শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ অধ্যয়ন করব কেন? (পর্ব -0২)

প্রকাশ: ২ অক্টোবর ২০২১ | ১২:৫৬ অপরাহ্ণ আপডেট: ২ অক্টোবর ২০২১ | ১২:৫৬ অপরাহ্ণ

এই পোস্টটি 335 বার দেখা হয়েছে

শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ অধ্যয়ন করব কেন? (পর্ব -0২)

ড. নিতাই সেবিনী দেবী দাসী

কিভাবে ভগবান আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করবে?

যত বেশি ভগবানের স্মরণ করবে, তত দ্রুত ভগবানের কাছে ফিরে যাওয়া যাবে। শ্রীল শুকদেব গোস্বামী ভাগবতের (১/২/১৭) বর্ণনা করেছেন, “পরমেশ্বর

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনি পরমাত্মারূপে সকলের হৃদয়েই বিরাজ করেন এবং যিনি হচ্ছেন সাধুবর্গের সুহৃদ, তিনি তাঁর পবিত্র কথা শ্রবণ এবং কীর্তনে রতিযুক্ত ভক্তদের হৃদয়ের সমস্ত ভোগবাসনা বিনাশ করেন।” তখন ভগবানের প্রতি প্রীতি বৃদ্ধি ও চিত্ত শুদ্ধ হবে। এহল উপকারিতা। যেমন: কোনো ঔষধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে, যেমন: মাথা ব্যাথা ও বমির ভাব হওয়া। তেমনি শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণের ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে। তার মধ্যে অন্যতম হল জড়-বাসনা থেকে মুক্তিলাভ এবং পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি আসক্তি বর্ধিত হওয়া। যদি এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না হয়, তাহলে বুঝতে হবে শ্রীমদ্ভাগবত পাঠে কোথাও ভুল হচ্ছে। শ্রীমদ্ভাগবত সঠিকভাবে পাঠ করলে যে কেউ শোক, মোহ এবং ভয় থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। ভগবানের ভক্তের উপর আসক্তি বাড়বে। যেমন: একজন মা তার সন্তানকে ভালোবাসার কারণে ঐ সন্তানের সাথে সম্পর্কিত প্রত্যেকটি জিনিস যেমন তার স্কুল ব্যাগ, পেন্সিল ইত্যাদির উপর একটা আলাদা ভালোবাসা থাকে। তেমনি ভগবানের উপর প্রীতি বর্ধিত হলে তাঁর ভক্তের প্রতিও আসক্তি বর্ধিত হবে। কারণ ভগবানের সাথে তাঁর ভক্তরা ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। এজন্য যখন কোন ভক্ত অন্য ভক্তকে দেখেন তখন তারা দু’জনই আনন্দিত হন। যদিও তারা পরস্পর পরস্পরকে জানে না যদিও তারা পরস্পর পরস্পরকে জানে না তবুও যখন কণ্ঠিমালা, তিলকযুক্ত কোন ভক্তকে দেখেন তখন তারা উভয়েই আনন্দিত হন। কারণ আমরা সবাই ভগবানের সাথে সর্ম্পকযুক্ত। এ সমস্ত বিষয়গুলো তখনই ভালোভাবে হয় যখন আমরা নিয়মিত শ্রীমদ্ভাগবত অধ্যয়ন করি। এজন্য প্রতিদিন শ্রীমদ্ভাগবত অধ্যয়ন করা অতীব জরুরী। প্রতিদিন কমপক্ষে দুই পৃষ্ঠা বা এক পৃষ্ঠা, এক বা দুই শ্লোক পাঠ করা উচিত। তখনি ভগবানকে আমরা জানতে পারব এবং ভগবানের প্রতি আমাদের ভালোবাসা বর্ধিত হবে। শ্রীমদ্ভাগবত (১/২/১৭) শ্লোকে বলা হয়েছে

শৃন্ততাং স্বকথাঃ কৃষ্ণঃ পুন্যশ্রবণকীর্তনঃ।
হৃদ্যন্তঃস্থো হ্যভদ্রাণি বিধুনোতি সুহৃৎসতাম্

