স্নেহের শক্ত বন্ধন

প্রকাশ: ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১:৫০ অপরাহ্ণ আপডেট: ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১:৫০ অপরাহ্ণ

এই পোস্টটি 142 বার দেখা হয়েছে

স্নেহের শক্ত বন্ধন

পরমেশ্বর ভগবান দেখিয়েছেন যে তিনি তাঁর ভক্তের
বিশুদ্ধ ভালোবাসার বন্ধন রজ্জুতে আবদ্ধ হন

রাধাগোবিন্দ গোস্বামী


বৈদিক শাস্ত্রে উল্লেখ আছে কিভাবে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভক্তবৃন্দদের সাথে নিত্য লীলাবিলাসে রত আছেন। উভয় জগতে বিশেষত পারমার্থিক এবং ভৌম জগতে যেখানে নির্দিষ্ট সময়ে তিনি আবির্ভূত হন। যেহেতু কৃষ্ণ চান অন্তরঙ্গ ভালোবাসার আদান প্রদান, তাই তাঁর প্রতি অন্তরঙ্গ ভালোবাসা হেতু কিছু শুদ্ধ ভক্ত ভুলে যান যে, তিনি ভগবান এবং পরম ঈশ্বর। কার্তিক মাসে (অক্টোবর-নভেম্বর) আমরা কৃষ্ণের এক বিশেষ লীলার স্মরণ করি যা এই তত্ত্বের একটি উপযুক্ত উদাহরণ। ভগবানের এক প্রীতিময় লীলায় তিনি তিরষ্কৃত হন এবং তাঁর মাতা যশোদা দই, মাখন চুরি করার অপরাধে কৃষ্ণকে রজ্জু বন্ধনে আবদ্ধ করেন।
এই প্রবন্ধের সকল তথ্য নেওয়া হয়েছে শ্রীমদ্ভাগবতের ১০ম স্কন্ধের ৯ম অধ্যায় এবং শ্রীল সনাতন গোস্বামী, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর এবং অন্যান্য বৈষ্ণব আচার্যগণের ভাষ্য থেকে। যখন মাতা যশোদা গোপীদের থেকে কৃষ্ণ কর্তৃক মাখন চুরি এবং তাদের মাখন পাত্র ভেঙ্গে দেওয়ার অভিযোগ শুনলেন, তখন তিনি আশ্চর্য হলেন যে, কেন তাঁর পুত্র অন্যের গৃহে গিয়ে চুরি করছে। যশোদা মাতা ভাবল, “কৃষ্ণ হয়তোবা আমাদের গৃহের মাখন পছন্দ করে না। হয়তোবা দধি উত্তম ছিল না অথবা মাখন ঠিক মত তৈরি হচ্ছিল না। না হলে কেন কৃষ্ণ ব্রজের অন্যান্য ঘরে গিয়ে মাখন চুরি করবে যদি সেগুলো ঘরেই পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে? আজই, আমি নিজেই মাখন তৈরি করব।”
যশোদা তখন উপলব্ধি করতে পারেন নি যে কৃষ্ণের প্রতি সকল গোপীদের ভালোবাসার কারণেই কৃষ্ণ সকলের গৃহে যায় ।
তাই মাতা যশোদা নিজে দুগ্ধ মন্থন করতে শুরু করেন যদিও রাণী হিসেবে এই কাজটি ছিল তার জন্য বেমানান। যশোদা নিজেই সকল সেবকদের অন্যান্য সাংসারিক সেবা বন্টন করে নিজেই দধিমাখন তৈরি করতে লাগলেন। যদিও গৃহসেবকগণ খুবই সুস্বাধু মাখন তৈরি করত তথাপিও কৃষ্ণের মাখন চুরি বন্ধ করে তাকে নিজ গৃহে সুখে রাখার জন্য যশোদা নিজেই মাখন তৈরি করতে লাগলেন ।
যশোদা যখনই দধি মন্থন করছিলেন তখন কৃষ্ণের বাল্যলীলা স্মরণ করে গান গাইছিলেন। কৃষ্ণ কি কি লীলা করেছিলেন তা তিনি মধুর সুরে গীত করছিলেন। এই লীলা থেকে আমরা শিখতে পারি, যদি ভগবানের গুণমহিমা কীর্তন করার জন্য আমাদের যথেষ্ট সময় না থাকে তবে আমরা শারীরিক বিভিন্ন কাজ করার সময় তা গাইতে পারি ।
মাতা যশোদা যতই মন্থন রজ্জু টানছিলেন তার স্বর্ণ কাঁকনের ঘর্ষনে একটি ঝিন ঝিন মধুর শব্দ হচ্ছিল। এছাড়া তার কর্ণ কুন্তল, নূপূর এবং স্বর্ণ কোমরবন্ধে সুললিত শব্দ উৎপন্ন হচ্ছিল। তার সকল অলংকারের শব্দসমূহ করতালের শব্দ বলে মনে হচ্ছিল। যতই তিনি মন্থন করছিলেন ততই কাঠের দণ্ডটি দধি পাত্রের সাথে ঘর্ষণে শব্দ হচ্ছিল যা শুনতে ঠিক ঢাকের শব্দের মত মনে হয়েছিল । সুতরাং কৃষ্ণের মহিমা কীর্তনের সাথে সাথে সকল বাদ্যযন্ত্রের সুর সন্নিবেশিত করেছিলেন।
চিন্ময় জগতে এমনকি অলংকার এবং দৈনন্দিন আসবাবপত্রও চেতনা সম্পন্ন, তাই তারা আনন্দে শব্দ করতে থাকে, কৃষ্ণের সেবা সম্পাদনের কারণে তারা মাতা যশোদাকে অভিনন্দন জানাত। আমাদের দেহ দামি স্বর্ণের অলংকারে সজ্জিত থাকলেই কেবল সুন্দর হয় না, এগুলো তখন সুন্দর হয় যখন আমরা পরমেশ্বর ভগবানের সেবায় যুক্ত থাকি । যশোদার কর্ণ কুন্তল ভাবল যে, তারা কতই না সৌভাগ্যশালী যে তারা কর্ণের নিকটবর্তী হওয়াতে কৃষ্ণের লীলা শ্রবণ করতে পারছে।


