এই পোস্টটি 174 বার দেখা হয়েছে
শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী ও শ্রীসনাতন গোপাল দাস
ভগবান কর্তৃক প্রদত্ত বিশেষ ছাড়
আমি তোমাদের মাঘ মাস বা মাধব মাস সম্পর্কে বলব। এই মাসে ভারতে লোকেরা কৃষ্ণকে অনেক পুষ্প নিবেদন করে, প্রাতঃস্নান করে এবং অন্যান্য সেবা করে। তাই প্রচারের সময় ভাল মাসগুলো জেনে নেওয়া ভাল, অবশ্যই যেসব ভক্ত নিত্য কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করছেন তাদের কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, কেননা তারা প্রতিদিন সেই সুবিধা নিচ্ছেন । তাই যারা ভগবানের সেবা করে না তারা যদি জানতে পারে মাঘ মাসে সামান্যতম ভগবৎ সেবায় বহুগুণ ফল প্রাপ্তি হয়, তবে তারা ভগবৎ সেবা শুরু করবে। বছরে তিনটি মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আর দামোদর মাস ভগবানের কাছে খুবই প্রিয়। এই মাসে আমরা বিভিন্ন তপশ্চর্যা অনুশীলন করি, যেমন আহার বিহারের সংযম ও বেশি সংখ্যক নাম জপ।
বৈশাখ মাসে নৃসিংহ চতুর্দশী ও চন্দন যাত্রা হয়, এই মাসটি বিগ্রহের সামনে নৃত্য করার জন্য, দান করা ও বিগ্রহ সেবার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই মাসে ভগবানের বিভিন্নরকম সেবা করা হয়ে থাকে. বেদে মাঘ মাসের গুরুত্ব উল্লেখিত আছে। তাই এই মাসে করণীয়-অকরণীয় সম্পর্কে প্রভুপাদকে আমি একটি চিঠি লিখেছিলাম, শ্রীল প্রভুপাদ প্রত্যুত্তর করেছিলেন যে, নতুন ও অনিয়মিত ক্রেতাদের জন্য আকর্ষণ করতে ভগবান বিশেষ অফার দেন। তিনি একটি দোকানের উদাহরণ দিয়েছিলেন যা নতুন ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে বিভিন্ন (ডিসকাউন্ট) অফার দেন। তখন নতুন ক্রেতারা বিশেষ ছাড়ে পণ্য ক্রয়ের সুবিধা নিতে পারেন। চিঠিটির উত্তর লিখেছেন শ্রীল প্রভুপাদ_লস আঞ্জেলস্ জানুয়ারি ৩০, ১৯৬৯ সালে :
“কার্তিক মাসের বিশেষত্ব হচ্ছে এমাসে কৃষ্ণভাবনাবিহীন ব্যক্তিরাও কিছু সেবা করার প্রেরণা পায়। যারা কৃষ্ণভাবনাময় কোনোকিছু করে না, তারা এ মাসে আন্তরিকভাবে সেবা করার অনুপ্রেরণা লাভ করে। এ বিষয়ে একটি ভালো উদাহরণ দেওয়া যায়, অনেক সময় বড় দোকানগুলো ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে মূল্যছাড় দেয়। কিন্তু যারা দোকানের নিয়মিত ক্রেতা, তাদের জন্য এমন ছাড় গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ তারা পণ্যটির গুরুত্ব বোঝে, তাই যেকোনো মূল্যে তা ক্রয় করবে। তেমনি যারা ভগবানের শুদ্ধভক্ত তারা কোনোরকম ছাড়ের অপেক্ষা না করেই বছরের ৩৬৫ দিনের ২৪ ঘণ্টাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভগবানের প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত থাকে।”এটা একটি ভাল সুযোগ, সাধারণত লোকেরা সকালে উঠে মঙ্গলারতিতে যেতে এবং প্রাতঃস্নানে যেতে চায় না; কিন্তু ভক্তরা তা প্রতিদিন। করে থাকেন।