অর্থাৎ, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনি পরমাত্মারূপে সকলের হৃদয়েই বিরাজ করেন এবং যিনি হচ্ছেন সাধুবর্গের সুহৃদ, তিনি তাঁর পবিত্র কথা শ্রবণ এবং কীর্তনে রতিযুক্ত ভক্তদের হৃদয়ের সমস্ত ভোগ-বাসনা বিনাশ করেন।
আমরা যখন ভগবানের পবিত্র কথা শ্রবণ এবং কীর্তন করি তখন ভগবান নিজেই আমাদের হৃদয়ের সমস্ত কলুষতা নির্মল করেন। ভগবানই জীবের প্রকৃত সুহৃদ। যেমন মনে করুন, আপনার গৃহে কোন অতিথি আসার আগে আপনি কি করবেন? সর্ব প্রথমে আপনার গৃহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করবেন। যদি কোন কারণবশত আপনি গৃহ পরিষ্কার না করেন তাহলে অতিথি সরাসরি কিছুই বলবে না। কিন্তু যখন তিনি চলে যাবেন তখন তিনি অন্যদের সাথে আপনার অপরিষ্কার গৃহের কথা আপনার অগোচরেই বলবে। কিন্তু যখন আপনার কোন নিকট আত্মীয় আসেন তখন তিনি কি করবেন? তখন তিনি আপনার সাথে গৃহ পরিষ্কার করতে শুরু করবেন। সেরূপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের সুহৃদ, তিনি আমাদের চিত্ত পরিশুদ্ধ করেন। সেটা সম্ভব হয় তার পবিত্র কথা শ্রবণ এবং কীর্তন করার মাধ্যমে। কারণ ভগবানের নাম ভগবান থেকে অভিন্ন। ভগবান আমাদের কাছে শুধু একটা জিনিস চান সেটা হল, দয়া করে আমাকে তোমার হৃদয়ে প্রবেশ করার সুযোগ দাও। কিভাবে ভগবান আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করবে? আমাদের দুইটা বড় বড় খোলা দরজা আছে (কর্ণ), সেই খোলা দরজা দিয়ে ভগবান আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করেন। আপনি চেষ্টা করলেও সেই খোলা দুইটা দরজা বন্ধ রাখতে পারবেন না। দেখুন, আমাদের চোখের উপর দুইটা দরজা আছে, কিন্তু আমাদের কানের উপর কোন দরজা নেই, কারণ সৃষ্টিকর্তা সেটা বিচার বিবেচনা করেই রেখেছেন।
এভাবে আমরা ২৪ ঘন্টা ভগবানের পবিত্র কথা শ্রবণ করতে পারি। রাতে ঘুমানোর সময়ও সেটা করতে পারি। শ্রীল প্রভুপাদের জপ রেকর্ডার চালিয়ে দিয়ে ঘুমাতে পারি। আমার বাসায় সেটা আমি করি। পুরো রাত সেটা চলতে থাকে। আপনারাও সেটা করতে পারেন (স্থান, কাল ও পরিস্থিতি বিচার করে)। এটা খুব ব্যয় বহুল নয়। ভগবান শুধু আপনার ভিতরে প্রবেশ করার সুযোগ খুঁজে, বাকি কাজ তিনি নিজেই করবেন। কিন্তু সাধারণত মানুষ ভৌতিক গান-বাজনা, হট্টগোল শুনতে খুব অভ্যস্ত। তারা ভগবানের কথা শুনতে চায় না। আর যদি শুনে তাহলে তাদের হৃদয় নির্মল হবে। এই কর্ণ রন্ধ্র দিয়ে ভগবানের প্রবেশ হয় হৃদয়ে। আপনি চোখ দিয়ে ভগবানকে সঠিকভাবে দর্শন করতে পারবেন না, আপনার মনে হবে সেটি একটি পাথরের অথবা কাঠের মূর্তি কিন্তু যখন আপনি শ্রবণ করবেন তখন আপনার দর্শনটা পরিপূর্ণ হবে।