“প্রত্যেকেই আবহাওয়া নিয়ে কথা বলে, কিন্তু কেউ এ নিয়ে কোন কিছু করে না।” আর কৃষ্ণের কৃষকরা জানেন, এরকম প্রচেষ্টাও নিতান্তই মূর্খতা। তিনি শুধু ভগবানের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যান আর যা কিছু প্রাপ্ত হয় তা ভগবানের রুপা হিসেবেই দর্শন করে।

কৃষ্ণভক্ত হওয়ার মানে বসে থাকা নয়, এর অর্থ হল সেবা করা এবং কৃষ্ণ সেবায় ঘাম ঝরানো উচিত। ভক্তির অর্থ হল ইন্দ্রিয় দাতার সেবায় সকল ইন্দ্রিয়কে নিয়োজিত করা। কৃষ্ণ আমাদের নিকট ইন্দ্রিয় প্রদান করেছেন এবং সেগুলো পরিপূর্ণভাবে তাঁরই সেবায় ব্যবহার করা উচিত।
মাতা যশোদা কোন প্রকারের অলসতা ছাড়াই তার সেবা সম্পাদনে প্রস্তুত ছিলেন। সূর্যোদয়ের পূর্বে ব্রহ্মমূহূর্ত থেকে তিনি কঠোর পরিশ্রম করা শুরু করেন।
তিনি ভাবছিলেন, “কৃষ্ণের জন্য আগেই মাখন তৈরি করব, যাতে সে জেগে ওঠার সাথে সাথেই তাকে মাখন খাওয়াতে পারি।” এই ভাবে, দধি মন্থনের সময়, তাঁর জিহ্বা কৃষ্ণ লীলা কীর্তনে, কর্ণ কৃষ্ণলীলা শ্রবণে, মন নিমগ্ন ছিল এই ধ্যানে যে, তিনি কিভাবে মাখন তৈরি করবেন যাতে কৃষ্ণকে নিবেদন করতে পারেন। এটিই হল শুদ্ধ ভক্তের স্থিতি: মন, দেহ এবং বুদ্ধিমত্তা সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণের প্রতি ভক্তিমূলক সেবায় যুক্ত করা।

