশাল এক প্রপাগাণ্ডা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, এগুলি তাদের মনকে বিশুদ্ধ করার পরিবর্তে আরো কলুষিত করে। এটি সমাজের বাহ্যিক জৌলুসপূর্ণ রূপকে তার অন্তসার বা প্রকৃতরূপ থেকেও বেশি বিশ্বস্থভাবে আমাদের নিকট উপস্থাপন করছে। যেমন, এখন মানুষের কাছে দৈহিক সৌন্দর্য চারিত্রিক সৌন্দর্যের চেয়েও বেশি আকর্ষণ করে। মানুষের তথাকথিত মনোরঞ্জনের কথা চিন্তা করে গণমাধ্যমগুলোও ফ্যাশন শো আর বেশি বেশি গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এর কুপ্রভাব সর্বত্র প্রযোজ্য। এখনই সময়, অনেক দেরি হবার পূর্বে আমাদের চেতনাকে যান্ত্রিকতায় নয়, প্রকৃতিগত মানবীয় প্রভাবের দ্বারা প্রভাবিত করে জীবনকে পরিচালিত করার।
(ব্রজবিহারী দাস, MBA, ইসকন মুম্বাইয়ের ব্রহ্মচারী ভক্ত। তিনি বিভিন্ন কলেজে ছাত্রদের মধ্যে কৃষ্ণভাবনামৃত শিক্ষা প্রদান করছেন।)
ত্রৈমাসিক ব্যাক টু গডহেড, অক্টোবর – ডিসেম্বর ২০১৩ |
|