এমনকি এই মাসে যদি কেউ ভোরে গরম জলেও স্নান করে তার অন্যান্য সময়ে স্নানের চাইতে ছয়গুণ বেশি ফল দেয়। আর যদি কেউ ঠাণ্ডা জলে স্নান করে তবে বার গুণ ফল লাভ করবে, পুকুরে স্নান করলে একশত গুণ, যদি সেটা গঙ্গায় করা হয় তবে ১০০০ গুণ এবং ত্রিবেনীতে স্নান করলে ১০০০০০ গুণ। কিন্তু ভক্তরা সেটি প্রতিদিনই করছে, ভগবানকে সন্তুষ্ট করার জন্য, কিন্তু অভক্তরা এটিকে সুযোগ হিসাবে নিতে পারে। পাদ্মে বৈশাখ-মাহাত্ম্যে শ্রীযমব্রাহ্মণ-সংবাদে- তুলসী গৌরকৃষ্ণাখ্যা তয়াভ্যচ্চ্য মধুদ্বিষম্ ।
বিশেষেণ তু বৈশাখে নরো নারায়ণো ভবেৎ ॥৩৪৪৷৷
মাধবং সকলং মাসং তুলস্যা যোঽচ্চ য়েম্নরঃ।
ত্রিসন্ধ্যং মধুহন্তারং নাস্তি তস্য পুনর্ভবঃ ।
শ্রীশ্রী হরিভক্তিবিলাস ৭/৩৪৫ ।।
অনুবাদ—অতঃপর বৈশাখ মাসে তুলসীদান-ফল পদ্মপুরাণে বৈশাখ মাহাত্ম্যে শ্রীযম-ব্রাহ্মণ-সংবাদে বর্ণিত হইয়াছে—বিশেষতঃ বৈশাখ মাসে গৌরবর্ণ ও কৃষ্ণবর্ণ তুলসীদ্বারা শ্রীমধুসূদনকে পূজা করিলে মনুষ্য নারায়ণসদৃশ হন। যাঁহারা সমস্ত বৈশাখ মাস তুলসীদ্বারা ত্রিসন্ধ্যা মধুরিপু শ্রীহরির পূজা করেন, তাঁহাদের আর জন্ম হয় না ৷৷
নানা প্রশ্ন
বৈশাখ মাসে অনেকে অশ্বত্থ, তুলসী বৃক্ষে জল দেন। কেন? ঐ মাসে কৃষ্ণভক্তদের কি নিয়ম পালন করা উচিত?
উত্তর : পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে, মাসো মাধবো মাধবপ্রিয়ঃ। মাধব (বৈশাখ) মাস হচ্ছে মাধবের (শ্রীকৃষ্ণের) বিশেষ প্রিয় মাস। এই মাসে অশ্বত্থ তুলসী প্রভৃতি পবিত্র বৃক্ষে জল দিলে পবিত্রতা ও ভক্তি লাভ হয়। সংসারে লোক টাকাপয়সা চায়, আধিব্যাধি থেকে মুক্ত হতে চায়, দরিদ্রতা ঘুচাতে চায়, পরিবারের সবার মঙ্গল চায়, সুন্দরভাবে কৃষ্ণসেবা করতে চায়, পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে চায়, নানাবিধ উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত হতে চায়। আর পদ্মপুরাণে বৈশাখ-মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে—
যশ্চাপি নিঃস্বঃ পুরুষো মাধবে মাসি মাধবম্ ।
পুষ্পাচনবিধানেন পূজয়েন্মধুসূদনম্ ॥
সর্বপাপবিনির্মুক্তঃ পিতৃণাং তারয়েচ্ছতম্।
স জন্মশতসহস্ৰং ন শোকফলভাগ্ ভবেৎ ॥
ন চ ব্যাধিভয়ং তস্য ন দারিদ্র্যং ন বন্ধনম্ ।
স বিষ্ণুভক্তো জায়েত ধন্যো জন্মনি জন্মনি ৷৷
“দরিদ্র লোক যদি বৈশাখমাসে কেবল ফুল দিয়েও শ্রীকৃষ্ণের অর্চনা করেন, তা হলে অখিল পাতক থেকে মুক্ত হয়ে শত পিতৃকুল পরিত্রাণে সমর্থ হবেন। শত সহস্ৰ জন্ম ব্যাপী শোক দুঃখ তাঁর ঘুচে যাবে। আধিব্যাধি, দরিদ্রতা ও বন্ধন ভয় থেকে মুক্ত হবেন। জন্মে জন্মে কৃষ্ণভক্ত ও ধন্যবাদার্হ হয়ে থাকবেন।”
বৈশাখমাসে নিত্য প্রাতে পবিত্র জলে স্নান, বেশি করে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ ও কীর্তন, ব্রত-উপবাস, নিরলসভাবে ভক্ত সেবা, ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন, জলদান, আহার্য দান প্রভৃতি মাঙ্গলিক কর্ম সম্পাদনে শ্রীমাধবের বিশেষ কৃপাশীৰ্বাদ লাভ হয়।
বৈশাখী অক্ষয় তৃতীয়া তিথি কি জন্য প্রসিদ্ধা?