কৃষ্ণের জাগরণ

যশোদার সুমধুর সংগীত ও দুগ্ধ মন্থনের ছন্দময় শব্দ শ্রবণ করে কৃষ্ণ অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু আগেই জেগে উঠলেন। যখন তিনি জেগে উঠলেন তখন তিনি মাতৃদুগ্ধ পান করতে চাইলেন। তিনি তাঁর মায়ের খোঁজ করছিলেন এবং ভাবছিলেন,
“কেন মা আজ আমার সাথে বিছানায় নেই?”
শিশুরা মনোযোগ আকর্ষণে পটু কিন্তু যখন তারা সেটি করতে পারে না তখন তারা অনিষ্ট করে। কৃষ্ণ তখন মিথ্যা কান্না করতে করতে সেই কক্ষে প্রবেশ করলেন যেখানে যশোদা মাতা গান গাইছিলেন। তিনি তাঁর নিকটবর্তী হলেন এবং গভীর মনোযোগে মাতার দিকে তাকালেন, কিন্তু যশোদা সেটি লক্ষ্য করলেন না। এটি আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। কৃষ্ণ কখন আমাদের কাছে আসবেন? তিনি তখনই আসবেন যখন আমরা ভক্তিমূলক সেবায় এত বেশি নিমগ্ন থাকব যে তাঁর উপস্থিতিও উপলব্ধি করতে পারব না। কৃষ্ণ তখন আমাদের সম্মুখে অবতীর্ণ হবেন না যখন আমরা শুধুমাত্র অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করব তখনই তিনি সুলভ হবেন ।
কৃষ্ণ মাতার আকর্ষণ লাভের জন্য মন্থন দণ্ডটি শক্ত করে ধরে বললেন, “বন্ধ করুন! আমাকে দুগ্ধ পান করান এখনি ।”
বৈষ্ণব ভাষ্যকারগণ কৃষ্ণ কেন দধিমন্থন কার্যে বাঁধা দিয়েছিলেন তার আরেকটি কারণ বর্ণনা প্রদান করেছেন: সম্পূর্ণরূপে শাস্ত্র ‘মন্থনের’ পর কেউ কৃষ্ণকে লাভ করে, কেননা কৃষ্ণ হলেন সবকিছুর উপসংহার। কিন্তু যশোদা ইতোমধ্যে কৃষ্ণকে লাভ করেছেন, তাহলে তার মন্থনের আর কি দরকার?
যশোদা কৃষ্ণের দিকে তাকালেন এবং অপেক্ষা করছিলেন কৃষ্ণ এরপর কি করবেন। কৃষ্ণ দুই হাতে তার বাহু আকর্ষণ করে, মাতা যশোদার কোলে উঠে স্তন্য পান করতে লাগলেন।
কৃষ্ণও ভাবতে লাগল, “আমি কেমন চতুর, মাতার কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে আমার অধিকার দাবি করেছি।” এই ভেবে তিনি স্মিত হাসলেন। যখনই তিনি পান করতে শুরু করলেন তখন মাতা এবং পুত্রের মধ্যে প্রতিযোগীতা শুরু হল । কৃষ্ণ সন্তুষ্ট হবেন না এবং মাতা যশোদার দুগ্ধও শেষ হবে না কেননা তিনি পুত্রস্নেহে যথেষ্ট আবিষ্ট ছিলেন। তিনি কিছুক্ষণ পুত্রকে স্তন্য পান করলেন।
তারপর এমন কিছু ঘটল যাতে যশোদার মনোযোগ বিভ্রান্ত হল। তিনি কিছু দুগ্ধ পাশ্ববর্তী চুলায় গরম করার জন্য দিয়েছিলেন। যশোদা কৃষ্ণকে সেখানে রেখে সেই দুধগুলো সংরক্ষণ করার জন্য গেলেন। এই দুধগুলো ছিল বিশেষ পদ্মগন্ধ গাভীর যা কেবল কৃষ্ণের জন্য ।
এই অপ্রাকৃত দুধ ভাবছিল, “কেন আমি এই আগুন সহ্য করছি যেখানে কৃষ্ণ মাতা যশোদার স্তন্য পান করে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তারচেয়ে বরং আগুনে ঝাপ দিয়ে আমার আত্মহত্যা করা উচিত।”
এইরূপে ভেবে, দুগ্ধ উপচে পড়ল। মা যশোদা দুধগুলো অগ্নিমুখ থেকে নিচে সরিয়ে রাখলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে কৃষ্ণ কি করছিল?