আমি প্রায়ই উদাহরণ দিয়ে থাকি শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের এক শিষ্য সরস্বতী ঠাকুরকে না বলে বৃন্দাবনের সমস্ত মন্দির দর্শন করতে বের হন, ঐ শিষ্য যখন ফিরে আসলেন তখন সরস্বতী ঠাকুর ওনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, how was your eye exercise? “তোমার চোখের ব্যায়াম কেমন হল?” তখন শিষ্য আশ্চার্যন্বিত হলেন এবং ভাবতে লাগলেন আমি ঠাকুরকে দর্শন করতে গেলাম আর গুরু মহারাজ রাগান্বিত হলেন। তখন সরস্বতী ঠাকুর শিষ্যকে বুঝালেন, বিষয়টা হল এমন তুমি সূর্যকে দর্শন করতে চাইছো বটে কিন্তু তোমার চোখ বন্ধ। কারণ হলো কোনো কিছু দেখার আগে তোমার ঐ জিনিস সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরী। সূর্যকে দর্শন করার জন্য শুধু তোমার একটা জিনিস দরকার সেটা হল তোমার চোখ খুলে দর্শন করা। সূর্যকে দর্শন করার জন্য তোমার এত হৈ-হুল্লোর করার দরকার নেই, শুধু চোখের অপারেশন দরকার। চোখের দৃষ্টি শক্তি তখনই ফিরে পাওয়া যাবে যখন আমরা শ্রীমদ্ভাগবত অধ্যয়ন করব। ভাগবত অধ্যয়ন করলেই আমরা পরিশুদ্ধ হব এবং হৃদয় নির্মল হবে। তখন আমরা সবকিছু সঠিকভাবে দর্শন করতে পারব। এখন সবকিছু আমরা সঠিকভাবে দর্শন করতে অক্ষম। বিষয়টা হল যেভাবে দর্শন করা উচিৎ আমরা সেভাবে দর্শন করতে পারছি না। কারণ আমরা এখন ভ্রান্তদৃষ্টিতে সবকিছু দর্শন করছি। কিন্তু যখন ভক্তির বলে ভগবানের কৃপায় আমাদের জ্ঞান চক্ষু উন্মোচন হবে তখন আমরা সবকিছু সঠিক ভাবে দর্শন করতে পারব। যখন আমরা শাস্ত্র অধ্যয়ন করব তখন বিচার বুদ্ধির ক্ষমতা বাড়বে।
শ্রীমদ্ভাগবত গৃহে থাকলে ৩৩ কোটি দেব-দেবী বিরাজ করেন। জ্ঞানের মাধ্যমে সন্তুষ্টি এবং চিত্ত শুদ্ধি হয়। সঠিক তথ্য জানা যায়। তখন ভগবানের মহিমা উপলদ্ধি করা যায়। শ্রীল রূপ গোস্বামী পদাবলীর ৪১ নং শ্লোকে বলেছেন। অর্থাৎ “কেউ যদি যশোদা সূত শ্রীকৃষ্ণের কথা শ্রবণ করে তাহলে কলির প্রভার তার উপর আসবে না। এই ভয়ংকর কলিযুগেও সে দিব্য আনন্দে থাকবে। এই হল শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ করার উপকারীতা।”
দামোদর মাসে (৩০দিন- কার্ত্তিক বা অক্টোবর-নভেম্বর) মাস ব্যাপী প্রতিদিন আমরা তা শ্রবণ করি, কিন্তু কখনো দেখিনি কোন ইস্‌কন ভক্ত তাতে বিরক্ত হতে, বরং তারা নব নব রস আস্বাদন করে। ভৌতিক এবং আধ্যাত্মিক আনন্দের এই হল পার্থক্য। ভৌতিক বিষয়ে আপনি পুনঃ পুনঃ আনন্দ পাবেন না, এক পর্যায়ে বিরক্তির ভাব চলে আসবে। কিন্তু আধ্যাত্মিক বিষয়ে আপনি যতবারই শ্রবণ করবেন ততবারই পুনঃ পুনঃ আনন্দ পাবেন। তাই আমাদের বারংবার শ্রবণ করতে হবে। ভক্তিতে আপনি যত পরিপক্ক হবেন একই শ্লোকে আপনি অনেক পার্থক্য অনুধাবন করতে পারবেন। অর্থ্যাৎ পাঁচ বছর আগে যে শ্লোক আপনি পড়েছেন, পাঁচ বছর পর আপনি একই শ্লোকে নতুন আনন্দ পাবেন। বারবার শ্রবণ না করলে আমরা ভক্তি জীবনে পিছিয়ে যেতে পারি।

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।