উত্তরঃ মৎস্য পুরাণে বলা হয়েছে — বৈশাখ মাসে শুরু তৃতীয়া তিথি হচ্ছে। এই বৈশাখী সত্যযুগের প্রথম দিন। ব্রহ্মলোক থেকে পবিত্রবতী গঙ্গাকে ভগবান পৃথিবীতে এই দিনে অবতারণ করিয়েছিলেন। পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে – শুক্লা তৃতীয়া শ্রীহরিপ্রিয়া হেতু লোকে অক্ষয় তৃতীয়া বলে। স্নানে, দানে, অর্চনে, শ্রাদ্ধে, জপে, পিতৃ তর্পণে অক্ষয়া এই তিথিতে যাঁরা যব দ্বারা শ্রীহরির অর্চন করেন, যত্নপূর্বক শ্রাদ্ধ করেন, তাঁরা বৈষ্ণব অতএব ধন্য।
কেন বৈশাখ মাসে তুলসী বৃক্ষে জলধারা দান কর্তব্য? এক্ষেত্রে বৈশাখ মাসের বিশেষ কোন মাহাত্ম্য আছে কি? বৈশাখ মাসে তুলসীতে জল দান আর অন্যান্য মাসে তুলসীতে জল দানের মধ্যে পার্থক্য কি?
উত্তর : প্রত্যেক মাসে প্রতিদিনই ভক্তগণ সকালে শ্রীকৃষ্ণপ্রিয়া তুলসীরে স্নান করিয়ে এই মন্ত্র বলে থাকেন –
ওঁ গোবিন্দবল্লভাং দেবীং ভক্তচৈতন্যকারিণীং ।
স্নাপয়ামি জগদ্ধাত্রীং কৃষ্ণভক্তিপ্রদায়িনীম্ ॥
সাধারণত গৃহ বা মন্দির মধ্যে জলটি তুলসী বৃক্ষের মূলে দেওয়া হলেও তুলসীর সর্বাঙ্গে সামান্য ছিটিয়ে দেওয়া হয়। বাগানমধ্যে তুলসীমূলে তো দিতেই হয়, এমনকি রোজ শাখা প্রশাখা পাতায়ও জল সেচন করে ধুয়ে দেওয়া কর্তব্য যাতে বৃক্ষের ক্ষতি না হয়। বৈশাখ মাসটি আমাদের দেশে নিদাঘ কাল। এ সময়ে প্রচণ্ড গরম ও সূর্যের তেজে গাছপালার কোমল পাতা পর্যন্ত ঝলসে যায়। গাছ শুকিয়ে যায়। শ্রীহরির প্রিয় তুলসীতে জলধারা দিয়ে বৃক্ষকে সুস্থ স্নিগ্ধ রাখার প্রথাও পুরাকাল থেকেই চলে আসছে। পদ্মপুরাণে বৈশাখ মাহাত্ম্যে যমরাজের উক্তি-সকল জাতীয় পত্র অপেক্ষা তুলসী হচ্ছে কেশবের প্রিয়। আরও বলা হয়েছে, বৈশাখ মাসের পুণ্যবাসরে অর্থাৎ অক্ষয়তৃতীয়া বা একাদশী প্রভৃতি তিথিতে যারা শ্রীহরিপূজার জন্য তুলসীপত্র সংগ্রহ না করে, তাদের জীবনে, যৌবনে ও অর্থ সঞ্চয়ে ধিক্। কি ইহকাল, কি পরকাল, কোনকালেই তারা সুখ লাভ করতে পারে না। বৈশাখে উত্তপ্ত দিনগুলিতে ভগবানের স্নিগ্ধ চন্দন যাত্রা, সলিলবিহার, নৌকাবিলাস, শালগ্রামের স্নানরত থাকা ইত্যাদি অনুষ্ঠান সম্পাদন করে ভক্তরা ভগবদ কৃপাদৃষ্টি ও পরমানন্দ লাভ করে থাকেন। তুলসীপত্র বিনা ভগবানের পূজা, স্নান, ভোজন, পান হয় না। (তুলসীপাতা দিয়ে অন্য কোনও ব্যক্তির পূজা হয় না, কোন দেবদেবীর পূজা হয় না, একমাত্র শ্রীহরি বা বিষ্ণুতত্ত্বের পূজা করা হয়।) তাই ভক্তরা প্রখর বৈশাখে তুলসীবৃক্ষ যাতে নষ্ট না হয়ে যায় সেজন্য সূক্ষ্ম জলধারা দিয়ে ভক্তিদাত্রী তুলসীর যত্ন করে থাকেন। তুলসী ও শালগ্রামকে জলধারা দিলে হৃদয়ও ভক্তিপ্লুত স্নিগ্ধ সুন্দর হয়।