ক্রুদ্ধ কৃষ্ণ

শিশু কৃষ্ণ খুবই রেগে গেলেন । “শুধুমাত্র কিছু সামান্য দুধ রক্ষার জন্য কিভাবে মাতা আমাকে ফেলে গেলেন! আমি এখনো ক্ষুধার্থ।” তিনি দাঁত দিয়ে তাঁর ওষ্টদেশ দংশন করলেন এতে তার দাঁত লাল বর্ণ ধারণ করল।
কৃষ্ণ মসলা পিষণে ব্যবহৃত হয় এমন একটি ছোট পাথর নিয়ে মাখন পাত্রের নিচে এমনভাবে আঘাত করলেন যেন শব্দ না হয় এবং মা যশোদা না জানে । তিনি যতই এগুতে লাগলেন, সবদিকে মাখনের পাত্র ভেঙ্গে দিলেন এবং নীরবে মাখনের ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগলেন। কৃষ্ণ এটা ভাবেন নি যে ইচ্ছে করেই তিনি মাখনের উপর হাঁটবেন । তিনি স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে হাঁটলেন কিন্তু তার যাত্রা পথে পায়ের ছাপ পড়ে গেল ।
কৃষ্ণ আরেকটি কক্ষে গিয়ে একটি উদুখলের ওপর উঠে ঝুলানো মাখন ভাণ্ড নিয়ে তা বানরদের খাওয়াতে লাগলেন, তারা সুখেই খেতে লাগল ।
চুলা থেকে দুধ নামিয়ে যশোদা মা ফিরে এসে দেখলেন ভাঙ্গা পাত্রগুলো। যদি কৃষ্ণ সেখানে থাকত, তবে তিনি হয়তোবা মনে করতেন ভাণ্ডগুলো আপনা থেকেই ভেঙ্গে গেছে। যেহেতু কৃষ্ণ সেখানে ছিল না, তাই তিনি বুঝলেন যে এই সব কৃষ্ণই করেছে এবং দৌড়ে পালিয়ে গেছে। মা যশোদা ভগ্ন পাত্রগুলো দেখে ক্রুদ্ধ হলেন না।


দুর্যোধন কৃষ্ণকে বন্দি করার জন্য ভৃত্যদের নির্দেশ দিলেন। কৃষ্ণ বললেন, “কিন্তু আমাকে বন্দি করার মত রজ্জু (দড়ি) কি আপনাদের আছে?” ভৃত্যরা কৃষ্ণের আশ্চর্যকর রূপ দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। তাই দুর্যোধন কৃষ্ণকে বন্দি করতে পারলেন না, কিন্তু মা যশোদা সফল হয়েছিলেন।

তিনি হাসলেন এবং ভাবলেন, “আমার কৃষ্ণ কেমন চতুর! সে এমন ভাবে পাত্র ভাঙ্গল যে, আমি কোন শব্দই শুনতে পেলাম না। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি তাকে একটি শিক্ষা দিবেন। তাই তিনি কৃষ্ণে চরণচিহ্ন অনুসরণ করলেন। একটি কূপের পাশে নিজেকে লুকানোর পর চতুর্দিকে দেখতে লাগলেন।

কৃষ্ণের ভয়

কৃষ্ণ চতুর্দিকে তাকালেন এবং যেকোন মুহূর্তে ধরা পড়ার আশংকা করছিলেন। তাঁর চোখ ছিল ভয়ার্ত। তিনি জানতেন যশোদা মা তাকে শাস্তি দিবেন। যশোদা মা কৃষ্ণের পিছনে গোপনে অগ্রসর হলেন। কিন্তু কৃষ্ণ মাতার হাতে ছড়ি দেখে উদুখল থেকে নেমে দৌড়াতে শুরু করলেন। যশোদা তাকে ধরে ছড়ি দিয়ে শাসন করতে লাগলেন ।
শুকদেব গোস্বামী বলেন, “যোগীরা কঠোর তপস্যা করেও কৃষ্ণকে পায় না, কিন্তু সেদিন মা যশোদা সেই কৃষ্ণের পেছনে ছড়ি হাতে দৌড়াতে লাগলেন।”
প্রথমে কৃষ্ণ এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে দৌড়াতে লাগলেন । তারপর গৃহ থেকে বের হয়ে গোকুলের রাস্তায় দৌড়াতে লাগলেন।
মা যশোদা ভাবলেন, “আমার হাত থেকে আজ আর তার রক্ষা নেই।” তিনি কৃষ্ণকে সর্বত্র খুঁজলেন। ব্রজবাসীরা এই দৃশ্য দেখে অনেক মজা পেল ।
যশোদা সাধারণত তেমন দৌড়ান না, তাই তিনি অল্পতেই ঘর্মাক্ত হলেন। অবশেষে তিনি কৃষ্ণকে ধরে তাঁর চোখের জল মুছে দিলেন।
যশোদা কৃষ্ণকে বললেন, “বানরগুলো কি তোমার আত্মীয়? এই কারণেই কি তুমি মুক্তভাবে তাদের খাবার দাও? তুমি মাখনের পাত্র ভেঙ্গেছ। এখন পর্যন্ত আমি গোপীদের কথা বিশ্বাস করিনি, কিন্তু এখন আমি তোমাকে হাতেনাতে ধরেছি। আজ আমি তোমাকে শাস্তি দিব।”
তার দিকে ছড়ি তুলে, যশোদা কৃষ্ণকে ভয় পাইয়ে দিলেন। কৃষ্ণ চোখের জল ফেলতে লাগলেন এবং তাঁর চোখের কাজল মুখের সর্বত্র লেগে গেল, এতে তাকে আরো সুন্দর লাগছিল ।
কৃষ্ণ বলল, “মা, আমাকে যেতে দিন। আমি প্রতিজ্ঞা করছি আমি আর কখনো এই কাজ করব না।”
মা যশোদা কৃষ্ণকে ভয়ার্ত দেখে তারা ছড়িটি ফেলে দিলেন। কৃষ্ণ হাফ ছেড়ে বাঁচল।
অবতাররূপে কৃষ্ণের সকল লীলার মধ্যে এই প্রথম তিনি দোষী হিসেবে তাঁর শাস্তির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কৃষ্ণের ভাগ্য সম্পূর্ণরূপে নির্ধারিত ছিল মা যশোদার হাতে। এটিই হল কৃষ্ণের নিত্য আলয় ব্রজের বাৎসল্য ভাব।

রজ্জুবন্ধনে কৃষ্ণ

যশোদা সিদ্ধান্ত নিলেন তাকে বন্ধনে আবদ্ধ করবেন। তিনি ভাবলেন যেহেতু কৃষ্ণ এখন ক্রুদ্ধ তাই সে কোথাও দৌড়াতে গিয়ে পড়ে আঘাত পেতে পারে।
“কিছু সময়ের জন্য তাকে বেঁধে রাখা হোক”, এই ভাবলেন তিনি। “আমি আরও কিছুক্ষণ দধি মন্থন করার পর তাকে শান্ত করতে পারব।
এই ভেবে তিনি তাকে বাঁধতে শুরু করলেন। কিভাবে তিনি তাকে বাঁধবেন? যেহেতু তিনি জানতেন না যে তিনি হলেন পরমেশ্বর ভগবান। যশোদা কৃষ্ণকে শুধুমাত্র তাঁর সাধারণ পুত্র বলে মনে করতেন, তাই তিনি তাকে বাঁধতে চাইলেন। কিন্তু পরমেশ্বর ভগবানের কোন আদি, অন্ত নেই, নেই কোন ভেতর কিংবা বাহির। তিনি সর্বব্যাপি। কিভাবে তিনি প্রকৃতির কারো দ্বারা বন্ধনে আবদ্ধ হবেন? এটি অসম্ভব ।
এইভাবে কৃষ্ণ মা যশোদার দৃঢ়তা যাচাই করছিলেন। যেহেতু তিনি সম্পূর্ণরূপে প্রচেষ্টা করছিলেন না, তাই কৃষ্ণও ধরা দিচ্ছেন না। কৃষ্ণ ভগবদ্‌গীতায় বলেছেন (৪/১১), যে যথামাং প্রপদ্যন্তে: “যারা যেভাবে আমার প্রতি আত্মসমর্পণ করে, আমি তাদের সেভাবেই পুরস্কৃত করি। হে পার্থ, সকলেই সর্বতোভাবে আমার পথ অনুসরণ করে।” কৃষ্ণ তার কৃপা দান করার পূর্বে আমাদের অন্য সকল কিছু প্রদান করার জন্য অপেক্ষা করেন।
মা যশোদা তার গৃহের সকল রজ্জু ইতোমধ্যে ব্যবহার করেছেন, তাই তিনি অন্য গোপীদের কাছ থেকে আরো রজ্জু নিয়ে আসলেন। ইতোমধ্যে গোপীগণ যারা যশোদার কাছে এলেন তারা সকলেই কৃষ্ণকে মুক্ত করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেন।
“সে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার নয়”, তারা জানালেন। “কেন তুমি জেদী আচরণ করছ?” কিন্তু যশোদা তার প্রচেষ্টা পরিত্যাগ করলেন না। গোপীগণ এবং যশোদা হাসছিলেন, কেননা তারা বুঝতে পারছিলেন না কি ঘটছিল? কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রারম্ভে কৃষ্ণ প্রথমে যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তি বা মিত্রতা স্থাপনের নিমিত্তে কৃষ্ণ শান্তির দূত হয়ে দুর্যোধনের সভায় উপস্থিত হলে দুর্যোধন কৃষ্ণকে বন্দি করে কারাগারে পাঠাতে চাইলেন। যাতে কৃষ্ণ পাণ্ডবদের যুদ্ধে সহযোগিতা করতে না পারেন। দুর্যোধন কৃষ্ণকে বন্দি করার জন্য ভৃত্যদের নির্দেশ দিলেন। কৃষ্ণ বললেন, “কিন্তু আমাকে বন্দি করার মত রজ্জু (দড়ি) কি আপনাদের আছে?” ভৃত্যরা কৃষ্ণের আশ্চর্যকর রূপ দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। তাই দুর্যোধন কৃষ্ণকে বন্দি করতে পারলেন না, কিন্তু মা যশোদা সফল হয়েছিলেন। কিভাবে? কেননা তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছিলেন যে কৃষ্ণ তার পুত্র।
পরিশেষে, যখন তিনি মা যশোদার অবিচল দৃঢ়তা এবং গ্লানি দেখলেন তখন কৃষ্ণ কৃপাবশত বন্দি হতে সম্মত হলেন ।
কৃষ্ণকে সত্যিই বন্দি করা যাবে?
শুকদেব গোস্বামী বলেন, “হ্যাঁ। কৃষ্ণ কৃপাবশত তাঁর ভক্তদের কর্তৃক বন্দি হন। কৃষ্ণের কৃপা প্রকাশিত হলে তাঁর সকল শক্তি অবদমিত হয়ে যায়।”
এভাবে কৃষ্ণ প্রদর্শন করলেন যে, কিভাবে তিনি তাঁর ভক্তদের দ্বারা বাধিত হন ।
“সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড এমনকি ব্রহ্মা এবং শিবও আমার নিয়ন্ত্রণাধীন কিন্তু আমি আমার ভক্তদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হই।” এটিই হল কৃষ্ণের নিত্য স্বভাব।

লেখক পরিচিতি : শ্রীমৎ রাধাগোবিন্দ গোস্বামী ১৯৭১ সালে ভারতের বারাণসীতে শ্রীল প্রভুপাদের দর্শন লাভ করেন। তিনি তৎক্ষণাৎ শ্রীল প্রভুপাদকে গুরুরূপে বরণ করেন এবং ১৯৭৫ সালে তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা লাভ করেন। ১৯৭৪ সাল থেকে তিনি বৃন্দাবনে কৃষ্ণ বলরাম মন্দিরে সেবা করে আসছেন। শ্রীল প্রভুপাদের আজ্ঞায় তিনি সমগ্র পৃথিবীতে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার করেন। তিনি শ্রীমদ্ভাগবতের পাণ্ডিত্যপূর্ণ এবং ভক্তিমূলক কথা পরিবেশনের জন্য ইস্‌কনে বহুল সমাদৃত।


 

অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৭ ব্যাক টু গডহেড
সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।